ঝিঙে পটল (ধারাবাহিক উপন্যাস, একাদশ পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
408

জমিটা পাওয়ার পর পটলের মানসিক স্থিতি অনেক চাঙ্গা । তার মনের অবস্থা অনেক বেশী স্থিতিশীল ও শক্তিশালী ।
ধীরে ধীরে পটল ব্যবসার দিকে মনোযোগ দিলো । তাকে আর্থিক সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে এলো রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক । রাস্তা ঘেঁষে ক্ষুদ্র আকারে দশ বাই বারো ফুট একটা ঘর বানালো এবং পাশে ছোট একটা ঘর ও বাথরুম বানিয়ে পটল নতুন উদ্যমে তার ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়লো । ব্যবসার বিস্তার ঘটানোই তার লক্ষ্য । লক্ষ্য পূরণের দিকে পটলের নিরন্তর প্রয়াস অটল রইলো ।
তারপর দীর্ঘদিন ।
বোনটাকে স্কুলে ভর্তি করেছে । ঝিঙে অনেক সমঝদার মেয়ে । স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি দাদাকে ব্যবসার কাজে সাহায্য করছে । দোকান ভাল সাজিয়েছে পটল । মুড়ি ঘুগনি ছাড়া চায়ের ব্যবস্থা । স্থানীয় এলাকায় দোকানটি সকলের কাছে পটলের চায়ের দোকান হিসাবে পরিচিত । পুরানো মুড়ি ঘুগনি ছাড়া পটলের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট, কেক, পাউরুটি-ওমলেট, বাটার-জেলি মাখানো স্লাইস পাউরুটি, পাকা কলা, টুকিটাকি প্রয়োজনীয় স্টেশনারি দ্রব্য যেমন সাবান, স্যাম্পু, নারিকেল তেল, সর্ষের তেলের প্যাকেট, ডাল, লবন, মশলার প্যাকেট, সার্ফ, কাগজ, কলম, ইত্যাদি । বাজারসৌ স্টেশন চত্বরে পটলের দোকান এখন ভীষণ জনপ্রিয় ।
ঝিঙে ভোরে ওঠে । তারপর দাদার সঙ্গে দোকানের কাজে ঢোকে । এক কড়াই ঘুগনি বানাতে সাহায্য করে । ঘুগনি নেমে গেলে দুজনের জন্য অল্প পরিমানে সেদ্ধ-ভাত বানায় । তারপর দুজনে সকাল ন’টা নাগাদ সেই ভাত খেয়ে যার যার কাজে মনোনিবেশ করে । সকালের দিকে পটলের ভীষণ ক্ষিদে । কেননা পটল প্রতিদিন ভোর পাঁচটার মধ্যে দোকান খোলে । ট্রেন যাত্রীরা পটলের দোকানের চা খেয়ে প্লাটফর্মে ঢোকেন । ভোর পাঁচটার পর পটলের কাজ সমানে চলতে থাকে । বিশ্রামের এতটুকু ফুরসত পায় না । সকালবেলায় সাড়ে আটটার ট্রেন ছেড়ে গেলে দুজনে সেদ্ধ-ভাত খায় । সেদ্ধ-ভাত খাওয়ার পেছনে তাদের আরও একটা যুক্তি – সকালবেলায় সেদ্ধ-ভাত খেয়ে নিলে সারাদিন না খেলেও চলবে । মাঝে মধ্যে চা পাউরুটি খেয়েও থাকা যাবে । মোটামুটি সেদ্ধ-ভাত খেয়েই ঝিঙে স্কুলে যায় ।
ঝিঙে প্রাইমারী স্কুল শেষ করে শক্তিপুর গার্লস হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হল । স্কুল অনেকটা দূরে । বাসে যাতায়াত । তবে ঝিঙের একটা সাইকেল দরকার । পটল খোঁজ নিয়ে জেনেছে মেয়েদের জন্য স্কুল থেকে সাইকেলের বন্দোবস্থ রয়েছে । তাই যতদিন স্কুল থেকে সাইকেল না পাচ্ছে, ততদিন সে বাসেই যাতায়াত করবে । ঠিক এক বছরের মাথায় ঝিঙের কপালে সরকারি সাইকেল জুটলো । ষষ্ট শ্রেণীতে উঠলো ঝিঙে । সাইকেলে তার স্কুলে যাতায়াত । সাইকেল চালানো শিখতে ঝিঙেকে প্রথমদিকে একটু বেগ পেতে হয়েছিল । এখন সাইকেল চালানোতে ঝিঙে খুব পটু ।
ঝিঙে পড়াশুনায় খুব ভাল । অল্পদিনের মধ্যে পড়াশুনায় দক্ষতা দেখিয়ে নিমেষেই দিদিমণিদের নজর কেড়ে নিলো । যার জন্য দিদিমণিরা ঝিঙেকে ভীষণ ভালবাসেন । দিদিমণিদের ধারণা, ঝিঙে ঠিকমতো গাইড পেলে শিক্ষা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে । তার প্রতিভা অন্যান্য ছাত্রীদের তুলনায় অনেক গুণ বেশী উৎকৃষ্ট । সেই কারণে দিদিমণিরা ঝিঙের পড়াশুনার খুঁটিনাটি ব্যাপারে অতিরিক্ত খেয়াল রাখছেন ।
পটল বোনের পড়াশুনার শ্রীবৃদ্ধি অবলোকন করে কিছুতেই তাকে দোকানের কাজ করতে দিতে চায় না । তার কথা, বোনটাকে সে তার সাধ্যমতো পড়াবে । বোনের পড়াশোনার ব্যাপারে পটল কোনো কার্পণ্য করবে না । সেইজন্য স্কুল যাওয়ার সময় বোনকে একরকম তৈরী করে পাঠায় । আবার ঠিকমতো ফিরছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখে । বোন তার জীবনে ঈশ্বরের প্রেরিত দূত । বোনটাকে ভীষণ ভালবাসে পটল । বোন তার নয়নের মণি !
তারপর পটল নিজস্ব স্টাইলে দোকান চালিয়ে যাচ্ছে । অন্যদিকে ঝিঙে পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত !
সেদিন রবিবার । রবিবারদিন ঝিঙে দাদাকে ঘরের কোনো কাজ করতে দেয় না । রান্না-বান্না থেকে শুরু করে ঘর-দোর গোছানো পর্যন্ত সমস্ত কাজ ঝিঙে নিজের হাতে সামলায় ।
ক্ষেন্তি মাসি গাঁয়ে গঞ্জে ঘুরে ঘুরে মাছ বিক্রি করে । সকাল বেলায় নদীর কিনারার জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনে গাঁয়ে গঞ্জে ঘুরে ঘুরে সেই মাছ বিক্রি । ক্ষেন্তি মাসির মাছের একটাই বিশেষত্ব, ছোট জাতীয় মাছ যেমন পুটি, ট্যাংরা, ছোট বোয়াল, বাটা, ল্যাঠা, পাবতা, রুই, কাতলা, ইত্যাদি এবং মাছগুলি টাটকা । সেই ক্ষেন্তি মাসির কাছ থেকে ঝিঙে দুই শত গ্রাম বাটা মাছ কিনেছে । বেগুন ভাজা, ডাল ও বাটা মাছের ঝাল বানিয়েছে ঝিঙে । রান্না শেষ হওয়ার পর তাদের স্নানের পালা । ইতিমধ্যে দাদা স্নান সেরে নিয়েছে । ঝিঙের স্নান সারা হলে দুজনে একসঙ্গে খেতে বসবে । ঝিঙে বাথরুম থেকে স্নান সারলো । তারপর দুজনে খেতে বসলো । খাওয়া শেষ হওয়ার পর দোকানে গিয়ে বসলো পটল । সেই সময় দোকানে খরিদ্দারের চাপ কম । তাই ভাত-ঘুম দেওয়ার জন্য পটল চায়ের দোকানের বেঞ্চে সটান শুয়ে পড়লো । অন্যদিকে দাদাকে শোওয়া দেখে তাকে না জানিয়ে ঝিঙে স্টেশনের প্লাটফর্মে নীরদকাকার পেয়ারার দোকানে হাজির । নীরদকাকা পেয়ারা টুকরো টুকরো করে কাটে, তারপর মশলা মিশিয়ে ঝাল ঝাল করে মশলা-পেয়ারা বানায় । মাখানো পেয়ারা খেতেও ভীষণ সুস্বাদু ।
নীরদকাকাকে ঝিঙে বলল, “কাকা ঝাল করে এক প্লেট মশলা-পেয়ারা বানিয়ে দাও ?“
হাসিচ্ছ্বলে নীরদকাকা বলল, “আজ তোর পেয়ারা খাওয়ার সখ্‌ । অথচ এতদিন প্লাটফর্মে কাটালি, একদিনও তুই আমার দেওয়া পেয়ারা মাখানো খেলি না । একটু অপেক্ষা কর্‌ আমি সুন্দর করে পেয়ারা মাখিয়ে দিচ্ছি ।“
মাখানো পেয়ারার প্লেট নিয়ে প্লাটফর্মের গাছের নীচের বেঞ্চে বসলো ঝিঙে । প্লাটফর্ম খালি । এখন কোনো ট্রেন ঢোকার সময় নয় । আরামে ঝাল ঝাল করে মাখানো পেয়ারা ঝিঙে তৃপ্তি করে খাচ্ছে ।
হঠাৎ !
হঠাৎ রক্ত । রক্ত দেখে ঝিঙে ভয় পেয়ে গেলো । আয়েশ করে পেয়ারা খাওয়ার পর্ব মাথা থেকে উধাও !
হঠাৎ শরীর থেকে রক্ত কেন, ঝিঙের বোধগোম্য হচ্ছে না । অথচ রক্ত যেখান থেকে ঝরছে সেটা কাউকে বলা যাবে না । খুব লজ্জাজনক পরিস্থিতি । কিন্তু রক্ত থামছে না । কী করবে ঠাহর করতে পারছে না । ঝিঙের ভীষণ ভয় করছে । বেঞ্চে চেপে বসে রইলো । উঠতে গেলে বেশী রক্ত । কীভাবে কাকে বলবে সেটা ঝিঙের মাথায় কাজ করছে না ।
কান্না জুড়ে দিলো ঝিঙে ।
নীরদকাকা ঝিঙের অস্বস্তি দেখে তার দিকে এগিয়ে গেলো ।
“কী হয়েছে ঝিঙে ? তুমি জড়সড় হয়ে বসে রয়েছো কেন ?” নীরদকাকা জিজ্ঞাসা করলো ।
বেঞ্চের উপর রক্ত দেখিয়ে ঝিঙে অস্ফুট স্বরে বলল, “কাকা, রক্ত !”
নীরদকাকা কোনো কিছু না ভেবে সোজা পটলকে ডেকে প্লাটফর্মে নিয়ে এলো । ঝিঙের ভীষণ কান্না । ব্যাপারটা পটলও বুঝতে পারছে না । বেঞ্চে কীসের রক্ত, সেটাও ধরতে পারছে না ।
ঝিঙেকে জিজ্ঞাসা করলো পটল, “কাঁদছিস কেন ?”
পুনরায় হাউ হাউ করে কান্না ! তারপর ঝিঙের মুখ দিয়ে সেই এক কথা, “দাদা, রক্ত ?”
পটল বোনকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বললেও ঝিঙে সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না । তার কাছে ঘেঁষতেও দিচ্ছে না । আচ্ছা জ্বলাতন !
কী বিপদ ! কী করবে বুঝতে পারছে না পটল । এইরকম সমস্যার সম্মুখীন পটল আগে কখনও হয়নি । বোনের শরীর থেকে কেন রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে তার ক্ষুদ্র মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না । রক্ত কোথা থেকে বের হচ্ছে, ঝিঙেও ঘুণাক্ষরেও সেটা বলছে না । পটল আর ধৈর্য রাখতে পারলো না । বোনকে বকাবকি শুরু করে দিলো ! পটলের চিৎকার চেঁচামেচিতে কয়েকজন লোক জড়ো হয়ে গেলো । জড়ো হওয়া লোকের মধ্যে থেকে একজন কলেজ পড়ুয়া মেয়ে এগিয়ে এসে পটলকে বলল,”দাদা, আপনি ঘাবড়াবেন না । আমি আপনার বোনের রোগটা বুঝতে পারছি । সমস্ত মেয়েদের জীবনে এই রোগটা আসে । বিশেষ করে আপনার বোনের বয়সের মতো মেয়েদের জীবনে ঘটনাটা ঘটে । এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা । উল্লেখ থাকে যে, আমার জীবনেও আমি এইরূপ ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলাম ।“
তারপর একটা কাগছে লিখে দিয়ে কলেজ পড়ুয়া মেয়েটি পটলকে সত্ত্বর নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করলো ।
মেয়েটি উপস্থিত মানুষজনকে সরিয়ে দিয়ে ঝিঙের পাশে গিয়ে বসলো । ঝিঙের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে বোঝালো, “এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই । মাসে বা একটা নির্দ্দিষ্ট সময়ে শরীরে এই ঘটনা ঘটবে । সেই ক্ষেত্রে আমি তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি, কী করতে হবে ?”
কলেজ পড়ুয়া মেয়েটির কথায় ঝিঙে দুশ্চিন্তামুক্ত হল । তারপর তার দিকে তাকিয়ে ঝিঙে বলল, “আমার কোনো বিপদ হয়নি তো ?”
দূর পাগল ! মেয়েদের জীবনে এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা ।
তারপর পটলের আনা ন্যাপকিন দিয়ে বাথরুমে গিয়ে ব্যাপারটা ভাল করে ঝিঙেকে বুঝিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি এবার স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করো । কিচ্ছু ভয়ের কারণ নেই । তিন-চার দিন এই অবস্থা থাকবে । তারপর আবার স্বাভাবিক জীবনযাপন ।“
পটল কলেজ পড়ুয়া মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলো তার বোনের কী হয়েছে ? উত্তরে সে জানালো, “এটা মেয়েলি ঘটনা । আমার পক্ষে বলা সম্ভব না । তবে এটা মেয়েদের জীবনে একটা স্বাভাবিক ঘটনা । এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই ।“
পটলের জীবনে মেয়েদের সাথে মেলামেশার সুযোগ ঘটেছে কম । যার জন্য মেয়েলি রোগ সম্বন্ধে পুরোটাই অজ্ঞ । তবে পটল এটা বুঝেছে, কলেজ পড়ুয়া মেয়েটার জন্য তার বোনের সমস্যা সমাধান সম্ভব হল ।
কলেজ পড়ুয়া মেয়েটিকে পটল হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বলল, “ধন্যবাদ দিদি । আমার হৃদয়ের বোনটাকে সুস্থ করার জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ ।“
- (চলবে)