মহাপ্রভুর পতিত উদ্ধারণ লীলা : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
980

শ্রীগৌরাঙ্গের পতিতপাবন নামের সার্থক প্রমাণ হল শ্রীশ্রীজগাই-মাধাই‌ উদ্ধার লীলা। প্রভুর ইচ্ছাতেই ভক্ত শিরোমনি ‘জগাই মাধাই’-এর অবণীতে আবির্ভাব হয়েছিল দুরাচারী, অত্যাচারী ও অসৎ চরিত্রের ব্যক্তিরূপে। এমন কোনো পাপ কর্ম এ জগতে ছিল না যা তাঁরা করতেন না । চুরি-ডাকাতি, মদ্যপান, গোমাংস ভক্ষণ, অপরের গৃহ অগ্নিদগ্ধ করা,স্ত্রী হত্যা, ব্রক্ষ্ম হত্যা ইত্যাদি সব রকম অসৎ কর্ম তাঁরা অবলীলায় করতেন। তবে হ্যাঁ, তাঁদের কোন বৈষ্ণব অপরাধ ছিল না। সে অপরাধ করার মতো পরিস্থিতি বা সুযোগ গড়ে ওঠেনি কোনদিন। কারণ, তাঁরা তো সর্বক্ষণ মদ্যপ সঙ্গীদের সঙ্গেই মত্ত থাকতেন, ভক্ত সঙ্গ করেনই-নি কোনসময় ।

নবদ্বীপবাসী কুলীন ব্রাহ্মণ শুভানন্দ রায়‌। নবদ্বীপের জমিদার বলেই তাঁর দেশ-বিদেশে খ্যাতি ছিল।সুমিষ্ট , সৎ ব্যবহারের জন্য পাতশাহ তাঁকে বিশেষ নজরে দেখতেন । তাঁর দুই পুত্র– জ্যেষ্ঠ রঘুনাথ আর কনিষ্ঠ জনার্দন দাস। রঘুনাথের পুত্রের নাম জগন্নাথ আর জনার্দনের পুত্র মাধব । এই জগন্নাথ আর মাধবই ওরফে জগাই-মাধাই নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁরা নবদ্বীপের কোটাল ছিলেন। যদিও জগাই মাধাইয়ের পূর্বপুরুষরা ছিলেন সকলেই সদাচারসম্পন্ন , কিন্তু মদ্যপ কুসঙ্গীদের পাল্লায় পড়ে তাঁদের চরিত্রের অবনমন ঘটে।আর, সেজন্যই স্বজনদের দ্বারা তাঁরা পরিতক্ত হয়েছিলেন। ভক্তসঙ্গ কী তা তাঁরা জানতেনই না। মদ্য পান করে রাস্তায় গড়াগড়ি পর্যন্ত যেতেন, কখনো বা বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকতেন‌ । আবার কখনো অশ্রাব্য গালিগালাজ করে নিজেদের মধ্যে কিলাকিলি-লাথালাথি করতেন। লোকে তাঁদের ভয়ে সন্ত্রস্থ থাকতেন সবসময় । যে পথ দিয়ে জগাই-মাধাই যেতেন, দূর থেকে দেখতে পেলেই পথিকেরা সে পথে মাড়াতেন না। এড়িয়ে অন্য পথ ধরতেন।

এমনই একদিন প্রচুর মদ্যপান করে রাস্তায় ধুলোয় পড়ে ‘কিলাকিলি-লাথালাথি’ করছিলেন জগাই মাধাই। মুখে একে অপরকে গালি দিচ্ছিলেন, কুকথা বলছিলেন, আবার অট্টহাস্যও করছিলেন। এদিকে শ্রীগৌরাঙ্গের আদেশে প্রতিদিন নিত্যানন্দ ও যবন হরিদাস নবদ্বীপের প্রতি ঘরে-ঘরে গিয়ে মানুষকে কৃষ্ণ নাম নেওয়াচ্ছেন সেসময় । সেদিন তাঁরা সম্মুখীন হলেন মদ্যপ জগাই মাধাইয়ের। অবাক হলেন ওভাবে মদের নেশায় পথে পড়ে থাকা তাঁদের পশুর মত দশা দেখে। তখন নিত্যানন্দ হরিদাসকে বললেন , “ইস্ , এদের কী করুণ অবস্থা! এমন পাতকী তো কোথাও দেখিনি। আমার প্রভু গৌরাঙ্গ পতিতদের উদ্ধার করতেই এসেছেন এযুগে। যদি এদের মত পাপীদের উদ্ধার করেন তিনি ,তবেই তো তাঁর পতিতপাবন নাম সার্থক হবে। তবে তো মানুষ জানবে প্রভুর মহিমা কতখানি! যাঁর ভৃত্য বলে আমরা গর্ববোধ করি, তিনি যে কতখানি ক্ষমতা ধরেন ,সে প্রমাণ পাবে মানুষ । না, এদেরকে ভক্তি পথে আনতেই হবে। যাঁরা ভক্ত হয় তাঁরা অতি সহজেই কৃষ্ণনাম নেয় , কিন্তু, যদি এদের মত দুরাচারীকেও নাম নেওয়ানো যায়, তবে আমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টা সফল হবে। নাহলে তো বৃথাই আস্ফালন সব! হরিদাস, আমাদের এখন প্রথম কাজ হবে এদেরকে উদ্ধার করা। অন্য জায়গায় আমরা পরে যাব। গৌরহরিকে এদের কথা জানাবো। তোমাকে যখন যবনরা প্রহার করেছিল, তুমি তো তখনও তাদের জন্য মঙ্গল কামনা করেছিলে। এবার, এদের মঙ্গল কামনা কর হরিদাস। তোমার মত মহাভক্তের চাওয়া ভগবান পূর্ণ করবেন ঠিক ।এরা উদ্ধার হবে এই পাপী জীবন থেকে তবে।”

হরিদাস বললেন ,” তুমি চেয়েছো যখন , তখনই তো তা পূরণ হয়ে গেছে ধরে নিতে হবে। তোমার ইচ্ছাই যে প্রভুর ইচ্ছা । আবার আমাকে টানছো কেন !” নিত্যানন্দ এ কথায় হেসে প্রেমালিঙ্গন দিলেন হরিদাসকে । তারপর ,একটু দূর থেকে উপদেশের সুরে জগাই-মাধাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন–
“বল কৃষ্ণ, ভজ কৃষ্ণ লহ কৃষ্ণনাম ।
কৃষ্ণ মাতা ,কৃষ্ণ পিতা, কৃষ্ণ ধন প্রাণ ।।
তোমা-সবা লাগিয়া কৃষ্ণের অবতার।
হেন কৃষ্ণ ভজ , সব ছাড় অনাচার।।”

কিন্তু , উলুবনে মুক্তো ছড়ানোর মত হল সব প্রচেষ্টা। জগাই এমন কথা শুনে একটু মাথা তুলে প্রথমে দেখলেন, তারপর, মহাক্রোধে “ধরতো, ধরতো, মাধাই” বলে ধাওয়া করলেন নিত্যানন্দ-হরিদাসকে। “রক্ষ কৃষ্ণ, রক্ষ কৃষ্ণ” বলে নিত্যানন্দ-হরিদাস কোনভাবে পালিয়ে জগাইয়ের হাত থেকে বাঁচলেন। সে কী রগড়ের দৃশ্য ! সামনে প্রেমে বিহ্বল দুই ভক্ত হাসতে হাসতে দৌড়াচ্ছেন,
পিছনে গর্জন করতে করতে দুই দস্যু ধাওয়া করেছেন তাঁদের।

শ্রীবাসের গৃহাঙ্গনে ভক্তবৃন্দ সমেত বসে আছেন বিশ্বম্ভর। নিতাই,হরিদাস হাঁপাতে হাঁপাতে এসে সব বললেন তাঁকে। শ্রীবাস পন্ডিত ও গঙ্গাদাস জগাই মাধাইয়ের বংশ পরিচয় জানালেন এবং তাঁদের দুষ্কর্মের আদ্যপান্ত বর্ণনাও দিলেন। নিত্যানন্দ বললেন, “প্রভু, আগে তোমায় এদেরকে উদ্ধার করতে হবে, তারপর অন্য কথা । তোমার পতিত পাবন নাম সার্থক হবে এদের পাপমোচনের দ্বারা। বিশ্ববাসী তোমার মহিমা দেখুক । গৌরাঙ্গ হেসে বললেন, যে মুহূর্তে তোমার দর্শন ওরা পেয়েছে , আর তুমি চেয়েছো যে ওদের উদ্ধার হোক, সেই মুহূর্তেই ওদের সব পাপ মোচন হয়ে গিয়েছে । এবার শুধু তুমি ওদের মঙ্গল চিন্তা করো। দেখবে অচিরেই শ্রীকৃষ্ণ মঙ্গল সাধনা করে দিয়েছেন তাদের। তোমার ইচ্ছাই ফলপ্রসূ হবে।”

একদিন রাত্রিবেলায় নগর ভ্রমণ করে নিত্যানন্দ যাচ্ছেন পথ দিয়ে হেঁটে। এমন সময় জগাই-মাধাই তাঁর পথ অবরোধ করে বললেন, “এই তুই কে রে! কোথায় চলেছিস এত রাতে?” নিত্যানন্দ বললেন, “আমি অবধূত ।গৌরগুণ গাই। এখন তাঁর গৃহে যাচ্ছি। নিত্যানন্দ নাম আমার।” অবধূত শব্দ শোনামাত্র মাধাইয়ের মাথায় যেন খুন চেপে গেল। তিনি করলেন কি, পথের পাশে পড়ে থাকা এক ভাঙ্গা কলসি উঠিয়ে নিয়ে আছাড় মারলেন নিত্যানন্দের মাথায়। সজোরে আঘাত করায় তাঁর মাথা ফেটে গেল আর রক্ত ঝরতে লাগল গলগল করে। অক্রোধ ,পরমানন্দ ,অভিমানশূন্য নিতাই নির্বিকার চিত্তে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রইলেন । তাঁর নির্লিপ্ততা দেখে আরো রেগে গিয়ে তাঁকে আবার মারতে উদ্যত হলেন মাধাই। কিন্তু , রক্তধারা আর নিতাইয়ের নিশ্চুপতা দেখে মন পরিবর্তন হয়ে গেল জগাইয়ের। তিনি বললেন , “না ,না, আর মেরো না। ওকে মেরে লাভই বা কী হবে! একে অবধূত , তায় দেশান্তরী ও। এত নির্দয় হতে হবে না ।” এই বলে তিনি মাধাইয়ের হাত ধরে ফেলে মারের হাত থেকে রক্ষা করলেন নিত্যানন্দকে।

এদিকে অন্যান্য পথচারীদের কেউ একজন ছুটে গিয়ে এই দুঃসংবাদ দিলেন গৌরাঙ্গকে। তিনি সপরিকর ছুটতে ছুটতে এলেন সেই মুহুর্তেই। তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় নিতাইয়ের অঙ্গ রক্তে ভেসে যাচ্ছে দেখে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন গৌরহরি। তাঁকে প্রহার করে রক্ত ঝরিয়ে দিলে তিনি এতখানি রুষ্ট হতেন না, যতখানি নিতাইয়ের ক্ষেত্রে হলেন। “চক্র, চক্র” বলে সুদর্শন চক্রকে আহ্বান জানিয়ে নিজের হাত উপরে তুললেন। সুদর্শন চক্র চলে এল তাঁর হাতে। ভক্তরা প্রমাদ গুনলেন। এবার তো আর নিস্তার নেই জগাই-মাধাইয়ের! চক্র দ্বারা প্রভু তাঁদের সংহার করবেনই করবেন। কিন্তু, কলিতে এযুগে এই অবতারে তো তিনি প্রেম দিয়ে জীব উদ্ধার করবেন, অস্ত্র ধরার কথা নয় তাঁর। তাঁর অঙ্গ-উপাঙ্গ স্বরূপ পার্ষদরাই তাঁর অস্ত্র । যাঁদের দ্বারা তিনি নাম-প্রেম প্রচার করবেন । তাঁর রূপমাধুর্য্যের দ্বারা অসুরের আসুরিক স্বভাবের পরিবর্তন করবেন। তাঁকে দর্শন করেই পরিবর্তিত হবে পতিতরা। এযুগে তিনি কাউকে সংহার করবেন না । বরং প্রেমভক্তি দিয়ে মনকে জারিত করে মনের পরিবর্তন ঘটিয়ে , ভক্ত বানাবেন অভক্তদের। মহাভাগবত হবেন এক একজন তাঁরা সকলে।

জগাই-মাধাইকে বাঁচাতে নিত্যানন্দ করলেন এক কৌশলতা । তিনি শশব্যস্তে বলে উঠলেন , “প্রভু , দেখ ,দেখ , এই জগাই আমায় প্রাণে বাঁচিয়েছে। মাধাই মারতে গেলে জগাই বাধা দিয়ে রক্ষা করে আমায় ‌।” একথা শুনেই গৌরাঙ্গের মনঃসংযোগ চক্র থেকে সরে জগাইয়ের দিকে গেল । বললেন তিনি, “তাই নাকি! তুমি আমার নিতাইকে প্রাণে বাঁচিয়েছো! প্রভু তোমার অনেক মঙ্গল করুন। নিত্যানন্দকে বাঁচিয়ে তুমি আমায় কিনে নিলে আজ।” এই বলেই তিনি জগাইকে জড়িয়ে ধরলেন। জগাইকে বাঁচিয়ে রেখে পাছে মাধাইকে মারেন, তাই নিত্যানন্দ বলে চললেন ,”প্রভু ,এই দুজনার শরীর আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি । তুমি তো এই যুগে প্রতিজ্ঞা করেছো যে অস্ত্র না ধরেও জীব উদ্ধারন লীলা করবে। তবে কেন তার ব্যতিক্রম করবে, বলো ! দু’জনকেই তুমি কৃপা করো ।” এদিকে গৌরাঙ্গ প্রেমালিঙ্গন দেওয়ায় প্রেমভার বইতে না পেরে জগাই মূর্ছিত হয়ে গেছেন। গৌরাঙ্গ বললেন, “জগাই ওঠো। তুমি মা মন চায় বরং চেয়ে নাও আজ। আমি সত্যসত্যই তোমায় প্রেমভক্তি প্রদান করলাম। আমার দেহ থেকেও নিত্যানন্দের দেহ আমার কাছে বড়। তুমি সে’দেহকে রক্ষা করেছো যখন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তোমায় অনেক কৃপা করবেন, এই আমি বললাম।”

জগাই দেখলেন গৌরহরি শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম ধারী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন । প্রেমানন্দে করজোড়ে তখন প্রাণের আকুতি ভরা প্রণাম জানাচ্ছেন গৌরাঙ্গকে তিনি। তাঁর নয়নের জল সর্বাঙ্গ বয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে । তিনি আবার জ্ঞান হারালেন। তখন গৌরহরি নিজের চরণখানি তার বক্ষের ওপর স্থাপন করলেন। যাঁর অভয়পদ স্বয়ং লক্ষ্মীদেবীর জীবন, সেই পদদ্বয় হৃদয়ে ধরে জগাই সদৈন্যে অশ্রু বিসর্জন করে চলেছেন। সেই দুরাচারী জগাই কই আর ! ইনি যে এখন মহাভক্ত এক । জগাইয়ের ওপর গৌরহরির এমন করুণা দেখে উপস্থিত ভক্তবৃন্দ হরিধ্বনি দিতে থাকলেন উচ্চস্বরে। আকাশ ভেদ করে সে দিব্য ধ্বনি যেন ব্রক্ষ্মলোকে পৌঁছে যাচ্ছিল ।

এতসবের সাক্ষী মৌন মাধাইয়ের মন এতক্ষণে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী জগাই এমন কৃপা পেয়ে গেল, পরিবর্তিত হয়ে গেল, উদ্ধার হয়ে গেল , অথচ ,তিনি তিমিরেই পড়ে রইলেন— একথা ভেবে মাধাই তখন পাগলপ্রায় হয়ে গৌরাঙ্গের পাদপদ্মে পড়ে গেলেন । তাঁর দুর্বুদ্ধির বিনাশ হয়ে গেছে। তিনিও এখন দুষ্কর্ম ছেড়ে জগাইয়ের মত ভক্তমন্ হতে চান । তাই বিনয় বচনে বললেন , “আমরা দুই ভাই জগাই-মাধাই সর্বক্ষণ একসাথে থাকি, একই কুকর্ম করি, একসাথে মদ্যপান করে একই পাপ করি ‌। তবে কেন একজনকে কৃপা করে অন্যজনকে বঞ্চিত করবে, প্রভু? আমাকেও উদ্ধার করো। ক্ষমা করে দাও আমায় অনুগ্রহ করে। আমাকে তোমার নাম গান প্রচারে শামিল করো । আমার মত দুর্জনকে তুমি উদ্ধার না করলে ,আর কে করবে? কী গতি হবে আমার? কৃপা করো দয়াময় ।”

গৌরাঙ্গ বললেন, ” না, তোমার কৃপা কোন মতেই হবে না। তুমি নিত্যানন্দের দেহে আঘাত করেছ।”
মাধাই– “অন্যান্য অবতারে তোমায় কত অসুরেরা কত আঘাত করেছে, বিদ্ধ করেছে বাণে। তুমি তো তাদের সকলকেই উদ্ধার করেছ। তোমার অভয়পদে স্থান দিয়েছ। তবে আমার বেলায় কেন তুমি স্বধর্ম ত্যাগ করবে,প্রভু!” গৌরাঙ্গ— “তুমি তো আমায় নির্য্যাতন করোনি । করেছো আমার প্রাণাধিক প্রিয় নিতাইকে। যদি আমায় করতে তাহলে ক্ষমা আমি অনেক আগেই করে দিতাম। কিন্তু, আমার দেহের থেকেও নিত্যানন্দের দেহ যে অনেক প্রিয় ,অনেক বড় আমার কাছে । তাঁকে দুঃখ দিয়ে আমার কৃপা কোনমতেই পাবে না আমার থেকে।”
মাধাই—“প্রভু, তুমি তো সর্বরোগহর বৈদ্য চূড়ামণি। তবে আমার এই কঠিন রোগ কেমন করে দূর হবে বলে দাও আমায়। কী করলে আমার পরিত্রান হবে এই ঘৃণ্য অপরাধের থেকে ? তুমি যা বলবে ,আমি তাই করবো।”
তখন গৌরসুন্দর বললেন, ” যদি নিজের পাপ মোচন করতে চাও তবে যাঁর চরণে তোমার অপরাধ হয়েছে, তাঁর শরণ নাও । নিতাইয়ের চরণে অপরাধী তুমি, তাই নিতাইয়ের কাছেই তোমায় ক্ষমা ভিক্ষা করতে হবে । সে যতক্ষণ না কৃপা করবে, তোমার প্রেমভক্তি ততক্ষণ বাদ।”

মাধাই নিত্যানন্দের শ্রীচরণে পড়লেন । যে পদ দেব-ঋষিগণ প্রার্থনা করেন ,শ্রীরেবতী যে পদযুগলের সেবা করেন সেই পদে মাথা কুটতে থাকলেন মাধাই। গৌরহরি বললেন, “নিতাই, তুমি ওকে ক্ষমা না করলে, ও যে উদ্ধার হবে না । তোমার কৃপা বিনা তো কেউ প্রেমভিক্ষা পায় না। তাই, এবার দেখো তুমি ওকে কী করবে।” নিত্যানন্দ হেসে বললেন, “আমার জীবনে যদি কিছু সুকৃতী থেকে থাকে, আমি তার সমস্তটা আজ মাধাইকে দান করলাম। এই বলে মাধাইকে নিজের চরণ থেকে তুলে কৃপা আলিঙ্গন দিলেন তিনি। মাধাইয়ের শরীরে নিজ শক্তি সঞ্চার করে দিলেন। সকল বন্ধনের বিমোচন হয়ে গেল মাধাইয়ের। গৌরাঙ্গ বললেন, “জগাই-মাধাই তোমাদের কোটি জন্মের পাপের ভার আমার হল আজ থেকে। আর কিন্তু নতুন কোনও পাপকার্য্য করো না এরপর। তোমাদের পূর্বের কর্মের সব পাপের ভার আমার হল।” জগাই-মাধাই সমস্বরে বলে উঠলেন ,”না ,না, বাবা ! আর নয় । আমরা আর কোনদিন কোন কুকর্ম করবো না। এমনকী করার কথাও ভাববো না।” গৌরাঙ্গ—“বেশ, তবে তোমাদের দেহে আমার অবতার হবে । তোমাদের দুজনার মুখদ্বার দ্বারা আহার হবে আমার।” এমন কৃপাশীর্বাদ পেয়ে দু’ভাই বাহ্য হারালেন । গৌরাঙ্গ বললেন ,”এদের দু-জনকে আমার ঘরে নিয়ে চলো। আজ সেই ধন আমি এদের দেবো যা ব্রক্ষ্মাদির দুর্লভ। এদেরকে সকলের থেকে উত্তম বানাবো। এরা এমন পুণ্যবান হবে যে এদের স্পর্শ করলে গঙ্গাস্নানের সমান ফল প্রাপ্ত হওয়া যাবে ।”

জগাই-মাধাইকে নিয়ে গেলেন ভক্তরা প্রভুর ঘরে। তাঁদের দুজনকে ঘিরে সংকীর্তন শুরু হল। কীর্তনের রোলে প্রেমানন্দে দু’বাহু তুলে অপার নৃত্য করতে থাকলেন জগাই মাধাই । তাঁদের দেহ দুখানি আবেশে বিভোর হয়ে প্রেমে ঢলঢল করে নৃত্যরত তখন। অশ্রুনীরে সর্বাঙ্গ সিক্ত।সাত্ত্বিক ভাবের প্রকাশ দেহে। দৈন্য-স্তুতি করে চলেছেন তাঁরা। তাঁদের সেই দশা বলে বোঝানোর নয় । তাঁদের দেখে বুক ফাটে এমন দশা তখন ভক্তদের । গৌরাঙ্গ বললেন, “আজ থেকে এরা আর মদ্যপ জীবনযাপন করবে না। এরা আমার সেবক । সকলে আশীর্বাদ করো এদেরকে। জন্মে জন্মে আমায় যেন না ভোলে আর কারোর চরণে যদি কিছু অপরাধ থেকে থাকে এদের , তোমরা সকলে নিজ গুনে সে অপরাধের ক্ষমা করে দিও। কৃপা কর সকলে জগাই-মাধাইকে।”
জগাই-মাধাই সকলের চরণ ধরে ধরে ক্ষমা ভিক্ষা করতে থাকলেন চোখের জলে ভেসে । ক্ষমাসুন্দর চোখে তাঁদেরকে আপন করে নিয়ে আশীর্বাদ করলেন সকল ভক্তরা। সেদিন থেকে তাঁরা অনুগত সেবক হলেন গৌর-নিতাইয়ের ।

এরপর সকলে মিলে কীর্তন করতে করতে গঙ্গাস্নান করতে গেলেন। অনেক জলকেলি হল। জগাই-মাধাইয়ের সব পাপ হরণ করেছেন যে ,সে প্রমাণ দিতে নিত্যানন্দ প্রভু ‘কালিয়া আকার’ ধারণ করেছিলেন সেদিন । স্নান সেরে উঠে নিত্যানন্দ ও গৌরাঙ্গ আপন আপন কন্ঠের মালা জগাই-মাধাইকে পড়িয়ে দিলেন। সেই থেকে মহাভাগবত হলেন জগাই মাধাই।

“মহাপ্রভু দুঁহে করিয়া আলিঙ্গন ।
বোলে আজি হৈতে মোর সেবক দুইজন ।।
নিতাই আলিঙ্গিয়া দুঁহে বলয়ে বচন।
প্রিয় শিষ্য হৈলা মোর তোমরা দুইজন।।
জগাই মাধাই হৈলা ভক্ত অতিশয় ।
দুই প্রভুর দুই শাখা মধ্যে গণনা যে হয় ।।”
(প্রেমবিলাস,২১)

“এতেক যতেক কৈল এই দুইজনে।
করিলাম আমি ঘুচাইলাম আপনে।।
ইহা জানি এ দুইয়ে সকল বৈষ্ণব।
দেখিয়া অভেদ দৃষ্ট্যে যেন তুমি সব।।
শুন এই আজ্ঞা মোর যে হও আমার।
এ দুইয়ে শ্রদ্ধা করি যে দিব আহার ।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড মাঝে যত মধু আছে।
সে হয় কৃষ্ণের মুখে দিলে প্রেমরসে ।।
এই দুইরে বট মাত্র দিবে যেইজন।
তার সে কৃষ্ণের মুখে মধু সমর্পণ।।
এ দুই জনেরে যে করিবে উপহাস।
এ দুইর অপরাধে তার সর্বনাশ।।
তবে গলার মালা দোঁহার গলে দিল।
প্রভু কৃপা পাই দোঁহে প্রেমেতে ভাসিল।।”(চৈ.ভা.-১৩)

পরম প্রেমিক , মহাভক্ত জগাই-মাধাই দুভাই এখন দিবানিশি কৃষ্ণপ্রেমে ডুবে আঁখিনীরে ভাসেন। প্রতিদিন ভোর বেলায় গঙ্গা স্নান করে এসে তারা দুই লক্ষ নাম নেন। কৃষ্ণ বলে নিরবধি হা-হুতাশ করেন । কৃষ্ণময় জগৎ এখন তাঁদের। কিন্তু, এত সবের সঙ্গে নিজেদের অতীতের কীর্তিকলাপের কথা ভেবে ধিক্কার দেন নিজেদেরকেই তাঁরা। নিজেদের জীবহিংসার কথা ভেবে মরমে মরে যায়। ভূমিতে পড়ে আকুলি-বিকুলি করে অনুশোচনায় । পতিত পাবন গৌরসুন্দর কত দয়াময়, আর,নিত্যানন্দ কত করুণাময়! তাঁদের এত অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন এত অবলীলায় , এত কৃপা করলেন! এসব ভেবে কেঁদে আকুল হন তাঁরা। বিহ্বল হয়ে যান প্রভুদের কৃপালীলার কথা ভেবে। কখনো কৃষ্ণপ্রেমানন্দে, কখনো বা নিজেদের অতীতের দুষ্কর্মের কথা ভেবে আহার করেন না । তখন নিতাই ও গৌরসুন্দর অনেক বুঝিয়ে আহার তুলে দেন মুখে তাঁদের । মাধাই আরো বেশি অনুশোচনায় ভোগেন জগাইয়ের থেকে। তিনি নিতাইকে প্রহার করেছেন , রক্ত বের করে দিয়েছেন মাথা ফাটিয়ে— কত না পাপীষ্ঠ তিনি(!) , একথা ভেবে বক্ষ ভাসান নয়নজলে । যদিও নিতাই তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছেন , তবুও একদিন তিনি দন্তে তৃণ ধরে আবার নিত্যানন্দের চরণে পড়ে ক্ষমাভিক্ষা চাইলেন । চোখের জলে নিত্যানন্দের চরণ ধুয়ে দিলেন, স্তব করলেন কত না ! সন্তুষ্ট নিত্যানন্দ বুকে টেনে নিলেন তাঁর প্রিয় মাধাইকে , বললেন , “তুমি এখনো এতদিন পরেও কেন এমন করো! শোক পরিহার করো মাধাই। তুমি তো এখন আমার দাস । তোমার শরীর এখন আমার সম্পদ । তুমি এভাবে দৈন ক্রন্দন করে আমাকে কেন কষ্ট দাও! শিশুপুত্র যদি পিতাকে মারে তাতে কী পিতার কিছু আসে যায় ! পুত্রের অপরাধ দেখেনা পিতা। তেমন তুমিও তখন অজ্ঞানী ছিলে শিশুপুত্রের ন্যায়। তোমার কোন অপরাধ আমি দেখিনি । তার ওপর আমার প্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ তোমায় আপন করে নিয়েছেন। যাকে তিনি কৃপা করেন সে আমার জন্মে জন্মে প্রিয়পাত্র হয়ে যায়। আর যে জন তাঁকে লঙ্ঘণ করে আমায় পূজা দেয়, সেই মূঢ় কখনো আমার কৃপার পাত্র হয়না, প্রিয়পাত্র হওয়া তো অনেক দূরের কথা। তোমায় তিনি কৃপা করেছেন যখন , তখন তুমি আমার যে কত প্রিয় হয়েছো তা আমি বোঝাতে পারবো না।” এই বলে নিত্যানন্দ মাধাইকে প্রেমালিঙ্গন দিলেন। তখন মাধাইয়ের অন্তর শান্ত হল। তিনি বললেন,”কিন্তু, প্রভু ,আমার যে অনেকের কাছে অনেক অপরাধ জমা হয়ে আছে ,তার কী হবে? আমি তো তাঁদের সকলকে চিনিও না , ভুলে গেছি তাদের মুখ। কী করে তাদের কাছে ক্ষমা চাইবো আমি? আমি বহু বহু পাপ করেছি এতদিন ধরে। কী করে সেই অপরাধবোধ যাবে আমার ?”

তখন নিত্যানন্দ বললেন ,”বেশ ,তবে এক কাজ করো । তুমি প্রতিদিন গঙ্গার তীরে গিয়ে ঘাট মার্জন করবে, ঘাটে যারা স্নান করতে আসবে তাদের যতটা সম্ভব সেবা করবে । তারা স্নান করে উঠলে তাদের প্রণাম জানিয়ে ক্ষমা চাইবে। প্রসন্ন হয়ে তারা যখন তোমায় আশীর্বাদ করবে কল্যাণ হোক বলে , তাতেই তোমার অপরাধবোধ চলে যাবে। হৃদয় প্রশান্ত হবে ।এই আকুলতা দূরে যাবে।”

নিত্যানন্দের দেখানো পথেই এখন জগাই- মাধাই আচরণ করেন। ঘাট মার্জন করে। প্রতিদিন ভোরবেলা থেকে গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকেন। যাঁরা স্নান করতে আসেন তাদের গামছা, সিক্ত বস্ত্রের জল ঝরিয়ে দেন, কলসে জল তুলে দেন, চরণ ধুয়ে দেন জগাই-মাধাই। সকলের চরণ ধরে ধরে প্রার্থনা করেন–“জ্ঞানে-অজ্ঞানে যত পাপ করেছি আপনাদের প্রতি ক্ষমা চাইছি সবের জন্য ‌। আপনারা ক্ষমা করুন এই জীবাধম কে । এ নরাধম ভিক্ষা চাইছে মার্জনা আপনাদের থেকে।” তাঁদের ক্রন্দন দেখে আর অনুরোধ শুনে ঘাটে আগত স্নানার্থীদেরও চোখে জল এসে যেত। তাঁরা নয়নাশ্রু ফেলে ক্ষমা করে দিতেন ।আবেগে তাঁদের কণ্ঠও রুদ্ধ হয়ে যেত জগাই মাধাইয়ের বিনয় দেখে।

প্রেমিক সুজন জগাই-মাধাই কঠোর থেকে কঠোরতম ভজনে নিমগ্ন হলেন । ব্রহ্মচারী বলে তারা খ্যাত হলেন। তাঁরা কোদাল চালিয়ে মাটি কেটে গঙ্গার ঘাট বানালেন নতুন এক। এখনো সেই ঘাট দর্শন হয় কাটোয়ায়। ‘মাধাইয়ের ঘাট’ নামে প্রসিদ্ধ সেই ঘাট । নিত্যানন্দের করুণাগুনে তাঁরা চৈতন্য চরণ পেয়েছেন। গৌরাঙ্গের পতিত পাবন লীলার মহাপ্রমাণ হলেন তাঁরা দুই ভাই। নিতাইয়ের কৃপাপাত্র এই দুই পরম ভাগ্যবান ভ্রাতারা আসলে শ্রীনারায়নের বৈকুণ্ঠ ধামের দুই দ্বারপাল জয় ও বিজয় । সনক মুনিদের অভিশাপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ধরণীতে।

“বৈকুণ্ঠে দরবার পালৌ যৌ জয়াদ্য বিজয়ান্তকৌ।
তাবাদ্য জাতৌ স্বেচ্ছাতঃ শ্রীজগন্নাথ মাধবৌ।।”
(গৌ. গ. দী.–৩১৫)

নিত্যানন্দ চেয়েছিলেন প্রাকৃত মদ্যপান করে যেমন অস্পৃশ্যরা মত্ত হয়, তেমন কৃষ্ণপ্রেমভক্তি সুধা পান করে জগাই-মাধাই পরিবর্তিত হয়ে কৃষ্ণপ্রেমে উন্মত্ত হোক, কীর্তন করুক, ভজন পরায়ন হোক। তাঁর সেই ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছিল প্রকৃত অর্থেই। মহাভাগবত, ভজনানন্দী হলেন। তাঁরা বিবাহ করেননি, থেকেছেন আজীবন ব্রক্ষ্মচারী হয়ে। তাঁদের দর্শনেও মানব পাপমুক্ত হত, কৃপাপ্রাপ্ত হত। ওহে মহাপ্রেমিক জগাই-মাধাই দুই ভ্রাতা— আপনারা কৃপা করুন এ অধমা, সাধন-ভজনহীনাকে যাতে নিতাই-চৈতন্য চরণ নিরবধি চিন্তা করতে পারি । তাঁদের সেবায় জীবন অতিবাহিত করতে পারি। আপনাদের শ্রীচরণে অনন্ত অর্বুদ কোটি প্রণাম আমার।

।সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here