ঝিঙে পটল (ধারাবাহিক, দশম পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
344

বোনটার দিকে তাকালে পটল খুব শান্তি পায় । মন খুশীতে ভরে ওঠে । ঝিঙে খুব ছোট । কিন্তু যেভাবে দাদার দুঃখ কষ্ট বোঝে সেটা ভাবতেই পটল হতবাক ! আর মনে মনে ভাবে এতটুকু মেয়ে সে কতো দরদী ! কোনো কারণে পটলের মন খারাপ হলে ঝিঙে থিক টের পায় । সঙ্গে সঙ্গে দাদার পাশে এসে বসে । দাদার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, ঠিক যেমন মায়েরা তাঁদের সন্তানের উপর করে । এইটুকু ছোট্ট মেয়ে, অথচ তার বুদ্ধিদীপ্ত কর্মকাণ্ড দেখলে পটলের মতো অনেকেই অবাক হবেন ! ঝিঙের মতো মেয়ে কীভাবে বর্তমান পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারে, সেটাই ভেবে উপলব্ধি করতে পারে না পটল । তাই আর পাঁচটা মেয়ের চেয়ে ঝিঙে সম্পূর্ণ আলাদা । পটলের বিশ্বাস, বোনটা সঠিক শিক্ষা পেলে একদিন সে অনেক বড় হবে । মানুষের মতো মানুষ হবে ।
আজিমগঞ্জগামী ট্রেনটি স্টেশনে ঢুকলো । বাজারসৌ স্টেশনে অনেক যাত্রীর ওঠানামা । কয়েকজন যাত্রী স্টেশনে নেমে সোজা পটলের মুড়ির দোকানে । তাঁরা মুড়ি খেয়ে বাড়ি ফিরবেন । ট্রেন স্টেশনে ঢুকলে, পটলের দোকানে বেচা-কেনা বাড়ে । যাই হোক সেই সময় তার দোকানের সামনে জনা দশেক খরিদ্দার মুড়ি ও ঘুগনি খেতে ব্যস্ত । হঠাৎ পটল দেখতে পেলো, ঘোষপাড়ার নটরাজ ও কার্তিক কয়েকজন পুলিশ নিয়ে তার দোকানের দিকে ধেয়ে আসছে । পুলিশের হাঁটার ভঙ্গী ও শারীরিক ভাষা দেখে পটল আন্দাজ করতে পারলো তার বিপদের সংকেত ?
“পটল কার নাম ?” পুলিশ জিজ্ঞাসা করলো পটলকে ।
স্যার আমিই পটল ।
আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে ।
স্যার, আমার অপরাধ ?
পরের জায়গায় অবৈধভাবে দোকান চালানো ও ঘর বানানোর অপরাধে থানায় যেতে হবে ।
কিন্তু অভিযোগ কে জানলো, স্যার ? কার অভিযোগের ভিত্তিতে আমাকে ধরে নিয়ে থানায় যাচ্ছেন স্যার ?
শুভ্রাংশবাবুর হয়ে নালিশ জানিয়েছে ঘোষপাড়ার নটরাজ ও কার্তিক ।
তাহলে জমির মালিক শুভ্রাংশবাবুকে আসতে দিন । তিনি আপনাদের লিখিত অভিযোগ জানালে আমাকে তুলে নিয়ে যাবেন ।
অত কথা শোনার ধৈর্য আমাদের নেই । কোনো বক্তব্য থাকলে থানার বড়বাবুকে ব্যক্ত করবেন । এখন কোনোকথা না বলে চুপচাপ আমাদের সঙ্গে গাড়িতে ওঠো । নতুবা পুলিশের লাঠি অনিবার্য ।
আমি এখন খরিদ্দার সামলাচ্ছি স্যার । খরিদ্দারদের খাওয়া হয়ে গেলে আমাকে থানায় নিয়ে চলুন ।
অন্য একজন পুলিশ কর্মী ধমকের সুরে পটলকে বললেন, “এক্ষুণি গাড়িতে ওঠো । নতুবা ঘা কতক খেলে ‘বাপ্‌ বাপ্‌’ করে ঠিক গাড়িতে উঠবে ।“
একরকম জোর করে পটলকে থানায় নিয়ে গেল । নিজের প্রতি পটলের সওয়াল পুলিশ শুনলো না ।
খরিদ্দারেরা চুপচাপ ! ঘটনার প্রেক্ষাপট খরিদ্দারেরা কিছুই বুঝতে পারলেন না । তাঁরা লক্ষ্য করলেন পটলকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ায় ঝিঙের কী কান্না ! কেউ তাকে থামাতে পারছেন না । কেঁদে কেঁদে ঝিঙে খরিদ্দারদের কাছে জানতে চাইছে, “দাদাকে কেন পুলিশ ধরে নিয়ে গেল ?“
ঝিঙে ঐ অবস্থায় দোকানের সমস্ত কিছু ফেলে ছুটলো গৌরীনগরে । দেখা করলো ভুঁড়িওয়ালা গদাই খুড়োর সঙ্গে । ঝিঙে কেঁদে কেঁদে শুধু বলতে পারলো, “দাদাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে ।“
গদাই খুড়ো বুঝতে পারলেন, “থানায় পটলকে ধরে নিয়ে গেছে । নিশ্চয় শুভ্রাংশবাবুর কাজ । অসম থেকে এসে থানায় নালিশ জানিয়েছেন । যার জন্য পটলকে ধরে নিয়ে যাওয়া । তাই তিনি গৌরীনগর থেকে জনা পাঁচেক লোক নিয়ে সোজা শুভ্রাংশবাবুর সঙ্গে দেখা করলেন ।
সমস্ত ঘটনা শুনে শুভ্রাংশবাবু আকাশ থেকে পড়লেন ! তিনি গদাই খুড়োকে জানালেন, “ তিনি এখনও তাঁদের পৈত্রিক ভিটায় যাওয়ার সময় পাননি । সুতরাং থানায় অভিযোগ জানানোর প্রশ্নই উঠে না । তখন উপযাজক হয়ে শুভ্রাংশবাবু গদাই খুড়োকে বললেন, “তিনিও তাঁদের সাথে থানায় যাবেন । তিনি কখনই চান না, একজন নিরীহ মানুষ সাজা পাক । তাঁর জমির ফয়সালা পরে হবে, বরং আগে পটলকে বাঁচানো যাক ।“
শুভ্রাংশবাবুর আন্তরিক ব্যবহারে গদাই খুড়ো ভীষণ আহ্লাদিত ।
তখন সন্ধে ৮টা । কার্তিক ও নটরাজ থানার আশপাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করছে । গদাই খুড়ো কার্তিককে ডেকে বললেন, “তোমরা আবার পটলকে বিপদে ফেলার জন্য উঠেপড়ে লেগেছো ? কিন্তু সেটা তোমরা আর পারবে না ।“
শুভ্রাংশবাবু গদাই খুড়োকে বললেন, “এরা দুইজন জমি বিক্রির জন্য নিয়মিত টেলিফোনে তাঁকে খুব উত্ত্যক্ত করতো ।“ তিনি চিন্তিত মনে আবার গদাই খুড়োকে বললেন, “পটলকে ফাঁসাবার জন্য এদের যদি কাজ হয়, তাহলে ঐ দুজনের উপর নজরদারী রাখতে হবে । প্রয়োজনে ঐ দুজনের স্টেটমেন্ট দরকার হতে পারে । নতুবা অন্য যে কারণে তাদের থানায় দরকার হবেই । সম্ভব হলে কেউ ওদের উপর পাহাড়ায় থাকুন । পালিয়ে গেলে ওদের শাস্তি দেওয়া যাবে না ।“
শুভ্রাংশবাবুর কাছ থেকে বেরিয়ে গদাই খুড়ো ঘোষপাড়ার মোড়ল অদ্বৈতনাথকে ডেকে আনার জন্য লোক পাঠিয়েছিলেন । তিনিও গদাই খুড়োর সাথে সাথে থানায় ঢুকলেন ।
শুভ্রাংশবাবু আধুনিক যুগের নামকরা ডাক্তার । উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত । তিনি ব্যাপারটার গভীরে অনুধাবন করতে পেরেছেন । ঘটনার বিবরণ শুনে তিনি স্তম্ভিত ! তাঁর জায়গায় ব্যবসা চালানোর দায়ে পটল নাকি অভিযুক্ত ? অথচ তিনি এই অভিযোগের কুলকিনারা নিজেই জানেন না । এই কুচক্রের পেছনে কার্তিক ও নটরাজের যে হাত রয়েছে তিনি পরিষ্কার সেটা বুঝতে পারছেন ! শুভ্রাংশবাবুর ধারণা, থানার সঙ্গে কুচক্রীদের নিশ্চয় কোনো যোসাজস রয়েছে । নতুবা তাঁর লিখিত অভিযোগ ছাড়া পটলকে পুলিশ কেন ধরে আনবে ? এখানে শুভ্রাংশবাবুর বারংবার মনে হচ্ছে, কার্তিক ও নটরাজ খুব সন্তর্পণে ও পরিকল্পিতভাবে তাঁকে বিপদে ফেলবার ছক কষছে । পটলকে সামনে তাঁর সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত । তাই তিনি যথেষ্ট সতর্ক রইলেন ।
“থানার বড়বাবু আছেন ?” থানার ডিউটি অফিসারকে ঝা-চকচকে সুটেট-বুটেট টাই পরিহিত শুভ্রাংশবাবু জিজ্ঞাসা করলেন ।
ডিউটি অফিসার শুভ্রাংশবাবুকে বসতে বলে বড়বাবুর চেম্বারে ঢুকলেন । তারপর ডিউটি অফিসার কিছুতেই বড়বাবুর চেম্বার থেকে বের হয়ে আসছেন না । তাই কৌতুহলবশত বড়বাবুর চেম্বারে ঢুকে শুভ্রাংশবাবু তাজ্জব ! চেম্বারে কেউ নেই । থানার গেটে টহলরত পুলিশকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, বড়বাবু ও ডিউটি অফিসার জরুরি মিটিংয়ে মহাকুমা শাসকের অফিসে গিয়েছেন । অগত্যা বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই ।
রাত্রি দশটা । থানার মেজবাবু হন্তদন্ত হয়ে থানায় ঢুকেই বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, শুভ্রাংশবাবু মেজবাবুকে চেপে ধরলেন এবং তাঁদের বিষয়ে কথা শুনতে বললেন । কিন্তু মেজবাবুর বক্তব্য পটলের কেসটা তদারকি করছেন বড়বাবু স্বয়ং নিজে । সেখানে তাঁর কিছু করার নেই । বলেই তিনিও থানা থেকে বেরিয়ে গেলেন । শুভ্রাংশবাবুর কাছে আরও পরিষ্কার হয়ে গেল, বড়বাবু ইচ্ছা করে পটলের কেসটা ঝোলাতে চাইছেন । ঠিক সেই কারণে আলোচনার টেবিল এড়িয়ে যাচ্ছেন ।
শুভ্রাংশবাবু আর ঝুঁকি নিলেন না । এমনকি গদাই খুড়ো উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারবেন সেই ভরসাও করতে পারছেন না । যত দেরী হবে রাত ততই বাড়বে । তাতে পটলের ক্ষতি । অন্যদিকে শুভ্রাংশবাবুর নিশ্চিত ধারণা, কার্তিক ও নটরাজের পেছনে নিশ্চয় কোনো বড় রাজনৈতিক নেতার মাথা কাজ করছে । নতুবা পটলকে হাজতবাস করানোর দুর্বুদ্ধি তাদের সাহসে কুলাতো না । এর একটা বিহিত হওয়া দরকার এবং এই রাত্রেই সেটার বিহিত চাই ।
ঝিঙের কান্না থামাতে না পেরে হোটেলের জগাই তাকে নিয়ে সোজা থানায় । কিন্তু সে দাদার সঙ্গে দেখা করবেই । তাকে থামানো গদাই খুড়োর পক্ষেও কঠিন হয়ে দাঁড়ালো । অবশেষে থানার এক পুলিশ সাহেবকে অনুনয়-বিনয় করে ঝিঙেকে তার দাদার সাথে দেখা করানোর ব্যবস্থা করা হল ।
দাদার সাথে দেখা হওয়াতেও বিপদ বাড়ছে বই কমছে না । কেন দাদা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তাকে কোলে নিচ্ছে না, এটাই ঝিঙের প্রশ্ন ? কেনই বা দাদাকে ঘরে দরজা দিয়ে আঁটকানো ? ঝিঙের কঠিন প্রশ্নজালে নাজেহাল গদাই খুড়ো । বাবা বাছা করে কোনোরকমে ঝিঙেকে শান্ত করা গেল । কিন্তু এবার তার নতুন বায়না, দাদার সাথেই সে বাড়ি ফিরবে । ঝিঙের বক্তব্য, দাদা দুপুর থেকে খায়নি । তাকে ছাড়া রাত্রে সে খাবে না । মহা ফাঁপরে পড়লেন গদাই খুড়ো । অগত্যা ঝিঙেকে তিনি নিজের কাছেই রাখলেন । ঝিঙেকে ইত্যবসরে অনেক বুঝিয়ে তাকে কিছু টিফিন খাইয়ে আনলেন । তারপর সকলে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন পটলের ছাড়া পাওয়ার অপেক্ষায় ।
শুভ্রাংশবাবু দিগ্‌ভ্রান্তের ন্যায় এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন । তাঁর অবধারিত ধারণা, পটলকে পাকাপাকিভাবে জেলে পাঠানোর একটা ঘৃণ্য চক্রান্ত চলছে । সেই কুচক্রীদের চক্রটাও ভীষণ শক্ত ! তাদের খুটির জোরও শক্তিশালী । তাদের সাথে পাল্লা দিতে গেলে সোজা উপর মহলে যোগাযোগ চাই । নতুবা গোড়াতেই হেরে ভুত ! তখন শুভ্রাংশবাবুর মনে পড়ল টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ঝুনঝুনওয়ালার কথা । তিনি ডিব্রুগড়ে চা বাগানের মালিকদের সঙ্গে মিটিং করতে গিয়ে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন । তাঁর সোডিয়াম নীচে নেমে গিয়েছিলো । বুকে প্রচুর কফ জমেছিলো । শুভ্রাংশবাবু রাতদিন নিরলস পরিশ্রম করে চেয়ারম্যানকে সুস্থ করে তুলেছিলেন । সেই সময় ঝুনঝুনওয়ালা সাহেব শুভ্রাংশবাবুকে বলেছিলেন, কলকাতায় বেড়াতে যেতে এবং প্রয়োজনে কলকাতার যে কোনো সমস্যায় তাঁকে জানাতে এমনকি পুলিশের বড় সাহেবদের প্রয়োজন পড়লেও । তিনি আরও বলেছিলেন, কলকাতায় শুভ্রাংশবাবুর সমস্যা সমাধানে তাঁর একটি ফোনই যথেষ্ট ! সমস্ত সমস্যা সমাধান !
তাই সাতপাঁচ চিন্তা না করে শুভ্রাংশবাবু পটলের ঘটনাটা ঝুনঝুনওয়ালা সাহেবকে জানালেন । টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সব শুনে তাজ্জব ! থানার নাম জেনে শুধুমাত্র ঝুনঝুনওয়ালা তাঁকে দুই মিনিট অপেক্ষা করতে বললেন ।
কিছুক্ষণ পর রাত্রিবেলায় থানায় হঠাৎ গাড়ির আওয়াজ ! একসঙ্গে তিনখানা গাড়ি । একটা এ্যাডিশনাল এস-পি’র গাড়ি, আর একটা এস-ডি-পি-ও’র গাড়ি এবং অন্যটা থানার বড়বাবুর গাড়ি ।
বড়বাবুর ঘরে গিয়ে শুভ্রাংশবাবু যেটা শুনলেন সেটা শুনে তিনি রীতিমতো চমকে উঠলেন ! থানার বড়বাবু তাঁকে কী শোনালেন, সেটা শুনে তিনি ধন্দে ? কার্তিক ও নটরাজের ফাঁদা জালে প্রথমে পটলকে ধরা । এরপরে তাদের টার্গেট, শুভ্রাংশবাবু ! শুভ্রাংশবাবুকে ভয় দেখিয়ে যে কোনো উপায়ে জমিটা হাতিয়ে নেওয়ার । বড়বাবুর কথাতে স্পষ্ট, কার্তিক ও নটরাজের সাথে থানার একটা গোপন সমঝোতা হয়েছিলো । যার জন্য থানার পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিলো । শেষে কিনা ঐ দুই কুচক্রীর গুড়ে বালি । তাদের পরিকল্পনা ভেঙ্গে চূড়মার । তারা দুজনে ঢুকে গেল লক্‌ আপে । বিচারে কী সাজা হবে সেটা ভবিষ্যৎ বলবে । আপাতত দুই বাছাধন কিছুদিন জেলের ঘানি টেনে আসুক ।
থানার বড়বাবু পটলকে ছেড়ে দিলেন । শুভ্রাংশুবাবু হাফ্‌ ছেড়ে বাঁচলেন । এতক্ষণ তিনি টেনশনে ঘামছিলেন । এখন মানসিক স্বস্তি ।
বোনকে নিয়ে পটল ডেরায় ফিরলো ।
ভোরের আবছা আলো ত্রিপল টাঙানো ঘরে উঁকি দিচ্ছে । পাখীর কলরব কেবলমাত্র শুরু হচ্ছে । পটলের ঘুম ভাঙ্গতে চাইছে না । আধ বোজা চোখে একবার বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকালো । তারপর বুঝতে পারলো, সূর্য উঠতে এখনও কিছুটা সময় বাকী ! ঘুমে চোখ বুজে আসছে । এমন সময় খরিদ্দারের কন্ঠস্বর, “পটল ভাই, দোকান খোলো । কাটোয়া যাওয়ার ফার্স্ট লোকাল ধরতে হবে । মুড়ি খেয়ে ট্রেনের কামরায় উঠবো ।
খরিদ্দারের আওয়াজ পেয়ে হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লো পটল । তখনও ছোট বোনটা ঘুমোচ্ছে । সারা রাত সেভাবে ঘুমোতে পারেনি । ভোরের দিকে ঘুম আসায় ছোট বোনটা ঘুমে বিভোর ।
দোকান খুলে প্রথমেই কড়াইতে ঘুগনি চাপালো । কড়াই থেকে ঘুগনি নামিয়ে শুরু হল মুড়ি ঘুগনির বেচা-কেনা । ব্যস্ততামুখর সকাল । বোনটা দোকানে না আসায় পটলকে নিজের হাতে খরিদ্দারদের জল দেওয়া, থালায় ঘুগনি-মুড়ি সাজিয়ে দেওয়া, তারপর খরিদ্দারদের কাছ থেকে পয়সা নেওয়া এমনকি থালা পরিষ্কার জলে ধোওয়া, সমস্ত কাজ পটল একা সামলাচ্ছে । বলা চলে তার ঘাম ঝরা ব্যস্ততামুখর সকাল ।
“স্যার, আপনি কতক্ষণ ?” শুভ্রাংশবাবুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কোতুহলি দৃষ্টিতে পটল জিজ্ঞাসা করলো ।
“কিছুক্ষণ । আমি তোমার কর্মব্যস্ততা লক্ষ্য করছিলাম । বয়সে ছোট হলেও আমি মনে করি, ব্যবসা চালানো এবং খরিদ্দারদের সামলানো উভয় ক্ষেত্রেই তুমি সমানভাবে দক্ষ । “ব্যবসার খুঁটিনাটি” তোমার কাছ থেকে অনেক শেখার আছে । এটা তোমার ব্যবসায়িক জীবনের চলার পথের ভাল লক্ষণ । আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ব্যবসায়িক জীবনে তুমি সাফল্য পাবেই ।“ শুভ্রাংশবাবু হেসে হেসে কথাগুলি পটলকে বললেন ।
তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ ।
“স্যার, আমার দোকানের মুড়ি খাবেন ? আপনি চাইলে, আমি চানাচুর ও ভাজা বাদাম মিশিয়ে দিতে পারি ।“ শুভ্রাংশবাবুকে সকালের জলখাবার হিসাবে মুড়ি খাওয়ার জন্য পটল অনুরোধ করলো ।
শুভ্রাংশবাবু পটলের আপ্যায়নে ভীষণ খুশী । আপন মানুষের মতো তার আবদার । তাই তিনি পটলের আবদার ফেলতে পারলেন না । শুভ্রাংশবাবু একগাল হেসে বললেন, “আমি যেমন তোমার আবদার মেনে নিলাম তেমনি আমার একটা আবদার তোমাকে অবশ্যই মানতে হবে ।“
“আপনার মতো বড় মাপের মানুষের আবদার আমার মতো সামান্য বাচ্চা ছেলের কাছে কী থাকতে পারে স্যার ? ঐসব ছেড়ে দিয়ে আপনি আমার ঝাল-মুড়ি খান্‌ । তাতে আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো ।“ পটল উল্টে চাপ দিলো ।
“উহুঁ ! আগে আমার আবদারে তুমি মত দাও, তারপর ঝাল-মুড়ি খাওয়া !” বেঁকে বসলেন শুভ্রাংশবাবু ।
শুভ্রাংশবাবুর নাছোড়বান্দা আবদারে পটল অগত্যা বলতে বাধ্য হল, “ঠিক আছে স্যার । এবার আপনার আবদারটা শোনা যাক ।“ শুভ্রাংশবাবু আসার জন্য এলাকার বেশ কিছু উদগ্রীব মানুষ পটলের দোকানে হাজির । জগাই দোকান থেকে বেরিয়ে এসে শুভ্রাংশবাবুর কাণ্ডকারখানা অবলোকন করছে । ঘোষপাড়ার মোড়ল অদ্বৈতনাথ খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন । তিনিও শুভ্রাংশবাবুর সাথে কথা বলতে চান । তিনি শুভ্রাংশবাবুর সঙ্গে কথা বলা দূরের কথা, এসে দেখেন বাজারসৌ এলাকার বহু মানুষ শুভ্রাংশবাবুকে ঘিরে গোটা পরিস্থিতির উপর নজর রাখছেন ।
এবার শুভ্রাংশবাবু পটলকে ডাকলেন । তাঁর পাশে বসালেন । শুভ্রাংশবাবুর স্নেহ ভালবাসা দেখে পটল ভয় পেয়ে গেল । তবে কী শুভ্রাংশবাবু তাকে বিপদে ফেলার জন্য ফাঁদ পাতছেন ! সেই কারণে পটল রাখঢাক না করে সোজাসুজি বললো, “আপনার এত আদিখ্যেতার কী দরকার ? সোজা কথা সোজাভাবে বলে দিন । যদিও আপনার আবদার মেটানোর মতো আমার শক্তি বা সামর্থ কোনোটাই নেই । তবুও এবার দয়া করে আপনার আবদার আমাকে জানিয়ে আমাকে চিন্তামুক্ত করুন । নতুবা আমি ভয়ে, শঙ্কায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ছি !
শুভ্রাংশবাবু পটলের মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহমাখা সুরে বললেন, “আমার ছোট্ট আবদার তোমার কাছে, আমি জমিটা তোমাকে দান করতে চাই । তুমি আমার জমিটা গ্রহণ করে আমাকে চিন্তামুক্ত করো ।“
শুভ্রাংশবাবুর কথা শুনে লাফিয়ে উঠলো পটল । তার চোখে জল । আকাশের দিকে তাকিয়ে পটলের হাউ হাউ কান্না ! তারপর শুভ্রাংশবাবুর পা জড়িয়ে ধরে বললো, “আপনি মানুষ নন, দেবতা । আমার কাছে আপনি আমার ভগবান !”
 (চলবে)