বিচক্ষণ : দিলীপ রায়।।।

0
430

বাজারসৌ স্টেশন । স্টেশনের প্লাটফর্মেই ফটিকের জীবনযাপন ।

ফটিক দোকানে দোকানে ফাইফরমাশ খাটে । অন্যদিকে ফটিকের মা, মধুবনি বাজারসৌ স্টেশনের কাছের পাড়াগুলিতে বাড়ি বাড়ি ঠিকা ঝি’র কাজ করে । শুধুমাত্র বলহরি কপালীর বাড়ি রান্না করে এবং দুপুরে সেখানেই খাওয়া । মাঝে মধ্যে অন্যান্য বাড়িতে সকালে টিফিন জুটলে ভাল নতুবা ঐ বলহরির বাড়িতেই দুপুরে সরাসরি স্নান-খাওয়া ।

ফাইফরমাশ খেটে ফটিকের যেটুকু উপার্জন, সেখান থেকে স্টেশনের কাছে সাধনের হোটেলে দুপুরের খাওয়া সারে । রাত্রিবেলায় মা ও বেটা একসঙ্গে ঐ সাধনের হোটেলে রূটি তরকারি খেয়ে প্লাটফর্মে রাত্রিযাপন । এভাবেই তাদের দৈনন্দিন জীবনের ঘাত প্রতিঘাত ।

ফটিক ষষ্টিদার চায়ের দোকানেও ফাইফরমাশ খাটে । তাতে ফটিকের কিছু বাড়তি উপার্জন ।

প্রতিদিন রাত্রে শোয়ার আগে একবার ষষ্টিদার দোকানে ঘুরে যাবেই । অনেক কাজ পড়ে থাকে সেগুলো সারে । তাই প্রতিদিনকার মতো সেদিন ফটিক ষষ্টিদার দোকানে গিয়ে দেখে ষষ্টিদা দোকানের পাশে চিৎ হয়ে পড়ে আছে । রাত্রি তখন ১১টা ৫০ মিনিট । প্লাটফর্ম ফাঁকা । প্লাটফর্মের সমস্ত দোকান বন্ধ । পরের ট্রেন রাত দুটো । স্টেশন মাস্টার মশাই অফিসের মূল দরজা বন্ধ করে ভিতরে নীরবে কাজ করছেন। পুরো স্টেশন চত্বর সুনসান । চারিদিক নিঝুম ও নিস্তব্দ । ফটিক কী করবে ঠাহর করতে পারছে না । অগত্যা ষষ্টিদার কপালে হাত দিয়ে দেখে তাঁর জ্বর নেই । হাতের ছোঁয়ায় হুঁশ ফিরে পেয়ে ষষ্টিদা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, “আমাকে চেপে ধরুন । আমার মাথা ঘুরছে । আমার মাথা চরকির মতো ঘুরপাক খাচ্ছে ।“ তারপর তাকিয়ে যখন ফটিককে দেখতে পেল তখন অসহায়ের মতো করুণ কন্ঠে বলল, “ শিগগির আমাকে হাসপাতাল নিয়ে চল্‌ । আমার মাথা প্রচণ্ড ঘুরছে ।“ ষষ্টিদার কথা শুনে ফটিক ভয় পেয়ে গেল । কী করবে আতঙ্কে দিশাহীন । হঠাৎ বিপদ ! সাতপাঁচ আর ভাবার সময় নেই । সে ছুটল ভ্যান রিক্সার খোঁজে । স্টেশনের নীচে পাকুড় গাছ তলায় গোবর্ধন ভ্যানের উপরে শুইয়ে তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে । গোবর্ধনকে ডেকে তুলল ফটিক । ভ্যানের উপর ষষ্টিদাকে শুইয়ে ছুটল শক্তিপুর হাসপাতালে । রাত তখন প্রায় একটা । কোনো ডাক্তার নেই । নার্স রয়েছেন । নার্স রোগীকে ভাল করে দেখে বললেন, বদ হজম অথবা হার্টের ব্যামোর কারণে মাথায় চক্কর খেতে পারে । এজন্য তিনি ট্যাবলেট খাওয়ালেন । তবুও তাঁর মাথার ঘোরপাক কমছে না । ইমার্জেন্সি রুমের মধ্যেই আবার চক্কর খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল ষষ্টিদা । ডাক্তার বাবু থাকেন দূরে । রোগীর মরণাপন্ন অবস্থা না থাকলে ডাক্তারবাবু তাঁকে ডাকতে নিষেধ করেছেন । কিন্তু ষষ্টিদার শারীরিক অবস্থা অবলোকন করে নার্স বাধ্য হলেন ডাক্তারবাবুকে ডাকতে । অনেকক্ষণ মোবাইলে চেষ্টা করার পর যোগাযোগ সম্ভব হল । হাসপাতালে পৌঁছে ডাক্তারবাবু ষষ্টিদার মাথার চক্করের গতিবিধির অবস্থা অনুধাবন করে বুঝতে পারলেন, এটা হার্ট বা পেটের সমস্যা নয় । দুটো কারণে হতে পারে – (১) ঘাড়ের স্পন্ডিলাইটিস, অথবা (২) কান থেকে । ডাক্তারবাবু সত্বর ইসিজি, ঘাড়ের এক্স-রে, রক্ত পরীক্ষা, ইত্যাদি করতে বললেন । ইতিমধ্যে ষষ্টিদার মাথার ঘোরপাক খাওয়া বন্ধ হওয়ার জন্য ঔষধ দিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, ষষ্টিদাকে নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবুকে দেখাতে । কান থেকেই তার মাথার এইরূপ পরিস্থিতি হওয়ার সম্ভাবনা ।
পরের দিন সকালে নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবু ষষ্টিদাকে দেখার পর তিনি কোনো ঔষধ দিলেন না, তিনি কানের কাছে ব্যায়ামের প্রক্রিয়ায় কানের ভিতরের সমস্যা ঠিক করে দিলেন । তারপর ১০দিন বাদে রিপোর্ট করতে বললেন । ডাক্তারবাবুর মতে এটা ‘বিপিপিভি’ রোগ ।
রাত থেকে পরের দিন প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত ফটিকের মা, মধুবনি তার একমাত্র সন্তানের খোঁজ পায়নি । চিন্তায় চিন্তায় সে কাহিল ! অন্যদিকে বাড়ির লোকজন ষষ্টিদার খোঁজ খবর না পেয়ে হতাশ । বাড়িতে কান্নাকাটির সোরগোল । স্টেশন মাস্টার মশাই কোনো হদিস দিতে পারেননি । সকলের ধারণা ষষ্টিদা অন্যত্র পালিয়ে গেছে । ষষ্টিদার বাড়ির লোকজনকে গাঁয়ের মানুষ বুঝিয়ে আস্বস্ত করার চেষ্টা করছে । ষষ্টিদার স্ত্রীর মন মানছে না । বাড়িতে না জানিয়ে ষষ্টিদা একটি কাজও করে না, অথচ সে নিরুদ্দেশ । নিশ্চয় কোনো বড় বিপদ, অথবা তাকে কেউ কিডন্যাপ করেছে । কিডন্যাপের কথা ভেবে বাড়ির মানুষ আতঙ্কিত । তাঁরা পুলিশে খবর দেওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছেন । তখন সন্ধ্যা রাত্রি । বাড়িতে গাঁয়ের লোকজনের জটলা । গ্রামবাসীদের মধ্যে গুঞ্জন, এত ভাল মানুষ ষষ্টি । তাকে কারা অপহরণ করলো ? গ্রামবাসীদের মধ্যে একে অপরের প্রতি মুখ চাওয়া-চাওয়ি ।

ঠিক সেই মুহূর্তে ফটিক ও ষষ্টিদার আগমন ।

ষষ্টিদাকে পৌঁছে দিয়েই ফটিক তার মায়ের কাছে ছুটল ।

বাড়িতে পৌঁছে গিন্নিকে ষষ্টি বলল, প্লাটফর্মের গোবেচারা ছেলেটির জন্য সে তাঁর জীবন ফিরে পেয়েছে । ফটিক তাঁর জীবনদাতা ।
কিন্তু ফটিক ? ফটিক কোথায় ?
স্টেশনে অনেক খুঁজেও ফটিকের হদিস নেই ।

তাই বাড়ির লোকজন সকলে মিলে ছুটল বাজারসৌ স্টেশনের প্লাটফর্মে ।

স্টেশনের প্লাটফর্মে তখন সাফাই অভিযান চলছে । কেননা বিভাগীয় প্রধান স্টেশন ভিজিটে আসবেন । তাই ফটিক ও তার মা, মধুবনি পরবর্তী আশ্রয়ের জন্য কাটিহারে কাছে চলে গেছে । ফটিককে খুঁজে না পেয়ে ষষ্টিদার স্ত্রী কান্নাভেজা গলায় বলল, সে নিশ্চয় ভগবানের পাঠানো দূত । যার জন্য তার স্বামী এযাত্রায় প্রাণে বাঁচল । ষষ্টিদার স্ত্রী ঈশ্বরের উদ্দেশে প্রার্থনা করল, ফটিক যেখানেই থাকুক ভাল থাকুক ।

————————-০————————-
এ১০ক্স/৩৪, কল্যাণী (ভারত), পিন-৭৪১২৩৫