কোথাও একদিন দেখা হয়ে যায়
নিজের সঙ্গে নিজের,অক্ষরে-অনুভবে,
কে কাকে বন্দী করে! সব হারায়
আমি সহস্র ‘আমি’ হয়ে দাঁড়াব,নীরবে!
বইপড়ার বিকল্প কোনোদিন হবে না!
কেউ বলেন,বই পড়ার সময় কোথায়? কেউ বলেন,বই পড়তে বসলেই ঘুম এসে যায়!কেউ বলেন,বই পড়ার মতো বোরিং কিছু আছে!
অথচ এই মানবসভ্যতার অগ্রগতি এবং উন্নয়ন, আরও জোর গলায় বললে বোঝা যায়,সুরক্ষা ও শক্তি, সবই বই পড়েই এসেছে।
তাই এ বিষয় তর্ক নয়।
বলা হচ্ছে,বই পড়ার অভ্যাস।যথাযথ পাঠক হয়ে ওঠা।তুমি যদি পাঠক হিসেবে অধম হও,আমি উত্তম হইব না কেন?
কথাটায় বঙ্কিমী স্টাইলের অনুকরণ থাকলেও,এতে একবিন্দু বঙ্কিম শ্লেষ নেই।বরং এক আশ্চর্য আলোর কথা বলতেই আপনাদের সামনে এসেছি। বই পড়ার অভ্যাস, শুধু অভ্যাস নয়,এ এক আলোর সাধনা।এসব বিশদ আলোচনার আগে,আমার প্রিয় প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরীর একটি কথা স্মরণ করা দরকার—
“বইপড়ার শখটা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ শখ হলেও আমি কাউকে শখ হিসেবে বই পড়তে পরামর্শ দিতে চাইনে।প্রথমত,সে পরামর্শ কেউ গ্রাহ্য করবেন না,কেননা আমরা জাত হিসেবে শৌখিন নই;দ্বিতীয়ত অনেকে তা কুপরামর্শ মনে করবেন, কেননা আমাদের টখন ঠিক শখ করবার সময় নয়।আমাদের এই রোগশোক দুঃখদারিদ্র্যের দেশে জীবনধারণ করাই যখন হয়েছে প্রধান সমস্যা, তখন সে জীবনকে সুন্দর করা মহৎ করার প্রস্তাব অনেকের কাছেই নিরর্থক এবং সম্ভবত নির্মমও ঠেকবে”
অর্থাৎ তেতো ঔষধ গেলবার মতো এই কথাগুলো পড়বেন না,অতি গঠনমূলক ও ইতিবাচক কথা হাজারবার বললেও,যখন চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনির গল্প হয়,তখন এইভাবে বই পড়ার কথা বলতে হয়।
কারণ এর আগে তিনি বার বার করে বলে গেছেন,
“যে জাতির যত বেশি লোক যত বেশি বই পড়ে,সে জাতি যে তত সভ্য”
“পৃথিবীতে সুনীতির চাইতে সুরুচি কিছু কম দুর্লভ পদার্থ নয়,পুরাকালে সাহিত্যের চর্চা মানুষকে নীতিবান না করুলেও রুচিমান করত।সমাজের পক্ষে এও একটা কম লাভ নয়”
“যে জাতি যত নিরানন্দ, সে জাতি তত নির্জীব। একমাত্র আনন্দের স্পর্শেই মানুষের মনপ্রাণ সজীব, সতেজ ও সরাগ হয়ে ওঠে।সুতরাং সাহিত্যচর্চার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে, জাতির জীবনীশক্তির হ্রাস করা,অতএত কোনো নীতির অনুসারেই তা কর্তব্য হতে পারে না,অর্থনীতিরও নয়,ধর্মনীতিরও নয়”
সোজা কথায় বই পড়তে হবে।ক’ জন তা জানেন! আপনাকে সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে না বা কবিতা লেখার জন্য রাত জাগতে হবে না,আপনিও শুধু ভালো পাঠক হয়ে ওঠুন।প্রতিভাধর সাহিত্যিকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় একজন সৎ পাঠক।একে-অপরের পরিপূরক।
আজকাল অনেকেই সোস্যাল মিডিয়াকে পড়ার মাধ্যম করেছেন এবং এমন অভ্যাস করে ফেলেছেন,সকালে উঠেই,সোস্যাল মিডিয়ার মুখ না দর্শণ করলে,তিনি নিজেকে অসম্পূর্ণ ও অন্ধকারময় মনে করেন।অবশ্যই সোসাল মিডিয়ার গুরুত্ব আছে।এই লেখাটিও আপনি সোস্যাল মিডিয়ায় পড়ছেন। অবশ্যই দেখুন,সেইসঙ্গে বোধ ও ব্যাপ্তি তৈরি করার জন্য বই পড়ুন।কারণ বই পড়ার যে নিভৃত জগৎ এবং নিরবচ্ছিন্ন নিমগ্নতা, তা সোস্যাল মিডিয়া দিতে পারে না।কারণ সোসাল মিডিয়ায় আপনি বিষয়ভাবনায় আত্মমগ্ন থাকতে পারবেন না এবং কোনো গভীরতাময় ভাবনায় একাগ্র হতে পারবেন না।যা বইপাঠ দিতে পারে। সৎ পাঠক নিজের মধ্যে সৃজনশীল অনুভবের আলোটি সঞ্চারিত করতে পারেন।এবং যে অন্তরতর শক্তিটি প্রদান করতে পারে,তা হল আত্মমনন এবং আত্মদর্শন।
রবীন্দ্রনাথ একটা কথা বলেন,শিক্ষক কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেই জোটে,গুরু তো ফরমাশ দিলেই পাওয়া যায় না”
এই গুরু কোথায়?
এই গুরু আপনার অন্তরে বসে আছে।যা জাগ্রত হয় পাঠক-সত্তার মাধ্যমে। কারণ ” সুশিক্ষিত লোক মাত্রেই স্বশিক্ষিত”
তা কমে যাচ্ছে!
মাইকেল মধুসূদন দত্ত মাত্র ৪৯ বছর আয়ুষ্কালে সৃজনকাল ২৩ বছর।এর মধ্যে তিনি ১২ খানি বাংলা বই,ইংরেজিতে ৪টি কাব্য,৫ টি নাটক,৫২ টি কবিতা,৭০ টি চিঠিপত্র, বাংলায় একটি চিঠি।এবং অসম্পূর্ণ রইল ১৪ টি নাটক- কবিতা-সংকলন।
এ সব সম্ভব হয়েছে তাঁর পাঠক সত্তার জন্য।তাঁকে আট নয় বছর বয়সে ফারসি শেখার জন্য সাগরদাঁড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে শেখাপুরা মসজিদের ইমাম লুতফল হকের কাছে।ফারসির পাশাপাশি আরবিও রপ্ত করতেন। কুড়ি বছর বয়সে অনুবাদ করলেন,ফারসি কবি সাদির কবিতা।মা জাহ্নবীদেবীর কাছে শিখলেন,রামায়ণ-মহাভারত-পুরানপাঠ।এই পাঠকসত্তার যে জন্ম হয়েছিল,তাঁর শৈশবেই,তাই মহাকবি হতে তাঁকে সাহায্য করেছিল।রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সর্বগ্রাসী এবং সর্ব অনুভবী পাঠক।তাই তিনি বিশ্বমানবতার কবি হয়েছেন।তাঁর পঠিত বইয়ের তালিকা নির্মাণ করলে,একটা মালগাড়ির আকার ধারণ করবে।তিনি যেমন লিখেছিলেন—-
অন্ধকার রুদ্ধগৃহে একেলা বসিয়া
পড়িতেছি মেঘদূত ;গৃহত্যাগী মন
মুক্তগতি মেঘপৃষ্ঠে লয়েছে আসন
উড়িয়াছে দেশদেশান্তরে….
একথা তিনি লেখার জন্য লেখেননি, তা তাঁর পাঠক সত্তার কথা পড়লেই প্রতিভাত হয়।
বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী,অথচ তিনিও সর্বগ্রাসী পাঠক ছিলেন।তাঁর প্রিয় কবি ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।তিনি বার বার ‘মেঘনাদবধকাব্য’ পড়তেন।কারণ তিনি বাঙালি জাতির হেদিয়ে পড়া বৈশিষ্ট্য পছন্দ করতেন না।তিনি জোর গলায় বলতেন,”ভাষাতেই ভাবের পরিচয় পাওয়া যায়,তা চার-শ বছর ধরে বাঙলা ভাষায় যা কিছু লেখা হয়েছে,সে সব এক কান্নার সুর।প্যানপ্যানানি ছাড়া আর কিছুই নেই।একটা বীরত্বসূচক কবিতার জন্ম দিতে পারেনি!”
এটা কোনো বিরোধিতামূলক বক্তব নয়,এ হল বাঙালির ভেতর পৌরুষত্ব জাগানোর বাণী।তিনি মহাকবি মধুসূদনের মধ্যে সেই পৌরুষ দেখেছিলেন,তাই তাঁকে genius বলেছেন।
জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চা ও বই পড়া সম্ভব এবং তা সবরকমের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, বঙ্গীয় শব্দকোষ এর প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘শব্দাম্বুধি’ উপাধি দিয়েছিলেন। পাশ্চাত্য দেশে জন্মালে তিনি নাইট-হুড পেতেন,সেই তিনি এ পোড়া দেশে ‘মহামহোপাধ্যায়’ সম্মানও পাননি! তাতেই তিনি দমেননি,এক অপার বাংলা শব্দের সমুদ্র রচনা করেছেন।এবং তিনি দৃঢ় বিশ্বাসে বলতেন–“নিত্য নিয়মিত প্রচেষ্টা, সুদৃঢ় অধ্যবসায় ও সঙ্কল্পসিদ্ধির ঐকান্তিক ইচ্ছা ব্রতসিদ্ধির মূলমন্ত্র।”
যাকে অপারেজয় কথাশিল্পী বলা হয়,তিনি কী পড়তেন? কার লেখা পড়তেন!হা,শরৎচন্দ্রের কথা বলছি,তিনি নিজেই তাঁর পাঠসত্তার কথা বলতে স্বীকার করেছেন রবীন্দ্রনাথের কথা,” আমার চাইতে তাঁকে কেউ বেশি মানেনি গুরু বলে,আমার চাইতে কেউ বেশি মকসো করেনি তাঁর লেখা।আজকের দিনে যে এত লোক আমার লেখা পড়ে,ভালো বলে,সে তাঁর জন্য’
কাজী নজরুল ইসলামকে অনেকেই কটাক্ষ করতেন,বিশেষ করে শনিবারের চিঠি র সম্পাদক সজনীকান্ত,এই কথা বলে,নজরুল শিক্ষাদীক্ষাহীন।তাঁর তেমন পড়াশুনা নেই বা বিলেতফেরত নয়! এই কথাগুলো বা নিন্দা যে কত বড় অসার এবং ব্যক্তিগত অসূয়াপন্ন,তা বোঝা যায়,নজরুলের সৃষ্টিসাধনার দিকে তাকালে।এখানে শুধু একটা দৃষ্টান্ত দিলেই হবে,কবি জয়মুদ্দিন নজরুল প্রসঙ্গে লিখেছিলেন,
আমি দেখিয়াছি গ্রামাফোন কোম্পানীতে নানান ধরণের গানের হট্টগোলের মধ্যে কবি বসিয়া আছেন,সামানে হারমোনিয়া,পাশে অনেকগুলি পান,আর গরম চা!ছ’সাতজন নামকরা গায়ক বসিয়া আছেন কবির রচনার প্রতীক্ষায়,একজনের চাই শ্যামাসঙ্গীত অপরজনের কীর্তন, একজনের ইসলামি সঙ্গীত,অন্যজনের ভাটিয়ালি গান,আরেকজনের চাই আধুনিক প্রেমের গান।এঁরা যেন অঞ্জলি পাতিয়া বসিয়া আছেন।কবি তাঁহার মানসলোক হইতে সুধা আহরণ করিয়া তাঁহাদের করপুট ভরিয়া দিলেন।”
এই মানসলোক এমনি এমনি তৈরি হয়নি!
সৈয়দ মুজতবা আলি মাতৃভাষা ছাড়াও একুশটি ভাষা জানেন এবং তার মধ্যে পনেরোটি ভাষা মাতৃভাষার মতো জলবৎ তরলং ছিল।তিনি তাঁর পাঠকসত্তার কথা বলতে একটা আফসোস করেছেন,হায়,আমার মাথার চতুর্দিকে যদি চোখ বসানো থাকতো, তাহলে অাচক্রবালবিস্তৃত এই সুন্দরী ধরণীর সম্পূর্ণ সৌন্দর্য একসঙ্গেই দেখতে পেতুম”
তা হয়নি বলেই, তিনি বই পড়েন।
এইসব মহজনদের পাশে আমার বইপড়া সেই সমু্দ্র ধারে নুড়ি নয়,বালি নয়,শুধু হাওয়া খাওয়ার জন্য দাঁড়ানোর যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা বলা যায়।
আপনিও পড়ুন।
এই লেখা যদি ভালো লাগে এবং আপনার কমেন্ট উৎসাহ পাই,তাহলে পরের পর্বে লিখব পাঠক হওয়ার নিজস্ব আলো অন্ধকার এবং কত অপমানের অল্প পাতার গুরুত্বহীন ইতিহাস।
এখন আঙুল থামাই।
একটু বই পড়ে নিই।
ভালো থাকুন।বই পড়ে।অবশ্যই বই পড়ে।
জয়তু।
———————-//—————-*****
২৬ মার্চ,২০২০©শুভঙ্কর দাস।হলদিয়া।