ক্যামেরার আড়ালে (অণু উপন্যাস, পর্ব-দুই) : মানস সরকার।

0
294

নিজের হাতঘড়িতে সময়টা দেখল তমালী। তিনটে দশ। হসপিটালে ওয়েটিং রুম বলতে সেভাবে কিছু নেই। এমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টে ধাপে ধাপে উঠে গেছে সিঁড়ি। তারই এককোণে মা আর বোন গুটিশুটি মেরে বসে রয়েছে। সব শোনার পর একবারও কেঁদে ওঠেনি মা। বোন অবশ্য একবার ‘দাদা’ বলে কেঁদে উঠে আবার চুপ করে গেছে। অটোর ভদ্রলোক দু’জনকে কোনওদিন ভুলবে না তমালী। কেসটাকে ক্রিটিক্যাল দেখিয়ে হসপিটালের লোকজন প্রথমেই ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল। ভদ্রলোক দু’জন না দাবড়ালে তমালীর একার চেষ্টায় বোধহয় দাদাকে অ্যাডমিট করা হত না। সকাল হলেই পাড়ার লোকের মধ্যে খবরটা নিশ্চয়ই ছড়াবে। হসপিটাল চত্বরে কেউ কেউ চলেও আসবে। ভোর হলে পুলিশও নাকি আসবে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। ডাক্তারকে কলবুক পাঠানোর সময়ে এমার্জেন্সি ডিউটিতে থাকা নার্স জানিয়ে দিয়েছে, ‘এটা পুলিশ কেস। হসপিটাল ছেড়ে কোথাও যাবেন না। এগজ্যাক্টলি কী হয়েছিল, তা কিন্তু বলতে হবে ডিউটি অফিসারকে।’ ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। মিনিট পনেরো পরেই আবার উঠে গিয়েছিল। মেল ওয়ার্ডের সিঁড়ি ধরে। রক্তের বোতল, অক্সিজেন মাস্ক, স্যালাইন–চেনা যাচ্ছিল না দাদাকে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি।

সারা শরীর জুড়ে এবার ক্লান্তি নেমে আসছে। ঘটনার তীব্রতা কেটে যাওয়ার পরে এটাই প্রাথমিক প্রভাব। আতঙ্ককে সরিয়ে অন্য ধরনের উদ্বেগ জায়গা করে নিচ্ছে। নিজের কাছে যে ক’টা টাকা ছিল, তার দু’টো স্যালাইনের বোতল আর একটা ইঞ্জেকশন আনতেই খরচ হয়ে গেছে। ফোনে মা’কে খবরটা দেওয়ার সময়েও হালকা করে টাকার চিন্তাটা ঘুরছিল। – মা, ফোনের লাইন সংযোগ হতেই এক সেকেণ্ড থমকে গিয়েছিল তমালী। তারপর প্রচণ্ড তেতো খাওয়ার মতো বিকৃত স্বরে বলে উঠেছিল, দাদার হঠাৎ করে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। – কোথায়! কখন! ফোন দিয়েই যেন হসপিটালে পৌঁছে যেতে চাইছিল মা।
আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিল ও, আমার সঙ্গে দু’জন আছেন। চন্দননগর হসপিটাল ভর্তি নিয়েছে এইমাত্র। বোনকে নিয়ে হসপিটালে একবার চলে এসো।
– হ্যাঁ রে, কেমন আছে ও? – তুমি এসোই না, চোয়াল দু’টো শক্ত করে যোগ করেছিল, পারলে কিছু টাকা নিয়ে এসো।
ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে আসছেন ডাক্তার। সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ উঠে ওনার মুখোমুখি হল তমালী। নিজের হাত দু’টোকে বুকের কাছটায় একটু জড়ো করে নিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞাসা করল, কী রকম কী বুঝছেন স্যর? আমি সৌম্য ঘোষের বোন।
– ক্রিটিক্যাল। লিভারে অনেকগুলো ইন্টারনাল হ্যামারেজ হয়েছে। যা হয় স্ট্যাবিং-এ…. ডাক্তারের মন্তব্য শুনে মনে হল এইরকম কেস এরা জীবনে এত দেখেছে যে, নিরুত্তাপ, আবেগহীন গলায় এ ভাবে বলাটা প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন ওনারা।
– তবুও…
– ২৪ টা ঘন্টা না কাটলে বলা খুব শক্ত। বরঞ্চ আমি সাজেস্ট করব, পারলে কলকাতায় শিফ্‌ট করার ব্যবস্থা করুন।
চুপ করে থাকতে হল। কলকাতায় শিফ্‌ট! টাকা-পয়সা, লোকবল কিছুই প্রায় নেই। সম্ভব আদৌ! হনহন করে ডাক্তার এগিয়ে গেল নিজের জেন গাড়িটার দিকে।
কথাগুলো শোনার পরও শরীরে সেই তীব্র কাঁপুনিটা ফেরত আসছে না, যা শুরু হয়েছিল দাদাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে। সব সামলে যখন এতটা করতে পেরেছে, তখন আরেকটু ভাল কিছু শোনার অধিকার কি ওর নেই। একদিক থেকে ডাক্তার ভাল করেছেন, মায়ের সামনে কথাগুলো না বলে। চারদিকটায় তাকাল তমালী। কোথা থেকে একটা বাচ্ছার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। এমার্জেন্সির সিঁড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরও দু-একজন লোক। এদের পেসেন্টরাও নিশ্চয়ই খুব খারাপ অবস্থায়। সাধ করে কি কেউ রাত জাগে! খিদেটা মরে গেছে। জেগে উঠছে তেষ্টা। মানুষের শরীর সত্যিই অদ্ভুত। অটোতে হসপিটালে ঢোকার সময়ে একটা চায়ের দোকানকে, যতদূর মনে পড়ছে, খোলা থাকতে দেখেছিল। হালকা পায়ে গেটের দিকে এগিয়ে এল।

সাওয়ারের জলটা সারা শরীর ঘিরে নেমে আসছিল। চোখ বুজে ঠান্ডা আমেজটা উপভোগ করার চেষ্টা করছিল ইন্দ্র। অটোতে ধরে বসার সময়ে ছেলেটার ক্ষতের রক্ত লেগেছিল জামায়। হাসপাতালে ঢোকার সময়ে আরও রক্ত….। দু’বার সাবান মাখা হয়ে গেছে। জামা খুলে ফেলে দিয়েছে। তবুও রক্তের আতঙ্কটা যেন এখনও মন থেকে যাচ্ছে না। বাথরুমের দরজায় ঠক্‌ ঠক্‌। নীতার গলা পেল, হল তোমার?
– আসছি, খুব হালকা গলায় উত্তরটা ছুঁড়ে দিল।
হসপিটালেই ফোন পেয়েছিল নীতার। যতটা সম্ভব সংক্ষেপে জানিয়েছিল

ঘটনাটা। ঝাঁঝ ফুটে উঠেছিল ওর গলায়, কেন ফালতু ঝামেলায় জড়াতে গেলে নিজেকে! নিরুপায় হয়ে বলে উঠেছিল, কিছু করার ছিল না। বিশ্বাস করো, কিছুতেই সাইড হতে পারলাম না।
– সাবধানে থেকো। কোনও সমস্যায় জড়িয়ে যেও না, একটু নরম লেগেছিল ওর গলার স্বর, আর যদি পারো একটু তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। ওর বলার ভঙ্গিমায় মাপতে চেষ্টা করেছিল ইন্দ্র, তাতে প্রেম না কর্তব্যের আভাস। রাত তিনটের সময়ে বাড়ি ঢোকার অভ্যেস কোনওকালেই নেই। তিন বছরে এই প্রথম। তাছাড়া আগে ফোনে বলে দেওয়ার জন্যই ততটা সিরিয়াস প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি ইন্দ্রকে।
বাথরুমের মেঝেটায় আর কোথাও বিন্দুমাত্র রক্তের দাগ আছে কি না, দেখার চেষ্টা করল। চোখে পড়ল না। বুঝতে পারছিল না কিছুতেই, আর জল ঢালবে কি না। বছর দু’য়েক আগেও নিজের বেডরুমের মেঝেতে পড়ে থাকা ফোঁটা ফোঁটা রক্তকে এভাবেই পরিষ্কার করার চেষ্টা করছিল। সে রক্তও কি খুনের জন্য। কাপুঁনি আসছিল শরীর জুড়ে। গা মুছে বেরিয়ে এল। খাবার টেবিলে গালে হাত দিয়ে বসেছিল নীতা। ইন্দ্র এগিয়ে আসতেই রুটির থালাটাকে আরেকটু এগিয়ে দিল। – মাছটা তুলে নাও। শুধু ঝোল আর রুটি খাব। এই ভোরবেলায় আর মাছ খেতে ভাল লাগছে না। পাশে রাখা একটা ছোট্ট প্লেটে নিঃশব্দে মাছটা উঠে যায়।
একটু চুপ করে থেকে বলল নীতা, কেমন আছে এখন? – মনে হয়, বেশ সিরিয়াস। মানুষ আজকাল এত হিংস্র হয়ে উঠছে। চোখ তুলে ওর দিকে নীতা একবার তাকাতেই আবার রক্তমাখা মেঝেটা

সামনে চলে এল। মাথা নীচু করে রুটিটা ছিঁড়ল ইন্দ্র। বাটির ঝোলে ডুবিয়ে মুখে দিতেই কেমন যেন একটা আঁশটে গন্ধ আক্রমণ করল। মুখটা কুঁচকে ফেলল ও।
– কী হল!
– বুঝতে পারছি না। আসলে এই সময়ে আগে কোনওদিন খাইনি।
বলা শেষ করেই প্রায় দৌড়ে বেসিনের কাছে গিয়ে মুখটা নামিয়ে দিল ইন্দ্র। হড় হড় করে কিছুটা বমি করে ফেলল।

ভাল করে তাকাতে বুঝতে পারল তমালী। এটা সেই অটোটা। সামনে রদিকে অল্প পা তুলে, মাথাটা পিছনে হেলিয়ে বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছে ড্রাইভার। মনে পড়েছে। ইস্‌! এতসব ঘটনার ঘনঘটার মধ্যে অটোভাড়াটা দিতেই ভুলে গেছিল। ব্যাপার দেখে ছেলেটাও আর চায়নি। নিশ্চয়ই ওর জন্যে অপেক্ষা করছে। একটু এগিয়ে এসে হালকা করে ডাক দিল, এই যে শুনছেন –
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চোখ মেলে তাকাল ছেলেটা। বড় বড় চোখ, আর উজ্জ্বল মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাঁ হাত দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে সোজা হয়ে বসে প্রশ্ন করল, আপনি? কেমন আছে এখন?
– খুব একটা ভাল না। আসলে ঝামেলার মধ্যে মনেই ছিল না। আপনাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। আপনার ভাড়াটা…
– না, না, আপনি ভুল করছেন, ভাড়ার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম না। আসলে ব্যাপারটা এমনই… মনে হল, যদি আপনি আরও কোথাও যান…
তাজ্জব বনে গেল তমালী। নিজের শহরে এরকম মানসিকতার মানুষজন আছে, জানা ছিল না। না কি ভাড়াটা নিতে অযথা বিনয় দেখাচ্ছে ছেলেটা। স্বাভাবিকভাবে বলে উঠল, সে জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু আপনি নিজেকে অযথা এর মধ্যে জড়াবেন না। জানেন তো এটা পুলিশ কেস?
পরের পৃষ্ঠায়………….১৩
(১৩)
– সে ভয় পেলে তো কখন পালিয়ে যেতাম। তবে আমার মনে হয়, স্টেটমেন্ট নেওয়ার জন্য পুলিশ এমনিই আমাকে খুঁজে বের করত। তবে আপনি নিশ্চিত থাকুন, যারা এটা করল তারা ধরা পড়বেই। – আমার তো উল্টো কথাটাই মনে হয়। – তাহলে বোধহয় আপনি জানেন না, নতুন যিনি ওসি হয়ে এসেছেন, খুব কড়া।
– কিন্তু ঘটনাটা ঘটেই গেল।
– ঘটল বটে। কিন্তু আবার বলছি। বদমাইশগুলো অ্যারেস্ট হবেই।
এ নিয়ে কথা আর এগোতে ইচ্ছা করল না তমালীর। বলল, আপনি কি চা খাবেন?
– তা খেলে মন্দ হত না। চলুন, সামনেই একটা দোকান আছে। সারারাত খোলা থাকে।
হাঁটতে শুরু করল তমালী। কয়েক পা হেঁটেই আবার পিছন ফিরে তাকাল, আপনার নামটা কী বলুন তো?
– সমীর। এখানে অনেকেই চেনে আমায়।
কয়েক পা হাঁটতেই দু’জনে চায়ের দোকানটায় পৌঁছে যায়। মনে পড়ল তমালীর, মা আর বোন দু’জনের কেউই বোধহয় খেয়ে আসেনি। কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে নিলে ভাল হত।
বরং চায়ে চুমুক দিতেই অল্প হলেও তৃপ্তির স্বাদ। দোকানে আরও দু’জন মাঝবয়সী পুরুষ বসে আছে। তাদের চোখে কৌতুহলের দৃষ্টি। চায়ের টাকাটা কত হয়েছে জিজ্ঞাসা করছিল তমালী। তার মধ্যে ছুটতে ছুটতে হাজির টুম্পা। ওর বোন।
– কী হল! নিজের গলা কেঁপে গেল।
– এইমাত্র একজন আমাদের কাছে এসেছিল, কাঁদো কাঁদো মুখে বলল টুম্পা,

দাদা মনে হয় –
– কী!!
– মনে হয়, দাদা আর নেই রে দিদি!
হাতে ধরা চায়ের ভাঁড়টা রাস্তায় পড়ে ভেঙে চুরমার হইয়ে গেল।

ক্রমশঃ—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here