
নিজস্ব সংবাদদাতা, বালুরঘাট:- বার্ধক্যে পৌঁছালে অনেকে যখন বিশ্রামের পথে হাঁটেন, তখন বালুরঘাটের বিশ্বাসপাড়ার আশি বছর বয়সি কিরণ শঙ্কর ঘোষ যেন জীবনের নতুন অধ্যায় লিখে চলেছেন। তাঁর সঙ্গী এখন এক কাপ গরম চা, কফি আর মানুষের গল্প। ‘চা উইথ টা’—নামেই যেমন মিষ্টতা, তেমনি এর আবহেও মিশে আছে ভালোবাসা, উষ্ণতা আর নতুন করে বাঁচার প্রেরণা। দোকানের এক কোণে লেখা—“It is always tea and coffee time.” যেন এই বার্তাই প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয়, জীবন কখনও থেমে থাকে না।
দু’দেড় মাস আগে খোলা ছোট্ট এই খাবারঘর এখন বিশ্বাসপাড়ার চেনা আড্ডাস্থল। চা, কফি, স্ন্যাকস, হালকা খাবারের সুবাসে ম-ম করছে দোকানটি। তবে শুধু ব্যবসা নয়—এই জায়গা যেন এক বৃদ্ধ মানুষের একাকীত্বের বিরুদ্ধে ভালোবাসার লড়াই।
কিরণবাবুর জীবনের পথ ছিল কণ্টকময়। একসময় পাড়ার ফুটপাথে সবজি বিক্রি করে সংসার চালিয়েছেন তিনি। পরিশ্রম, ধৈর্য আর নিঃশব্দ সংগ্রামেই এগিয়েছিলেন জীবনপথে। কিন্তু কিছু বছর আগে স্ত্রীর মৃত্যুতে যেন থেমে গিয়েছিল সবকিছু। চার সন্তানের মধ্যে এক কন্যা প্রয়াত। একমাত্র পুত্র সত্যজিৎ ঘোষ রাজ্য সরকারি স্কুলের শিক্ষক, পুত্রবধূ স্বাতি সরকার ঘোষও বালুরঘাটের এক সরকারি স্কুলে পড়ান।
স্বাতির চিন্তাতেই জন্ম ‘চা উইথ টা’র। শ্বশুর যেন আবার হাসি ফিরে পান, সেই ভাবনাই তাঁকে এই পদক্ষেপে অনুপ্রাণিত করেছিল। দীর্ঘদিন কিরণবাবুর দিনের আনন্দের কেন্দ্র ছিল নাতি—যাকে স্কুল, টিউশন, নানা কাজে পৌঁছে দিতেন তিনি। কিন্তু নাতি যখন উচ্চশিক্ষার জন্য কল্যাণীতে চলে গেল, তখন নিঃসঙ্গতা তাঁর নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছিল।
সেই শূন্য বিকেলগুলো আজ আবার রঙিন। দোকানের কাউন্টারের পেছনে বসে থাকা এক আশি বছরের মানুষকে দেখলে বোঝা যায়, জীবনের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এখনও অটুট। প্রতিবেশীরা, পুরোনো বন্ধুরা, নতুন মুখ—সবাই এসে চায়ের কাপে গল্পের সুর তোলে। কারও জন্মদিনের ছোট আয়োজন, কারও পারিবারিক আড্ডা—সব মিলিয়ে ‘চা উইথ টা’ আজ শুধু একটি খাবারঘর নয়, একটি অনুভূতির নাম।
একসময় যে বাড়ি নিঃস্তব্ধ ছিল, আজ সেখানে প্রতিদিন চায়ের কাপের টুংটাং আওয়াজে ভরে ওঠে জীবন। কিরণ শঙ্কর ঘোষের এই উদ্যোগ যেন এক নীরব বার্তা—বয়স কখনও বাঁধা নয়, ইচ্ছে থাকলে প্রতিদিনই নতুন করে শুরু করা যায়।
এক কাপ চা, একটু হাসি, আর কিছু ভালোবাসা—এই তিনেই যেন আশি বছরের কিরণ শঙ্কর ঘোষ আবার খুঁজে পেয়েছেন জীবনের মানে।












Leave a Reply