এডভেঞ্চারের সেই রাত : শতাব্দী মজুমদার।

0
923

এডভেঞ্চার এর নেশা পেয়ে বসেছিল আমাদের।এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ,প্রথমবার ঘাটশিলা , এবার ছিল চাঁদিপুর।বাড়িতে না জানিয়ে তিন চারদিন বন্ধুদের সঙ্গে মস্তি,খাও পিও মৌজ করো।হোস্টেলের শৃঙ্খলা থেকে বেড়িয়ে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে দেদার ফুর্তি।

আমরা পাঁচ জন গোগোল ,ঋজু,সায়ন্তন,
ঋদ্ধিমা আর আমি আত্রেয়ী।প্রত্যেকেই মফস্বল থেকে এসে কলকাতায় পড়াশুনা করছি।ইউনিভার্সিটির ই হোস্টেলে থাকি আমরা।ছেলেরা ছেলেদের হোস্টেলে আর মেয়েরা মেয়েদের হোস্টেলে।

চাঁদিপুরে যাবো বলে ভোরের ধৌলি এক্সপ্রেসের টিকিট কাটা হয়েছিল প্রথমটায়।সেমিস্টার যেদিন শেষ হচ্ছে তার পরের দিনই আমাদের বেড়িয়ে পড়ার কথা।বাড়িতে অবশ্য আমরা প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট দিনে সেমিষ্টার শেষ হওয়ার ঠিক তারিখটা না জানিয়ে আরও দিন তিনেক পর শেষ হবে বলেছিলাম।কারণ ওই সময়ই আমাদের বেড়িয়ে পড়ার সুযোগ।এর আগের বারও তাই করেছিলাম।

কিন্তু মুশকিল হলো একটা রাজনৈতিক দলের হঠাৎ বন্ধ ডেকে দেওয়ায়,এক্সাম একটা দিন পিছিয়ে গেল।অগত্যা চিন্তায় পড়লাম সবাই।গোগোল মুশকিল আসান করলো ,ভোরের ধৌলি এক্সপ্রেসের টিকিট ক্যানসেল করে সন্ধ্যের জগন্নাথ এক্সপ্রেসের টিকিট কাটা হলো।হাওড়া থেকে বালেশ্বর সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা ,তারপর বালেশ্বর থেকে গাড়িতে আধ ঘন্টা -চল্লিশ মিনিট, চাঁদিপুর ।ওই বারোটা সাড়ে বারোটার মধ্যেই পৌঁছে যাবো নিশ্চিত।

হাওড়া থেকে নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন ছাড়লেও একটু লেট করেই প্রায় সাড়ে এগারোটায় আমরা বালেশ্বর স্টেশনে নেমে পড়লাম।ডিসেম্বরের মাঝামাঝি।শীত কাল,এখানে আবার একটু বৃষ্টিও হচ্ছে।রাতে কোথায় থাকবো এরকম প্ল্যান কিছু আমরা আগে থেকে করিনি।ওই গিয়ে দেখা যাবে,এরকমই কথা হয়েছে।স্টেশন থেকে বেড়িয়ে আমরা গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি।একটা অটো এসে দাড়ালো,একটা অন্ধকার মতো জায়গায় ,আমরা এগিয়ে গেলাম অটোটির দিকে।চাঁদিপুর নিয়ে যেতে রাজি হলো অটোচালক।রাতে থাকার মতো একটা হোটেলে নিয়ে যেতে বললো সায়ন্তন।কলকাতার অটোর থেকে এখানকার অটোগুলি একটু বড় ।আমরা তিন জন পিছনে আর দুজন ড্রাইভারের দু পাশে বসলাম।ড্রাইভার লোকটি বেশ লম্বা মাঙ্কিটুপি তে মুখ মাথা এবং মুখেরও অনেকটা ঢাকা।চোখে চশমা,গায়ে একটা সোয়েটারের ওপর চাদর জড়ানো।অটো ড্রাইভার সারা রাস্তা একদম কথা বললো না।তবে ভাড়া নিয়ে কথা বলার সময় তার গলার স্বর যা শুনলাম তাতে মনে হলো খুব চেঁচিয়ে বা ঠান্ডা লেগে হয়তো গলার আওয়াজ ফ্যাসফ্যাসে বা বসে গেছে।

আধ ঘন্টার মধ্যেই অটোওয়ালা একটি গেস্টহাউসের সামনে অটো দাঁড় করালো।বৈজয়ন্তী গেস্ট হাউস,ইংরেজিতে লেখা তার নিচে ওড়িয়া তেও সম্ভবত গেস্ট হাউসের নামই লেখা।তিনশো টাকা ভাড়া বার করে আমি অটোয়ালাকে দিতে গিয়ে দেখলাম ওর হাতের চেটো ,আঙ্গুল একদম পুড়ে যাওয়া।খারাপ লাগলো একটু, এই শীতের রাতে পুড়ে যাওয়া হাত নিয়ে ড্রাইভিং করছে।অন্যদেরও মনেহয় তাই মনে হলো।ঋজু আমার কানের কাছে মুখ এনে ওকে আরো পঞ্চাশ টাকা এক্সট্রা দিয়ে দিতে বললো।

হোটেলের রিসেপশনে একটু বয়স্ক যিনি বসে আছেন এতো রাতে,তিনিও মাঙ্কি টুপি পড়ে, চাঁদর মুড়ি দিয়ে আছেন।একটা খাতা ও পেন রাখা ছিল, তাতে আমাদের নাম,ঠিকানা লিখতে বললেন।ওনারও গলার আওয়াজ ভাঙা ভাঙা।কদিন থাকবো তাও লিখতে হলো।আমাদের প্রত্যেকের আইডি কার্ড দেখে উনি দুটো রুমেরই চাবি দিলেন ঋজুর হাতে।আর তখনই দেখলাম ওনার হাতও সেই ড্রাইভারের মতো পুড়ে যাওয়া।আমি কৌতূহল বশত জানতে চাইলাম আপনার হাতে কি হয়েছে?উনি এবার দু হাতেরই চেটো আমাদের সামনে মেলে ধরলেন।দেখলাম দুটো হাতই বীভৎস ভাবে পুড়ে যাওয়া।ঋদ্ধিমা আতকে উঠলো।উনি বললেন।সবই কপাল মা,সবকিছু পরে জেনো এখন তোমরা রুমে যাও।আবারও আমাদের সবারই বেশ খারাপ লাগছিল।কিন্তু এডভেঞ্চারের উত্তেজনায় মুহূর্তে খারাপলাগা ভুলে আমরা রুমে ঢুকে পড়লাম।

দুটো রুম নিলেও আমরা বেশিরভাগ সময় সবাই একটা রুমেই থাকবো।গোগোল আর ঋদ্ধিমা বোতল খুলে বসেছে সঙ্গে ঝাল বাদাম আর চিপস।সায়ন্তন বাথরুমে,আমি আর ঋজু সিগারেট ধরিয়েছি,নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলছি।হঠাৎ কারেন্ট অফ।সায়ন্তন বাথরুম থেকে চেঁচাচ্ছে। ওকে আস্বস্ত করে আমরা জেনারেটরের চালু হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি কিন্তু মিনিট পাঁচেকের মধ্যেও জেনারেটর বা কারেন্ট কোনোটাই না আসায় গোগোল ইন্টারকমে ফোন করে জেনারেটর চালু করবার কথা বলতে গেল।কিন্তু না, ফোন অচল।আমি আর গোগোল রিসেপশনে গেলাম,ফোনের টর্চ জ্বলিয়ে।না ,ওখানে কেউ নেই তো!
সেই ম্যানেজার ভদ্রলোক গেলেন কোথায়!বেশ মুশকিলে পড়া গেলো তো!আর কোনো বোর্ডার আছে বলেও তো মনে হচ্ছে না পাশের ঘর গুলিতে ,সব ঘর ই বন্ধ তবে কয়েকটা ঘরে তালা দেওয়া নেই ,মনে হচ্ছে
ভিতর থেকে বন্ধ।দরজা নক করতেই ভিতর থেকে দরজা খুলে গেল।মোবাইলের আলোয় কাউকে দেখতে পেলাম না।বাইরে বৃষ্টি পড়ছে অল্প,আমরা রুমে ফিরে এসেছি।হঠাৎ সায়ন্তন চেঁচিয়ে উঠলো,আমরাও লক্ষ করলাম মোবাইলের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দাগ গুলো।হাতের ছাপ স্পষ্ট দেওয়ালে,কালো কালো পুড়ে যাওয়া হাতের দাগ।বেশ অবাক হলাম সবাই, কই যতক্ষন কারেন্ট ছিল ততক্ষণ তো চোখে পড়েনি কারুর, এতটা এরকম স্পষ্ট দাগ!এর মধ্যে বাইরে বেশ কয়েকজন মানুষের কথা বার্তার অস্পষ্ট আওয়াজ পেলাম।ভাবলাম বুঝি জেনারেটর দিতে লোক এসেছে।কিন্তু হঠাৎ ই আবার সেই কথাবার্তার আওয়াজ মিলিয়ে গিয়ে সব শুনশান হয়ে গেলো।এই অন্ধকারের মধ্যেই মাঝে মাঝে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে ঘর আলোকিত করে আমরা একটা পেগ শেষ করে ফেলেছি।ঋদ্ধিমা হঠাৎ বলে উঠলো ,এই এখানে ভুত নেই তো!কেমন গা ছমছমে গেস্টহাউস টা না!আমরা বাকি চারজন হেসে ফেললাম।আসলে আমরা তখনো সেভাবে ভয় পাইনি।গোগোল বললো,ভুতের সঙ্গে রাত্রিবাস ,বেশ জমে যাবে কিন্তু আমাদের ট্যুরটা।

এরমধ্যেই হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা তাপপ্রবাহ খেলে গেলো। ভীষণ গরম লাগতে শুরু করলো আমাদের।আর প্রায় সাথে সাথেই ঘরের বাইরে শুরু হলো প্রবল আর্তনাদ।অনেকগুলি কণ্ঠের বাঁচাও,বাঁচাও।মুহূর্তের মধ্যে আমাদের ঘরের দরজা কে যেন খুলে দিল।আগুন লেগেছে গেস্টহাউসে,চারদিকে বীভৎস আগুন লোকজন সব পালাতে চাইছে শরীরে আগুন নিয়ে।ওই ড্রাইভার কে দেখতে পাচ্ছি,রিসেপশনের সেই বয়স্ক ভদ্র লোককেও দেখতে পাচ্ছি।আমরা পাঁচজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আতঙ্কে চেঁচাচ্ছি।আমাদের শরীরে আগুন নেই কিন্তু আমাদের চারদিকে তো আগুন আর ধোঁয়া।পালাতে পারছিনা আমরা ,শক্তি নেই গায়ে এতটুকু।এক্কেবারে নিশ্চল হয়ে পড়েছি।

পরদিন সকালে একজন মহিলা ও দুজন কনস্টেবল এর সাথে আমরা স্থানীয় থানায় চলেছি।গতকাল রাতের ঘটনা এক এক করে মনে পড়ছে ।কিন্তু পুলিশের সাথে কেন ,আমরা!আমি যখন ওই মহিলা পুলিশের হাতের ঠেলায় চোখ মেলি তখন দেখি সায়ন্তন আর ঋদ্ধিমা জেগে গিয়ে রিসেপশনের চেয়ারে বসে আছে।আর গোগোল ,ঋজুকেও ওঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে হোটেল এর সামনের ফাঁকা জায়গাটা থেকে।আমাদের সবারই হাত পা একটু একটু কেটে ছোড়ে গেছে।প্রথমে একটি হাসপাতালে আমাদের আনা হয়েছে।খতস্থানগুলোতে একটু ওষুধ দিয়ে আবার পুলিশের গাড়িতে উঠে বসতে হয়েছে।
আমরা পাঁচজন একে অপরকে দেখলেও কোনো কথা বলিনি যেন আমরা সব ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।

পুলিশ অফিসারের ঘরে আমাদের পাঁচ জনকে বসানো হয়েছে।মাঝ বয়সী অফিসার ,ইংরেজিতে জানতে চাইলেন আমাদের বাড়ি কোথায়?একেই কাল রাতের আতঙ্ক, তারপর পুলিশ !যদি বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায় ,কাউকে না বলে এভাবে এতদুরে আমাদের চলে আসা!ঋজু ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল, আমরা সবাই কলকাতা থেকে এসেছি।অফিসার এবার জানতে চাইলেন ,আমরা কি করি?ঋজু সত্যি কথাই বললো।আমরা স্টুডেন্ট ,ইউনিভার্সিটির নামও বলে দিল।ঋজুকে বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছে।এবার গোগোল, অফিসার কিছু বলার আগেই অফিসারকে প্রশ্ন করে বসলো,স্যার ওই গেস্টহাউসটা কি ভুতের? অফিসার গোগোলের দিকে তাকালেন,কেনো ভুতের হবে কেন?আমি এবার একটু সাহস নিয়ে বলেই ফেললাম গত রাতের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা।আমার সঙ্গে বাকি সবাই সেই ভয়াবহ রাতের কথা বলে গেল।অফিসার বেশ মন দিয়ে শুনছেন।কিন্তু অবাক হচ্ছেন না মোটেও।তবে এবার অফিসারকে অনেকটা সহানুভূতিশীল বলে মনে হচ্ছে।উনি আমার এবং ঋদ্ধিমার দিকে তাকিয়ে বললেন,আপনারা এভাবে বাড়িতে না জানিয়ে বেড়িয়ে ঠিক করেন নি,যদিও আপনারা প্রাপ্তবয়স্ক।এরপর উনি আমাদের যা বললেন তা এই রকম,

মাস দেড়েক আগে গভীর রাতে হোটেলে শর্টসার্কিট হয়ে আগুন লাগে।অনেকে আহত হলেও প্রায় জনা দশেক মানুষ পুড়ে মারা জান।তারমধ্যে কয়েকজন হোটেলের কর্মী ছাড়াও বোর্ডার এবং এক জন অটো ড্রাইভার ,যে কিনা রাতেও ওই হোটেলে থাকতো এবং হোটেল ম্যানেজার। এই ঘটনার পর থেকে এখনও পর্যন্ত হোটেল টি সিল করে দেওয়া হয়েছে।তবে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার উনি এইরকম ঘটনার সম্মুখীন হলেন।দিন পনেরো আগে একটি ছেলে ও মেয়ে কে সকালবেলায় হোটেলের সামনের রাস্তা থেকে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।ঠিক আমাদেরও যেভাবে উদ্ধার করা হয়েছিল।থানায় এনে তাদের মুখেও একই ঘটনার কথা শোনা যায়।সেই অটো ড্রাইভার ,সেই হোটেল ম্যানেজার,কারেন্ট অফ,আগুন ধরে যাওয়া।অফিসারের মুখে এইসব শুনে আমাদের মুখের সব রক্ত যেন শুকিয়ে গেল।মাথা ঝিম ঝিম করছিল।সত্যিই এতো ভয় জীবনেও পাইনি আমরা।হাড়হিম হয়ে এলো যেনো।

অফিসার আমাদের চা ,ডিমটোস্ট এনে খাওয়ালেন থানাতেই।তারপর ফোনটোন করে বিকেলে ইস্ট কোস্টের টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন ,কোলকাতা ফেরার জন্য।থানা থেকে পুলিশের গাড়িতেই আমাদের বালেশ্বর স্টেশনে পৌঁছে দেওয়া হলো।ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা কলকাতা ফেরার ট্রেনে উঠে বসলাম।

সায়েন্সের স্টুডেন্ট আমরা ,ভুতে কখনোই বিশ্বাসী ছিলাম না।কিন্তু গতরাতের ওই ঘটনা বিজ্ঞানের সমস্ত যুক্তি বুদ্ধিকেও হারিয়ে দিল।হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে আমরা এ ওর গায়ে পড়েছিলাম , ওই বাড়ি থেকে পালাবার চেষ্টা করার সময় পরে গিয়ে হাত পা কেটে গিয়েছিল বা আঘাতও লেগেছিল।এখন ট্রেনে উঠে সবাই ব্যাথা টের পাচ্ছি।ভীষণ ক্লান্ত সবাই।গত কয়েক ঘন্টা যে কি ঘোরের মধ্যে দিয়ে কেটে গেলো,ভীষণ ঘুম পাচ্ছে ,শরীর অবশ হয়ে আসছে।তবে এবার আরেকটা চিন্তা কোথায় ফিরবো সবাই! হোস্টেল এ তো বলে দিয়েছি বাড়ি চলে যাচ্ছি।আর বাড়ি তে তো জানে পরীক্ষা শেষ হতে এখনো কদিন বাকি।গোগোল মুশকিল আসান করলো ,বললো চল বনগাঁয় আমার বাড়ি।বাড়ি ফাঁকা মা বাবা বেনারস বেড়াতে গেছেন।ট্রেন চলছে,হাওড়া পৌঁছতে এখনো অনেক দেরী।যাক সবাই এবার কিছুটা সময়ের জন্য নিশ্চিন্ত, ঘুমে ঢলে পড়লাম আমরা পাঁচজনই।