এস না ভাঙাতে ঘুম : ডঃ অশোকা রায়।

0
499

সেদিন যে সবুজ মাঠের গল্পটা শোনাবো বলে গিয়েছিলেম তোমার কাছে,
সেই মাঠটা তোমাদের বাড়ির দেউড়ির এ পারে, একেবারে তোমাদের বসতবাড়ির লাগোয়া। ঐ সবুজ মাঠটা আমার বড়ো প্রিয়। কারণ ঐ সবুজ মাঠে নীল আকাশের নীচে দোলনায় প্রথম দুলতে দেখেছিলাম তোমায়। চৈত্র মাস ছিল না সেটা। তোমার কথা জানি না। তবে আমার সর্বনাশের বোধহয় সেদিনই শুরু। সেটাই আমাদের প্রথম দেখা। তখন আমি গ্রাম থেকে আসা ধুতির ওপর টুইল শার্ট পরা এক কিশোর।পরিচয় তোমাদের বাড়ির আশ্রিত সুবলা মাসীর ছেলে। আমার মায়ের পরিচয় তোমাদের বাড়িতে খাস দাসীরও হতে পারতো।হয় নি শুধু তোমার মায়ের জন্য। দুজনে সই পাতিয়ে ছিল। তবুও আশ্রিতের ট্যাগটা বেশ পড়তে লাগত তোমাদের বাড়ির অন্য সদস্যদের।তোমার ঠাকুমাকে প্রায়ই বলতে শুনেছি,
” বৌমার যত আদিখ্যেতা সুবলা কে নিয়ে।ওকে পানে চুনটা কম হয়েছে বলাতেও আপত্তি” ।অন্যেরা ঠেস দিয়ে বলত,” এ বাড়ির পাটরানীর পেয়ারের লোক তুমি সুবলা, – উঁচু হোক, নীচু হোক কোন কাজই তোমাকে দিয়ে করানো যাবে না।” এ সব কথা থাক।বললাম শুধু তোমাদের বাড়িতে আমাদের অবস্থান বোঝানোর জন্য। তোমাদের বাড়ির থেকে কিছু পাই নি – বলাটা ভুল। আজ উত্তর কলকাতার এক বনেদী বাড়ির আমি যে মুহুরী বাবু- তা তোমার বাবার বদান্যতায় বি. কম পাশ করার ফল। কৃতজ্ঞতা তো একটা রয়েই গেছে। তবে সে কৃতজ্ঞতায় ফাটল ধরিয়ে ছিলাম কি আমি তোমায় ভালোবেসে? হ্যাঁ তোমাদের অন্দরে তো সেরকমই কানাকানি-” কি বজ্জাত ছেলে রে বাবা! ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোবার সাধ? তুই বামুন, চাঁদ ধরতে যাস কোন দুঃসাহসে?” হ্যাঁ দুঃসাহস তো আমি মরীয়া হয়ে শেষবারের মতো দেখিয়েছিলাম…. চুপিসারে গিয়েছিলাম তোমার ঘরে অনেক দিন ধরে লেখা সবুজ মাঠের গল্পটা শোনাব বলে. তখন রাত্রি। বেশ অনেকটাই রাত্রি।চেয়েছিলাম হেঁটে হেঁটে চলে যাব দুজনে বহুদূর নক্ষত্রদের সাথে। অতো রাতে! ভেবেছিল হয়তো রাতচরা কিছু পাখি । ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে অশালীন। তবুও পারিনি সংযত হতে।ফয়সালা যে দরকার. গল্পটা যে তোমাকে শোনাতেই হতো।
গল্পের তো মাত্র দুটি চরিত্র,
তুমি আর আমি।
গল্পটাও তেমন জোরালো নয়, বলতে পারো, উঠতি কিশোর প্রেমের জোলো আবেগ।
গল্পের প্রতিটি শব্দে ভেজা হেমন্তের শিশিরপাত।
ওগুলো যে আমার ভালোবাসার নিরুক্ত শব্দ।
তবে নীরক্ত নয়, নিঃস্ব নয় । বলতে পারো ভালোবাসার রঙে লালে লাল।মন দেয়ার ধনে ধনী। বলতে চেয়েছি বারবার, পারিনি হয়তো অবস্থানের আলোকবর্ষ ব্যবধানের জন্য। সবকালেই তো চাঁদির চাকতির জয়।
ভেবেছিলাম ব্যতিক্রম তো আছে। হয়তো তুমি সেরকম এক ব্যতিক্রম। নিপাতনে সিদ্ধ ভালোবাসার টানে অনুভবী সিদ্ধান্ত নেবে। আমার না বলা কথা বুঝবে।
তাই তো গিয়েছিলাম তোমাকে বলতে, চল একবার ঐ সবুজ মাঠে খোলা আকাশের নীচে। বাতাসে উড়িয়ে দাও তোমার যত দ্বিধা সংকোচ আর আবেগহীন অনুভূতি। বাঁচো শুধু ভালোবাসার জন্য।আমি যে একটা গল্প লিখেছি তোমাকে নিয়ে.. একটু একটু করে জমানো ভালোবাসার গল্প। তখন তুমি বারান্দায়।
ফেরাওনি মুখ একবারো । এক ঢাল চুলের এলো খোঁপায় তোমার বিদিশার নেশা নেশা ভাব। সবুজ মাঠের ল্যামপোস্টের আলোর আলতো চেরায় সেলুলয়েডের সাদা-কালো ছবি। ছবি জুড়ে
নিথরতা নিস্পন্দতার আভাস।
মুখে বোধহয় নির্লিপ্ততার কারুকাজ।
কত আর নির্লজ্জ হই বলো। তোমার চুপিসারে ফেলা নিঃশ্বাসে ভেসে এসেছিল তোমার উত্তর। তোমাদের বনেদি চকমেলানো দালানে আমি যে মুহুরী।সবুজ মাঠের আলোটা দুবার দপদপ করে নিভে গিয়েছিল ।
হয়তো সে ও চেয়েছিল গল্পটা যেন না যায় থেমে।
আর আমি?
নিস্তেজ মনে এসেছি ফিরে আমাদের মা – ছেলের জন্য বরাদ্দ ঘরে।
আফসোস শুধু খড়কুটো দিয়ে বাসা বাঁধার গল্পটা শোনানো হল না তোমাকে।
এ’ বহু বছর আগের ঘটনা।
আজ তুমি কোথায় জানা নেই। প্রথম দিকে গ্রাম থেকে কলকাতায় যাতায়াত ছিল আমার। কিন্তু ইচ্ছে ছিল না তোমার খবর নেবার। সত্যি কথা বললাম বলে কিছু মনে করো না। আজ তোমার সুখ-অসুখ আমার সুখ- অসুখের থেকে অনেক দূরে। তুমি চিরকালই আমার জীবনে গোপনচারিনী হয়ে ছিলে, আর আজ তো তুমি আমার থেকে অনেক দূরে। তোমাকে ভুলে গেছি… এ কথাটা বলা ভুল হবে। তার চেয়ে বরং বলা ভালো মনের সুক্তির খোলে মুক্তো হয়ে তুমি ঘুমিয়ে আছো। তোমার ভালোবাসাকে সেই প্রথম দিন থেকেই তুলোর মত বুকের মাঝে আলতো ভাবে রেখেছিলাম। তাই গল্পের প্রথম দু- চার পাতা দামি তুলোট কাগজে লিখেছিলাম।

আমি এখন লেখক। পাঠক- পাঠিকার সংখ্যা বেশ ভালোই বলতে পারো। প্রকাশকরা আমার প্রসাদপুষ্ট হলে আপ্লুত হয়। সভা সমিতির সংবর্ধনা বেশ লাগে জানো। এক কালের তোমাদের বাড়ির আশ্রিত বিধবার ক্যাবলা ছেলেটা নেহাত বি কম পাশ করেছিল, তাই তোমাদের তাল পুকুর জমিদারিতে একটু গালভরা খেতাব তার জুটেছিল… “মুহুরী বাবু “। না আইন আদালতের কোন লোক তোমাদের বাড়িতে কেউ ছিল না. বংশ পরম্পরায় চলে আসা হিসাব রক্ষককে তোমাদের বাড়িতে মুহুরী বাবু বলা হতো.
জানো তুমি আমায় সেদিন প্রত্যাখান করে ভালোই করেছিলে।ভেঙে পড়া জীবনের একটা দিশা খুঁজে পেয়েছিলাম নিজের লেখালেখির নেশার মধ্যে । তোমাকে নিয়ে সবুজ মাঠের যে গল্পটা আবেগের বশে লিখে ফেলেছিলাম, পরবর্তীতে সেই লেখালেখি কে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছি. অবশ্য যখন মাকে নিয়ে পরদিনই খুব ভোরে বেরিয়ে এসেছিলাম তোমাদের দেউড়ি পার করে, এতটা আত্মপ্রত্যয় ছিল না আমার ।আত্মপ্রত্যয় ছিল না বলে হয়তো লক্ষ্যও নির্ধারিত হয় নি তখনো. শুধু ভেবেছিলাম তোমার বাবার মুখোমুখি যেন না হতে হয়. অন্দর মহলের কথা বার মহলে আসার প্রক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়া.. দুটোই বেশ জটিল. তাই তোমার মা তোমার – আমার গল্পটাকে অন্দরের মাঝেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন.

… তোমার বাবার জলসা ঘরের সারেঙ্গীর ছড়ে সে ভোরে সবে ঝড় তোলা বন্ধ হয়েছে। পিতোরা বাঈের ঘুঙুর বোল আর যাচ্ছে না শোনা। সূর্য ওঠার ক্লান্তি তার সারা শরীর জুড়ে. জীবনের সবকিছুই সূর্যের আর চাঁদের ওঠা আর অস্ত যাওয়ায় বাঁধা। জানি তোমার বাবার ঘুমের সময় সেটা। সাক্ষাতের সম্ভাবনা কম. কিন্তু হিসেবী বেনিয়াবুদ্ধির কাছে শারীরিক ক্লান্তি ধর্তব্য নয়. জরুরি কাজে যদি ডাক পড়ে আমার, যাওয়াটা ভেস্তে যাবে। প্রত্যাখাত আমি আর থাকতে চাই নি তোমাদের ইঁট-কাঠ-পাথরের ভালোবাসা হীন রাজপ্রাসাদে। নিজের বাবার কাছ থেকে, ঐ একটা জিনিসেরই উত্তরাধিকার পেয়েছিলাম…. আত্মাভিমান। খিড়কি দোর দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম মা আর আমি। সোজা দেশের বাড়ি- যেখানে নাগরিকত্বের কোলাহল আর কলুষতা নেই। মা বলেছিল,
” পেট চলবে কি করে? ” বলেছিলাম, “জীব দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি। ” খেতে হাল ধরেছি, বাগানের এতদিনের পড়ে থাকা আম-জাম- নারকেল- তালের যত্ন করেছি। সবজির গাছ বসিয়েছি, পিতৃপুরুষের পুকুরের মাছের ভাগ পেয়েছি। কিছু খেয়েছি কিছু বিক্রি করেছি. পেট ভরানো চলে গেছে কোনক্রমে. কিন্তু জীবনধারণের অন্য অনেক জিনিসেরও প্রয়োজন। মা ছেঁড়া থানে চোখ মোছে। একদিকের ডাঁটি ভাঙা চশমা সুতোয় বেঁধে কানে লাগিয়ে কুপির আলোয় আমার ছেঁড়া শার্ট রিপু করে। আর সেই শার্ট পড়ে কাউকে খেতের দায়িত্ব সেদিনের মতো দিয়ে আমি কলকাতা রওনা দিই রাত জেগে লেখা দিস্তা কাগজ নিয়ে…” গল্প চাই গো, চাই কবিতা? বাবুরা পরখ করে দেখুন না কেমন হয়েছে?” কত পয়সা পাওয়া যাবে? জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয়েছে,অবশ্যই মনে মনে।ভয়ের চোটে মুখ ফোটে নি। জানো তখন টাকা শব্দটাও উচ্চারণ করতে পারিনি। পয়সার কথাই মনে মন ভেবেছি. সেটাও উচিত হয়নি হয়তো। কিন্তু কি করব বল পেটের দায় বড়ো দায়। সেই দায়ের স্পর্ধা দেখানোর সমুচিত শাস্তিও পেয়েছি। কিছু প্রকাশক নম্রভাবে পুলটিশ দিয়ে, কেউ বা হাঁকডাক করে রাবিশ লেখা বলে তাড়িয়ে দিয়েছে। কেউ চোখ বুজে কানে পায়রার পালকের আরাম খেতে খেতে বলেছে অন্যত্র দেখুন মশাই. কেউ বলেছে কলকাতায় যাতায়াতের রাহাখরচ বাঁচলেও তো লাভ. লেখালেখি যার-তার কর্ম নয়. ততদিনে আমার সাকিন আর সংসারের হাল হকিকৎ অনেকেরই জানা হয়ে গেছে. হাল ছাড়িনি। সপ্তাহে দুদিন কাগজের তাড়া নিয়ে ঘুরেছি দিশেহারা হয়ে ।
আচম্বিতে ভাগ্যের চাকা ঘুরল। এক প্রকাশকের বদান্যতায় ছাপা হল আমার সাত ফর্মার এক গল্প সংকলন। নতুন নভিশের লেখা। পাঠক লুফে নিল। পরে সরকারি পুরস্কারও পেল. ব্যস তারপর আর নো পেছনে তাকাতাকি। সামনে সাহিত্যের সোনার কেল্লা।আর সেই কেল্লায় বলতে পারো আমারই আধিপত্য। কমপিটিটর যে নেই.. অমন বুরবকের মত কথা আমি বলি না। তবে ওরা লেখে বেশি, আমি কম। শূয়োর আর সিংহের প্রসব করা সন্তানের সংখ্যার তারতম্যের মত। এখানেই বৌদ্ধিক ক্যালকুলেশন ওদের ভুল। আরে বাবা, সাহিত্যও খাবারের মত মেপেজুপে পরিবেশন করতে হয়, নয়তো একঘেয়ে লাগে, অরুচি হয়।আর অরুচি হলে খেলে বদহজম হয়। সেদিনের তোমার মুখচোরা প্রেমিক আজ কত তালেবর হয়েছে বল তো? তালিবানদের মত নিজের রুল নির্বিচারে চালাচ্ছে ভাবছো তো? না গো অনেক পোড় খেয়ে বুঝেছি সব ক্ষেত্রে একটা স্ট্রাটেজিক স্ট্যান্ডার্ড থাকা দরকার। আমি ভুল কি ঠিক জানি না। এটা আমার জীবন অনুধাবনের অনুষঙ্গ হিসেবে অভিজ্ঞতা। আমি বুঝেছি প্রেমে পড়লে মানুষ রোমান্টিক হয়। আর রোমান্টকতা আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর আর বৈচিত্র্যময়। জগতটাই তো প্রেমের জন্য। আনন্দ কে ভাগ করলে দুটো উপকরণ পাওয়া যায়… প্রেম আর জ্ঞান। যে ভালোবাসার মাঝে আশংকা থাকে, আর সেই আশংকা যদি চোখে জল এনে দেয়… সেটাই প্রকৃত ভালোবাসা।
তা যাক গে তুমি কোথায় এখন ,সত্যি জানি না। জানতেও ইচ্ছে হয় না। আজকে আমার বাস কলকাতায়। নিজস্ব বাড়ি গাড়ি। রয়্যালটি বাবদ প্রচুর রোজগার। গ্রামের ভূমি পুত্রের ভূমিকাটাও বজায় রেখেছি সমাজে একটা ইমেজ বজায় রাখতে। সপ্তাহে একদিন যাই গ্রামে শুধু লাঙ্গল ধরতে আর বুক ভরে অক্সিজেন নিতে। তোমার দেয়া একটা বিরাট ক্ষত তো বুকে আজো আছে। বড্ড জ্বালা করে গো। কোন জ্বালানি এমন করে জ্বালায়-পোড়ায় না। সময় অসময় না মেনে যখন তখন আমাকে জ্বালায়। কত কষ্ট যে সহ্য করতে হয় কেউ জানে না।কারণ এর তো কোনো বহিঃপ্রকাশ নেই
গ্রামের অক্সিজেন নিলে সাময়িক আরাম তো হয় বটে। মনে হয় কিছুদিনের নিশ্চিন্তি। মন দিয়ে নিজের কাজ করতে পারব। কিন্তু আবার তুমি দিনক্ষণ না মেনে তোমার স্মৃতির দঙ্গলে আমাকে হারানোর হাতছানি দাও। অবশ্য আমার লেখায় তোমার আর প্রভাব পড়তে দিই না। আজকের আমি আমার লেখার ব্যাপারে খুব পজেসিভ।

তুমি ভেবে নিও না ,তোমার বিরহে বিবাগী হয়ে লোটা কম্বল সম্বল করেছি । মায়ের পছন্দের পাত্রীকে বিয়ে করেছি। নাঃ পাত্রী দেখতে যাইনি। তোমার কথা মনে করে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছি। মায়ের মনোনয়নে সন্মত হয়েছি।
জায়া- পুত্র নিয়ে সুখ বাঁধা পড়েছে ঘরে।

তোমার আমার গল্পটা কোন প্রকাশককে দিই নি ইচ্ছে করে। থাক না তোমার আমার গল্পটা লোকের অজানা হয়ে। হলদে তুলোট কাগজে বন্দী ভালোবাসা জানো আজো কাঁদে। নিশুতি রাতে আমি কান পেতে তার ফোঁপানি শুনি কোন গল্প লিখতে লিখতে,নয়তো বৌয়ের পাশে শুয়ে নিস্তব্ধ রাতকে নিঃশব্দে চলে যেতে দিয়ে।
সত্যি বলছিতোমার আর আমার সেই অসম -ভালোবাসা আজো কাঁদে একা একা। আমি তার একমাত্র সাক্ষী। জানা নেই আমার তুমি কোথায় কেমন আছো। ভাবো কি আমার কথা?
আমাদের ভালোবাসা তোমার কাছে ছিল শুধু খেলা। বুঝেছি অনেক পরে। বৈভবের ঘেরাটোপ থেকে পারো নি বের হতে।
বৈভবের চাহিদায় তুমি নিজের ভুল শেষ পর্যন্ত বুঝেছিলে। তাই তো সরে গিয়েছিলে। আমার জীবনে হয়েছিলে তুমি বৈশাখী ঝড়। সব কিছু তছনছ হয়ে গিয়েছিল। আঘাতের জলোচ্ছ্বাস হৃদয়ের গহীণ গহ্বরে ঘুরপাক খেয়েছে। বহ্নিপতঙ্গের মত মন বারবার ধেয়ে গেছে তোমার দিকে। কত বুঝিয়েছি নিজেকে, এ’ ভালোবাসা হয়তো নয় আমার জন্য। এক সন্ধ্যায় আমাকে তোমার উজাড় করে দেওয়ার উপহার আজ উপহাস মনে হয়। আমার জীবনে বসন্ত বিফল। আজকের আমি বসন্তের গানে রেডিওর নব বন্ধ করে দিই।
অনেক আগে এক বসন্তে বড়ো সুন্দর স্বপ্ন দেখিয়েছিলে তুমি ” রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো আমায়”। তোমার সেই চাওয়া রঙ আমার মর্মে লেগে গিয়েছিল। আজো তা এতটুকু ফিকে হয়নি। কারণ বসন্ত তখন আমার মন- উপবনে তার হলুদ উত্তরীয় বিছিয়ে দিয়েছে। আজ অবশ্য ইচ্ছে করে বসন্ত কে ভুলেছি আমি। এখনকার বসন্ত কখন আসে- যায় খেয়াল রাখি না। যাওয়া-আসার পথে কতসময় পড়ে থাকা লাল নরম পলাশ যে পায়ে মাড়িয়ে ফেলি- সে বোধ থাকে না।অথচ একদিন তোমার কবরী সাজাতাম ঐ পলাশের নরম আগুনে।
রোদের তাপের শেষে মোম জোছনার ভেসে যাওয়া ছাতে
তোমার-আমার কিছু বলা আর কিছু না বলা কথার কথা আজ আর আমি ভাবি না। বৃন্তচ্যুত মুকুলের মত সে সব কবে ঝরে গেছে। কোথায় শুরু, কোথায় শেষ- তা আজ আর মনে নেই। সত্যিই কি মনে নেই? না সব মনে আছে। আর আছে লড়াই। সে সব দিনের কথা গুলোকে ভোলার লড়াই। লড়াইয়ের ময়দান আমাকে ছাড়তে হয়েছিল লড়াইয়ের কৌশল না জানার জন্য। তাই আজো নিজের সাথে আমার নিজের লড়াই চলতে থাকে

জানো আমার বৌ আর ছেলেকে বলে রেখেছি, যখন এই পৃথিবীর খেলাঘর ছেড়ে যাব, তখন তুলোট কাগজের হলদেটে পান্ডুলিপিটা যেন আমার বুকে দিয়ে দেয়। ওটাই আমার গীতা বাইবেল কিংবা কোরাণ। জানোই তো,কোন ধর্মে আত্যন্তিক বিশ্বাস আমার কোনকালেই ছিল না। তোমাকে ভালোবাসায় আমার বিশ্বাস,আমার দায়বদ্ধতা।সে দায়বদ্ধতা থেকে বিচ্যুত হইনি কোনদিন।শুধুমাত্র তোমাকে জানতে দিতে চাই নি। তাইতো আমার শেষ ইচ্ছে আমার সাথে তোমার-আমার গল্পটাও একমুঠো ছাই হয়ে যাক।ভাবব মৃত্যুর পর তুমি আমার সাথে আছো। আসলে তোমাকে ভুলতে চেষ্টা করেও পারেনি “তোমার- আমার গল্পের “এই লেখক। বার্নার্ড শ এর কথা খুব মনে হচ্ছে জানো, ” প্রেম একটা জ্বলন্ত সিগারেট, যার শুরুতে আগুন, এবং শেষ পরিণতি ছাই।
তোমাকে ভালোবেসে তোমার ভালোবাসা না পেয়েও আমি নিজেকে নিঃস্ব ভাবিনি। বরং সে ভালোবাসা কে আমি নিজের মত বাঁচিয়ে রেখেছি। স্বস্তি হয়তো পাই নি, তবে শান্তি পেয়েছি। তোমার ভালোবাসা না পেয়েও তোমাকে ভালোবাসার শান্তি।
জানো বয়েস হয়েছে। আজকাল একটা উপলব্ধি বড়ো জোরদার হয়েছে- ভালোবাসার মানুষের চোখে যদি জলই না এল, তবে পার্থিব অস্তিত্বের মূল্য কি রইলো? আমার বেঁচে থাকার সময়ে হয়তো কেন, নিশ্চিত আমার জন্য তোমার চোখে জল আসে নি। আমার মৃত্যুর পর দু ফোঁটা চোখের জল আমার জন্য ফেলবে তো? আমার মৃত্যু তো চুপিসারে হবে না। খবরের কাগজ, টিভি- কোন একখান থেকে নির্ঘাত তোমার কানে পৌঁছবে। দেখতে আসতে হবে না মৃত আমি টাকে। মৃত আমি হয়তো তোমাকে কষ্ট দেব। যে ভালোবাসা কে তুলোর মত করে এতকাল বুকের মাঝে আদরে রেখেছি,কষ্ট দিতে চাইনি সে ভালোবাসা আমার সামনে কাঁদবে, কষ্ট পাবে, আমার ঘুম ভাঙাতে চাইবে… তাতে তো আমার এতদিন ধরে সংগোপনে একা একা তোমাকে ভালোবাসার মগ্নতা নষ্ট হবে। তোমাকে ভালোবেসে আমি যে মগ্নমৈনাক হয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছি। তুমি যে আমার তুলোট কাগজে মোড়া নরম প্রেম। তাই ঘুমোতে দিও শান্তিতে । এস না আমার ঘুম ভাঙাতে।