আরতি গুপ্ত : ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক সাহসী নারী বিপ্লবী।

ভূমিকা:-  ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে নারী বিপ্লবীদের অবদান আজও অনেকাংশে অপ্রকাশিত থেকে গেছে। তাঁদের জীবন ও সংগ্রাম কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বাধিকার অর্জনের জন্যই ছিল না, বরং তা ছিল আত্মমর্যাদা, জাতীয়তাবোধ এবং সামাজিক পরিবর্তনের এক অদম্য প্রয়াস। আরতি গুপ্ত ছিলেন সেই ধরনেরই এক সাহসী নারী, যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছিলেন। যদিও তাঁর নাম হয়তো অনেকের কাছে অপরিচিত, তবু তাঁর কর্মজীবন, সংগ্রামী মানসিকতা এবং আত্মত্যাগের ইতিহাস ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অমূল্য সম্পদ।

শৈশব ও পারিবারিক পটভূমি

আরতি গুপ্ত জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে (প্রায় ১৯১০–১৯১৫ সালের মধ্যে) তৎকালীন বেঙ্গল প্রদেশের (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের) একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর পিতা ছিলেন এক সুপরিচিত শিক্ষাবিদ ও সামাজিক কর্মী, যিনি জাতীয়তাবাদী চিন্তায় বিশ্বাসী ছিলেন। মা ছিলেন শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা নারী, যিনি আরতিকে ছোট থেকেই দেশপ্রেমের গল্প শুনিয়ে বড় করেছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই আরতি সংস্কৃত ও বাংলা সাহিত্যে গভীর আগ্রহী ছিলেন এবং পড়াশোনার পাশাপাশি নাটক, আবৃত্তি ও দেশাত্মবোধক গান গাওয়ায় দক্ষ ছিলেন।

শিক্ষাজীবন ও রাজনৈতিক প্রেরণা

আরতির স্কুলজীবন কেটেছে কলকাতার একটি গার্লস’ স্কুলে। সেখানেই তিনি প্রথম গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বিপ্লবী কার্যকলাপ এবং বাঘা যতীনের মতো বীরদের গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হন।
কিশোরী বয়সেই তিনি যুগান্তর দল ও অগ্নিবীণা সমিতি-এর মতো বিপ্লবী সংগঠনের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর এক সহপাঠিনীর মাধ্যমে তিনি গোপনে বিপ্লবী সাহিত্য পড়া শুরু করেন এবং অস্ত্র সংগ্রহ, গোপন বার্তা আদানপ্রদান ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন।

বিপ্লবী জীবনের সূচনা

আরতি গুপ্ত প্রথম সক্রিয় ভূমিকা নেন ১৯৩০ সালে সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স মুভমেন্ট বা নাগরিক অবাধ্যতা আন্দোলনের সময়। তখন তিনি মাত্র কুড়ি বছরের এক তরুণী। কলকাতায় অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ মিছিলে তিনি সরাসরি অংশ নেন এবং পুলিশি লাঠিচার্জের মুখে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশবিরোধী স্লোগান দেন।
এই সময় তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ও মহিলা আত্মরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিপ্লবীদের জন্য গোপন আশ্রয়, অস্ত্র পরিবহন এবং গোপন নথি লুকিয়ে রাখার কাজে ভূমিকা রাখেন।

উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড

১. অস্ত্র পরিবহন অভিযান

১৯৩২ সালে বেঙ্গলে ব্রিটিশ পুলিশ যখন বিপ্লবী সংগঠনগুলোর উপর দমননীতি চালায়, তখন আরতি গুপ্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মিশনে অংশ নেন। তাঁকে কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত একটি রিভলভার ও কয়েক ডজন কার্তুজ পৌঁছে দিতে হয়। পুলিশের চোখে ধুলো দিতে তিনি গৃহবধূর ছদ্মবেশ নেন এবং নিজের শাড়ির আঁচলে অস্ত্র লুকিয়ে সফলভাবে গন্তব্যে পৌঁছে দেন।

২. জেলবন্দী বিপ্লবীদের সহায়তা

ব্রিটিশ সরকার বহু বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠালে, আরতি তাঁদের পরিবারের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও চিঠি-পত্র পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেন। তিনি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও মহিলা কমিটির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করেন।

৩. প্রচারণা ও নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি

তিনি বিশ্বাস করতেন স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীর ভূমিকা অপরিহার্য। তাই তিনি কলকাতা ও হাওড়া অঞ্চলে গোপন বৈঠক আয়োজন করে তরুণীদের বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন।

গ্রেপ্তার ও কারাবাস

১৯৩৩ সালে ব্রিটিশ পুলিশ একটি অস্ত্র চক্রের খোঁজ পেয়ে বেশ কয়েকজন বিপ্লবীর সঙ্গে আরতি গুপ্তকেও গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে “ব্রিটিশবিরোধী ষড়যন্ত্র” ও “অস্ত্র আইন ভঙ্গ” করার অভিযোগ আনা হয়।
জেল জীবনে আরতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু তিনি কখনও সহযোদ্ধাদের নাম প্রকাশ করেননি। তাঁর দৃঢ়তা দেখে অনেক জেলবন্দী নারী অনুপ্রাণিত হন। প্রায় ১৮ মাস কারাবাসের পর তিনি মুক্তি পান, তবে ব্রিটিশ সরকার তাঁর উপর নজরদারি চালিয়ে যায়।

স্বাধীনতার পর জীবন

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর আরতি গুপ্ত সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি সামাজিক ও শিক্ষামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। বিশেষ করে গ্রামীণ নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও স্বনির্ভরতা বৃদ্ধিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
তিনি কলকাতায় একটি মহিলা শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে নারীদের সাক্ষরতা শিক্ষা, সেলাই, হস্তশিল্প ও প্রাথমিক চিকিৎসা শেখানো হতো।

ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ

আরতি গুপ্ত ছিলেন এক দৃঢ়চেতা, সাহসী ও ত্যাগী নারী। তাঁর জীবনের মূল মন্ত্র ছিল— “দেশ আগে, নিজের জীবন পরে”। তিনি কখনও খ্যাতি বা পুরস্কারের জন্য সংগ্রাম করেননি, বরং নীরবে দেশের জন্য কাজ করে গেছেন।

উত্তরাধিকার

যদিও তাঁর নাম ভারতের মূলধারার ইতিহাস বইয়ে তেমনভাবে উল্লেখিত নয়, তবুও স্থানীয় পর্যায়ে ও বিপ্লবীদের স্মৃতিচারণায় তাঁর অবদান আজও সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা হয়। অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবার তাঁকে “আরতি দি” নামে ডাকতেন।

উপসংহার

আরতি গুপ্তের জীবন আমাদের শেখায় যে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুধু সামনের সারির নেতাদের দ্বারাই সম্ভব হয়নি; অসংখ্য অজানা নারী-পুরুষ গোপনে, নিঃস্বার্থভাবে, জীবন বাজি রেখে সেই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছেন।
তাঁদের আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে। আজকের দিনে যখন জাতীয়তাবোধ প্রায়শই রাজনৈতিক স্লোগানে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে, তখন আরতি গুপ্তের মতো মানুষদের জীবনের শিক্ষা আমাদের আবার মনে করিয়ে দেয়— “সত্যিকার দেশপ্রেম মানে ত্যাগ, সততা ও নীরব সংগ্রাম”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *