‘শিরোধার্য শোকধ্বনি’ এক মানবিক আত্মার ঘ্রাণে জারিত কাব্য : তৈমুর খান।

0
379

শুভঙ্কর দাসের ‘শিরোধার্য শোকধ্বনি'(২০২১) ৬৪ পৃষ্ঠার কাব্যগ্রন্থটি মোট ৫৬টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা প্রেমিদের কাছে একটা দারুণ সুখবর বৈকি! শুভঙ্করের প্রতিটি কবিতায় এক মানবিক আত্মার ঘ্রাণ পাওয়া যায়। যে আত্মাকে আমরা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বর্তমান সভ্যতার আলোকোজ্জ্বল রাজপথেও দেখতে পাই। আর সেই কারণেই ইতিহাস ও পুরাণের অন্তরাল থেকে চিরন্তন মানবাত্মার স্বরটিই বেরিয়ে আসে। মানবচৈতন্যের বৃহত্তর পথ খুলে দেয়। পৃথিবীরজন্মের প্রবাহে তখন সবাই শামিল হন।
কাব্যের প্রথম কবিতা ‘অনুরাগ’-এ কবি উল্লেখ করেন:
“অশ্রুর গায়ে হরপ্পার দাগ।
সেই চোখ থেকে উদ্ভাসিত আলো
যা প্রথম হৃদয়ের কথা বলে অন্ধ হয়ে গেছিল…..”
হরপ্পা সভ্যতাকে আজও অশ্রুর মধ্যে দিয়ে উপলব্ধি করার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। যে চোখ মানবিক সভ্যতার সাধনেই আলোকিত হয়েছিল। সেই চোখ ‘হৃদয়ে’ এসে অন্ধ হয়ে গেছে। এই অন্ধত্বই অনুরাগের কাছে সমর্পিত। অমরত্বের পুনরাবৃত্তি তো সেই ইতিহাস থেকে আসে না। পৌরাণিক বৃত্তেও তার সমর্থন নেই। মানবপ্রক্রিয়ায় রক্তমাংসের মন্থনে সূর্যোদয়ের আলোক সাম্যে তাই কবি নব উত্থানের কাব্য গরিমায় দীক্ষিত হতে চেয়েছেন। একে একে উঠে এসেছে: জন্মগাছে জল দেওয়া অগৌতমী সুজাতা, বুকের রক্তে ছবি আঁকা রামকিঙ্কর, আলোর চাকা হাতে স্বয়ং ঈশ্বর। ট্রাম লাইন বরাবর ভোরের জীবনানন্দকেও দেখতে পাই। তাঁর হরিণ, শিকারি, নারী, নবান্ন এবং ধান প্রভৃতি আশ্চর্য আলোয় অপ্রকাশিত কবিতা। কিন্তু মৃত্যুর চালক তাঁকে নিয়ে চলে গেছে ‘জন্মকে সার্থক’ করে। ‘জীবনানন্দ’ কবিতায় কবি লিখেছেন:
“হরিণ এবং শিকারির ঘামের মধ্যে,
নারী এবং পাখির ডানার মধ্যে,
নবান্নের ধান আর সবুজ নদীর মধ্যে—
কেউ জানে না, কেন কবিতাটি প্রকাশ পেল না!”
জীবনানন্দ যে বিপন্ন বিস্ময়ের বিমূঢ় এক কবি এখানে তারই ইঙ্গিত আছে। কিন্তু মানবসভ্যতার চক্রে অনবদ্য শ্রমের মহিমাই মহামানবের জন্ম দিতে পারে। তাই পান্তাভাত-নুনলঙ্কার মধ্যে দিয়েই মহামানবের পথের সন্ধান পান কবি। গৌতম বুদ্ধ থেকে হযরত মুহাম্মদ, রামকৃষ্ণ পরমহংস সব মনীষী লোকেরই প্রত্যার্পণ ঘটে। জন্ম-মৃত্যুর স্তর সরিয়ে জেগে ওঠে সভ্যতা, যাকে ‘পালাবদল’ বলেছেন:
“শুধু মানুষের জন্ম আর মৃত্যু
তার মাঝখানে আকাশছোঁয়া মাটি, মাটি নরম নদী, নদী ব্যাকুল নৌকা,
নৌকার দোলন জন্ম-মৃত্যু
মধুর গৃহ আর গৃহগহন চাষবাসের জন্য এত দূর আসা”
এই জীবন প্রবাহ, এই সভ্যতা নির্মাণ যে চাষবাসের ক্রিয়ায় সর্বব্যাপী জাগরণ তা বলাই বাহুল্য।
‘শীত রোদের কবিতা পড়তে পারে’ চমৎকার উপলব্ধি কবির। আত্মজীবনীর পাতায় ধানক্ষেত এবং নৈঃশব্দ্যের একটা স্পেসও উপলব্ধি করার প্রবণতায় সভ্যতাগামী জীবনাচারের পরিচয় বহন করে। চোখের জলের শব্দে নৌকার ভেসে যাওয়াও এক উত্তরণের মাধুর্যে বিষাদকে জয় করার আনন্দ। যেখানে নতুন ভোরের ডাক শোনা যায়। যেখানে রাক্ষসদের প্রসব যন্ত্রণা থাকে না।
‘আয়ুর কথোপকথনে’ ছায়াছবির মতো অতিজীবনের প্রচ্ছায়ায় স্বয়ংক্রিয় অভিযাপন দেখতে পাই:
“নদী ভেঙে সেতু, সেতু ভেঙে ঋত্বিক ঘটক”
রিয়ালিজমের অতীত জাদুবাস্তবের আবহ তৈরি হয়। আর এই ‘সেতু’ বাঁচারই এক উচ্চারণ, যাকে ‘জীবন’ বলা চলে। সভ্যতার সীমাহীন অন্তরায়কে মিলিয়ে দেয় এই সেতুই। এই ‘সেতু’ই অর্থাৎ জীবন ভেঙেই ঋত্বিকের ছবি নির্মিত হয়। কান্নাজমা বুক, দুঃখকে মালা পরানো জীবন অনন্তের সন্ন্যাসী হয়ে জেগে থাকে। ‘ভাত’ লেখার পর ‘ক্ষুধা’ ক্রিয়াটিও সক্রিয় হয়ে ওঠে। তেমনি ‘অমরত্ব’ও মৃত্যু থেকেই আসে। পরমান্ন পৃথিবীর সন্ধান এভাবেই চলতে থাকে। অসংখ্য বিষয় নিয়ে কবি মণীন্দ্র সরণির দেখা পান। সবই পাণ্ডুলিপি হয়ে যায় তখন। দুর্বোধ্য কবিতার প্রবেশ পথে দেবতাদেরও চৈতন্য প্রার্থনা তখন।
বাংলা কবিতায় এক মগ্ন অভিভাষাকে শুভঙ্কর চৈতন্যের বৃহত্তর স্পেসে নিয়ে যেতে পেরেছেন। কবিতাগুলি তাই ভারমুক্ত অথচ নিবেদিত প্রজ্ঞাসুন্দরের সংকেতের অভিজ্ঞান হয়ে উঠেছে। আলাদা করে তাঁকে চেনা যায়। শব্দগুলির প্রতীকী ব্যবহার এক ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। সায়েন্স ফিকশনের বিখ্যাত লোমহর্ষক আমেরিকান লেখক স্টিফেন কিং(জন্ম:১৯৪৭) বলেছিলেন:
“Symbolism exists to adorn and enrich, not to create an artificial sense of profundity.”
(Stephen King, On Writing: A Memoir of the Craft)
অর্থাৎ প্রতীকতত্ত্ব সজ্জিত এবং সমৃদ্ধ করার জন্য বিদ্যমান, গভীরতার একটি কৃত্রিম অনুভূতি তৈরি করার জন্য নয়।
শুভঙ্করের প্রতীকায়িত শব্দ ব্যবহার সম্পর্কে এ কথার সত্যতা প্রমাণিত।’বক’ কবিতায় তাঁর চিত্রকল্প ব্যবহার সম্পর্কে বলেছেন :
“এ কি শুধু আকাশের ছবি? না, এমন একটা অন্তরের
যেখানে চৈতন্য নড়েচড়ে বসে।
সমুদ্রের গভীরতার চেয়েও গভীরে, পর্বতের স্থিরতার চেয়েও
স্থিরসুন্দরে। গাছের পাতার চেয়েও সপর্যা সবুজে।
এমন একটা চক্ষুজন্ম, যেখানে সমগ্র আলো দিয়ে বিন্দু আঁকা যায়
সেই বিন্দু দিয়ে গোটা ব্রহ্মাণ্ড
এক পলকে ছোঁয়া যায়, বানানো যায় নতুন করে।”
শুভঙ্কর মানবচৈতন্যের গভীরে এই দৃশ্য প্রতিস্থাপন করতে পেরেছেন। যত ক্ষুদ্রই হোক তা ব্রহ্মময় অনন্তের শরিক। তাই তাঁর উচ্চারণ সাময়িকতাকে অতিক্রম করে চিরন্তনতায় পৌঁছে দেয়। প্রত্নবিশ্বাসের আলোকশস্যকে তিনি সভ্যতার দিগদিশারি মহাজীবনের অভিমুখ করে তুলেছেন। আর সেই কারণেই বলতে পেরেছেন :
“মহাকালের মুখে স্নানঘরের পর্দা টানা
একটি নৌকা এল, শেষদিনের পোশাক ভরে…”
এ গল্পের সূচনা ও সমাপ্তি নেই। এই গল্পেই জীবন ফুটে ওঠে। গৌরব ও গুপ্তধন আশ্রয় পায়। জন্মদ্বার খুলে দেয় নতুন জন্মের। মৃত্যু ও জন্মান্তরে জীবনের পর্যটন চলতে থাকে। দার্শনিক শুভঙ্করক আরও স্পষ্ট হয়ে পরিচিতি পান বাংলা কবিতা পাঠকের কাছে। ভগীরথ সর্দারের সুন্দর প্রচ্ছদ কাব্যটির উৎকর্ষ এনে দিয়েছে।
————————————————-
শিরোধার্য শোকধ্বনি: শুভঙ্কর দাস
লিপি প্রকাশন, বাড়বড়িশা, কোলাঘাট, পূর্ব মেদিনীপুর-৭২১১৩৪,
মূল্য: ৮০ টাকা।

(ছবিতে কবি শুভঙ্কর দাস ও তাঁর কাব্যগ্রন্থ)

#বুকরিভিউ