গ্রীসের পথে পথে (ধারাবাহিক, পর্ব -১) : রাজাদিত্য ব্যানার্জী।

0
1500

কলকাতার বড়বাজারের মতন জায়গাটা । এক্সার্হিয়ার ( এথেন্স, গ্রীস ) থেকে বেশি দূর নয় । অলি গলির মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে বার বার দেখলাম মান্ধাতা আমলের বড় বড় সুইচ বোর্ড । মনে হয়েছিল এথেন্সে নয়, কলকাতায় আছি ।
অনেকে এসেছেন দেখা করতে আমাদের সঙ্গে । আমাদের থিয়েটার দেখতে | পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে গ্রীসে এসে জড়ো হয়েছেন নতুন জীবনের সন্ধানে ।

ওদের ভাষায় বেটার লাইফের সন্ধানে । বাংলায় শরণার্থী , ইংরেজিতে এলিয়েন । যুদ্ধ চলছে নিজেদের দেশে, খাবার নেই , মাথার ওপর ছাদ নেই, কিছুই নেই আছে অন্ধকার আর বেঁচে থাকার একটা প্রবল ইচ্ছে । হিল্লে করতে হবে ভগ্নপ্রায় জীবন । এরা সত্যিই এলিয়েন কারণ এদের আমরা মানুষ বলে গণ্য করিনা । ভিনগ্রহীদের মতন আচরণ করি এদের সঙ্গে ।

কেউ অনেক টাকা দালালকে দিয়েছেন, কেউ সস্তা পঁচা কাঠের নৌকো বানিয়ে কোনমতে নির্মম নিষ্ঠুর ভূমধ্য সাগর পেরিয়ে গ্রিসের মাটিতে পা দিয়েছেন । তবু বিপদ কাটেনি, থাকবেন কোথায় ? খাবেন কি ? কেউ পারেননি । ভূমধ্য সাগরেই সলীল সমাধি হয়েছে ।
শিশুরাও বাদ যায়নি ।

থেমে গেছে অনেক জীবন যাদের নাম আমরা কোনদিন জানবনা বা জানতে চাইনি , চিনতে চাইনি তাঁদের , ভাগ করে নিতে চাইনি তাদের পাওয়া না পাওয়ার গল্পগুলো । অভিমানে সলিল সমাধী হয়েছে ওদের । তাতে কি এসে গেল ইউরোপের ? পৃথিবীর কি কিছু কী এসে যায় ?
এর মধ্যে অনেক শিল্পী ছিলেন । সলিল সমাধি তাদের কাছে সৃজনে থাকার মতন ।

চোখ বুঁজে ভাবুন , ভাববার চেষ্টা করুন । একটি ১০ X ১০ ঘরের মধ্যে ২৭ জনের থাকার জায়গা হয়েছে। ১-২ বাথরুম । বেঁচে থাকা একেই বলে বোধহয় ? বাচ্চারা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, মাঝে মধ্যে তাঁদের ঘুম ভাঙ্গেনা ।মনোবিদরা বলেন ট্রমা । বাসনা, ভালোলাগা গুলোকে পকেটে পুরে নিয়ে ওরাও পাড়ি দিয়েছে অজানা অচেনা আরেকটা ব্রহ্মান্ডে । এই গ্রহ ওদের কিছু দেবেনা, ওরা কিছু পাবেনা ।

কোটি কোটি টাকা ডলার , ইউরো , টাকা খরচ করে গবেষণা হবে কি ভাবে দারিদ্র দূর করা যায় । গবেষণা হবে হিউমান ডিগনিটি ও রাইটস এর ওপর । পৃথিবীর বুকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত কিন্তু গবেষণা শেষ হবেনা । এলিট প্রতিষ্ঠানের এলিট গবেষকরা জানবেন না কোনওদিন গৃহহীন , ক্ষুদার্ত হয়ে থাকতে কেমন লাগে কিন্তু প্রিন্টারের কালি ও পাতা নষ্ট করেই চলবেন । পাবেন নানান পুরস্কার । এলিয়েনরাও পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হবেন না । মৃত্যু , ক্ষিদে , যুদ্ধ থেকে পালিয়ে বেড়ানো কি কম বড়ো পুরস্কার |

ওরা আর উঠবেনা । বাকিরা কোনদিনই প্রায় ঘুমোতে পারেনা। হিটলারের মতাদর্শে বিশ্বাসী গোল্ডেন দন পার্টির সমর্থকেরা তাঁদের ঘুমোতে দেয়না । দিনের পর দিন বোমা পড়ে রেফিউজি শেল্টারে । পার্টির গুন্ডারা বোমা মারেন পরিত্যক্ত বাড়িতে যেখানে ওরা আশ্রয় নেয় । এই ভাবে কাটে ওদের সকাল সন্ধ্যে । এর মধ্যে এসাইলাম না দেওয়া হলে পুলিশ ফেরৎ পাঠিয়ে দেয় নিজেদের দেশে । আবার প্রচেষ্টা শুরু হয় ইউরোপে প্রবেশ করার– এই গল্পের শেষ কোথায় ওরাও জানেনা | জানবেও না । শুধু জানে থেমে থাকার নাম মৃত্যু , তাই এগিয়ে যেতেই হবে যে ভাবে হোক ।

হাসিমুখে আমাকে ওরা বলল ওয়েলকাম টু গ্রীস । ওদের বাড়তি পাওনা গ্রীসের ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সংকট । দেউলিয়া একটি দেশে দেউলিয়া কয়েক লক্ষ্য মানুষ নতুন জীবনের সন্ধানে এসেছেন । এ কেমন পৃথিবীতে বাস করছি আমরা ? যেখানে রাজনীতিবিদরা বলেন ড্রোন ও ফাইটার জেট দিয়ে এলিয়েনদের রুখতে হবে ? তাঁদের কি আশ্রয় দেওয়া যায়না ? নতুন জীবন উপহার দেওয়া যায়না ? প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে অর্থনীতি কাদের জন্যে ? মানুষই যদি না বাঁচে লাভ ক্ষতির হিসেব করবে কারা ?

আসল প্রশ্নটা কিন্তু কেউ করছেনা : কেউ কি নিজের ইচ্ছেয় বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে চায় ? তারা বাধ্য হন

এত অন্ধকারের মধ্যে আলো দেখাচ্ছেন কিছু সাধারণ মানুষ কিছু গ্রিক দ্বীপে ও অস্ট্রিয়াতে ভিয়েনা শহরে । আশ্রয় দিয়েছেন এই এলিয়েনদের , শীতের পোশাক, খাবার ও ভাষা শেখাচ্ছেন যাতে রুজি রোজগারের ব্যবস্থা করতে পারেন এই এলিয়েনরা । এলিয়েনই বটে! অন্য গ্রহের বাসিন্দা বলে কথা ।
এরা মানবিকতা দেখাতে পারলে আমরা পারবনা কেন ? সরকার কেন পারবেনা ? মানবিকতা কি তাহলে এক ডাইনোসর যে বিজ্ঞাপনের ভিড়ে হারিয়ে গেছে ।

নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল , খুব রাগ হচ্ছিল । ক্রিস্টাল বলটা নেই কেন আমার কাছে ? বদলে দিতে পারিনা কেন সবকিছু নিমেষে ? জীবন অনেকগুলো অসহায়তার বীজ বুনে দিয়েছে আমার মনে , শরীরে ।
কলের পুতুলের মতন সিন্তাগ্মার দিকে রওনা দিলাম । মনে পড়ছিল মহিনের ঘোড়াগুলির সেই গানের লাইনটা

…..” তাই তো বলি আমায় বরং ঘেন্না করো,
ঘেন্না করো ”
__________________________________
©️ রাজাদিত্য ব্যানার্জী
ছবি । এথেন্সে রাজাদিত্য ব্যানার্জী |
খিচিক : কাইকু নেনা গ্রেসা
ফিলাডেলফিয়া বিমানবন্দর , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
০২ জুলাই ২০১৫ , বিকেল ০৫.৪৩ মিনিট
*রিপোস্ট , অনেকে পড়তে চেয়েছিলেন