
️ শেষ বৃষ্টির দিন
সেদিন আকাশটা একটু অন্যরকম ছিল। দুপুরের রোদটা যেন কোথাও হারিয়ে গিয়ে হঠাৎই নেমে এলো হালকা বৃষ্টি। কলেজের শেষ বর্ষের দিনগুলো, ক্লাস এগজাম–সব মিলিয়ে সবাই তখন ব্যস্ত, কিন্তু অনিরুদ্ধের চোখে আজ অন্য আলো। কারণ আজই সে ঠিক করেছে মেঘলার কাছে তার মনের কথাটা বলবে।
মেঘলা—চুপচাপ, মায়াভরা চোখের মেয়ে। খুব বেশি কথা বলে না, কিন্তু যার মুখে হাসি ফুটলে আশেপাশের সবকিছু আলোকিত হয়ে ওঠে। অনিরুদ্ধ তাকে প্রথম দেখেছিল লাইব্রেরিতে, হাতে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা। সেই দিন থেকেই মেয়েটির চোখে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল সে।
প্রথম দেখা, প্রথম কথা
মেঘলা বই খুঁজছিল। উঁচু তাকের ওপরের বই। হাত উঠিয়ে পৌঁছাতে পারছিল না। অনিরুদ্ধ এগিয়ে গিয়ে বলল—
“আমি এনে দেব?”
মেঘলা আকাশের মেঘ দেখে হাসল, “দেখি আপনি পারলে।”
সেই হাসিটা আজও অনিরুদ্ধ ভুলতে পারেনি।
সেই থেকে দু’জনের দেখা, কথা, ক্লাসের প্রোজেক্ট—সবই যেন নিজে থেকেই এক সুতোয় গাঁথা।
বন্ধুত্বের ভিতর লুকিয়ে থাকা প্রেম
মেঘলা তাকে তার ছোট্ট পৃথিবীর গল্প বলত—
তার মা নেই, বাবা দার্জিলিংয়ে চাকরি করেন, তাই বেশিরভাগ সময়ই সে একা থাকে।
অনিরুদ্ধ চুপচাপ শুনত, কখনো কিছু বলত না; শুধু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করত—
“আমি থাকব, সবসময়।”
মেঘলাও অনিরুদ্ধকে খুব বিশ্বাস করত।
ক্লাসে প্রেজেন্টেশন দিতে হলে প্রথমেই অনিরুদ্ধকে খুঁজত,
লাইব্রেরিতে নতুন বই পেলে তাকে দেখাত,
নতুন শাড়ি কিনলে ছবি পাঠিয়ে মতামত চাইত।
কিন্তু ভালোবাসার কথা… দু’জনেই বলতে পারেনি।
️ সেই দিন, সেই বৃষ্টি
সেদিন কলেজ বন্ধ। মেঘলা বলল—
“আমার একটু কাজে বেরোতে হবে… তুমি আসবে? একা যেতে ইচ্ছে করছে না।”
অনিরুদ্ধ যেন অপেক্ষাতেই ছিল।
দু’জনে বাসস্ট্যান্ডে নামতেই বৃষ্টি নামল হঠাৎ।
মেঘলা ছাতা আনেনি, অনিরুদ্ধ ছাতাটা এগিয়ে দিল।
দু’জনের মাঝে মাত্র একটি ছাতা… আর চারপাশে ভিজে শহর।
মেঘলা তাকাল—
“অনিরুদ্ধ… তুমি আজ একটু চুপ হয়ে আছো, কিছু বলবে?”
অনিরুদ্ধ মন সমবেত করল।
“হ্যাঁ, বলব, কিন্তু ভয় হচ্ছে… শুনে তুমি হয়তো দূরে চলে যাবে।”
মেঘলা মৃদু হেসে বলল—
“আমি দূরে যাওয়ার মানুষ নই।”
অনিরুদ্ধের গলার স্বর কেঁপে উঠল—
“মেঘলা… আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি। অনেকদিন ধরে। তুমি… তুমি কি আমার জীবনের সাথী হতে পারবে?”
ছাতার নিচে দু’জনের নিঃশ্বাসের ভাঁজে জমে থাকা নীরবতা হঠাৎ থেমে গেল।
মেঘলা চোখ তুলে তাকাল—চোখ ভিজে, নাকি বৃষ্টির জল তা বোঝা যাচ্ছিল না।
“অনিরুদ্ধ… এতদিন ধরে তুমি যেটা ভাবছো, জানো… আমিও ঠিক একইটা ভাবছিলাম।”
বৃষ্টির শব্দটা যেন করতালির মতো শোনাল।
নতুন শুরু
সেই দিন থেকেই তাদের গল্পের নতুন অধ্যায় শুরু হল।
শহরের প্রতিটি ক্যাফে, প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি লাইব্রেরির কোণে যেন তাদের দু’জনের হাসির চিহ্ন ছড়িয়ে পড়ল।
মেঘলার একাকীত্বের জায়গা ভরে গেল অনিরুদ্ধের উপস্থিতিতে।
আর অনিরুদ্ধের ছেলেবেলার শূন্যতা পূর্ণ হলো মেঘলার ভালোবাসায়।
শেষ বৃষ্টির রাতে প্রতিশ্রুতি
কলেজ শেষের দিন। আবার বৃষ্টি।
মেঘলা তার পুরোনো ডায়েরি খুলে অনিরুদ্ধকে দিল।
ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা—
“যেদিন প্রথম ‘শেষের কবিতা’ হাতে নিয়ে তাকেটিতে দাঁড়িয়েছিলাম, সেদিনই আমার জীবনের শুরু হয়েছিল—অনিরুদ্ধকে দেখার এক নতুন জীবন।”
অনিরুদ্ধ কিছু বলার আগেই মেঘলা বলল—
“চলো, আজ একটা প্রতিশ্রুতি করি—
যতদিন বৃষ্টি থাকবে, ততদিন আমরা একে অপরের ছাতা হয়ে থাকব।”
অনিরুদ্ধ তার হাতটা ধরে বলল—
“বৃষ্টি থেমে গেলেও, আমি তোমার হাত ছাড়ব না।”
আর বাইরে তখন টুপটাপ করে বৃষ্টি নামছে—
একটি নতুন প্রেমের গল্পকে আশীর্বাদ জানিয়ে।












Leave a Reply