কলকাতা, সৌগত রাণা কবিয়ালঃ- ভারতীয় জীবধারায় সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ শিল্পীগন সবসময় তাদের অসাধারণ অনন্যতা নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে এক গুনগুনি সুখের একান্ত ভালো লাগার সময়ের চিরসাথী..! যে কারণে হয়তো আমাদের সকল প্রকারের আবেগ প্রকাশ ও উৎযাপনের ক্ষেত্রে, মোঃ রফি, কিশোর কুমার, মুকেশ চন্দ মাথুর, লতা মুঙ্গেশকর, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো লিজেন্ড কণ্ঠশিল্পীরা তাদের অসাধারণ স্বকীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রায় পঞ্চাশ বছর পরেও আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের এক অসাধারণ যাদু সুখের অংশ হয়ে আছেন..!
‘মুকেশ চন্দ মাথুর’, ভারতীয় সঙ্গীত আকাশের এমনই এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র যার স্বকীয় সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ, ভারতীয় সম্বৃদ্ধ সঙ্গীত আকাশের এক আনন্দময় আলো..! ২২ শে জুলাই ১৯২৩ সালে জন্ম নেয়া প্রতিভাবান এই কণ্ঠশিল্পী মুকেশ চন্দ মাথুর যিনি মুকেশ নামেই সর্বাধিক পরিচিত, যার গাওয়া গানে একসময় ভারতীয় চলচিত্রের প্রবাদ পুরুষ ‘রাজ কাপুর’ তার সিংহভাগ গানের লিপ দিয়েছিলেন..! ১৯৮৮ সালের শেষের দিকে লিজেন্ড অভিনেতা রাজ কাপুরের মৃত্যুর পর চারিদিকে ব্যপক ভাবে সাধারণ মানুষগন মুকেশের গানের প্রবল অনুরাগী শ্রোতা হয়ে ওঠেন..! রাজ কাপুরের লিপে ‘আওয়ারা হু’ গানটি দেশ এবং বিদেশের সঙ্গীত প্রিয় মানুষদের কাছে এতোটাই জনপ্রিয় হয়েছিলো যে আন্তর্জাতিক ভাবেও বিশেষ করে রাশিয়াতে মুকেশ ভিষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন..!
তিনি পুরুষ কণ্ঠশিল্পীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-এ অসংখ্যবার মনোনয়ন পাওয়ার পাশাপাশি ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া রজনীগন্ধা চলচ্চিত্রের “কাই বার যুহি দ্যাখা হ্যায়” গানটিতে কন্ঠ দেয়ার জন্য পুরস্কার লাভ করেন…!
সময়ের স্রোতে শিল্পীর প্রজন্ম বদলায়, রুপ-রস বদলায় সঙ্গীতের, বদলায় শ্রোতাদের সুখের ধরন.. কিন্তু এর মাঝেও পরবর্তী প্রজন্মের কিছু কণ্ঠশিল্পী তাদের পূর্ববর্তী লিজেন্ড কণ্ঠশিল্পীদের গানকে নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যুগোপযোগী করে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে একসময় নিজেদের আপন জনপ্রিয়তার সুখ উপভোগ করেন..! এ ক্ষেত্রে মোঃ রফি, কিশোর কুমার, লতা মুঙ্গেশকর, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো লিজেন্ড কণ্ঠশিল্পীদের অনুরনন নিয়ে অনেক কণ্ঠশিল্পী ভারতীয় সঙ্গীত জগতে নিজেদের যায়গা করে নিলেও, কোথায় যেন যোগ্য প্রজন্ম শিল্পীর অভাবে কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে থাকেন মুকেশ চন্দ মাথুরের কালজয়ী সব গান..!
সঙ্গীতে সাধারণত দু-ধরনের প্রিয়তা থাকে, এক হচ্ছে জনপ্রিয়তা, দুই হচ্ছে মনপ্রিয়তা…! মুকেশের ক্ষেত্রে তার পরবর্তী প্রজন্মের সফলতা বা ব্যার্থতার কথা বলতে গেলে হয়তো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যার্থতার দায়টাই বেশী..!
তবে আমাদের সকলের অগোচরে এই ব্যার্থতাকে সফলতায় পরিনত করতে চাওয়া একজন মানুষ ‘পার্থ চক্রবর্তী’ ঠিক যেন এই তথাকথিত জনপ্রিয়তার চাইতে মানুষের মনপ্রিয়তার যায়গাটাতে মুকেশ চন্দ মাথুরের কন্ঠের সমার্থক একজন সঙ্গীত সাধক..! দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে গুরু সাধক এই প্রতিভাবান কণ্ঠশিল্পী গুরুদক্ষিণা হিসেবে তার প্রাণপ্রিয় লিজেন্ড গায়ক মুকেশ চন্দ মাথুরের গানে নিজেকে মগ্ন করেছেন, শুধুমাত্র সঙ্গীতের যায়গায় মুকেশের প্রতি তার একান্ত অনুরাগ আর একজন সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে নিজের দায়বদ্ধতাকে ভালোবেসে..!
বাংলার সঙ্গীত আকাশের নীরব এই সাধক শিল্পী শ্রী পার্থ চক্রবর্তী মহাশয় ‘মুকেশ লাভারস এস্যোসিয়েসন’ নামে পশ্চিমবাংলায় মুকেশ এর একমাত্র ফ্যান ক্লাবের মাধ্যমে বিগত ২৫ বছর ধরে মুকেশের গানকে বাঁচিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন..! দীর্ঘ এই ২৫ বছর তিনি প্রায় একক প্রচেষ্টায় ও অর্থে নিজের প্রিয় দু-তিনজন বন্ধুকে নিয়ে ভারতের আগামী প্রজন্মের জন্য মুকেশ চন্দ মাথুরের অসাধারণ সৃষ্টিগুলোকে ধরে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন সাধারণ সঙ্গীত অনুরাগী মানুষের মনের মনিকোঠার ভালোবাসা নিয়ে…! প্রতি বছর মুকেশ চন্দ মাথুরের প্রয়াণ দিবসের দিনে (২৭ শে অগাস্ট) এই ফ্যান ক্লাবের আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাংলার প্রতিষ্ঠিত সকল গুনি শিল্পীগন মুকেশ এর গান গেয়ে ভারতের এই লিজেন্ড কণ্ঠশিল্পীকে সন্মান জানানোর পাশাপাশি আগামী প্রজন্মের কাছে যুগোপযোগী করে তুলে ধরেন মুকেশের অনবদ্য সব সুর-সৃষ্টিকে..!
অন্তর্মুখী মেধাবী এই কণ্ঠশিল্পী এভাবেই নিজেকে একজন মুকেশের একনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে তার গানকে বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন নিভৃতে প্রচারের অন্তরালে..!
মুকেশ-কন্ঠি এই কণ্ঠশিল্পী ১৯৮৯ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারিতে প্রথম মঞ্চে মুকেশের গান গাওয়া শুরু করেন মাত্র ১৭ বছর বয়সে..! বর্তমানের ৫০ বছর বয়সেও গুরুদক্ষিণা হিসেবে মুকেশ এর গানকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিজের সঙ্গীত সাধনা এবং তার সংগঠনের মাধ্যমে….!
শ্রী পার্থ চক্রবর্তী মহাশয় জানান,
“মুকেশ হলেন প্রথম ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী যার গাওয়া ‘ও মেরে হামরাহী’ কালজয়ী এই গানটি প্রথম হলিউডের ‘ The Right And The Wrong’ ইংরেজি সিনেমাতে ব্যবহৃত হয়…!
মুকেশ তার সারাজীবনে তার সমসাময়িক প্রতিষ্ঠিত কণ্ঠশিল্পী মোঃ রফি, কিশোর কুমার, লতা মুঙ্গেশকরের তুলনায় অনেক কম প্রায় হাজার খানেক গান গাইলেও এই লিজেন্ড কণ্ঠশিল্পীর হিট গানের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে অনেক এগিয়ে..! তৎকালীন একটা জরিপে প্রকাশ পায় যে ৬০ থেকে ৭০ দশকের হিট গানের তালিকায় মুকেশের গান অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিলো তখন”..!
ছোটবেলা থেকে রফি সাহেবের ভক্ত থাকলেও ক্লাস টুয়েলভ থেকে মুকেশ এর গানের প্রতি পার্থ চক্রবর্তীর ভালোবাসা শুরু হয়..!
পার্থ চক্রবর্তীর ভাষায়, ” মুকেশের গান গেয়ে শ্রোতাদের চোখে মুখে মুকেশ স্যারের গানের প্রতি যে অসাধারণ ভালোবাসার স্ফুরণ দেখি, তখন মনে হয় আমার গুরুদক্ষিণা সার্থক হলো..!
১৯৯৭ সালে প্রথম আমার মুকেশ এর ফ্যান ক্লাবের চিন্তাভাবনা আসে.. ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সরকারের রেজিস্ট্রার্ড আমাদের এই ফ্যান ক্লাবের ২৫ তম বছর পূর্তি উপলক্ষে এই কোভিড পেন্ডামিকের জন্য প্রতিবারের মতন নিয়মিত প্রোগ্রাম সেভাবে না হলেও মুকেশ লাভারস অ্যাসোসিয়েশনের পেজ ও অনলাইন প্লাটফর্মে মুকেশ ফ্যান ক্লাবের অনুষ্ঠান চলবে..! ১৯৭৬ সালের ২৭শে অগাস্ট মুকেশ চন্দ মাথুরের প্রয়াণ দিবস..উনার মৃত্যু নিয়ে প্রচলিত একটা ধারণা হলো যে মুকেশ গান গাইতে গাইতে স্টেজেই মৃত্যু বরণ করেন…কিন্তু উনার প্রয়াণ নিয়ে প্রকৃত সত্যটা হলো আমেরিকার মিশিগান ডেট্রয়েট শহরের একটি শোতে যাওয়ার আগে হোটেলের ঘরে নিজের স্বভাবসুলভ রেওয়াজ সেরে স্নান করার সময় হঠাৎ স্ট্রোক করেন এই শিল্পী, উনার ছেলে ঋতীশ মুকেশ উনার সাথে তখন অবস্থান করছিলেন, তিনি তখন তার বাবাকে তাৎক্ষণিক ভাবে হোটেল থেকে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং সেখানেই মৃত্যু হয় ভারতের কালজয়ী এই কণ্ঠশিল্পীর..! মুকেশ এর মৃত্যু দিন ২৭ শে অগাস্ট মুকেশ ফ্যান ক্লাবের ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি সন্ধ্যা-A tribute to Mukesh’ নামক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পূর্ববর্তী প্রতি বছরের এই সময়ে মুকেশ এর গানকে বাঁচিয়ে রাখতে এখানে গান গেয়েছেন- সৈকত মিত্র, শ্রীকান্ত আচার্য, গৌতম ঘোষ সহ প্রমুখ প্রতিষ্ঠিত শিল্পীগন.! এছাড়া প্রতি বছর মার্চ এপ্রিল মাসের যে কোন উপযুক্ত সময়ে ক্লাবের তরফ থেকে ‘আনন্দ সন্ধ্যা’ নামক আরও একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, সেই অনুষ্ঠানে মুকেশ ছাড়াও সকল লিজেন্ড কণ্ঠশিল্পীদের গান পরিবেশন করেন নবীন, প্রবীণ ও শিশু কণ্ঠশিল্পীরা “..!
দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে সঙ্গীত নিয়ে সাধনা করা এই কণ্ঠশিল্পী শ্রী পার্থ চক্রবর্তী মহাশয় একজন শুদ্ধস্বরের সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তার অবস্থান থেকে মূলত একাই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ভারতের সঙ্গীতের অন্যতম সেরা নক্ষত্র স্যার মুকেশ চন্দ মাথুরের অতুল্য সব সুর-সৃষ্টি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সময়ের চাকায় ধরে রাখতে..! যদিও অবাক হলেও সত্যি যে এই ক্ষেত্রে বাংলার মিডিয়া প্লাটফর্মকে সেভাবে তিনি নিজের পাশে পাননি…!
আজকের ভারতের সংস্কৃতির যে আধুনিক সংস্করণ তাতে কোথায় যেন একটা অসহায় অসুখ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অকারণ অপ্রয়োজনীয় শিল্প সৃষ্টির বানিজ্যিক বিজ্ঞাপন, যার ভীড়ে রঙধনুর মতো ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে উঠছে প্রকৃত মেধাবী শিল্পীর অসাধারণ সৃষ্টিগুলো….!
তবে আশার কথা পার্থ চক্রবর্তীর মতন কোন শিল্পী যখন নিজেকে তার প্রিয় শিল্পের সাধক হিসেবে বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তখন প্রাপ্তির যায়গা থেকে অনেক বেশি পূর্ণতা পায় আপন হৃদয়ের তৃপ্তির সুখের ঘরটি…!
পরিশেষে মুকেশ চন্দ মাথুরের একটি গান দিয়েই বলি,
” জিনা ইহা, মরণা ইহা..
ইসকে সিবা জানা কাহা…”
ক্ষয়িষ্ণু এই জীবনে একজন শিল্পীর জন্য শুদ্ধতার প্রতিফলন সমাজকে তার সঠিক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে পারে…!
শুদ্ধ শিল্পের জয় হোক…!
আজ ২২ শে জুলাই এই কালজয়ী ভারতীয় লিজেন্ড কণ্ঠশিল্পী মুকেশ চন্দ মাথুর এর জন্ম দিবস উপলক্ষে সব খবরের পরিবারের পক্ষ থেকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি..!
কলমে : সৌগত রাণা কবিয়াল
( কবি সাহিত্যিক ও কলামিস্ট )
বিঃদ্রঃ- (এই লেখাটির সত্ত্বাধিকার ‘সব খবর’ দ্বারা সংরক্ষিত এবং এর কোন অংশ প্রতিলিপিকরন লেখক ও সব খবরের অনুমতি সাপেক্ষ)
Leave a Reply