সময়টা ১৮৯০ সাল । বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী তখন তাঁর সন্ন্যাসগুরুর আদেশমত ঘোর সন্ন্যাসব্রত পালন করে চলেছেন । পত্নীর থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে পত্নীকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছেন আগেই । কিন্তু স্বামীর থেকে দূরত্ব পত্নী যোগমায়াদেবী আর সহ্য করতে পারছেন না । ইচ্ছে প্রাণত্যাগ করার । তাই প্রায়দিন অনাহারে থাকা শুরু করলেন। যা-যা করলে শরীরে রোগব্যাধি হতে পারে তার সবই শুরু করে দিলেন। সেইসময় ঢাকায় মশার উপদ্রব। মশাবাহিত রোগের সংক্রমণ চারিদিকে।যোগমায়াদেবী মশারি পর্যন্ত নিতেন না ঘুমানোর সময় । অতএব, বোঝাই যাচ্ছে যে তাঁর অন্তরের অভিসন্ধি ঠিক কী ছিল । স্বাভাবিকভাবেই এসব শারীরিক অত্যাচারের দরুণ তাঁর শরীর শীর্ণ হতে থাকল, তিনি ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে পড়তে থাকলেন । একসময় তাঁর শারীরিক দশা এমন হল যে তা আর চোখে দেখা যায় না । অবশেষে তিনি পতিবিরহ সহ্য করতে না পেরে পত্র লিখলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর কাছে যাতে প্রভুপাদ তাঁকে বৃন্দাবনে আসার অনুমতি প্রদান করেন ।
ইতিপূর্বে লোকমুখে সব জেনে ও পত্র পাঠ করে অবস্থার গত্যন্তর না দেখে বিজয়কৃষ্ণ ফেরৎ পত্র লিখলেন এই বলে যে, অসুবিধা বিস্তর হলেও কিছু যখন আর করার নেই, তখন ঝুলন বা রাসপূর্ণিমার সময় যেন যোগমায়াদেবী চলে আসেন ব্রজে ।
যোগমায়াদেবী নিজের মাতৃদেবীর বারণ পর্যন্ত না শুনে পুত্র যোগজীবন ও কনিষ্ঠা কন্যা প্রেমসখীকে নিয়ে ব্রজে চলে এলেন । পথে অবশ্য জ্যেষ্ঠা কন্যা শান্তিসুধার কাছে দ্বারভাঙ্গায় কিছুদিন ছিলেন । তবে বৃন্দাবনে আসার পর স্বামীর যে সঙ্গসান্নিধ্য পাবার আশায় তিনি ছুটে এসেছিলেন, তা কিন্তু পাওয়া হল না । বিজয়কৃষ্ণ তাঁকে এড়িয়ে চলেন। এমনকি তাঁর সঙ্গে পূর্ব-পরিচিতা রমণীর প্রতি ব্যবহারটুকুও করেন না । স্বামীর এ উপেক্ষা আর সহ্য করতে পারেন না যোগমায়াদেবী । একদিন স্বামীকে এ প্রসঙ্গে বলায়, বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “আমি তো তোমায় আগেই বলেছি । তুমি বরং অন্যত্র বাসা ভাড়া নিয়ে থাকো । আমার সঙ্গ আর কোনদিনই পাবে না ।”
যোগমায়া দেবী অনেক ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, তিনি পতিদেবের থেকে দূরে থাকতে পারবেন না । শুধু দর্শনটুকু আর সেবার সুযোগটুকু দিলেই হবে। কিন্তু, বিজয়কৃষ্ণ বেশ রুষ্ট হয়েই জানিয়ে দিলেন, এ ব্যাপারে তাঁকে যেন আর বিরক্ত না করা হয় ।
যোগমায়াদেবীর এত মনঃকষ্ট হল যে, তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন আর কোনদিনও যাতে পতিদেবকে বিরক্ত করতে না পারেন এবার সে ব্যবস্থা করবেন নিজেই । গভীর রাতে তিনি যমুনায় ডুব দিয়ে মরতে গেলেন । কিন্তু, ঝাঁপ দিতে যাওয়ামাত্র বিজয়কৃষ্ণের দীক্ষা গুরুদেব স্বামী ব্রহ্মানন্দ পরমহংসজী বাধা দিলেন প্রকট হয়ে । সান্ত্বনা বাক্য বলে বুঝিয়ে বিরত করলেন এ সিদ্ধান্ত থেকে যোগমায়াকে তিনি । তখন যোগমায়াদেবী প্রাণ ত্যাগের ইচ্ছা পরিত্যাগ করে অলঙ্গবৈষ্ণবীর আখড়ায় গিয়ে উঠলেন ।
ওদিকে যোগমায়াদেবীর সন্ধান চলছে । পাওয়া যাচ্ছে না তাঁকে কোথাও। “আমি চললাম । তোমরা আমার আর অনুসন্ধান করো না।” —–এই লেখা ছোট্ট একটা চিরকুট পাওয়া গেল । সকলে ভীত হল এই ভেবে যে তাহলে বোধহয় আত্মহত্যা করেছেন যমুনায় ডুবে যোগমায়াদেবী । কারণ তিনদিন ধরে কোন খোঁজ নেই তাঁর । বিজয়কৃষ্ণ প্রভু তো পুত্র যোগজীবনকে আদেশই দিয়ে দিলেন, ভগিনীকে নিয়ে যেন ঢাকায় ফিরে যায় সে । আর সেখানে মন্দির গড়ে যোগমায়াদেবীর ব্যবহৃত বস্ত্রাদি রেখে পূজা করা হয় নিত্য ।
যখন মোটামুটি সকলে নিশ্চিত ইহলোকে আর যোগমায়াদেবী নেই—-তখন দাউজীর সেবাইত শ্রীদামোদর পূজারী এসে সংবাদ দিলেন শ্রীগোবিন্দের ঘেরায় অলঙ্গবৈষ্ণবীর আখড়ায় যোগমায়াদেবী বাস করছেন । সকলে স্বভাবতঃই নিশ্চিন্ত হলেন সে কথা শুনে ।
বিজয়কৃষ্ণ প্রভুপাদ ও আরও কয়েকজন মিলে গেলেন অলঙ্গবৈষ্ণবীর আখড়ায় । যোগমায়াদেবী ফেরৎ আসলেন । দাউজীর প্রসাদ পাবার পর বিজয়কৃষ্ণ আদেশ করলেন যোগমায়াকে প্রসাদ পেতে । কিন্তু, যোগমায়া তখনও অভিমানী হয়ে রইলেন । বিজয়কৃষ্ণ নিজের ভুল স্বীকার করলেন, বললেন, “বেশ। আমি ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে । যদি পারো ক্ষমা করে দিও।” এই শোনামাত্র যোগমায়াদেবী বললেন, “এসব আপনি কী বলছেন!এসব তো শোনাও আমার পাপ। না, না! আর একথা বলবেন না!” প্রসন্ন যোগমায়া স্বাভাবিক হলেন ।
এরপর থেকে এক বাড়ীতেই থাকতে লাগলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী ও যোগমায়াদেবী।
কিন্তু , এই ব্যাপার নিয়ে বৃন্দাবনের সাধুদের মধ্যে বিস্তর সমালোচনা শুরু হল । সাধু হয়ে পত্নীর সঙ্গে একত্র থাকেন ! এ তো ধর্মবিরোধী ব্যাপার ! সেসময় রামদাস কাঠিয়াবাবা এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করলেন সকলের কাছে— “মহারাজ সমর্থবান পুরুষ । পত্নীর সঙ্গে একত্র বাসে তাঁর সাধনে কিছুমাত্র ক্ষতি হয় না । তেজস্বীরা অনেক কিছুই করতে পারেন যা সাধারণেরা পারে না । তাঁরা অগ্নি ভক্ষণ করতে পারেন । বিষ হজম করতে পারেন । যেমন মহাদেব পেরেছেন। তাঁদের কর্মদোষ হয় না । গোস্বামীজী উর্দ্ধরেতা পুরুষ। নিষ্কাম তিনি । পত্নীর সঙ্গে একত্র বাস তাঁর কাছে কোন ব্যাপার নয় ।”
( ক্রমশঃ )
——-ভক্তকৃপাপ্রার্থিনী, সেবাভিলাষিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক