মূল্যবান মনুষ্য জীবন ও মহাকুম্ভ মেলা-2025 : স্বামী আত্মভোলানন্দ(পরিব্রাজক)।।

মূল্যবান মনুষ্য জীবনে আবারও এসেছে আর একটি মহা অমৃতকুম্ভ যোগ। ১৮৮১সালে প্রয়াগে মহাকুম্ভ এরপর আরও ১৪৪-টি বছর পরে এসেছে ২০২৫ সাল ও এই পুণ্যতিথি ও মহাকুম্ভের বিশেষ যোগ। গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদী যেখানে মিলেছে সেই সঙ্গমতীর্থেই ১৪৪ বছরের ব্যবধানে আয়োজিত হয় মহাকুম্ভ মেলা। প্রয়াগরাজের পূর্ণকুম্ভ অনুষ্ঠিত হয় গ্রহরাজ বৃহস্পতি বৃষভ রাশিতে ও সূর্য মকর রাশিতে অবস্থান করলে। বর্তমানে পৃথিবীর ঘূর্ণন, সূর্যের চারপাশের পরিক্রমণ, পৃথিবীর আকার ইত্যাদি নিয়ে অনেক সত্যের উদঘাটন করেছেন ঠিকই কিন্তু আমাদের ভারতবর্ষের জ্ঞানী গুণীজন এসব জানতো হাজার হাজার বছর আগেই। শুধু এই নয়, বৃহস্পতির সূর্য পরিক্রমা সম্বন্ধেও অবহিত ছিলো পুরাকাল থেকেই। ১২ বছরে বৃহস্পতি যে একবার পৃথিবীর পরিক্রমণ সম্পন্ন করে ও সেই অনুযায়ী ভারতের চারটি বিশেষ স্থানে কুম্ভমেলার অনুষ্ঠান সম্ভবপর, বহু যুগ আগে থেকে সে একমাত্র ভারতীয় পণ্ডিতরাই সঠিকভাবে জানতো। তাই, প্রয়াগরাজ, হরিদ্বার, উজ্জয়িনী ও নাসিকে অমৃতকুম্ভের যোগ আমরা নির্দিষ্ট সময় পরপর দেখতে পাই।

মহাকুম্ভ মেলা থেকে ফেরা পুণ্যার্থীদের অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছি। আমরা গত ১৩ই জানুয়ারী রাতের বিভূতি এক্সপ্রেসে তৎকাল টিকিট কেটে উঠে পড়লাম প্রয়াগরাজের উদ্দেশ্যে। পর দিন ১২ টা নাগাদ নেমে হাঁটা শুরু করলাম আর দুপুর ৩ টে নাগাদ পৌঁছে গেলাম সঙ্গমে। পথিমধ্যে দেখলাম যত্রতত্র বিলি হচ্ছে জল, খাবার, বিস্কুট, খিচুড়ি। লাইন দিয়ে লোকে খাচ্ছে। বাদ আমরাও গেলামনা। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তায় প্রায় ৯ বা ১০ কিমি হাঁটতে হয়েছিলো, কারন ১৪ ই জানুয়ারী ছিলো অমৃত স্নান। স্নানের দুই দিন আগে প্রয়াগরাজে পৌঁছান এবং ভিড় এড়াতে আগাম ব্যবস্থা নিন। অমৃত স্নানের আগের দিন ও পরের দিন সব যানবাহন নিয়ন্ত্রণ থাকে।

তাই, স্নান সেরে একটা অস্থায়ী সেতু পার করে পৌঁছে গেলাম নদীর ওপারে, যেখানে হাজারো হাজারো আখড়া আর টেন্ট ভর্তি। মোট গোটা ৩০বা ৩৫ টা সেক্টরে পুরো মেলা এলাকা ভাগ করা। একটা থেকে আর একটা সেক্টরের দূরত্ব কমবেশী ১ কিমি। আমরা একটা আখড়ার ভান্ডারায়(যেখানে নিখরচায় খাওয়ার বিতরণ করা হয়)খিচুড়ি খেয়ে থাকার জায়গার খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। ঘুরতে ঘুরতে ১৯ নাম্বার সেক্টরে এসে একটা খালসা আখড়ায় উঠলাম বটে, কিন্তু ওদের ওইদিন নিজেদের কমিউনিটির লোকজন বেশী থাকায়, আমাদের স্থান দিতে পারলনা। তবে খাইয়ে ছাড়লো। ঠিক তার দু একটা পরের আখড়ায় গিয়ে থাকার জন্য অনুরোধ করায় ওনারা সঙ্গে সঙ্গেই অনুমতি দিলেন। ঢুকে পড়লাম। চলে এলো বিছানা পত্র, কম্বল ও বালিশ, ঝকঝকে তকতকে। চেঞ্জ করে দে ঘুম। রাত ৩ টায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো মহারাজদের দৌড়ঝাঁপ দেখে। ব্যস্ততার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট বানানোর কাজ করছেন। উঠে পড়লাম বেডটি চলে এলো সঙ্গে পুরি তরকারি আর ঘিয়ে স্নান করানো হালুয়া। ওহ! অমৃত অমৃত।

আমরা ওখানেই ব্যাগপত্র রেখে, শুধু মোবাইল আর পার্স আর গামছা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে। সারাদিন রাত ঘুরে ঘুরে, যেখানে সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে নানাবিধ খাবার খেয়ে খেয়ে এবং প্রায় লাখ খানেকের মধ্যে কয়েকটা বায়ো টয়লেট ব্যবহার করে আবার ওই আখড়ায় ফিরে এলাম। ভীড়? নিরাপত্তা? পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা? খরচ? প্রচুর ভীড়, কিন্তু মারাত্মক নিয়ন্ত্রিত, বাচ্চা থেকে বয়স্ক, বয়স্কা কারোরই কোনও অসুবিধা নেই। নিরাপত্তা নিয়ে কোনও কথা হবেনা। তিন হাত ছাড়া পুলিশ, আর্মি ভর্তি। তবে আর্মিদের কোনো ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে ওরা বলতে পারবেনা। পুলিশকে জিজ্ঞেস করাই শ্রেয়। ওরা খানিকটা বেটার। প্রায় লাখ দেড়েক ডাস্টবিন গোটা মেলায়, ৬৫১ কিমি অস্তায়ী রাস্তাকে প্রতিদিন ঝাড়ু ও জল দিয়ে বারংবার ধোয়া,ও আখড়া গুলো পবিত্রতার নিদর্শন নিয়ে দাঁড়িয়ে।

আমাদের শুধু যাতায়াতের খরচই লেগেছে। বাকি থাকা খাওয়ার এক পয়সা খরচ তো হয়ইনি, উপরন্তু এত নানা প্রকার খাবার খেয়ে খেয়ে পেটের অবস্থা খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়ে গিয়েছিল। *অমৃত স্নানের আগের দিন ও পরের দিন সব যানবাহন নিয়ন্ত্রণ থাকে। তাই পুরো হাঁটতে হবে। গাড়ি কোত্থাও পাবেন না, এম্বুলেন্স ছাড়া। বাকি দিন গুলোয় গেলে সব জায়গায়ই গাড়ি পাবেন, টোটো অটো সব।* জল আনার চিন্তা নেই ওখানেই কন্টেনার বিক্রি হচ্ছে,১/২/৩/৫/১০ লিটারের। তবে মাটি পাওয়াটা বেশ চাপের৷ কারণ, প্রশাসন থেকে পুরো নদীর পাড় আলাদা বালি এনে ভরিয়ে দিয়েছে।

আমরা যেখানে ছিলাম সেটা ১৯ নাম্বার সেক্টরের একটা দুর্দান্ত আখড়া। এরকম কয়েক হাজার নানাবিধ আখড়া পাবেন থাকার জন্য, যা একদম ফ্রি। খাওয়ার এর কোনো চিন্তা করতে হবে না। অসম্ভব ভালো ভালো সব খাবার সব আখড়ায় সারা দিন রাত পরিবেশন হচ্ছে। তাও সম্পুর্ণ ফ্রি। কুম্ভ মেলার বিশেষত্ব হলো তার বিশালতা এবং আধ্যাত্মিক পরিবেশ। তবে এই অভিজ্ঞতা উপভোগ করতে হলে পরিকল্পনা, প্রস্তুতি এবং শারীরিক কসরতের জন্য তৈরি থাকতে হবে। সঠিকভাবে পরিকল্পনা করলে কুম্ভ মেলার অসাধারণ অভিজ্ঞতা আপনার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
জীবনে আপনার হিমাচল আসবে, কাশ্মীর আসবে, নাগাল্যান্ড আসবে, সুইজারল্যান্ডও আসবে, কিন্তু সারা জীবনেও আপনার এই মহাকুম্ভমেলা আর আসবেনা। তাই মনস্থির করুন। বেরিয়ে পড়ুন। দায়িত্ব নিয়ে বলছি, কোনও চিন্তার কারণ নেই, কোনও চিন্তার ব্যাপার নেই। শুধু পায়ে বল আর মনে শক্তি নিয়ে কুম্ভের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ুন। প্রায় ৪০ টি ঘাটে স্নানের ব্যবস্থা রয়েছে এই মহাকুম্ভে। কুম্ভমেলা পর্বে ১০০ কোটি লোকসমাগম হলেও যাতে পরিকাঠামো তৈরী থাকে সেই মতো প্রশাসন সব ব্যবস্থা রেখেছে। *ধারাবাহিক দ্বিতীয় পর্যায় চলবে..*
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্ …..।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *