
স্কটল্যান্ডের প্রাণকেন্দ্র, তারুণ্যের স্পন্দন, পুরনো ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার অনন্য মেলবন্ধন—এই তিন শব্দে গ্লাসগোকে বর্ণনা করা যায়। শহরটি যেন এক জীবন্ত ক্যানভাস, যেখানে শিল্প, সংগীত, স্থাপত্য, ইতিহাস ও মানুষের উষ্ণ আতিথেয়তা মিলেমিশে এক অপূর্ব পরিবেশ তৈরি করেছে। ভ্রমণপিপাসুদের কাছে গ্লাসগো সবসময়ই এক আলাদা আকর্ষণ—এখানে যেমন আছে প্রাচীন গির্জা ও ঐতিহাসিক ভবন, তেমনি আছে মনোমুগ্ধকর জাদুঘর, শপিং স্ট্রিট এবং নদীর ধারে হাঁটার পথ।
গ্লাসগো – প্রথম দেখায় কী মনে হয়
বিশাল রাস্তা, সুপরিকল্পিত শহর, পুরনো ভিক্টোরিয়ান দালান এবং রাস্তার দুপাশে আধুনিক ক্যাফে—গ্লাসগোতে পৌঁছেই বোঝা যায় শহরটি কতটা প্রাণবন্ত।
এ শহরের মানুষ অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ, তাই ঘোরাঘুরি করার সময় মনে হয় যেন নিজের পরিচিত কোনো শহরে ঘুরছি।
১. গ্লাসগো ক্যাথেড্রাল – মধ্যযুগের চিরন্তন সাক্ষী
গ্লাসগোর সবচেয়ে ঐতিহাসিক স্থাপনা গ্লাসগো ক্যাথেড্রাল, যেটি স্কটল্যান্ডের মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত।
গথিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই গির্জার ভিতরে ঢুকলেই যেন সময় পিছিয়ে যায়।
সবুজ প্রান্তরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাথেড্রালের কালো পাথরের গায়ে সময়ের ছাপ যেমন দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি এর নির্মাণশৈলী চোখ জুড়িয়ে দেয়।
ক্যাথেড্রালের পাশেই রয়েছে Necropolis—একটি ঐতিহাসিক ভিক্টোরিয়ান সমাধিক্ষেত্র, যেখান থেকে পুরো শহরটিকে দেখা যায় অসাধারণভাবে।
২. কেলভিনগ্রোভ আর্ট গ্যালারি অ্যান্ড মিউজিয়াম – শিল্পের স্বর্গ
এটি শুধু গ্লাসগো নয়, পুরো স্কটল্যান্ডের অন্যতম আকর্ষণ।
ভবনের বাহ্যিক লাল বর্ণের স্থাপত্যই দেখার মতো, আর ভেতরে আছে—
- ২২টি গ্যালারি
- প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন
- মিশরীয় সংগ্রহ
- ইউরোপীয় শিল্পীদের কালজয়ী চিত্রকর্ম
- এমনকি সালভাদর দালির বিখ্যাত Christ of Saint John of the Cross
শিল্প প্রেমীদের কাছে এটি স্বর্গের মতো।
৩. রিভার ক্লাইড – নদীর ধারে আধুনিক গ্লাসগো
গ্লাসগো শহরকে যিনি সবচেয়ে সুন্দরভাবে রূপ দিয়েছেন, তিনি হলেন River Clyde।
নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায়—
- Clyde Arc Bridge
- চমৎকার আধুনিক ভবন
- রিভারসাইড মিউজিয়াম
- The Tall Ship ক্লাইডে নোঙর করে থাকা পুরনো জাহাজ
সন্ধ্যাবেলায় ক্লাইড নদীর ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখা গ্লাসগো ভ্রমণের অন্যতম সুন্দর অভিজ্ঞতা।
৪. রিভারসাইড মিউজিয়াম – পরিবহন ইতিহাসের আকর্ষণীয় জগৎ
জাহাজ, ট্রাম, পুরনো ট্রেন, গাড়ি—এখানে পরিবহনের বিবর্তন দেখানো হয়েছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে।
The Tall Ship-এ উঠে দাঁড়ালে মনে হয় যেন পুরনো কোনো সমুদ্রযাত্রার গল্পে ঢুকে পড়েছি।
৫. জর্জ স্কোয়ার – গ্লাসগোর হৃদয়
গ্লাসগো সিটি সেন্টারের কেন্দ্রস্থল হলো George Square।
এখানে সারাদিন—
- লাইভ সংগীত
- রাস্তার শিল্পীদের পরিবেশনা
- কবুতরের কলরব
- স্থানীয়দের আড্ডা
সব মিলিয়ে স্কটিশ শহুরে জীবনের প্রাণবন্ত রূপ দেখা যায়।
৬. বিশ্ববিদ্যালয় অফ গ্লাসগো – এক চলচ্চিত্রিক সৌন্দর্য
গথিক স্থাপত্যে নির্মিত University of Glasgow যেন হারি পটার-এর মুঘলিয়ান জাদুশিক্ষালয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।
সবুজ আঙিনা, পুরনো করিডর, আর্চওয়ে—সব মিলিয়ে এক অপূর্ব পরিবেশ।
এখানে থাকা Cloisters হল ফটোগ্রাফি প্রেমীদের জন্য স্বপ্নের জায়গা।
৭. বোটানিক গার্ডেন – প্রকৃতির সঙ্গে একান্তে
যাঁরা শহরের কোলাহল থেকে একটুখানি শান্তি চান, তাঁদের জন্য বোটানিক গার্ডেন উপযুক্ত স্থান।
গ্লাসগো গ্রিনহাউসের গ্লাস প্যালেস—Kibble Palace—অত্যন্ত সুন্দর।
৮. গ্লাসগোতে শপিং, খাবার ও নাইটলাইফ
- Buchanan Street – স্কটল্যান্ডের সেরা শপিং স্ট্রিট
- Merchant City – রেস্টুরেন্ট, পাব, লাইভ মিউজিক
- West End – ক্যাফে, বইয়ের দোকান, শিল্পীদের এলাকা
স্কটল্যান্ডে এসে অবশ্যই চেখে দেখার মতো কিছু খাবার—
- Haggis
- Traditional Scotch Pie
- Cullen Skink soup
চাইলে ভারতীয় রেস্টুরেন্টেও ভালো খাবার পাওয়া যায়।
কবে গেলে ভালো?
গ্লাসগো ভ্রমণের সেরা সময়—
- এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর – রোদেলা আবহাওয়া, লম্বা দিন
- শীতে যদিও ঠান্ডা বেশি, তবুও ক্রিসমাস সাজে শহর হয় আলোকোজ্জ্বল ও রূপকথার মতো।
শেষ কথা
গ্লাসগো এমন একটি শহর যেখানে ইতিহাস, আধুনিকতা, শিল্প-সংস্কৃতি এবং মানুষের উষ্ণতা মিলেমিশে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
এ শহর শুধু দেখার নয়—এ শহর অনুভব করার।
নদীর ধারে দাঁড়িয়ে হিম বাতাসে চোখ বুঁজলে মনে হবে আপনি এক প্রাণবন্ত, শিল্পময়, উজ্জ্বল পৃথিবীর অংশ।












Leave a Reply