
ইউরোপের মানচিত্রে সুইজারল্যান্ড মানেই একটি আলাদা মায়া—সাদা বরফে ঢাকা পর্বতশিখর, স্ফটিকস্বচ্ছ হ্রদ, পরিপাটি শহর আর ছবির মত সাজানো গ্রাম। তার মধ্যেই সবচেয়ে রূপকথার মত জায়গাটি হলো ইন্টারলাকেন। জার্মান শব্দ Inter-laken— অর্থাৎ “দুই হ্রদের মাঝখানে”—নামটিতে যেমন আছে, শহরটিও ঠিক তেমনই অবস্থিত লেক থুন ও লেক ব্রিয়েঞ্জ-এর মাঝখানে। চারদিকে তুষার-ঢাকা পাহাড়, সবুজ উপত্যকা, আলপাইন ফুলের পসরা আর নীলাভ হ্রদ—ইন্টারলাকেনে পৌঁছানো মানেই যেন প্রকৃতির কোলে ফিরে যাওয়া।
ইন্টারলাকেন পৌঁছানোর প্রথম অনুভূতি
সুইস ট্রেনে বসে ইন্টারলাকেনের দিকে যেতে যেতে জানলার বাইরে দৃশ্য বদলাতে থাকে—ক্ষুদ্র কুঁড়েঘর, বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর, ক্ষীণ শব্দে বয়ে যাওয়া নদী আর দূরে বরফে মোড়া পাহাড়। ট্রেন ইন্টারলাকেন ওস্ট (Interlaken Ost) স্টেশনে থামতেই আপনার মনে হবে যেন আপনি ইউরোপের পোস্টকার্ডে এসে দাঁড়িয়েছেন। বাতাসে ঠান্ডা হাওয়া, তবু সেই হাওয়ার বিশুদ্ধতা এমন যে বুক ভরে শ্বাস নিলে মনে হবে জীবনে প্রথমবার সত্যিকারের ফ্রেশ বাতাস নিচ্ছেন।
ইন্টারলাকেনের বিশেষ সৌন্দর্য – জুঙফ্রাউ অঞ্চলের প্রবেশদ্বার
ইন্টারলাকেনের সবচেয়ে বড় পরিচয়—এটি জুঙফ্রাউ অঞ্চল (Jungfrau Region) এর “Gateway” বা প্রবেশদ্বার। জুঙফ্রাউ, মইরেন, লটারব্রুনেন, গ্রিন্ডেলওয়াল্ড—সব বিখ্যাত আলপাইন গ্রাম এখান থেকেই ঘোরা যায়।
জুঙফ্রাউইয়োখ – Top of Europe
ইন্টারলাকেন থেকে ট্রেনে লটারব্রুনেন বা গ্রিন্ডেলওয়াল্ড হয়ে আপনি পৌঁছে যেতে পারেন ইউরোপের সবচেয়ে উচ্চতম রেলস্টেশন জুঙফ্রাউইয়োখ-এ (৩,৪৫৪ মিটার)। এখানে সারাবছর বরফ পড়ে। চারদিকের যে দৃশ্য দেখা যায় তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন—একদিকে Aletsch Glacier, অন্যদিকে বরফের খাঁজকাটা পর্বত, আর আকাশের এক অদ্ভুত নীল আভা।
লেক থুন ও লেক ব্রিয়েঞ্জ – দুই রঙের দুই হ্রদ
ইন্টারলাকেনের দুই পাশে দুটি হ্রদ—
- Lake Thun: গভীর নীল
- Lake Brienz: টারকয়েজ সবুজ
দুটির জলের রং আলাদা হওয়ায় এর সৌন্দর্য আরও রহস্যময় লাগে।
Boat Cruise
ইন্টারলাকেন থেকে নৌকায় উঠে করলে আপনি মধ্যযুগীয় দুর্গ, ঘাসে মোড়া পাহাড় আর লেকের ধারে ছড়িয়ে থাকা গ্রাম দেখতে পাবেন। সূর্যাস্তের সময় লেক ব্রিয়েঞ্জে ক্রুজ চলার অভিজ্ঞতা সত্যিই মনে রাখার মতো।
হার্দার কুলম – ইন্টারলাকেনের Balcony
ইন্টারলাকেন শহরকে পাখির চোখে দেখতে হলে ফিউনিকুলার চড়ে উঠে যান Harder Kulm-এ (১,৩২২ মিটার)। উপরে একটি ভিউপয়েন্ট রয়েছে—দুধসাদা জুঙফ্রাউ massif, নীলাভ দুই হ্রদ আর সবুজ উপত্যকার যে মিলনরূপ দেখা যায় তা অসাধারণ। বিশেষ করে সন্ধ্যার সময় এখানে দাঁড়ানো মানেই রূপকথার কভার পেজে থাকা।
অ্যাডভেঞ্চারের রাজধানী – ইন্টারলাকেন
যদি আপনি রোমাঞ্চপ্রিয় হন, তবে ইন্টারলাকেন আপনার স্বপ্ন পূরণের জায়গা।
Paragliding
নীল আকাশে রঙিন প্যারাগ্লাইডারের সারি প্রতিদিনই দেখা যায়। আপনি চাইলে গাইডসহ Höheweg মাঠ থেকে উড়ে গিয়ে পাহাড়ের ওপর দিয়ে লেকের উপর ভেসে বেড়াতে পারবেন।
Skydiving
তুষারপাহাড়ের উপর দিয়ে স্কাইডাইভিং—এক কথায় ভয়ঙ্কর রোমাঞ্চকর।
Kayaking & Canoeing
লেক ব্রিয়েঞ্জের নীল পানিতে কায়াকিং করলে মনে হবে কোনো চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মধ্যে আছেন।
লটারব্রুনেন – ৭২টি জলপ্রপাতের উপত্যকা
ইন্টারলাকেন থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের ট্রেন যাত্রায় লটারব্রুনেন। পুরো উপত্যকাটি জলপ্রপাতের রাজ্য। অসংখ্য জলপ্রপাত পাহাড়ের বুক থেকে ঝরছে—শুনলে বিশ্বাস না-ও করতে পারেন, লটারব্রুনেনে ৭২টি জলপ্রপাত রয়েছে!
সবচেয়ে বিখ্যাত Staubbach Falls এতটাই লম্বা যে তার জল বাতাসে পাউডারের মতো ভেসে যায়।
গ্রিন্ডেলওয়াল্ড – আলপাইনের সবুজ গ্রাম
ইন্টারলাকেন থেকে গ্রিন্ডেলওয়াল্ডে যাওয়া মানেই যেন নরম সবুজ চাদর বিছানো উপত্যকায় হাঁটতে থাকা। এখানের চূড়াগুলো এতটাই কাছে লাগে যে হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবেন মনে হয়।
সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান: First Cliff Walk—কাচের উপর দাঁড়িয়ে নিচে বিশাল উপত্যকা দেখা যায়।
ইন্টারলাকেনের রাস্তাঘাট ও সংস্কৃতি
শহরের মধ্য দিয়ে Hoheweg নামের সুন্দর রাস্তা চলে গেছে, যার দু’পাশে ঘড়ির দোকান, সুইস চকোলেট শপ, কফি হাউস আর আল্পস-ভিত্তিক রেস্তোরাঁ। সন্ধ্যার আলোয় এই রাস্তা এতটাই শান্ত, পরিষ্কার ও সাজানো যে মনে হবে যেন সিনেমার সেট।
সুইস চকোলেট টেস্টিং
ইন্টারলাকেনে বিভিন্ন দোকানে “চকোলেট টেস্টিং সেশন” হয়—বিশেষ করে Funky Chocolate Club খুব জনপ্রিয়।
কখন ভ্রমণ করবেন
- April–June: ফুলে ভরা উপত্যকা
- July–September: আউটডোর অ্যাডভেঞ্চারের জন্য সেরা
- December–March: স্কিইং আর শীতের বরফরাজ্যের স্বর্গরাজ্য
কোথায় থাকবেন
ইন্টারলাকেনে থাকার জন্য বিভিন্ন অপশন রয়েছে—
- Luxury: Victoria Jungfrau Grand Hotel
- Mid-range: Hotel Interlaken
- Budget: Backpackers Villa
সবচেয়ে ভালো হয় ইন্টারলাকেন ওস্ট বা ওয়েস্ট স্টেশনের কাছেই থাকা।
ইন্টারলাকেন – ভ্রমণের শেষে মন ভরে যায়, চোখ ভরে না
ইন্টারলাকেন এমন একটি শহর যেখানে গেলে আপনি বুঝবেন প্রকৃতি কীভাবে নিজ হাতে একটি শহরকে সাজিয়ে তুলতে পারে। পাহাড়, নদী, হ্রদ, গ্রাম, বরফ আর নীল আকাশ—সবকিছুর এমন মিলন আর কোথাও দেখা মেলে না।
হাঁটতে হাঁটতে হয়তো হঠাৎই দূরে চোখে পড়বে তুষারঢাকা জুঙফ্রাউ-এর শিখর। সেই সৌন্দর্য আপনাকে নিজের ভিতরের শান্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। ভ্রমণ শেষে মনে হবে—ইন্টারলাকেন কেবল একটি জায়গা নয়; এটি এক অনুভূতি, যেখানে গিয়েই মানুষ আবার স্বপ্ন দেখতে শেখে।












Leave a Reply