কল্লোলিনী : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
285

উষসী ঘুমিয়ে পড়েছে । উঠেছে কোন্‌ ভোরে । উঠে প্রাতর্ভ্রমণ । সব মিলিয়ে চল্লিশ মিনিটের হাঁটা । ঘরে ঢুকে প্রত্যুষের জন্য লিকার চা । তার আবার চায়ে দুধ ও চিনিতে অরুচি । চা বানানোর ক্ষেত্রে কতো ঝকমারি ! প্রত্যুষ চা খাওয়ার পর বাথ রুমে ঢুকলো । ঠিক সাতটা নাগাদ বাজার থেকে ছোট পুটি ও ট্যাংরা মাছ এনে উষসীর মুখের সামনে রেখে বললো, “আমাকে আটটার ট্রেন ধরতে হবে । পেঁয়াজ ফোড়ন দিয়ে আলু ও বেগুনের ট্যাংরা মাছের মাখা মাখা ঝোল করো । ট্যাংরা মাছের ঝাল আমার খুব ভাল লাগে । আমি স্নানে ঢুকলাম !”
তারপর হুটোপুটি করে রান্না ! স্নান সেরে ধোঁয়া ওঠা ভাত ও মাছের ঝোল দেখে প্রত্যুষের কী গোসা ! রেগে উষসীকে কতকগুলি আলতুফালতু কথা শুনিয়ে দিলো । যে কথাগুলির কোনো মানে নেই । অথচ কথাগুলি খুব পীড়াদায়ক, ঠিক শরীরে হুল ফোটানোর ন্যায় ! “সারাটা দিন খাও, আর ঘুমাও । কাজের মধ্যে সকালবেলায় দুমুঠো রান্না আর রাতের বেলায় দুখানা রুটি ! এইটুকু কাজে লম্ফঝম্ফ !” এর পরেও প্রত্যুষের হুল ফোটানো কথার শেষ হয় না । বলতে থাকে, “আয় করার একফোটা মুরোদ নেই । তার আবার বড় বড় কথা ! ঘাম ঝরিয়ে সে উপার্জন করে না আনলে পেটে ভাত জুটবে না ।“ আরও কতোগুলি আবান্তর কথা শুনিয়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ছুটলো অফিসে ।
প্রত্যুষকে অফিসে রওনা করিয়ে দিয়ে তনুর প্রতি ধ্যান দিলো উষসী । তনুর সামনে স্নাতক ডিগ্রির ফাইনাল পরীক্ষা । কিন্তু পড়াশুনায় তেমন মন নেই । বাবার মতো রাগী । যদিও মেয়ের রাগের কোনো মাথামুণ্ড নেই । দুমদাম অবাঞ্ছিত কথার আস্ফালন ! সবচেয়ে দুঃখজনক, লোকজনের মাঝে হিসাব না করে তনুর আলটপকা বেফাঁস কথা বলা । যার জন্য উষসীকে বিপাকে পড়তে হয় । মেয়ের কথা যে কাউকে আঘাত করার উদ্দেশে নয়, এমনকি কথাটা অতি সাধারণ মানের সেটা বোঝাতে উষসীকে মধ্যস্ততা করতে হয় । যাই হোক তনু পুটি মাছ ভাজা ও ট্যাংরা মাছের ঝাল দিয়ে ভাত খেয়ে সেজেগুজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো । সম্ভবত কলেজে যাওয়া তার উদ্দেশ্য ।
উষসীর আজ আর খেতে ইচ্ছা করছে না । যে ধরনের কথাবার্তা উগরে দিয়ে প্রত্যুষ অফিসে বেরিয়ে গেলো সেগুলো ভাবলে তার গলা দিয়ে ভাত নামবে না । বিয়ের পর দিন থেকেই উষসী সম্যকভাবে বুঝেছিলো, তার কপাল পুড়েছে । মা-বাবার চাপে সে ভুল নৌকায় পা দিয়েছে । যেখানে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল ! যার খেসারত সারাটা জীবন তাকে দিতে হচ্ছে । লেখাপড়া কলেজের গণ্ডি পর্যন্ত । সেই সময় দৌড়ঝাঁপ করলে হয় তো প্রাইমারী স্কুলের মাস্টারি নতুবা নিদেনপক্ষে সরকারি অফিসে ছোটখাটো কাজ জোটাতে পারতো । সেখানেও আপত্তি তার বাবা-মায়ের । চাকরি করে কী হবে ? সেই তো বিয়ে হয়ে যাবে । সুতরাং প্রত্যুষের মতো ভাল ছেলের সন্ধান যেহেতু পাওয়া গেছে, তাকে হাত ছাড়া করা বোকামীর পরিচয় । পাত্রের সরকারি চাকরি । বাবা পেনশন পান । দুটো বোন বিয়ে হয়ে গেলে নির্ঝঞ্ঝাট ফ্যামিলি ।
দাঁতে দাঁত চেপে বাবা-মা ও দাদার সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধে গিয়ে উষসী বলেছিলো, “সে একটা ছেলেকে ভালবাসে ।“
এই কথা শুনে উষসীর বাবা রেগে গিয়ে ভীষণ বকাবকি । উষসীর দাদা তাকে মারতে শুধু বাকী রেখেছিলেন, কিন্তু বিশ্রী ভাষায় চূড়ান্ত অপমান করেছিলেন । দাদাকে ছাড়িয়ে বৌদি কয়েকগুণ উঁচু গলায় উষসীকে যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করেছিলেন । পরিণতিতে যেটা হল, উষসীর ভালবাসাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে দাদা ও বাবা উঠেপড়ে লেগেছিলেন প্রত্যুষের সঙ্গে সত্বর বিয়ে দিতে । প্রত্যুষদের বাড়ি থেকে অনেক উপঢৌকন দাবি ছিলো । সেগুলি মিটিয়ে বাবা ও দাদা একরকম জোর করে উষসীকে বিয়ে দিলেন ।
প্রত্যুষের আসল কদর্য রূপ প্রকাশ পায় বিয়ের দ্বিরাগমনের পর পরেই । এক বিছানায় শোওয়ার আগে প্রত্যুষের দাবি, “এই মুহূর্তে বাপের বাড়ি থেকে দুই লাখ টাকা না আনলে আমাকে তুমি কোনোদিন স্বামী হিসাবে পাবে না ।“ উষসী কল্পনাও করতে পারেনি, প্রত্যুষের প্রলোভনের মাত্রা লাগামছাড়া । অনেক টাকা পাওয়ার লালসা ঊর্ধ্বগতি ! প্রত্যুষের এই ধরনের অভব্যতা উষসীর একদম পছন্দ না । তাই উষসী বিছানায় গা এলিয়ে না দিয়ে স্বামীর বিরূদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বললো, “বেঁচে থাকতে আমি বাবা-মাকে কিছুতেই টাকার কথা বলতে পারব না ।“ এই কথা শুনে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলো প্রত্যুষ ! রাগে, ক্রোধে অতো রাত্রিতে উষসীকে চুলের মুঠি ধরে বেধড়ক পিটিয়েছিলো । বলা চলে এলোপাথাড়ি ঠ্যাঙানি !
( ২ )
খুব কষ্ট পেয়েছিলো উষসী । রাগে দুঃখে ব্যথিত হৃদয়ে সেই রাত্রে স্বামীর বাড়ি থেকে পালায় উষসী । তারপর স্টেশনে ট্রেন ধরার জন্য অপেক্ষায় ছিলো । কিন্তু ট্রেন ঢোকার আগেই প্রত্যুষ লোকজন নিয়ে উষসীকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেলো । অথচ পরে উষসী জানতে পারে, প্রত্যুষ তার বাবার কাছ থেকে দুই লাখ টাকা আদায় করেছিলো । শুধু তাই নয়, প্রত্যুষের বড় বোনের বিয়ের সময় চাপ দিয়ে উষসীর বাবার কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করেছিলো । প্রায় এক বছর একসঙ্গে একবিছানায় থাকলেও কেউ কাউকে ছুঁতো না । উষসী জেনেছিলো, “কলাবতী প্রত্যুষের অফিসের পিয়ন । সে বিধবা । স্বামী মারা যাওয়ার পর সেই জায়গায় পিয়নের চাকরি । কলাবতীর সাথে প্রত্যুষের খুব দহরম-মহরম ।“ এটা জানার পর প্রত্যুষের শরীর ছুঁতেও উষসীর ঘিনঘিন ।
উষসীর মনের ভিতর একটা সিদ্ধান্ত ঘোরপাক খাচ্ছে, তনুর বিয়েটা হয়ে গেলে নিজের জীবন নিয়ে উষসী কিছু একটা ভাববে । কেননা প্রত্যুষের দেওয়া জ্বালা যন্ত্রণা, সহনশীলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে । তার শরীর মন মানসিক অবসাদে ভারাক্রান্ত ! প্রত্যুষের বিবেকহীন ব্যবহারে উষসী তিতিবিরক্ত ! সাংসারিক জীবন থেকে সে মুক্তি চায় । এখন কোথাও আশ্রমবাসী হওয়ার ইচ্ছা । মাঝখানে মেয়েটি কোলে আসায় মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে উষসীর এতদিন বেঁচে থাকা । যদিও উষসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, এই বাঁচাটার মধ্যে কোনো প্রাণের স্পন্দন নেই । আছে শুধু, স্বামীর স্বেচ্ছাচারিতা সহ্য করা এবং তার আস্ফালন নীরবে মুখ বুজে সহ্য করা । উষসী বড্ড ক্লান্ত । সে মনেপ্রাণে মুক্তি চায় ।
তনুর সম্বন্ধের ব্যাপারে তার বাবা খুব ব্যতিব্যস্ত । কিন্তু উষসী চেয়েছিলো মেয়েটা আগে নিজের পায়ে দাঁড়াক । তারপর তার বিয়ে । কিন্তু কে শোনে কার কথা ! মেয়েটাও বাবার তালে তাল দেয় । বিয়ে করার জন্য মেয়েটাও উদগ্রীব । পাত্র ব্যবসায়ী । অনেক পয়সার মালিক । অথচ ছেলেটাকে দেখলে শান্ত-শিষ্ট মনে হয় না । কথাবার্তায় তেমনি উগ্র । মার্জিত স্বভাবের ছিটেফোঁটা নেই । সেই কারণে ছেলেটাকে উষসীর ভাল লাগে না । তার না-পসন্দ ! তবুও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না । পাছে বাড়িতে অশান্তির ঘনঘটার ভয় ।
( ৩ )
প্রত্যুষ ও তনু বাড়ি থেকে নিজ নিজ কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পর উষসীর কিচ্ছু ভাল লাগছে না । খাওয়ার ইচ্ছা নেই বললেই চলে । কাজের মাসি কাজ সেরে অনেকক্ষণ বেরিয়ে গেছে । ঘড়িতে বেলা বারোটা তিরিশ । এখন তার স্নান করার সময় ! সকাল থেকে উষসী অভুক্ত । তার মুড অফ । সারা শরীর-মনে একটা বিষণ্ণতার ছাপ । আয়নার সামনে দাঁড়ালো উষসী । খিদেয় তার ঠোট দুটি শুকিয়ে কাঠ । বয়স অনেক বেড়েছে । কিন্তু তার শরীরের জেল্লা এখনও আকর্ষণীয় । শরীরের দিকে তাকিয়ে উষসীর কলেজ জীবনের কথা মনে পড়ে গেলো । কল্লোল ছিলো তার ন্যাওটা । উষসীর পিছে ঘুরঘুর তার স্বভাব । কতো সরল সোজা ছেলে । ঘোরপ্যাঁচ তার স্বভাববিরূদ্ধ । প্রশংসনীয় তার ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি । যেটা উষসীর মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিত । উষসীর প্রতি কল্লোলের যত্ন অবর্ণনীয় । উষসীর কী দরকার, কী খাবে, কীভাবে বাড়ি ফিরবে সবদিকেই তার নজর ! অর্থনীতি বিষয়টা উষসীর অপছন্দ । অথচ সেই বিষয়ে পাশ করা বাধ্যতামূলক ! কল্লোল তাকে সুন্দরভাবে অর্থনীতি বিষয়ের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দেওয়ায় অর্থনীতিতে উষসী ভাল ফল করেছিলো যেটা আশাতীত ! ঘনিষ্টভাবে মেলামেশার কারণে নিজের অজান্তে উষসী কখন যেনো কল্লোলকে খুব ভালবেসে ফেলে । গোবেচারা কল্লোলকেই জীবনসঙ্গী হিসাবে ভেবে রেখেছিলো উষসী । ভেবে রাখা কেন, কল্লোলকেও তার অফুরন্ত ভালবাসার কথা ব্যক্ত করেছিলো । কিন্তু কল্লোল তখন উপার্জনহীন এক বেকার যুবক । তাই নিজেকে দাঁড় করানোর জন্য কিছুদিন সময় চেয়েছিলো । সেই কল্লোল এখন উষসীর জীবনে ইতিহাস ।
হঠাৎ প্রত্যুষের টেলিফোন । ফোন করে জানালো তার ফিরতে রাত্রি হবে । অফিসের কাজে তাকে অন্যত্র যেতে হচ্ছে । যদিও পরে উষসী জানতে পেরেছিলো, প্রত্যুষ বিধবা কর্মীর বাড়িতে তার মেয়ের জন্মদিনের পার্টিতে আমন্ত্রিত গুরুত্বপূর্ণ অতিথি ।
সাতপাঁচ চিন্তা বন্ধ করে উষসী বিছানায় গা এলিয়ে দিলো ।
ভর দুপুরে না খাওয়া ক্লান্ত শরীর । নিমেষেই ঘুমিয়ে পড়লো ।
ঘুমাবার আগে বাড়িতে ঢোকার সদর দরজা বন্ধ করতে বেমালুম ভুলে গেলো ! এমনকি তার শোওয়ার ঘরের দরজা পর্যন্ত খোলা । দরজা খোলা রেখে এলো চুলে খাটের উপর ঘুমিয়ে পড়লো উষসী ।
( ৪ )
“উষসী তুমি ওঠো । তাকিয়ে দেখো আমি এসেছি !”
উষসী ঘুমে বিভোর । আবার কল্লোল ডাকলো, “উষসী ওঠো । চোখ মেলে তাকাও !”
তবুও উষসীর ঘুম ভাঙছে না । উষসীর সেই বাঁধ ভাঙ্গা হাসির মুখটা আজও অমলিন ! উষসীর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কল্লোল । তার শারীরিক স্থিতি দেখে কল্লোল মনে মনে ভাবছে, উষসী এখনও ঠিক আগের মতো রয়েছে । যেরকমটি দুজনের যৌবন বয়সের সময় ছিলো । অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে উষসীকে প্রাণভরে দেখছিলো কল্লোল । তারপর তার ঘুম না ভাঙ্গার দরুন বাধ্য হয়ে পরস্ত্রীর শরীরে আলতোভাবে ছোঁয়া দিয়ে কল্লোল পুনরায় ডাকলো, “ওঠো উষসী । আমি কল্লোল । তোমার সাথে দেখা করার জন্য অনেক দূর থেকে ছুটে এসেছি ।“
ঘুমের মধ্যে কল্লোলের হাতের ছোঁয়া অনুভব করছে উষসী । কিন্তু তখনও সে গভীর ঘুমে আছন্ন । চোখ মেলে তাকাতে পারছে না ।
এবার উষসীর হাত ধরে টানতে গিয়ে কল্লোল বুঝতে পারলো, উষসীর শরীরে ভীষণ জ্বর । জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে । জ্বরের কারণে রীতিমতো ঘামছে । জ্বরের শরীরে চোখ মেলে তাকালো উষসী । উষসী দেখতে পেলো, তার সামনে অন্তরে লুকিয়ে থাকা ভালবাসার মানুষ কল্লোল দাঁড়িয়ে । তারপর উষসী উঠে বসতে চেষ্টা করে । কিন্তু জ্বরের জন্য শারীরিক ভারসাম্য রাখতে পারছে না ।
কল্লোল উষসীকে কোলে নিয়ে ছুটলো ডাক্তারখানায় । ডাক্তারবাবু ঔষধ দিয়ে বললেন, “উষসীকে মানসিক চাপমুক্ত থাকতে হবে । খাওয়া দাওয়ার প্রতি যথেষ্ট নজর দেওয়া চাই ।“
বাড়ি ফিরে কল্লোল ব্যাগ থেকে একগুচ্ছ লাল গোলাপ ফুলের তোড়া বের করে উষসীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, “আজও তুমি আমার মনের মণিকোঠায় উজ্জীবিত । তোমাকে ভালবাসার পর আমি আর কাউকে ভালবাসতে পারিনি । আমার হৃদয় আজও খালি ! শুধু শূন্যতায় ভরা ।“
উষসী কল্লোলের হাত নিজের বুকের কাছে নিয়ে শুধুই কান্না ।
তারপর হঠাৎ একদিন কলেজ থেকে ফিরে তনু সারা বাড়ি খুঁজে তার মাকে পাচ্ছে না । তনুর পড়ার টেবিলে একটা চিঠি । “স্নেহের তনু, মাকে খুঁজলেও পাবে না । কেননা আমি এখন অনেক দূরে । আমার অনুরোধ, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসো । তাতে তোমার মঙ্গল হবে ।“ ইতি, হিতাকাঙ্খী মা ।
————-০—————-
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী-৭৪১২৩৫ (ভারত)