শ্রীযুগলপিরীতি : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
517

কবি বিদ্যাপতি শ্রীরাধার প্রেমের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখলেন—
“অনুক্ষণ মাধব মাধব সোঙারিতে সুন্দরী ভেলি মাধাই ।
ও নিজভাব স্বভাব হি বিছুরল আপন গুণ সুবধায় ।।”
——অর্থাৎ, অনুক্ষণ বা প্রতিমুহুর্তে মাধবের কথা ভাবতে ভাবতে সুন্দরী অর্থাৎ শ্রীরাধা যেন নিজেই মাধবত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন। তাঁর নিজ স্বভাব সরে গিয়ে মাধবের স্বভাব প্রকাশ হচ্ছে। মাধবের অন্তরের ভাব এখন তাঁর অন্তরে । তাইতো মাধবের আচরণ তাঁর দ্বারা আচরিত হচ্ছে। তাইতো কখনো দুটি হাত শ্রীমুখের কাছে ধরে বেনুবাদনের ভঙ্গী করছেন, কখনো বা ময়ূরপুচ্ছ কুড়িয়ে নিয়ে মস্তকে গুঁজছেন। কখনো ত্রিভঙ্গ ভঙ্গীমায় দাঁড়িয়ে বঙ্কিম নয়নে বঙ্কিম হাসি হাসছেন ইত্যাদি সব করছেন।
শ্রীরূপ গোস্বামীপাদের ‘শ্রীউজ্জ্বল নীলমণি’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, শ্রীকৃষ্ণ যখন মথুরায় গমন করলেন, তখন প্রবাসজাত বিপ্রলম্ভ দশায়, অর্থাৎ, নায়ক প্রবাসে গমন করলে তাঁর বিরহে নায়িকার মধ্যে যে অতি তীব্র ,অসহ্য, অশেষ, বিরহ-বেদনার বিলোড়ন দেখা যায়, তাঁর প্রভাবে শ্রীরাধার যে দশা হয়েছিল তা অবর্ণনীয়, অচিন্ত্যণীয় ছিল। অগত্যা প্রাণপ্রিয়া সখীর সে দশা দেখে আর স্থির থাকতে না পেরে শ্রীললিতা সখী পত্র লিখলেন মথুরায় শ্রীকৃষ্ণের কাছে—
শ্রীমতী তোমার বিরহে দৈন্য সাগরে ডুবেছে। নিরাভরণা, মলিনবেশা, ভিখারিণীর ন‍্যায় দশা তার। মুখে কথা নেই। চিন্তাশক্তিও লুপ্ত হয়েছে। এমনকি উন্মাদ দশাটিরও প্রকাশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। চোখের জলও শুকিয়ে গেছে। তাই, অশ্রু বিসর্জনও বন্ধ হয়ে গেছে। হে কংসারি, তোমার বিরহে সেই পদ্মের ন‍্যায় সুন্দরী শ্রীরাধার একমাত্র সহচরী এখন মূর্ছা হয়েছে । (অর্থাৎ, তাঁকে ধরে রাখা যাচ্ছে না। অনবরত সে মূর্ছা যাচ্ছে।)
ললিতার পত্র পেয়ে শ্রীউদ্ধব মথুরা থেকে প্রত্যুত্তরে জানালেন যে, শ্রীকৃষ্ণেরও একই দশা শ্রীরাধার বিরহে। রত্নখোচিত ক্রীড়াগৃহে দুগ্ধ ফেননিভ শয্যায় পালঙ্কে শয়ন করেও তিনি শান্তি পাচ্ছেন না। গিরিগুহার শিলাতটে শ্রীরাধার সাথে তাঁর রতিবিলাসের কথা স্মরণে আসছে। আর তিনি কাতর হচ্ছেন মনোঃকষ্টে। নিদ্রার মধ্যে তিনিও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ক্রন্দন করতে থাকেন রাধে, রাধে বলে।
রসিকাকেন্দ্র চূড়ামণি শ্রীমদনমোহন এবং মহাভাবময়ী শ্রীমতী রাধিকার পারস্পরিক প্রেম যে এমনই প্রবল, প্রগাঢ় ! পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গনাবদ্ধ থাকা অবস্থাতেও একে অপরের আনন তিলেক অদর্শনে বেদনাতুর হয়ে পড়েন। একে অপরের থেকে বিচ্ছেদ ভাবনায় ভীত হয়ে পড়েন। চিত্ত কেঁপে ওঠে উভয়েরই পরস্পরকে হারাবার ভয়ে, আশঙ্কায়। সেই তিলেক অদর্শনের বিরহ যদি ভবিতব‍্য হয়ে কোনোদিন নেমে আসে জীবনে এই দুর্ভাবনায় মুহুর্তেই দু’জনার বক্ষ যেন কম্পিত হয়। আরও অধিক নিবিড় আলিঙ্গনে তখন আবদ্ধ হন তাঁরা। পরস্পরের বাহুপাশে যেন আরও একটু গভীরাবদ্ধ হয়ে স্বস্তি, নিশ্চিন্ততার আশ্রয় অণ্বেষণ করা তখন তাঁদের।
তাইতো,
শ্রীচন্ডীদাস লিখেছেন—-
“দুঁহুঁ কোড়ে দুঁহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া ।
তিল আধ না দেখিলে যায় যে মরিয়া।।”
হায়! কবে এই অধমা রাধাবিনোদিনী দাসী সেই বিশুদ্ধ শ্রীযুগলপিরীতিকে অনুভব ,অনুধাবন করে অন্তরের অন্তরতম অলিন্দে অনুরাগভরে আস্বাদন করতে পারবে তা!
“রূপ-রঘুনাথ পদে হইবে আকুতি, কবে হাম বুঝবো সে যুগল পিরীতি ।।”
(—শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর মহাশয়ের প্রার্থনায়)
——ওহে, শ্রীরূপ-রঘুনাথ গোস্বামীবৃন্দগণ, কৃপা-করুণা বর্ষণ করে সেই প্রেমাস্বাদনের যোগ্য অধিকারিণী করুন আমায়!
সকল গৌরভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে প্রণতি অর্পণ পূর্বক প্রার্থনা রাখি যেন শ্রীরূপ-রঘুনাথ পদে আকুতি সদাসর্বদা বজায় থাকে আমার, সেই আশীষ প্রদান করুন আমায়। কারণ, তাঁদের কৃপাতেই যে যুগলপ্রেমাস্বাদন সম্ভব !

——–রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক