“আমি চিনি গো চিনি তোমারে , ওগো বিদেশিনী”- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই বিদেশিনীকে কি করে চিনেছিলেন .. আর সেই বিদেশিনীই কে ছিলেন ? : কামনা দেব। 

0
405

আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী..
-গানটি লেখার প্রায় ৩০ বছর পর লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনায় যান । তখন কবি তার সেই বিদেশিনীকে খুঁজে পান। সেই বিদেশিনী হলেন, আর্জেন্টিনার এক নারীবাদী লেখিকা ও সাহিত্যিক *ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো* ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সাহিত্যের হাত ধরেই সেই বিদেশিনীর পরিচয়। যদিও কবি সেই বিদেশিনীকে *বিজয়া* নামে পরিচয় করান। সেই বিদেশিনী *বিজয়া*-ই হোক বা *ভিক্টোরিয়া* তবে রবিঠাকুরের সঙ্গে এক গভীর বন্ধুত্ব ছিল । অনেকে অবশ্য তখন এই বন্ধুত্বকে প্রেম বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন। সাত সমুদ্র তেরো নদী পারের এক বিদেশিনীর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কখন কীভাবে এমন রহস্যময় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল,তা আজও রহস্যে ঘেরা। তবে এই রহস্যের উত্তর জানতে গিয়ে যতটুকু অতীত নজরে আসে তা হলো, —
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর ভিক্টোরিয়ার হাতে এসে পৌঁছয় *গীতাঞ্জলী*- বইটির ইংরেজি, স্প্যানিশ ও ফরাসি ভাষার অনুবাদ। সেই গীতাঞ্জলী পড়ে ভিক্টোরিয়া বা বিজয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একজন পরম ভক্ত হয়ে যান রীতিমত। সেই সময় *ভিক্টোরিয়া* *রবীন্দ্রনাথ পড়ার আনন্দ* – নামে একটি লেখাও লিখে ফেলেন। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চেনার আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটে যায় ভিক্টোরিয়ার।

এরই মধ্যে ১৯২৪ সালে পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে পেরুর দিকে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু হঠাৎই মাঝপথেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে বাধ্য হয়ে কিছুদিন আর্জেন্টিনার *প্লাসা হোটেল*-এ থাকার সিদ্ধান্ত নিতে হয় কবিকে।
এদিকে কবি আর্জেন্টিনায় রয়েছেন সেকথা জানতে পেরেই পরম ভক্ত ভিক্টোরিয়া এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। তখন নভেম্বরের শুরুতেই একদিন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করতে চলে আসেন *প্লাসা হোটেল* ।
এরপর সেই হোটেল থেকে ‘মিলারিও’তে পৌঁছে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো একটি বাড়ি ভাড়া নেন।নিজের হীরের টায়রা বিক্রি করে।
সেই বাড়ির পাশ দিয়েই লা-প্লাতা নদী বয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেদিন মিলারিওর ভাড়া বাড়িতে পৌঁছলেন, সেদিনই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো *বিদেশী ফুল* নামে একটি কবিতাটি লিখেন। এরপরে ভিক্টোরিয়া পর পর আরো তিনটি কবিতা লিখেন , *অন্তর্হিতা*, *আশঙ্কা* এবং *শেষ বসন্ত*।
এই তিনটি কবিতায় এতই তীব্র প্রেমের প্রকাশ ছিল যে, কবিতাগুলি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশে তার পুত্র ও পুত্রবধূদের পাঠাতেও নিষেধ করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ এবং ভিক্টোরিয়া, মিলারিওর বাড়ির বারান্দায় একসাথে বসে কখনও সেই নদীর বয়ে চলা দেখতেন। আবার কখনও বাড়ির নিকট তিপা গাছের নিচে বসে আড্ডাও দিতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বাংলা কবিতা বিজয়াকে আবৃত্তি করে শোনাতেন । বিজয়াও শোনাতেন শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা। সেই সময়টাকে তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরোদমে উপভোগ করেছিলেন।
১৯২৫ সালে *ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো*-কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রকাশিত *পূরবী* কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেন। সেই উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছিলেন- *বিজয়ার করকমলে*।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে *পূরবী* বইটি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে উৎসর্গ করেছেন সেই খবরটি আর্জেন্টিনায় চিঠি লিখেও জানিয়েছিলেন এবং আক্ষেপ করে লিখেও ছিলেন, – *বইখানা তোমায় উৎসর্গ করা, যদিও এর ভিতরে কী রয়েছে তা তুমি জানতেও পারবে না।*
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে *Tagore en las barrancas de San Isidro * , একটি পুরো একটি বই লিখে ফেলেন । ১৯৬১ সালে সেই বই প্রকাশিত হয়। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সেই বই বাংলায় *সান ইসিদ্রোর উপত্যকায় ঠাকুর* বা *সান ইসিদ্রোর উপত্যকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকু*।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বায়োপিক *থিঙ্কিং অব হিম* সিনেমাতেও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো বা বিজয়ার সঙ্গে তাঁর সেই সখ্যতার কাহিনী উঠে এসেছিলো।

১৯২৪ সালে আর্জেন্টিনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর দেখা হওয়ার পর ১৯৩০ সালে আবার প্যারিসে দেখা হয় তাঁদের। প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ একটি চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। সেই সময়ে এটি ছিল অত্যন্ত খরচ-সাপেক্ষ এবং অনুমতি-সাপেক্ষ একটি বিষয়।

শোনা যায় এক বছর আগে থেকে আবেদন করলেই মিলত সেই প্রদর্শনী আয়োজনের অনুমতি। কিন্তু ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো মাত্র এক মাসের মধ্যে সেই অনুমতি সহ প্রদর্শনী আয়োজনের ব্যবস্থা করে দেন। সেখানে রবি ঠাকুরের ১২৫ টি ছবিই বিক্রি হয়। ছবি বিক্রির টাকা বিশ্বভারতী তহবিলে দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে বারবার শান্তিনিকেতনে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং একাধিক বার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো শান্তিনিকেতনেও আসেন বলে শোনা যায়।
এরমধ্যে একবার শান্তিনিকেতন ভ্রমণের কথা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো নিজেই লিখেছেন তাঁর লেখাতে। তবে দেখা না হলেও দুজনেই নিয়মিতই টেলিগ্রামে বার্তা আদান-প্রদান করতেন। একেবারে শেষ চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে লিখেছিলেন, -*এতোদিন পরে তোমার আমাকে মনে পড়ল – কী যে ভালো লাগছে! পৃথিবীর সব রঙ ফিকে হয়ে আসছে যখন, বিমর্ষ মন কেবল তাদের নৈকট্যই কামনা করে যাদের স্মৃতি সুখময় দিন গুলোর সাথে জড়িয়ে আছে। যতো দিন যায়, সেই স্মৃতিগুলো যেন গাঢ় হতে থাকে।*

এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, তখন তার পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো । নিজের গাড়িতে বসেই রেডিওর মাধ্যমে ঠাকুরের মৃত্যু সংবাদ জানতে পেরেছিলেন ভিক্টোরিয়া। মৃত্যুর চার মাস আগে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে ভেবে লেখা রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ পৌঁছে দিয়েছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কাছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বন্ধুত্ব বা সখ্যতা কেমন ছিল তা সত্যিই আর জানা যায় নাই। যদি তা বন্ধুত্ব হয় বা প্রেমই হয়, তবে সেটা ছিল এক নিষ্পাপ প্রেম বা প্লেটোনিক প্রেম। যা দুরত্ব আর বয়সের কাছে হার মেনেছিল । বাঁধনহীন এ প্রেম বা বন্ধুত্ব ছিল এক ঐতিহাসিক সম্পর্ক। তাতে এতটুকু অন্য কিছুরই ছোঁয়াও ছিল না।
—————————–‐———————————-
লেখাটি সংগ্রহীত তথ্যভিত্তিক
©️ কামনা দেব।™️ 08/05/2022

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here