রীতি মেনে আজও হচ্ছে ৪৫০ বছরের পুরানো ভড়ার বড়মন্ডল পরিবারের দূর্গাপূজা।

আবদুল হাই, বাঁকুড়াঃ ৪৫০ বছরের পুরানো ভড়ার বড়মন্ডল পরিবারের দূর্গাপূজা::::::::: প্রবহমান কালের স্রোতে হারিয়েছে জমিদারী,নেই জমিদার‌ও।তবে বিষ্ণুপুর ব্লকের ভড়া গ্রামের বড়মন্ডল পরিবারের দূর্গাপূজা হারায়নি তার জৌলুস,অতিহ্য ও আভিজাত্য। কুলপুরোহিত পন্ডিত অজিত কুমার চক্রবর্তীর কথায় আনুমানিক ৪৫০ বছরের প্রাচীন এই দূর্গাপূজা আজ‌ও সমান জমজমাট।প্রাচীন নাটমন্দির,নহবতখানা আর বহু স্মৃতি বিজড়িত এই দূর্গা দালানে আজ‌ও সমান ভাবে পূজিত হন দেবী দুর্গা।‍ @@@@@@কথিত আছে আজ থেকে ৪০০-৪৫০ বছর পূর্বে বর্গী আক্রমনের সময় অধুনা কোতুলপুরের লাউগ্রাম থেকে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের নির্দেশে ভড়া গ্রামে আসেন লুইধর বাবুর পরিবার।তখন এই ভড়া গ্রাম ছিল ঘনজঙ্গলাকীর্ণ বর্ধমান মহারাজাদের অধীন একটি তালুক বা এলাকা।”ভড়” নামক এক চন্ডাল জনজাতির বাস ছিল।তারা বেশীরভাগই পশুপাখি শিকার করে জীবন নির্বাহ করত।লুইধরের পৌত্র গোপাল মন্ডল একদা পেটের ব্যামোয় প্রাণ ওষ্ঠাগত কিছুতেই সারে না।চাষের হালধরার পর্যন্ত ক্ষমতা নেই শরীরে। তখন গোপালবাবুর স্বপ্নাদীষ্ট হয়ে বিষ্ণুপুরের মা মৃন্ময়ী তাকে শক্তিপূজার বিধান দেন। তখন‌ও পাকাপাকিভাবে জমিদার হয়ে ওঠেননি গোপালবাবু। কিন্তু মায়ের সপ্নাদেশ, খড় ও তালপাতার ছাউনী দিয়ে তৈরি করা হল দূর্গামন্দির।পুকুরের পদ্মফুলের ভ্যাট ও চাষের গুড় দিয়ে তৈরি হল মায়ের প্রসাদ “ভ্যাটলাড়ু”।যা পরবর্তী অনেক দশক ধরেই মাকে নিবেদন করা হতো। শোনা যায় মাতৃআরাধনার ফলস্বরূপ গোপালবাবুর পেটের ব্যামোও সেরে যায়,ফুলে ফেঁপে ওঠে বড়মন্ডল পরিবারের জমিদারী।@@@@@@@ এখন মায়ের মূলমন্দির আধুনিক ধাঁচে তৈরী হলেও নাটমন্দির নহবতখানা সহ দূর্গামেলাতেই খুঁজে পাওয়া যায় অতীতের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। পারিবারিক এই সাবেকী পূজোতে হাজির হন বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকা প্রায় সকলেই।পুরানো দিনের গল্প আড্ডায় জমে ওঠে দূর্গাদালান। দেশ-বিদেশের গল্পে ঠাকুরদালান জমজমাট আট থেকে আশির ভীড়ে। ষষ্ঠী থেকেই শুরু হয়ে যেত নহবতখানায় সানাইয়ের সুমধুর সুর।‌দুর্গাপুজোয় যাত্রাপালা মাস্ট ছিল বড়মন্ডল পরিবারের মেলায়। পালা দেখতে ভেঙে পড়ত গ্রাম। বাড়ির মেয়েরা যাত্রা দেখতেন দোতলার আড়াল থেকে। সেসব এখন অতীত। তবে আজও পুজোর সময় ভিড় বাড়ে জমিদার বাড়ির আনাচ-কানাচে। পরবাস ছেড়ে ঘরে ফেরেন গোপাল মন্ডলের উত্তরসুরীরা। যাত্রাপালা না হলেও আসর মাতে অন্তাক্ষরীর সুরে, নাটকের নেশায়। এই আমেজ গুপ্তধনের থেকে কম কী? সপ্তমীর সকালে শোভিত ও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে ভড়াগ্রামের সবকটি মেলার নবপত্রিকা আনয়ন এলাকার মানুষদের জন্য বড় আকর্ষণ। স্থানীয় “সানবাঁধা” নামক এক পুরানো পুকুর থেকে একে একে কলাবৌ স্নান করে শোভাযাত্রা সহকারে মেলায় মেলায় নবপত্রিকা চৌদালে করে আনা হয়।বড়মন্ডল পরিবারের বর্তমান একসদস্য দেবাশীষ মন্ডল ( দেবুদা) জানান, বর্তমান সরকার ঐতিহ্যবাহী “সানবাঁধা” ঘাটটির সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধক করার উদ্যোগ নিয়েছেন।শোভাযাত্রার সবার প্রথম থাকে এই বড়মন্ডল পরিবারের চৌদাল।ঐতিহ্য আছে। সঙ্গে বনেদিয়ানাও। পড়তি হলেও, আড়ম্বরহীন নয়। যেন ছাই চাপা আগুন। অষ্টমীর দিন বিষ্ণুপুরের মা মৃন্ময়ীর কামানের তোপধ্বনির আওয়াজ শুনে শুরু হয় এই জমিদার বাড়ির পূজার মহাখ্যান। দেবাশীষ বাবু জানান, “পারিপার্শ্বিক অনেক গ্রামের পূজোতে নবমীতে পাঁঠাবলি হলেও আমরা জীবহত্যা পছন্দ করি না”। এলাকার বাসিন্দা সত্যজিৎ রায়,তাপস চৌধুরীর কথায় রাতজেগে আশেপাশে সমস্ত ঠাকুর দেখতে গেলেও বড়মন্ডল পরিবারের দূর্গাপূজা না দেখলে পূজা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *