বাঙালি জাতীয়তাবাদী নজরুল :: অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায়।।

“পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!”
নজরুল তাঁর লেখা নিছক কাব্য করতে হবে বলেই লেখেন নি। এমন কি কালোত্তীর্ণ হবার কোনও বাসনাও তাঁর ছিল না। ছিল সমাজের প্রতি, জাতির প্রতি একটা দায়বদ্ধতা। সারা জীবন খুব একটা সুখে কাটেনি তাঁর। সোনার চামচ মুখে নিয়ে তো জন্মান নি। উপরন্তু আশৈশব লড়াই করে গেছেন। মাত্র আট বছর বয়সে পিতৃ বিয়োগ। তারপর কখনো রুটির দোকানে চাকরি, কখনো মসজিদের মুয়াজ্জিন আবার কখনো লেটো দলে কাজ। সাহিত্যের জগতে পা রাখা বোধহয় এই লেটো দলের বিভিন্ন নাটকের জন্য গান ও কবিতা লেখার মধ্য দিয়েই। তারপর ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান। সেখান থেকে ফিরে সাংবাদিকতা। এমন বর্ণময় অথচ মাটির কাছাকাছি থেকে নিরন্তর সংগ্রাম তাঁকে সমাজের প্রতি এতোখানি দায়বদ্ধ করে তুলেছিল।
নজরুল ইসলামের বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহিদা খাতুন। বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাযারের খাদেম। দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করা নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মভিত্তিক। অথচ, তাঁর সমগ্র জীবনকে চর্চা করলে দেখতে পাওয়া যাবে তিনি যতখানি মুসলমান, ঠিক ততখানিই হিন্দু। আবার সমগ্র ধর্মীয় গোঁড়ামির উর্ধে তিনিই দৃপ্তকন্ঠে বলতে পারেন, ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনও মন্দির-কাবা নেই’। বাংলার নবজাগরণের যে ঐতিহ্যের সূত্রপাত বাঙালির রাম রাজা রামমোহনের হাত ধরে, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ হয়ে সেই মশাল বহন করে নিয়ে গেছেন নজরুল।
আজীবন রাজনৈতিক ভাবে সচেতন এক ব্যক্তি নজরুল। সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনায় বিশ্বাস রাখতেন তিনি। নজরুলের এক হাতে ‘বাঁকা বাঁশের বাঁশরী/ আর হাতে রণ-তূর্য।’ অজস্র রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও নজরুলের জীবন আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ করলে বুঝতে বাকি থাকে না বাঙালি জাতীয়তাবাদ তাঁর হাত ধরেই বাঙালির মননে প্রবেশ করেছে। দ্বিজাতি তত্ত্বের শরাঘাতে বিভক্ত যে জাতি, তাকে কেবলমাত্র বাঙালির পরিচয়ে একত্রিত করার গান গেয়ে এসেছেন আজীবন। জাতীয়তা বনাম সম্প্রদায়বাদী চেতনাই যে দেশীয় রাজনীতির প্রধান দ্বন্দ্ব্ব সেটা বুঝতে তাঁর বাকি ছিল না। তাই তাঁর সাধনা ‘সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তা’র সাধনা। এই সাধনা তাঁর কাব্য সৃষ্টি ও রাজনৈতিক কর্মে উদ্ভাসিত। মত ও পথ বদলেছে, কিন্তু বদলায় নি গন্তব্য। তিনি কখনও গান্ধীবাদী, কখনও স্বরাজ্যপন্থি, কখনও বিপ্লববাদী, কিন্তু বরাবরই সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী, এমনকি সাম্যবাদী হয়েও ওই একই নিশানা তার।
“বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে- ‘বাঙালির বাংলা’ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে। বাঙালির মতো জ্ঞান-শক্তি ও প্রেম-শক্তি (ব্রেন সেন্টার ও হার্ট সেন্টার) এশিয়ায় কেন, বুঝি পৃথিবীতে কোনো জাতির নেই। কিন্তু কর্ম-শক্তি একেবারে নেই বলেই তাদের এই দিব্যশক্তি তমসাচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাদের কর্ম-বিমুখতা, জড়ত্ব, মৃত্যুভয়, আলস্য, তন্দ্রা, নিদ্রা, ব্যবসা-বাণিজ্যে অনিচ্ছার কারণ। তারা তামসিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে চেতনা-শক্তিকে হারিয়ে ফেলেছে”। বাঙালির বাংলা প্রবন্ধে এই উক্তি নজরুলের নিজের। আবার একই প্রবন্ধে আরেক জায়গায় তিনি বলছেন, “বাংলা সর্ব ঐশীশক্তির পীঠস্থান। হেথায় লক্ষ লক্ষ যোগী মুনি ঋষি তপস্বীর পীঠস্থান, সমাধি; সহস্র ফকির-দরবেশ অলি-গাজির দর্গা পরম পবিত্র। হেথায় গ্রামে হয় আজানের সাথে শঙ্খঘণ্টার ধ্বনি। এখানে যে শাসনকর্তা হয়ে এসেছে সেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। বাংলার আবহাওয়ায় আছে স্বাধীনতা-মন্ত্রের সঞ্জীবনী শক্তি। আমাদের বাংলা নিত্য মহিমাময়ী, নিত্য সুন্দর, নিত্য পবিত্র”। এই লাইনগুলো পড়েও কাজী নজরুল ইসলামের মূল রাজনৈতিক আদর্শ যে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল, এটা বুঝতে বাকি থাকে না। বাঙালিকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান কাজী নজরুল ইসলামই দান করেন। এই কবিতায় তিনিই লিখলেন,
“জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ!
জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন!”
এই কবিতার ছত্রে ছত্রে বাংলা ও বাঙালিয়ানার জয়গান গাওয়া হয়েছে। এই জয়গানই পূর্ব পাকিস্তানের শেখ মুজিবর রহমানকে প্রেরণা জোগালো বাঙালি জাতিয়তাবাদে নেতৃত্ব দিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠার। বর্তমান পশ্চিম বর্ধমান জেলার ছোট্ট গ্রামে জন্মানো সেদিনের সেই ছোট্ট দুখু মিঞা আজ দুই বাংলার অগণিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের মুল প্রেরণা।

(প্রাবন্ধিক অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায় ডাঃ বি.সি. রায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সহকারী অধ্যাপক। অধ্যাপনার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চার নেশা। প্রবন্ধ ছাড়াও গল্প এবং কবিতার জগতও তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘সলতে’, ‘আমাদের পঞ্চম’কার সাধন’, ‘পিওনি ফুলের বিপরীতে’। সুরজিত ও বন্ধুরা কবিতা ক্লাব থেকে পেয়েছেন ‘কলমকার’ সম্মাননা। রাজ্য যুব ও ক্রীড়া দফতর থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন ছোটগল্পকার হিসেবে।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *