শ্রীধাম নবদ্বীপ শ্রীবাস অঙ্গনের শ্রীরাধাপ্রেমরস-রসিক প্রভুপাদ শ্রী শ্রীজীব গোস্বামীর দিব্য জীবনী (পর্ব-২) : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

সিদ্ধ সাধক তিনকড়ি গোস্বামী বিনা কড়িতেই ক্রয় করে নিলেন শ্রীজীব গোস্বামীর হৃদয়খানি। সর্বারাধ্য সার শিরোমণি শ্রীরাধারাণীর প্রেমসেবা প্রণয়ণ করলেন । রাধাদাস্য ভজন শিক্ষা করালেন । মধুকর যেমন করে মধু লোভে পদ্ম পুষ্পের চারিপার্শ্বে গুঞ্জন করে ফেরে আর তারপর নিশ্চল হয়ে মধুপানে একসময় বিভোর হয়ে যায় , তেমন শ্রীজীব গোস্বামীর চিত্তভৃঙ্গ এখন বৃন্দাবনের নবনিকুঞ্জ কুঞ্জ—-যেখানকার লতাবিতান শ্রীরাধার হস্তকমল দ্বারা সংস্পৃষ্ট ,যেখানকার মধুভূমি শ্রীরাধার প্রেমামৃতমকরন্দ রসপ্রবাহ পূর্ণ চরণকমল শোভায় সুশোভিত, যেখানকার বিহগকুল শ্রীরাধার গুণ-গানে সর্বদা মুখরিত—- শ্রীরাধার সেই বিহারবিপিনে সর্বদা গুঞ্জন করে ফেরে । তিনি শ্রীরাধা নামের দিব্যনিধির দিব্যচিন্তাতেই দিনরাত বিভোর হয়ে থাকেন। তাঁর মন আর কোকিলের সুমধুর তানে, নির্ঝরিণীর কুলুকুলু গানে , বসন্তের সুনির্মল বায়ুতে, প্রফুল্লিত নন্দনকাননের সুষমায় বা মধুপের গুঞ্জনে মোহিত হয় না । তিনকড়ি গোস্বামী তাঁকে যেমন যেমন আদেশ করেছেন, তিনি তেমন তেমন রীতিতে মরমীয়া কিঙ্করী হয়ে সর্বানন্দ আকর শ্রীরাধার সেবা করেন ‌। অন্তঃশ্চিন্তিত মঞ্জরী দেহে যেমন প্রাণঢালা সেবা চলে তেমনই বাহ্যদেহে চলে অহর্নিশি মালায় মহামন্ত্র জপ । মহাভাবে তাঁর শ্রীঅঙ্গ অলংকৃত হয়। দিব্যভাবভূষণে ভূষিত হয় কলেবর।

এরই মাঝে শ্রীজীব গোস্বামী অপর এক মহাজনের সঙ্গ লব্ধ হলেন। তিনি হলেন শ্রীকানুপ্রিয় গোস্বামী। নবদ্বীপের শ্রীবাস অঙ্গনের অবিরত কীর্তনের বোল, মৃদঙ্গের রোল, আস্বাদিত ভক্তবৃন্দের কলরোল, অষ্টপ্রহর সেবা—- সব মিলে ভৌম-গোলক-ভূমির অনুভব জাগরিত করলো।

প্রসঙ্গতঃ, একটি ঘটনা জানাই, তিনকড়ি গোস্বামীর ভজনপ্রভাব সম্পর্কে। যখন প্রথম প্রথম প্রতিদিন রাত্রি আটটার পর শ্রীজীব গোস্বামী তিনকড়ি গোস্বামীর চরণদর্শন করতে যেতেন , তখন একদিন তাঁর মাতা সরস্বতী দেবী তথা সীতাদেবীর মনে সংশয় জাগে যে পুত্র কেন নিত্যদিন রাতের বেলায় কোথাও একটা যায়! দুশ্চিন্তা হয় তাঁর স্বাভাবিক ভাবেই। পুত্র কোন কুসঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে না তো এই চিন্তায় ব্যাকুল হন তিনি। একদিন প্রশ্ন করেই ফেললেন এ ব্যাপারে। শ্রীজীব জানালেন যে তিনি একজন মহাপুরুষের সাথে সঙ্গ করতে যান ওই সময়। সীতাদেবী বললেন, “বেশ আমাকেও তাহলে নিয়ে চলো আজ। আমিও তাঁর চরণদর্শন করতে চাই। দেখতে চাই কে তিনি!” শ্রীজীব জানালেন, ” না মা , তুমি যেও না । তিনি তো মহিলাদের মুখদর্শন করেন না । তুমি গেলে অসন্তুষ্ট হতে পারেন।” বুদ্ধিমতী, বিচক্ষণা সীতাদেবী আর এ প্রসঙ্গে কোন বাক-বিতণ্ডা করেন নি। তিনি মৌন রইলেন শুনে ।

এরপর একদিন দিনের বেলায় বিশ্বনাথ নামের যে পরিচিত রিক্সাচালক শ্রীজীব গোস্বামীকে নিয়ে প্রতিদিন মণিপুর ঘাটে তিনকড়ি বাবার ওখানে নিয়ে যেতেন তাঁকে সীতাদেবী আদেশ দিলেন নিয়ে যেতে সেই স্থানে যেখানে তিনি শ্রীজীবকে নিত্য নিয়ে যান। বিশ্বনাথ একটু কিন্তু-কিন্তু করছিলেন সীতাদেবীকে নিয়ে যাবার বিষয়ে, কিন্তু মাতৃআজ্ঞা বলবতী যে ! তাই আর না করতে পারলেন না। মণিপুর ঘাটে পৌঁছতেই বেশ অনেকটা দূরে থাকা চট বাবাকে দেখতে পেলেন বিশ্বনাথ। তিনি বললেন,”মা! ওই দেখুন চট বাবা আসছেন !ওই যে ! ”
সীতাদেবী সঙ্গে-সঙ্গে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়ালেন । তিনি দেখলেন বেশ অনেকটা দূরেই গঙ্গাস্নান সেরে আসা একজন সাধু, পরিধানে কেবল চট , হস্তে কমন্ডুল ধরা—কুটীরে প্রবেশ করে গেলেন । সীতাদেবী সেখান থেকেই তাঁকে প্রণাম নিবেদন করে চলে এলেন গৃহে। মনে মনে আশ্বস্ত হলেন পুত্রের সাধুসঙ্গ বিষয়ে।

লেখিকা—রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

এর দু’দিন পর শ্রীজীব গোস্বামী এসে তাঁর মাতৃদেবীকে বললেন, ” মা ,আমি না তোমায় বারণ করেছিলাম যেতে ! তুমি তাও গেলে, মা!” সীতাদেবী তৎক্ষণাৎ বুঝে গেলেন যে তাঁর আদরের নিধি কোথায় যাবার কথা বলছে। মনে মনে তিনি অসন্তুষ্ট হলেন রিক্সাচালক বিশ্বনাথের প্রতি, এই ভেবে যে “বারণ করা সত্ত্বেও সে সব বলে দিল শ্রীজীবকে!” কিন্তু পরক্ষণেই তাঁকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে শ্রীজীব বললেন, “তিনকড়ি গোস্বামী তোমার জন্য একটি শাড়ি ও দশটা টাকা পাঠিয়ে প্রণাম জানিয়েছেন। সেদিন তাঁর মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। তিনি বললেন— তোমার মা এসেছিলেন। দূর থেকে প্রণাম করে চলে গেছেন । তিনি এসে জাহ্নবা মায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন।”

সীতাদেবী বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন সিদ্ধপুরুষ তিনকড়ি গোস্বামীর অলৌকিক ক্ষমতার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে।
(ক্রমশঃ)
—–ভক্তকৃপা প্রার্থিনী

নম্রানতা
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *