পটল চায়ের দোকান খুলবে । চায়ের দোকান খোলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত । অনেক ভেবেচিন্তে চায়ের দোকান খোলার সিদ্ধান্ত । ময়মী ছেলের সিদ্ধান্তের কোনো প্রতিবাদ না করে বরং সায় দিয়ে বলল, “গতর খাটিয়ে যেটুকু আয় করবি, জানবি সেটাই ঠিক ও সম্মানজনক উপার্জন ।“
শালিকডাঙার বাঁকে কিছুটা এগিয়ে পটল বাঁশের খুঁটি পুতলো । অর্ধেক দোকান ঘর তোলা হয়ে গেছে । বাঁধা দিলো সনাতন কাকা । সে কিছুতেই পটলাকে চায়ের দোকান খুলতে দেবে না । তার বক্তব্য, শালিকডাঙার বাঁকে একটা চায়ের দোকান রয়েছে । সুতরাং চায়ের দোকান থাকা সত্বেও দ্বিতীয় কোনো চায়ের দোকান খোলা যাবে না । পটল চায়ের দোকান খুললে, সনাতন কাকার চায়ের দোকানের বেচাকেনা ঝিমিয়ে যাবে । তাই সনাতন শুধু বাঁধা দিয়ে ক্ষান্ত রইল না বরং হুমকি দিয়ে পটলকে জানিয়ে দিলো, তার কথা না শুনলে দোকান ঘর তো ভাঙবেই উপরন্তু তাদেরকে বিলাসপুর গাঁ থেকে উচ্ছেদ করে ছাড়বে ।
তল্লাটে সবাই জানে সনাতন হিংস্র ধরনের মানুষ । খুনখারাপির কাজ করতেও তার বিবেকে বাধে না । সনাতন কাকার অন্তরটা কুৎসিত ষড়যন্ত্রে ভরপুর । মানুষের সাথে ভাব ভালবাসা কম । দোকানের খরিদ্দারদের সাথেও তার অভব্য আচরণ । যার জন্য তার দোকানে একবার কেউ চা খেলে দ্বিতীয়বার চা খেতে চায় না । নেহাত শালিকডাঙার বাঁকে একটিমাত্র চায়ের দোকান, তাই মানুষ বাধ্য হয়ে তার দোকানে ঢোকে । তা ছাড়া সনাতন খুব নিম্ন মানের চা পাতা ব্যবহার করে । চায়ের স্বাদ ভাল না । পটল খবর নিয়ে জেনেছে, যেহেতু মাসুদুল মিঞা তাকে দোকান খুলতে সবরকম সহযোগিতা করছে সেইজন্য সনাতন কাকার খুব রাগ ! সনাতন কাকা সিরাজডাঙার লোকজনদের পছন্দ করে না । পছন্দ না করার পেছনে অনেক ইতিহাস । সনাতন ওপার বাংলার মুসলমানদের তাড়া খেয়ে এদেশে আশ্রয় নিয়েছে । সেই কারণে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ তার কাছে ভীষণ অপছন্দের । সনাতন কাকার একটাই কথা, মুসলমানদের তাড়া খেয়ে দীর্ঘ কয়েক পুরুষের ভিটে-মাটি ছেড়ে এদেশে আশ্রয় নিয়েছে । তারপর তাদের বাঁচার লড়াই । হাড়ভাঙ্গা কঠোর পরিশ্রম করে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করা । অথচ মাসুদুল মিঞা মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ হয়ে শালিকডাঙার বাঁকে মুদিখানার দোকান চালাচ্ছে । এটাই সনাতন কাকা সহ্য করতে পারছে না । তাই মাসুদুল মিঞার মুদিখানার দোকান চালানোতে ভীষণ রাগ ! তার গাত্রদাহ ।
সনাতন কাকার হুমকির খবর নিমেষের মধ্যে বিলাসপুর রিফিউজি কলোনীতে ছড়িয়ে পড়ল । বিলাসপুর গ্রামকে স্থানীয় পাড়ার লোকেরা রিফিউজি কলোনী নামে বেশী চেনে । কেননা ওপার বাংলার ছিন্নমূল উদ্বাস্তু লোকেদের হাতে গ্রামটির পত্তন । যাই হোক সনাতন কাকার অপ্রীতিকর ব্যবহারে রেগে গেল মাসুদুল মিঞা । সে বলল, এটা কী ধরনের অরাজকতা ! একটা গরীব ঘরের ছেলে গতর খাটিয়ে বাঁচতে চাইছে, তাকে কিনা হেনস্থা করা ! তার উপার্জনের পথ বন্ধ করে দেওয়া । এটা অমানবিক কাজ ! তার তো কোনো অপরাধ নেই । পটল কারও ক্ষতিও করছে না । তবে কেন অহেতুক ছোট ছেলেটার কঠোর পরিশ্রম করে বাঁচার প্রচেষ্টাকে সনাতন অবরুদ্ধ করে দিচ্ছে ! সুতরাং সনাতন কাকার গোয়ার্তুমির একটা যথাযোগ্য শিক্ষা হওয়া উচিত !
ময়মী সনাতন কাকার সঙ্গে দেখা করল । ময়মী সনাতন কাকাকে বুঝিয়ে বলল, “পটল খুব ছোট । তার একমাত্র অবলম্বন পটল ও ঝিঙে । ঝিঙে খুবই ছোট । অভাবী সংসার । আপনি ভালভাবেই জানেন শারীরিক অসুস্থতার জন্যে আমি ক্রমশ কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি । এমতাবস্থায় পটল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চায়ের দোকান খুলতে চাইছে । মাসুদুল মিঞা সহযোগিতা না করলে দোকান খোলার স্বপ্ন পটলের কাছে অধরা থেকেই যেতো । মিঞা ভাই বাঁশ খুটি কিনে দেওয়ার জন্য পটল দোকান খোলার সাহস পেয়েছে । তাই আপনাকে আমার বিনীত অনুরোধ, আমার ছেলেটার উপার্জনের সৎ সাহসটা আপনি নষ্ট করে দেবেন না দাদা ।“
পটলের মায়ের অনুরোধে সনাতন কাকার কোনো হেলদোল নেই । সে তার হুঙ্কার বহাল রাখল । পটলকে চায়ের দোকান খুলতে কিছুতেই দেবে না ।
বিলাসপুর গাঁয়ের মোড়ল সনাতন কাকার চায়ের দোকানের নিত্য খরিদ্দার । সেই সুবাদে গাঁয়ে সনাতন কাকার প্রভাব প্রতিপত্তি যথেষ্ট । পটলের চায়ের দোকান খোলার ব্যাপারে মাসুদুল বড্ড বেশী নাক গলাচ্ছে ! মাসুদুল মিঞাকে সনাতন একটা উচিত শিক্ষা দিতে চায় । শালিকডাঙা বাঁকে দোকান খোলা ও দোকান চালানোর ব্যাপারে সনাতন কাকা শেষ কথা । সনাতন কাকা আবার পঞ্চায়েতের শ্রীহরি পালের সঙ্গে ওঠাবসা । তাঁর সঙ্গে ভাব ভালবাসা । যার জন্য সনাতন কাকার মেজাজ সবসময় তুঙ্গে । তার কথার বিরোধীতা সাধারণত কেউ করে না । সেই জন্য মাসুদুল মিঞা সাতপাঁচ ভাবছে, সনাতন কাকাকে কীভাবে আক্রমন করা যায় ! কীভাবে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া যায় ! অনেক ভেবেচিন্তে এগোতে চায় ।
দোকান যাতে খোলা যায় সেই আর্জি নিয়ে পটল মাসুদুল মিঞার স্মরণাপন্ন হল । তাকে বোঝাল, দোকান খুলতে না পারলে তাদের বেঁচে থাকা খুব কষ্টের । মায়ের শারীরিক স্থিতি একেবারেই ভাল না । বরং তার মায়ের শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি ঘটছে । ডাক্তারবাবু তার মায়ের ক্যানসার রোগ সন্দেহ করছেন ! বোনটা ভীষণ ছোট । সে দুইবেলা ঠিকমতো পেট ভরে খেতে পাচ্ছে না । তাই মায়ের করুণ অবস্থা, বোনের শুকনো মুখ, পটলকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে । দোকান চালু করতে না পারলে তাকে পরের বাড়ির জমিতে খাটতে হবে । সেই ক্ষেত্রে কাজের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা ষোলোআনা ।
পটল কী করবে ভেবে পাচ্ছে না । পটল যেমনি নিজে সনাতন কাকাকে অনুরোধ করল তেমনি তার মা জোড় হাতে সনাতন কাকাকে অনুরোধ করল পটলকে দোকান খুলতে দেওয়ার জন্য । কিন্তু কোনো অনুরোধেও তার সিদ্ধান্ত বদল হচ্ছে না ! উপরন্তু সনাতন কাকা নিজের জেদ বজায় রাখার জন্য নেতা, পঞ্চায়েতের সাথে দরবার করছে । যাতে সনাতন কাকার বিরূদ্ধে কেউ টুঁ শব্দ করতে না পারে !
বিলাসপুর গাঁয়ের মোড়লের কাছে বিচার চাইল পটল । সনাতন কাকা অন্যায়ভাবে তাকে চায়ের দোকান খুলতে দিচ্ছে না । পটল এর একটা বিহিত চায় !
মোড়ল বিচার সভা ডাকলেন । উপস্থিত গ্রামবাসীদের মোড়ল মশাই বললেন, “সেদিনের পুচকা ছোকরা চায়ের দোকান খোলার জন্য মরিয়া । শালিকডাঙা বাঁকে জায়গা কম । তা ছাড়া সেখানে সনাতনের চায়ের দোকান রয়েছে । পটল চায়ের দোকান খুললে সনাতনের ব্যবসা মার খাবে । পটলকে বলা সত্বেও সে শুনছে না । উল্টে সনাতনের বিরূদ্ধে জনমত তৈরী করছে । এটা আমরা ভাল চোখে দেখছি না । অন্যদিকে বৌটার মুখ ঝামটার জন্য পটলের বাবা পালিয়েছে । শুনছি অন্য একটা মেয়েছেলের সাথে ঘর বেঁধেছে । আমার সাফ কথা, পটলের চায়ের দোকান খোলাটা অযৌতিক । পটলকে দোকান খুলতে নিষেধ করা হোক ।“
গ্রামবাসীরা সমস্ত কাহিনী শুনে চুপচাপ !
গ্রামবাসীদের চুপচাপ থাকা অবলোকন করে মোড়ল মশাই বিধান দিলেন, “শালিকডাঙা বাঁকে পটলকে দোকান খুলতে দেওয়া হবে না ।“
পটল হতাশ ! পটলের মতে, মোড়ল মশাইয়ের বিধান ন্যায়সঙ্গত হল না । বিচারের নামে প্রহসন !
মাসুদুল মিঞা এবার নড়েচড়ে বসল ।
সিরাজডাঙা গাঁয়ে মাসুদুল মিঞা পটলের ঘটনাটা জানালো । সিরাজডাঙা গাঁয়ের মানুষ পটলের পক্ষে । তাঁরা মাসুদুল মিঞাকে অনুরোধ করে বলল ব্যাপারটা নিয়ে সনাতন কাকার সঙ্গে কথা বলতে, যাতে পটল শালিকডাঙা বাঁকে চায়ের দোকান খুলতে পারে ।
সনাতন কাকা বেঁকে বসল । মাসুদুল মিঞাকে পাত্তাই দিলো না । বরং চোখ রাঙিয়ে জানিয়ে দিলো, পটলকে নিয়ে বেশী ট্যাঁ-ফোঁ করলে মাসুদুল মিঞার মুদির দোকান তুলে দেবে । শালিকডাঙার বাঁক হচ্ছে বিলাসপুর রিফিউজি কলোনীর অধীনে । সুতরাং বিলাসপুরের গাঁয়ের মানুষ ছাড়া সেখানে অন্য গাঁয়ের মানুষদের দোকান খোলা বারণ । তা সত্বেও মাসুদুলকে দোকান চালাতে দেওয়া হয়েছে সেটা সনাতন কাকার ইচ্ছানুসারে । সুতরাং পটলকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে তার বিপদ অনিবার্য । কথাটা মাসুদুল মিঞাকে মাথায় রাখতে বলেছে ।
মাঝখানে মাসুদুল মিঞা সনাতনের কাজে নাক গলাচ্ছে দেখে সনাতন কাকা জোর করে পটলের দোকানের বাঁশ খুটি তুলে ছুড়ে ফেলে দিলো । পুনরায় হুমকি দিয়ে পটলকে শাসালো, “শালিকডাঙা বাঁকের ত্রিসীমানার মধ্যে তোকে যেন না দেখি ।“
মাসুদুল মিঞা সিরাজডাঙার লোকজন এনে সনাতনকে চেপে ধরলো, “পটলের দোকানের বাঁশ খুটি লাগিয়ে দাও । নতুবা তোমার বিরূদ্ধে আমরা থানার দ্বারস্থ হব । তোমার কোনো আইনগত অধিকার নেই, শালিকডাঙা বাঁক থেকে পটলকে উচ্ছেদ করার ।“
সনাতন দোকান থেকে বাইরে বেরিয়ে চিৎকার করে বলল, “পটলকে তাড়িয়েছি, বেশ করেছি । তুই কৈফিয়ৎ চাওয়ার কে ?”
“আমি পটলের কেউ না । কিন্তু তুমি যেভাবে পটলের প্রস্তাবিত দোকানকে ভেঙে দিলে সেটা অন্যায় ! তুমি যদি তোমার কাজের সংশোধন না করো তাহলে আমি থানায় জানাতে বাধ্য থাকবো ।“ কথাগুলি বলে মাসুদুল মিঞা দলবল নিয়ে তার দোকান ঘরে ঢুকলো ।
সনাতন সঙ্গে সঙ্গে গাঁয়ে ছুটলো । জনা পঁচিশেক লোক নিয়ে হাজির । তারপর তাদের বিশ্রী ভাষার আস্ফালন ! কদর্য ভাষায় মাসুদুলকে গালাগালি, “এটা বিলাসপুরের অধীনে শালিকডাঙার বাঁক । মাসুদুলের বাপের সম্পত্তি নয় যে তার ইচ্ছামতো এখানে কেউ দোকান খুলতে পারবে ? বেশী তড়পালে মাসুদুলকেও তাড়িয়ে ছাড়ব ।“
সিরাজডাঙার লোক তখনও মাসুদুলের দোকানে বসা । তাঁরা বিলাসপুরের মানুষের চিৎকার চেচামেচি শুনে স্থির থাকতে পারল না । তাঁরাও প্রতিবাদ করল । দুই গ্রামের মানুষের চিৎকার চেচামেচিতে শালিকডাঙার বাঁক উত্তপ্ত হয়ে উঠল । কথা কাটাকাটির মধ্যে সনাতন চিৎকার করে বেফাঁস মন্তব্য করল, “মুসলমান জাতটা হিংস্র ! মুসলমানদের অত্যাচারে তাঁরা দেশ ছাড়া । এখানেও সেই মুসলমানদের দাপট ! এটা মানা যায় না ।“ তারপর বিলাসপুর গ্রামবাসীদের উদ্দেশে বলল, “তোমরা আর তাকিয়ে থেকো না । এখন ঝাপিয়ে পড়ার পালা । এদের উচিত শিক্ষা দিতে না পারলে মুসলমানদের কথাতে আমাদের উঠতে হবে, বসতে হবে । আবার আমরা এদেশেও মুসলমানদের অত্যাচারে বিপর্যস্ত হব ।“
একথা শোনার পর বিলাসপুরের মানুষ হাতের কাছের ইটের টুকরো দিয়ে সিরাজডাঙার মানুষদের আক্রমন করল । অতর্কিতে ইট ছোড়ার জন্য সিরাজডাঙার কয়েকজনের মাথা ফেটে রক্ত ঝরলো । সিরাজডাঙার মানুষদের তখন পাল্টা আক্রমন । লাঠি নিয়ে মারামারি । মারামারিটা হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে হওয়ায় চারিদিকে রটে গেল শালিকডাঙা বাঁকে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভয়ংকর রায়ট । খবর গেল থানায় । খবর পাওয়া মাত্র থানার বড়বাবু বিরাট পুলিশ ফোর্স নিয়ে শালিকডাঙা বাঁকে উপস্থিত । থানার বড়বাবুর মধ্যস্থতায় মারামারি থামল বটে কিন্তু উত্তেজনা ষোলোআনা রয়ে গেল । বিলাসপুরের মানুষ ক্রোধে ফুঁসছে । গোটা বিলাসপুরের মানুষ সিরাজডাঙার মানুষদের উপর ক্ষিপ্ত ।
সন্ধ্যা নামল । চারিদিক কিছুক্ষণের মধ্যে অন্ধকারাচ্ছন্ন । অন্ধকারের মধ্যে চুপিসারে বিলাসপুরের মানুষেরা দুরভিসন্ধি করে শালিকডাঙা বাঁকের মাসুদুলের দোকানে আগুন ধরিয়ে দিলো । অন্যদিকে মুসলমানদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধার জন্য বাড়ি থেকে পটলদের তাড়িয়ে ঘরে আগুন ধরিয়ে দিলো ।
পটলদের চোখের সামনে তাদের বাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলছে । ময়মীর চোখে জল । ঝিঙে উদাস চোখে তাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে । পটল ডুকরে ডুকরে কাঁদছে । অতঃপর কী করণীয় পটল ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছে না । অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছছে ।
( চলবে )