বাংলার সমুদ্রতটগুলির মধ্যে যদি কোনোটি সত্যিই প্রকৃতির নিরিবিলি সৌন্দর্য, আধুনিকতার ছোঁয়া ও শান্ত পরিবেশের অনন্য মেলবন্ধন হয় — তবে তা নিঃসন্দেহে মন্দারমণি। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ছোট্ট সমুদ্রসৈকত এই মন্দারমণি এখন দ্রুতই হয়ে উঠছে নতুন প্রজন্মের পছন্দের গন্তব্য। এখানে নেই দীঘার ভিড়, নেই শহরের কোলাহল; আছে শুধু নীল সমুদ্র, লাল সূর্যাস্ত, ঝাউগাছের সারি, আর তরঙ্গের মৃদু স্পর্শ।
ভৌগোলিক অবস্থান
মন্দারমণি অবস্থিত দীঘা–কাঁথি রোডের ধার ঘেঁষে, কলকাতা থেকে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার দূরে। এটি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত, এবং বাংলার অন্যতম পরিচ্ছন্ন ও দীর্ঘতম ড্রাইভ-ইন সমুদ্র সৈকত হিসেবে খ্যাত। অনেক পর্যটক গাড়ি চালিয়ে সরাসরি সৈকতের বালির উপর দিয়েই যান—এই অভিজ্ঞতাই মন্দারমণির অন্যতম বিশেষত্ব।
সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত – রঙে রঙে ভরা আকাশ
মন্দারমণির সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই অনবদ্য। ভোরে যখন সূর্যের প্রথম কিরণ ঢেউয়ের গায়ে পড়ে, তখন পুরো সমুদ্র যেন সোনালি জ্যোতিতে ঝলমল করে ওঠে। আবার বিকেলের শেষে যখন সূর্য অস্ত যায়, তখন আকাশ রাঙিয়ে তোলে রক্তিম আলোয়, যা ধীরে ধীরে সমুদ্রের ঢেউয়ে মিশে যায়। অনেক পর্যটক এই দৃশ্য দেখতে দেখতে হারিয়ে যান ভাবনায়, মনে হয় সময় যেন থমকে গেছে।
দেখার মতো আকর্ষণীয় স্থানসমূহ
মন্দারমণির সৌন্দর্য শুধু সৈকতে সীমাবদ্ধ নয়। এখানে এবং আশেপাশে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে—
- মন্দারমণি সমুদ্র সৈকত: এই তট বাংলার সবচেয়ে দীর্ঘ সৈকতগুলির একটি। এখানকার ঢেউ শান্ত ও স্নিগ্ধ, তাই স্নানের জন্য নিরাপদ।
- চাঁদপুর সৈকত: মন্দারমণি থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত, এটি আরও নির্জন এবং প্রকৃতিপ্রেমীদের প্রিয় স্থান।
- শঙ্করপুর ও তাজপুর: মন্দারমণির পাশেই অবস্থিত এই সৈকত দুটি তুলনামূলকভাবে কম জনাকীর্ণ, কিন্তু অত্যন্ত সুন্দর।
- মৎস্যজীবী গ্রাম: সকালে বা বিকেলে স্থানীয় জেলেদের নৌকায় মাছ ধরার দৃশ্য দেখতে পারেন। সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে তাঁদের জীবনযুদ্ধের গল্প মিশে আছে এখানে।
- দীঘা ও উদয়পুর: অল্প দূরত্বে অবস্থিত, এক দিনে যাওয়া সম্ভব।
মন্দারমণির বিশেষ আকর্ষণ
মন্দারমণির অন্যতম চমক হল রেড ক্র্যাব বা লাল কাঁকড়া। সৈকতের বালুর ওপর হাজার হাজার লাল কাঁকড়া একসঙ্গে ছুটে বেড়ায়—দেখলে মনে হয় পুরো তট যেন লাল কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে। এই দৃশ্যই মন্দারমণির পরিচিতি এনে দিয়েছে “লাল কাঁকড়ার রাজ্য” নামে।
এছাড়াও এখানে রয়েছে বিচ মোটর রাইড, প্যারাসেলিং, বানানা বোট রাইড, এমনকি সন্ধ্যায় বিচ পার্টি ও বোনফায়ার–এরও আয়োজন।
স্থানীয় খাবার ও রন্ধনপ্রণালী
মন্দারমণি গেলে অবশ্যই চেখে দেখবেন এখানকার সি-ফুড।
চিংড়ি মালাইকারি, মাছ ভাজা, কাঁকড়া ঝোল, সি-ফিশ কাটলেট—সবই অবিশ্বাস্য স্বাদে ভরপুর। সৈকতের ধারে ছোট ছোট রেস্তোরাঁয় গরম গরম খাবার পরিবেশন করা হয়, আর তার সঙ্গে লবণাক্ত সমুদ্রের হাওয়া যেন মসলার স্বাদ আরও বাড়িয়ে দেয়।
থাকার ব্যবস্থা
মন্দারমণিতে সমুদ্রের ধারে সারি সারি রিসোর্ট, হোটেল ও কটেজ রয়েছে।
বেশিরভাগ রিসোর্টের সামনেই সরাসরি সৈকত, তাই হোটেলের বারান্দা থেকেই ঢেউয়ের শব্দ শোনা যায়।
জনপ্রিয় রিসোর্টগুলির মধ্যে রয়েছে—রোজ ভ্যালি রিসোর্ট, সী ব্লু হোটেল, সনরাইজ ভিলা, ডিউন রিসোর্ট ইত্যাদি।
বাজেট ভ্রমণকারীদের জন্যও এখানে সুলভ ও পরিষ্কার অতিথিশালা পাওয়া যায়।
কীভাবে পৌঁছাবেন
- রেলপথে: হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে কাঁথি (Contai) স্টেশন পর্যন্ত ট্রেন যায়। সেখান থেকে গাড়ি বা টোটো করে প্রায় ৩০ কিমি দূরে মন্দারমণি পৌঁছানো যায়।
- সড়কপথে: কলকাতা থেকে দীঘা রোড হয়ে গাড়িতে প্রায় ৪–৫ ঘণ্টার পথ। রাস্তা সুন্দর এবং ড্রাইভটি খুবই উপভোগ্য।
- নিকটবর্তী শহর: দীঘা, তাজপুর ও শঙ্করপুর একদিনে ভ্রমণযোগ্য।
প্রকৃতি ও মানুষের বন্ধন
মন্দারমণির মানুষ অতিথিপরায়ণ, সহজ-সরল এবং হাসিখুশি। তাদের জীবিকা মূলত পর্যটন, মৎস্যধরন এবং হস্তশিল্পের ওপর নির্ভরশীল। সমুদ্রের সঙ্গে এই মানুষের সম্পর্ক একান্ত অন্তরঙ্গ। তাই এখানে এলেই এক ধরণের উষ্ণতা ও আন্তরিকতার ছোঁয়া অনুভব করা যায়।
শান্তির ঠিকানা
যদি আপনি কোলাহল থেকে দূরে কিছুদিন প্রকৃতির মাঝে সময় কাটাতে চান, তবে মন্দারমণি আপনার জন্য নিখুঁত স্থান।
এখানে নেই শহরের কোলাহল, নেই বাণিজ্যিক ভিড়—আছে শুধু সমুদ্রের শব্দ, ঝাউবনের ছায়া, আর এক চিরন্তন প্রশান্তি।
উপসংহার
মন্দারমণি কেবল একটি সমুদ্র সৈকত নয়, এটি এক অনুভূতি। ঢেউয়ের গর্জনে, লাল কাঁকড়ার দৌড়ে, সূর্যাস্তের আলোয় মিশে থাকা এক অনন্ত প্রশান্তি।
এই জায়গা যেন এক প্রেমের কবিতা—যেখানে প্রতিটি শব্দের বদলে শোনা যায় ঢেউয়ের সুর। 













Leave a Reply