সৈয়দ শাহ হোসেন কেরমাণির ঊরসে হাজার হাজার ভক্তের সমাগম।

আবদুল হাই, বাঁকুড়াঃ প্রতিবছর আজকের দিন অর্থাৎ ১২ চৈত্র সর্বধর্মের মহামিলনের তীর্থক্ষেত্র হয়ে ওঠে বাঁকুড়ার ইন্দাস থানার কড়িশুন্ডা গ্রাম। এদিন দূর-দূরান্ত থেকে কয়েক হাজার ভক্ত ছুটে আসেন সৈয়দ শাহ হুসাইন কেরমাণি (রহমত উল্লাহ আলাইহে ) সাহেবের পবিত্র উরুষ উৎসবে যোগ দিতে। এদিন রাতভর চলে জলসা। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, ঈসাই সব ধর্মের মানুষ বাবা হোসেন কোরমাণির মাজারে এসে মনবাসনা জানান। তার আগে বাবার চাদর মাথায় নিয়ে করিশুন্ডা গ্রাম পরিক্রমা করেন ভক্তরা। রীতির এই ধারাবাহিকতা চলে আসছে শতাব্দী পার করে।

বাবা সৈয়দ শাহ হুসাইন কেরমাণির এই জলসা ১৯৯০ সাল পর্যন্ত পরিচালনা করে এসেছেন সৈয়দ পরিবারের সৈয়দ শামসুল হুদা ( রহমত উল্লাহ আলাইহে ) সাহেব। এরপর মহামিলনের এই ঊরসের হাল ধরেছেন করিশুন্ডা দরবার শরীফের আলহাজ্জ সৈয়দ রুহুল হুদা সাহেব। বর্তমানে ১৯৯১ সালে প্রয়াত পীরজাদা সৈয়দ শামসুল হুদা ( রহমত উল্লাহ আলাইহে ) সাহেবের একটি মাজার তৈরি করা হয়েছে করিশুন্ডা গ্ৰামে। শামসুল হুদা সাহেবের ভক্তরা এসে সেখানে মনস্কামনা জানিয়ে চাদর চড়ান। এক্ষেত্রেও ধর্মীয় কোনো ভেদাভেদ এই সৈয়দ পরিবার রাখেনি।

পীরজাদা সৈয়দ নুরুল্লাহ কোরমানি জানান আজ এই ধর্মীয় সভা জলসায় অংশগ্রহণ করতে এবং শান্তির বার্তা দিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৫০-৬০ হাজার মানুষ কড়িশুন্ডায় উপস্থিত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন ‘আজ ১২ চৈত্র, এই দিনে আমাদের পূর্বপুরুষ
সৈয়দ শাহ হোসেন কেরমাণি (রহমত উল্লাহ আলাইহে ) কড়িশুন্ডায় এসেছিলেন বিশ্ব শান্তির বার্তা নিয়ে। তিনি ইরান দেশের কেরমান শহর থেকে এখানে এসেছিলেন’।

বাবা কেরমাণি সাহেবের এই কড়িশুন্ডা গ্রামে প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে রয়েছে একটি কাহিনি। যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ বংশের রাজ। কথিত রয়েছে, ১৫০০ শতাব্দীর কোনো এক সময় ইরানের কেরমাণ শহর থেকে পরিব্রাজক হিসাবে বাবা সৈয়দ শাহ হোসেন কেরমানি এই কড়িশুন্ডা গ্রামে এসে পড়েন। এখানেই তিনি কিছুদিন বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নিয়ে আস্তানা গাড়েন। তখন ইন্দাসের এই অঞ্চল ছিল জনমানবহীন। এখানের সমস্ত এলাকাটাই ছিল বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের অধীনে।

প্রচলিত ইতিহাস, সেই সময় মল্লরাজা মন্ত্রী, সেনাপতি, পাইক-পেয়াদা এবং পারিষদদের নিয়ে ওই পথে গঙ্গাস্নান করতে যেতেন। একদিন পীরজাদা রাজার ওই পারিষদদের থামিয়ে জিজ্ঞাসা করেন তাঁরা এই বিশাল লোকলশকর নিয়ে কোথায় চলেছেন। যখন তিনি জানলেন যে রাজা চলেছেন গঙ্গাস্নান করে পূণ্যার্জন করতে তখন বাবা সৈয়দ শাহ হোসেন কেরমাণি রাজাকে বলেন ‘গঙ্গা তো এখান থেকে বহু দূরে। এতটা পথের ক্লান্তি নিয়ে রাজামশাই যাবেন শুধুমাত্র গঙ্গাস্নান করতে! তিনি যদি এখানেই রাজাকে ওই গঙ্গাস্নান করানোর ব্যবস্থা করেন তাহলে কি মল্ল নৃপতি রাজি হবেন?’ শুনে রাজা অবাক হয়ে ভাবেন, তা কিভাবে সম্ভব? বাবা তখন দৈব বলে রাজাকে সেখানেই গঙ্গাস্নান করান। মল্লরাজ বুঝতে পারেন পীরজাদা কোনো সাধারণ মানুষ নন। তিনি তখন বাবা সৈয়দ শাহ হোসেন কেরমাণিকে প্রণাম করে তাঁকে ওই অঞ্চলের ২২০০ বিঘা নিষ্কর জমি দান করেন। এখনো সেই জমি রয়েছে সৈয়দ পরিবারের হাতে। সেখানেই রয়েছে সৈয়দ শাহ হোসেন কেরমাণির পবিত্র মাজার। মানুষ তাঁদের মনবাসনা নিয়ে আজও বাবার মাজারে চাদর চড়ান। নিয়মিত ধূপ আর মোমবাতি জলে ঘুমিয়ে থাকা বাবার মাজারে। প্রচলিত ইতিহাস বা কথিত কাহিনির ঊর্ধ্বে উঠে সব ধর্মের শান্তির মিলন এসে মেশে সৈয়দ শাহ হোসেন কেরমাণির এই মাজারে। আর বাবার আগমনের দিনটাকে বিশ্বশান্তির দিন হিসেবে চিহ্নিত করে আয়োজন করা হয় ঊরস। বর্তমানে আলহাজ্জ সৈয়দ রুহুল হুদা সাহেব এই ঊরস পরিচালনা করে আসছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *