মনস্কামনা : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
486

সতীনাথ কপালীর ডাক নাম সত্য । কেউ আবার পদবী কপালী ধরেও ডাকে । অনেকে আবার সত্য কপালী নামেও ডাকে । কেউ ডাকলেই সত্য কপালীর চিরাচরিত সাড়া দেওয়ার অভ্যাস, “আজ্ঞে” । আজ্ঞে শব্দটা শুনলেই তাঁর বৌ, পদ্মাবতীর ভীষণ গোঁসা ! মুখের উপর সত্যকে শুনিয়ে দেয়, “আজ্ঞে বলাটা বন্ধ করো । আজ্ঞে শব্দটা শুনলেই মনে হয় ভিখিরির বাচ্চা ! এমনিতেই সংসারের করুণ অবস্থা । কোনোরকমে মোটা কাপড় মোটা ভাতে দিন গুজরান ।“ যদিও আগেই পদ্ম (পদ্মাবতীর ডাক নাম, পদ্ম) সত্যকে বার কয়েক স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, আজ্ঞে কথাটা বন্ধ করতে । কিন্তু বেচারা কপালী পরেছে মহা ফাঁপরে । গিন্নির কথার অবাধ্য হলে তাঁর চোখ রাঙানী অহরহ । অথচ বহুদিনের পুরানো অভ্যাস, ত্যাগ করাটাও তার পক্ষে দুঃসাধ্য !
পদ্মকে সত্য কপালী ভীষণ ভালবাসে । যদিও পদ্ম ও সত্যর বিয়ে ভাব-ভালবাসা করে । ভাব-ভালবাসার বিষয়টিও সত্যর জীবনে একটা ইতিহাস । সেদিন সন্ধ্যাবেলায় আকাশ জুড়ে কালো মেঘ । একেই সন্ধ্যার অন্ধকার, তার উপর কালো মেঘের কারণে গাঢ় অন্ধকার । কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচণ্ড ঝড় । ঝড়ের মাত্রা লাগামছাড়া । জ্যেষ্ঠের শেষদিক । ঝড়ের গতিবিধি লক্ষ্য করে সত্য ভাবল, গ্রামের পুন্ডরীকাক্ষ’র আম বাগানে ঝড়ের তাণ্ডবে অনেক আম মাটিতে পড়ার কথা । সন্ধ্যার পরে পুন্ডরীকাক্ষের বাগানে কোনো রক্ষী থাকে না । সত্তর বছরের ঘাটের মরা চৈতন্য বাহাদুর বাগানের গার্ড । সেই সময় বাহাদুর বাড়ি ফিরে যায় । ভোরবেলা থেকে তার ডিউটি শুরু আর সূর্যাস্তের সাথে সাথে ছুটি । এটাই মোক্ষম সময় । সন্ধ্যার ঘোর অন্ধকার । বাইরে তুমুল ঝড় । বৃষ্টি তখনও শুরু হয় নি । সত্য পাটের বস্তা মাথায় দিয়ে সোজা পুন্ডরীকাক্ষের আম বাগানে । আসলে পুন্ডরীকাক্ষ হাড়কৃপণ । কেউ চাইলেও তিনি কাউকে আম দেবেন না । অথচ তাঁর গাছের আম বড় বড় । খেতে ভীষণ সুস্বাদু । আমের গুণগত মান সম্বন্ধে এই তল্লাটের সকলেই অবগত । তাই চেয়েও আম না পাওয়ার জন্য গাঁয়ের ছেলেপুলেদের ভীষণ রাগ হাড়কৃপণ পুন্ডরীকাক্ষের উপর । তার উপর চৈতন্য বাহাদুরের খবরদারীর জন্য কারও কপালে আম জোটে না । সত্য ভাবছে এটাই মোক্ষম সময় ! ঝড়ের মধ্যে আম কুড়িয়ে সোজা বাড়ি ফেরা । তাহলে কাক-পক্ষীও টের পাবে না । ছুটল আম বাগানে । আম বাগানে গিয়ে দেখে তার আগে গাঁয়ের গোটা কয়েক ছেলে-মেয়ে আম কুড়াচ্ছে । সত্য প্রায় পচিশটা আম কুড়িয়ে বস্তায় ঢোকালো । তারপর ভারী বস্তাটা পাশে রেখে আবার ছুটল আরও আম কুড়াতে । ততক্ষণে প্রচণ্ড বৃষ্টির তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে । বৃষ্টির জলে সত্য ভিজে একশা । হঠাৎ সত্য লক্ষ্য করল, তার বস্তা থেকে সাদা কাপড় জড়ানো কেউ একজন আম সরাচ্ছে । সত্য তৎক্ষণাত ঐ মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে ছুটে গিয়ে তাকে জাপটে ধরল । আর সত্যর কী হুমকী ! “আমার কুড়ানো আম নিয়ে পালানো ! এবার মজাটা টের পাবে !” বলেই সত্য সাদা কাপড় সরিয়ে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে দেখতে পেলো পদ্মকে । তারপর তার আরও গর্জন, তুই আমার আম নিয়ে পালাচ্ছিস ?
“তোমার অত আম কীসের দরকার ?” তারপর কটমট করে সত্যর দিকে তাকিয়ে পদ্ম বলল, “তুমি নিজে একজন আম চোর হয়ে আমাকে চোখ রাঙাচ্ছো !”
তারপর দুজনের মধ্যে তুমুল তর্কাতর্কি । আবোল-তাবোল কথা কাটাকাটি । শেষে রাগে দুঃখে সবগুলি আম পদ্মকে দিয়ে সত্য বাড়ি ফিরল ।
আম কুড়ানোর পরদিন থেকেই মারকুটে পদ্ম, সত্যর প্রতি সুপ্রসন্ন । দেখা হলে দুজনে চারদণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলে । হাসি মস্করা চলে । এইভাবে দুজনের মধ্যে ভাবভালবাসার সম্পর্কের বীজ ক্রমশ অঙ্কুর থেকে গাছে রুপান্তরিত হয় । বেঁকে বসে উভয় বাড়ির লোক । পদ্ম লেখাপড়া জানা মেয়ে, অথচ সত্য একটা গণ্ডমূর্খ । এই নিয়েই মূলত দুই বাড়ির মধ্যে অশান্তি । উভয় বাড়িতে অনড় সিদ্ধান্ত, “ তাদের বিয়ে দেবে না ।“ ফলে বাধ্য হয়ে দুজনে অন্ধকার রাত্রিতে বাড়ি থেকে পালায় । পালিয়ে আশ্রয় নেয় ফরাক্কায় । বাঁচার অন্য পথ না পেয়ে, সত্য ফরাক্কায় প্রথমে মুড়ি ও তেলে ভাজার দোকান খোলে । তারপর চায়ের দোকান । ফরাক্কা ব্যারেজ কোয়ার্টারের বাজারের পাশে বাসস্ট্যান্ড এবং বাসস্ট্যান্ডের লাগোয়া বটগাছ তলায় টিনের ছাউনির চায়ের দোকান । ঐ চত্বরে যতগুলি চায়ের দোকান তার মধ্যে সত্যর চায়ের দোকান ভীষণ চালু ।
পদ্মকে নিয়ে সত্য যত ভাবে ততই পুরানো স্মৃতি তাঁর মনে জেগে ওঠে । পদ্ম যেমন সাহসী তেমনি মানসিকভাবে ভীষণ শক্ত । সত্যর একবার সাংঘাতিক জ্বর । জ্বরের কাঁপুনিতে সত্য দিশেহারা । টাইফয়েডের সাথে নিমোনিয়া । ডাক্তারবাবু ঝুঁকি নিতে পারছিলেন না । সেই অসুখের চিকিৎসা টানা তিন মাস চলেছিল । কিছুদিন সত্যর পক্ষে বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা ছিল না । সেই সময় পদ্ম নিজের কাঁধে তাঁর চায়ের দোকান ও চিকিৎসার ভার তুলে নিয়েছিল । ভোর সাড়ে চারটায় বহরমপুরের প্রথম বাস । সুতরাং ভোর চারটের সময় পদ্মকে চায়ের দোকান খুলতে হত । কেননা কয়েকজন সবজি ও মাছ ব্যবসায়ী প্রত্যেকদিন ঐ বাসে ধুলিয়ান থেকে সবজি ও মাছ কিনে ফিরে ফরাক্কা বাজারে বাজার ধরে । তাঁদের ভোরবেলায় চা খাওয়া চাই । তা ছাড়া কিছু মানুষের ধুলিয়ানের আশেপাশে কৃষিজমিতে কাজের উদ্দেশ্যে ঐ বাসটাতেই যাতায়াত । তারাও সত্যর চায়ের দোকানের নিয়মিত খরিদ্দার । কয়লার উনুন ধরিয়ে চা বানিয়ে খরিদ্দার ধরে রাখার স্বার্থে পদ্মকে ঐ ভোরে বট গাছ তলায় বসতে হত । তারপর সারাদিন চায়ের দোকানদারি । মাঝখানে বাড়ি এসে রান্না এবং সত্যর ঔষধ খাওয়ার তদারকি । সত্যকে খাইয়ে এবং নিজে স্নান খাওয়া সেরে পুনরায় রাত্রি দশটা পর্যন্ত চায়ের দোকানের কাজ । তারপর আবার সত্যর ডাক্তার দেখানো থাকলে ডাক্তারের কাছে তাঁকে নিয়ে যাওয়া বা অন্যান্য যেমন বিভিন্ন প্যাথোলজিক্যাল টেষ্টের জন্য রক্ত দেওয়া, ইত্যাদি কাজগুলি তাকেই সারতে হত । সেই সময় পদ্ম ছিল পোয়াতী । তার মধ্যেও তাঁর কাজের নিষ্ঠা অবর্ণনীয় ।
মেয়েকে নিয়ে তাঁদের সংসার । পদ্মর যত অশান্তি তার মেয়ে পিয়াশাকে নিয়ে । মেয়েটা ভীষণ জেদি । পড়াশুনার চেয়ে দৌড়ঝাঁপ, ঘোরাঘুরি, উল্টোপাল্টা খেলাধুলায় বেশী উৎসাহী । পাড়ার ছেলেমেয়েদের সাথে মারামারি, খুনসুটি অহরহ । কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। একটু এদিক-ওদিক বেতাল দেখলে, সে ছেলে-বুড়ো বাছবিচার না করেই তার উপর পিয়াশার রণমূর্তি ধারন । মেয়ের দস্যিপনার জন্য পদ্মের অশান্তি । মেয়ের নেশা খেলাধুলা । প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই ছোটে মাঠে । নাওয়া নেই, খাওয়া নেই শুধু দৌড়ঝাঁপ । পদ্ম নিজেও জানে না মেয়েটা মাঠে কী খেলছে ? ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা বড় বড় মেডেল বাড়িতে এনেছে । জিজ্ঞাসা করলে পিয়াশার উত্তর, খেলে পুরষ্কার পেয়েছি । কিন্তু পদ্ম পিয়াশাকে সর্বক্ষণ বলে যাচ্ছে ঐসব মেডেলে আমাদের পেট ভরবে না । লেখা পড়া শিখে মানুষ হতে হবে । নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে । নিজের পায়ে দাঁড়ালে তবেই বিয়ে । পদ্ম আবার আত্ননির্ভরশীলতায় বিশ্বাসী । অ্যাথলিট হলে পেটে ভাত জুটবে না । অন্যদিকে সত্যর আবার মেয়ের প্রতি বেশী মাত্রায় দরদ । সত্যর মতে পিয়াশা খেলাধুলায় দক্ষ, সুতরাং তাকে খেলাধুলায় উৎসাহ দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয় । কিন্তু পদ্ম সত্যর সওয়ালের একেবারেই মার্ক দেয় না । বরং উল্টে বলে, চায়ের দোকান নিয়ে বেশ তো রয়েছো । মিছে কেন মেয়েটাকে খেলাধুলার দিকে উস্কিয়ে গোল্লায় পাঠাচ্ছো !
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর কলেজে ভর্তির যখন তোড়জোড়, জেলার স্পোটর্স আধিকারিক ফোন করে জানালেন পিয়াশা এবছর জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় চারশ মিটার রানে এবং লং জাম্পে ডাক পেয়েছে । এবছর জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতা হচ্ছে জয়পুরে । বিশদ বিবরণের জন্য পিয়াশাকে নিয়ে সত্যকে সত্বর বহরমপুরে যেতে বললেন ।
সংসারের উপায়ের জায়গা ঐ চায়ের দোকান । চায়ের দোকান বন্ধ রাখা খুব মুস্কিল । তাতে সংসারে টান পড়ে । তাই পদ্ম মেয়েকে নিয়ে বহরমপুরে গিয়ে জেলা স্পোটর্স আধিকারিকের সঙ্গে দেখা করল । জেলা স্পোটর্স আধিকারিক পিয়াশার কোচ ফরাক্কার জনার্দন মাস্টারের সাথে জয়পুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পাকা করলেন । এই প্রথম পিয়াশা মা-বাবা ছেড়ে ভিন্‌ রাজ্যে পারি দিচ্ছে । জনার্দন মাস্টার আগাগোড়া পিয়াশাকে খেলা শেখান । জনার্দন মাস্টার নিষ্ঠার সাথে পিয়াশাকে খেলাধুলায় কোচ দিয়ে আসছেন । অথচ এদিকে মেয়ে খেলাধুলায় এতটা উন্নতি করেছে পদ্ম ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি । তাই পদ্ম মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলল, “তোকে ভারতীয় মহিলা অ্যাথলিট হিসাবে আরও বড় হতে হবে ।“
স্পোটর্স অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার কলকাতা থেকে দুদিনের ট্রেনিং ব্যবস্থা হল পিয়াশার জন্য । পরেরদিন ভোরের ট্রেনে কোচ জনার্দন মাস্টারের সাথে কলকাতা যাওয়ার ব্যবস্থা পাকা । হঠাৎ আগেরদিন সকাল বেলায় মাঠে পিয়াশের অনুশীলনের সময় কোচ জনার্দনবাবুর মোবাইলে একটি টেলিফোন, “আগামীকাল ট্রেনিং পিয়াশের হচ্ছে না । পিয়াশের নমিনেশন বাতিল হয়ে গেছে । তার জায়গায় হাওড়া জেলা থেকে তমাশার নাম নথিভূক্ত হয়েছে । সুতরাং পিয়াশা জয়পুরে অনুষ্ঠিত জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারছে না ।“
জনার্দন মাস্টারের মাথায় হাত ! তাঁর তৎক্ষণাত প্রশ্ন, “পিয়াশার অপরাধ ?”
এটা উপর মহলের অর্ডার ।
ভেঙ্গে পড়ল পিয়াশা । তার অনেকদিনের স্বপ্ন, জাতীয় স্তরে খেলে বাবা-মাকে সারপ্রাইজ দেবে । তার লুক্কায়িত প্রতিভার সাফল্যে ঘটানোর । কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল পিয়াশা । সে এখনও ধন্দে, তাকে বাদ দেওয়ার হেতু কী ?
পদ্ম শোনা মাত্রই ক্ষেপে লাফিয়ে উঠল ! নিশ্চয়ই পেছনে বড় হাত রয়েছে । যার অঙ্গুলি হেলনে তার মেয়ের নাম তালিকা থেকে বাদ গেছে । অথচ কদিন আগেই জনার্দন মাস্টারের ই-মেলে পিয়াশার অফিসিয়াল নমিনেশনের চিঠি এসেছে । তারপর ট্রেনিং-এর জন্য সাই, কলকাতা থেকে আবার ই-মেল । সুতরাং অফিসিয়ালি পিয়াশা জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে খেলার জন্য নির্বাচিত । পদ্ম হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয় । সঙ্গে সঙ্গে ছুটল বহরমপুরে । সেখানে গিয়ে জানতে পারল, পিয়াশা রাজনৈতিক যাঁতাকলের শিকার ।
পদ্ম গর্জে উঠল ! “এটা অন্যায় । আমি ছাড়ব না । মেয়ের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমি লড়ব !”
কিন্তু সত্য নরম মনের মানুষ । সে ঝুটঝামেলায় যেতে নারাজ । তাই পদ্মকে বলল, “থেমে যাও গিন্নি । মেয়ের কপালে যা হবার তাই হবে । অহেতুক বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের বিরাগভাজন হলে আখেরে আমাদের পরিবারের বিপদ হতে পারে !”
“আমরা দয়াকে ঘৃণা করি, কিন্তু যোগ্যতার যথাযথ মর্যাদা চাই । মর্যাদা আদায়ের লড়াইয়ে আমি এর শেষ দেখতে চাই । পিয়াশার মনস্কামনা পূর্ণ করাই আমার লক্ষ্য ।“ চোখ লাল করে স্পষ্ট জবাব পদ্মের ।
পরেরদিন ভোরের ট্রেনে সোজা সল্টলেকে সাই ট্রেনিং সেন্টারে । সেখানে তমাশাকে দেখতে পেয়ে পদ্ম তাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল তার বাবা একজন দুঁদে আমলা । আর তা ছাড়া তমাশার বাবা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ও রাজ্যের মন্ত্রীদের খুব কাছের মানুষ ।
জনার্দন মাস্টার পদ্মর সাথে রয়েছেন । সংশ্লিষ্ট সাই অধিকর্তা অভদ্র ভাষায় ভীষণ রূঢ়ভাবে জানালেন, চায়ের দোকানদারের মেয়ে কী করে জাতীয় স্তরে খেলার আশা করে ? উত্তরে পদ্ম একটা কথাই মুখ ফুটে বলেছিল, “তার মেয়ে পিয়াশা নিজের পারফর্মেন্সের যোগ্যতায় জাতীয় স্তরের খেলায় নির্বাচিত হয়েছে । সুতরাং তাঁরা দয়া ভিক্ষা চাইতে আসেনি !” তখন জনার্দন মাস্টার পদ্মকে বললেন, সাই অর্থাৎ স্পোটর্স অথরিটি অফ ইন্ডিয়া নমিনেশনের ব্যাপারে কিছু করবেন না । সুতরাং এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করার অর্থ “অরণ্যের রোদনের ন্যায়” ।
পদ্ম জানত অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রাজ্যের মাননীয় রাজ্যপাল । তাই পদ্ম ভাবল বিষয়টি রাজ্যপালের গোচরে আনা দরকার । তখন বিকাল তিনটে । ছুটল রাজভবন । উত্তর গেটে গিয়ে সোজা রাজ্যপালের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারিকে ফোন করে মাননীয় রাজ্যপালের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করল পদ্ম । মাননীয় রাজ্যপাল ঠিক পাঁচটায় পদ্মকে সময় দিলেন । হাতে সময় কম । ট্যাক্সিতে গিয়ে নিউ মার্কেট থেকে ফুলের তোড়া সংগ্রহ করে রাজ্যপালের চেম্বারে পদ্ম জনার্দন মাস্টারের সঙ্গে প্রবেশ করল । পদ্ম কোনো কথা না বলে সরাসরি রাজ্যপালের পা জড়িয়ে ধরে বলল, “আমার মেয়েটার সম্মান ফিরিয়ে দিন । মেয়েকে জাতীয়স্তরে খেলার সুযোগ ফিরিয়ে দিন ।“
তারপর রাতের ট্রেনে ভোর বেলায় ফরাক্কায় ফেরা ।
ততক্ষণে পিয়াশার খবরটা প্রচারের আলোতে ব্যাপকভাবে প্রচার পেয়েছে । নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন । মাননীয় রাজ্যপাল সমস্ত কাগজপত্র ঘেটে যেটা বুঝেছেন, “সরকারিভাবে পিয়াশাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সে জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত, কিন্তু তাকে বাদ দেওয়ার কোনো সরকারি যোগাযোগ নেই । তার অর্থ পিয়াশার নমিনেশন তখনও বৈধ । অথচ অন্যায়ভাবে একটা ফোনের মাধ্যমে যোগ্য মেয়েকে জাতীয় স্তরে খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে ?”
তারপর …………?
তারপর জয়পুরে খেলার একদিন আগে পিয়াশার কোচ জনার্দন মাস্টার জানতে পারলেন, “পিয়াশা জয়পুরে জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে ।“
অনেক টাকা ধার করে ফ্লাইটের টিকিট কেটে পিয়াশা জনার্দন মাস্টারের সাথে জয়পুরে খেলার স্টেডিয়ামে হাজির ।
পরেরদিন টানটান উত্তেজনা । প্রতিটা রাজ্য থেকে বাছাই বাছাই অ্যাথলিটরা এসেছে । জনার্দন মাস্টার পিয়াশাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন, “যেভাবে হোক তাকে তার মায়ের মান রাখতে হবে । খেলায় জিতে ফরাক্কার মানুষের আবেগকে মর্যাদা দিতে হবে ।“
পিয়াশা জনার্দন মাস্টারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে মাঠে প্রতিযোগীদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালো । মোট কুড়িজন প্রতিযোগী । প্রথমেই রানের প্রতিযোগিতা । সকলেই প্রস্তুত ।
চারশ মিটার রানে ফার্স্ট । আর লং জাম্পে তৃতীয় স্থান ।
ফরাক্কায় নামার সাথে সাথে পিয়াশাকে কাঁধে নিয়ে সতীর্থদের হৈ হুল্লোর । আনন্দে উন্মাদনার চূড়ান্ত । দূরে পদ্ম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছছে ।
(বি-দ্র ঃ উল্লেখ থাকে যে গল্পটির সমস্ত চরিত্র, অথরিটি, প্রতিষ্ঠান, সবটাই কাল্পনিক । কারও সঙ্গে বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে গেলে সেটা নিছকই কাকতালীয় ও আকস্মিক্‌ ।)
——————–০——————–