সৌগত রাণা কবিয়ালঃ-প্রাচীন চীনা দার্শনিক – লাও ঝু এর মতে- “শ্রেষ্ঠ নেতা সে-ই, যার অধীনে কোনওকিছু অর্জিত হলে তার সাথে জড়িত প্রতিটি মানুষই ভাবে যে তারা সবাই মিলে কাজটি করেছে”…!
প্রায় হাজার বছর ধরে সামাজিক, প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক বৈচিত্রের আমাদের এই ভারতবর্ষে সামান্য কিছু মানুষ তাদের সময়ের চাইতে এগিয়ে থেকে বিশ্বমঞ্চে ভারতকে সন্মানিত করে গেছেন নিজেদের প্রজ্ঞার প্রতিফলনে…!
“জর্জ ম্যাথিউ ফার্নান্ডেজ”..
ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘ, সুদীপ্ত, বর্ণাঢ্য, এমন একজন মানুষ, যিনি নিজ মেধা ও প্রজ্ঞায় প্রমাণ করেছেন যে রাষ্ট্রনীতিতে সবসময় মননশীলতা ও মানবিকতার দর্শন চর্চা থাকলে তাহলে নিদ্দিষ্ট সীমানার মাঝেও দেশের সকল মতের মানুষের কাছে একজন সম্পদ হয়ে ওঠা যায়…!
স্বাধীন উত্তর ভারতের ইতিহাসে
” জর্জ ম্যাথিউ ফার্নান্ডেজ ” নামটা চীর উজ্জ্বল হয়ে আছে তার বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক জীবন ও আপোষহীন মতাদর্শের কারনে…!
রাষ্ট্রনীতির উত্তাল ঢেউয়ের সাথে অনুকুল ও প্রতিকূল দুই পরিস্থিতিতেই দেশের একজন সুনাগরিক হিসেবে নিজের কর্মে নিষ্ঠার ছাপ পড়লে একজন মানুষ অবলীলায় নিজেকে ছাপিয়ে হয়ে উঠতে পারেন রাজনৈতিক পুরোধা ব্যক্তিত্ব….!
একজন ট্রেড ইউনিয়নবাদী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও
মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে মুম্বাই থেকে পথ চলার শুরুটা সমতা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে হলেও পরবর্তীতে তিনি ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত জনতা পার্টির অন্যতম প্রধান সদস্য হয়ে ওঠেন..! একাধারে বিভিন্ন সময়ে তিনি বিচক্ষণ নেতৃত্ব দেন রাষ্ট্রীয় সরকারের প্রতিরক্ষা, শিল্প, যোগাযোগ, রেল সহ বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের প্রধান হিসেবে..!
জীবনের বেশীর ভাগ সময়ে লোকসভায় বিহারের প্রতিনিধিত্বকারী হয়েও তিনি আপন মেধা-দর্শন ও দূরদর্শী রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য হয়ে ওঠেন সমগ্র ভারতের একজন প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব…!
ধর্মীয় যাজক থেকে পরবর্তীতে মুক্তচিন্তার আদর্শ নিয়ে সমাজের দলিত শ্রমিক শ্রেনীর নেতৃত্বে নিজেকে শক্ত করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, তারপর বারংবার একজন সফল নির্বাচিত জন প্রতিনিধি হিসেবে আবার কখনোওবা সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়ে, সমকালীন বিরোধী রাজনৈতিক জীবনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম…
জীবনের এই দীর্ঘ সময়ের ভাঙা গড়ার পথে একজন সমাজবাদী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলক, বিদেশি বিনিয়োগের আগ্রাসনের বিরোধী, দেশের বহুল আলোচিত রেল ধর্মঘট , রেল প্রকল্পে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, কার্গিল যুদ্ধকালিন ও পোখরানে ভারতে সফল পারমাণবিক পরীক্ষা সময়কালের সফল রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী, প্রবীণ সমাজতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক এই দার্শনিক ” “জর্জ ম্যাথিউ ফার্নান্ডেজ “.. বারবার অযাচিত রাজনৈতিক বিতর্কের মুখোমুখি হয়েও নিজেকে তার থেকে মুক্ত করে রাজনৈতিক অঙ্গনে করে গেছেন তার মতাদর্শের সফল পদার্পণ…!
জর্জ ফার্নান্ডেজ জন জোসেফ ও এলিস মার্থা ফার্নান্ডেজের ম্যাঙ্গালোরী ক্যাথলিক পরিবারবের সন্তান জর্জ তার বৈচিত্র্যময় পারিবারিক জীবনে নিজ শিক্ষা জীবনের অপূর্নতাকে পূর্ণ করেছেন বাস্তব জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষায়..! একসময়ের ধর্মযাজক পরবর্তীতে মুক্তচিন্তার মানুষ হয়ে শোষিত শ্রমিকদের সংগঠিত করে নিজের জীবনে দেখা সমাজ বৈষম্যের প্রতিবাদে মানুষের জন্য নিজেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে সফলভাবে উৎসর্গ করে গেছেন..!
জীবনের প্রথম নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ১৯৬৭ সালে তৎকালীন মুম্বাইয়ের বলিষ্ঠ কংগ্রেস নেতা সাকা পাতিলকে পরাজিত করে ‘জর্জ দ্যা জায়ান্ট কিলার’ নামে আখ্যায়িত হয়েছিলেন..! তিনি ছিলেন ভারতের ইতিহাসে প্রথম অ-কংগ্রেস সরকারে বিরোধী দলের একজন মন্ত্রী…! প্রথম জীবনে মুম্বাইয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশের পর ১৯৮৯ সালে বিহারে ফিরে জনতা দলের প্রার্থী হয়ে লোকসভায় একাধিকবার জনপ্রতিনিধি এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব একসময় লালু প্রসাদ যাদবের জনতা দল থেকে বেড়িয়ে বিজেপির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সমতা পার্টি..! তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে লোকসভায় জনপ্রতিনিধি হিসেবে মুম্বাই- ১৯৬৭, মোজাফফরপুর- ১৯৭৭, ১৯৮০, ১৯৮৯, ১৯৯১, ২০০৪, নালন্দা- ১৯৯৬, ১৯৯৮, ১৯৯৯ এবং রাজ্যসভা – ২০০৯ এ নির্বাচিত হন..!
ব্যক্তিগত জীবনে সংগ্রাম করে
চৌপট্রি স্যান্ডসের বেঞ্জে ঘুমিয়ে রাত কাটাতে গিয়ে টহল পুলিশের সন্দেহের শিকার হয়ে অনেক নির্ঘুম রাত পার করা এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব একসময় সংস্পর্শে আসেন প্রবীণ ইউনিয়ন নেতা প্ল্যাসিড ডি মেলো এবং সমাজতান্ত্রিক রামমনোহর লোহিয়ার, যা তার পরবর্তীকালে রাজনৈতিক জীবনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে এবং ক্ষুদ্র পরিসেবা শিল্পে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় সমাজতান্ত্রিক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মাধ্যমে ট্রেড ইউনিয়নবাদী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন..!
১৯৭৩ সালের শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সময়কালে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারের রাজনৈতিক ইতিহাসে আলোচ্য তৎকালীন জরুরি অবস্থার সময় জর্জ বিরোধী রাজনীতি মতাদর্শের জন্য নিজের আপন ভাইয়ের মৃত্যু সহ অনেক চড়াই-উৎরাই এর মুখোমুখি হোন.. যা কিনা পক্ষান্তরে তাকে স্বাধীন ভারতীয় রাজনীতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে…!
জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন সময়ে তিনি নারীর ক্ষমতায়নের উপর বিশেষ অবদান রাখেন, মুজফফরপুরের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে একটি দূরদর্শন কেন্দ্র, কান্তি তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র, লিজজাত পাপড় কারখানা সহ উল্লেখযোগ্য অনেক কাজ করেন..!
১৯ বছর বয়সে কর্ম জীবন শুরু করা এই প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বৈদেশিক মূদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেন যা কিনা পরবর্তীতে ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের আমলে বাস্তবায়িত হয়..!
১৯৭৪ সালের অল ইন্ডিয়া রেল ধর্মঘট ছিলো তার রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম আলোচ্য ঘটনা যে ধর্মঘটে কার্যত পুরো দেশ থমকে গিয়েছিলো..! দ্বিতীয় ও তৃতীয় জাতীয় গনতান্ত্রিক জোট সরকারে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি তার অফিসে হিরোশিমা বোমা ছবি করেছিলেন এবং কাশ্মীরে ৬০০ মিটার সিয়াচেন হিমবাহের বরফ উচ্চতায় একাধিকবার উপস্তিতির মাধ্যমে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর মনোবল বৃদ্ধি করেছিলেন যা কিনা এই পর্যন্ত পৃথিবীর সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্র হওয়ার রেকর্ড ধারণ করে আছে.. এবং ভারতের প্রতিরক্ষায় দেশের অবস্থান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তিশালী করার জন্য তার প্রচেষ্টা একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে প্রবল দেশপ্রেমেরই পরিচয় বহন করে..!
জর্জ ফার্নান্ডেজ তার ছাত্রজীবনে লেখালেখি ও সাংবাদিকতার বিশেষ অনুরাগী ছিলেন, তিনি কোঙ্কানি ভাষা মাসিক পত্রিকা, কন্নড সাপ্তাহিক পত্রিকা, ইংরেজি মাসিক দ্যা ওয়াল সাইড এর সম্পাদক এবং দ্যা ডকম্যান পত্রিকার পূর্ন সম্পাদক ছিলেন…!
রাজনীতি বিষয়ক তার লেখা একাধিক গ্রন্থের মধ্যে, ওয়ার্ল্ড আইলস সোশালিস্ট, ভারতে সমাজতান্ত্রিক কমিউনিস্ট মিথস্ক্রিয়া, প্রতিবন্ধী বছরে ভারতের প্রতিবন্ধী সরকার, প্রবন্ধে সমাজতন্ত্র ও গনতন্ত্র, এবং তার নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ জর্জ ফার্নান্দিস স্পিকস উল্লেখযোগ্য…! তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে দ্যা আমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ, এবং ভারতের প্রেস কাউন্সিলের একজন সদস্য ছিলেন…! আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে তিনি দশটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ভাষায় সাবলীল কথা বলতে পারতেন..!
আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হয়ে এই পুরোধা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ২৯ শে জানুয়ারি ২০১৯ সালে ৮৮ বছর বয়সে রাজধানী দিল্লিতে তার বর্ণাঢ্য জীবনের ইতি টানেন…!
তার মৃত্যুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের শান্তি কামী প্রবাদ প্রতিম মানুষদের শোকবার্তায় স্পষ্ট ফুটে ওঠে যে ভারতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি কতোটা মানবিক রাজনৈতিক চর্চার ধারক ছিলেন…!
ভিন্স লম্বারডির ভাষায় “নেতারা জন্মায় না; কঠোর চেষ্টা ও ত্যাগের মাধ্যমে একজন সাধারণ মানুষ নেতায় পরিনত হয়..!
১৯৬৭ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত নয়বার লোকসভায় জন-প্রতিনিধি এবং মরনোত্তর পদ্মবিভূষণ প্রাপ্তিতেই শুধু একজন ” জর্জ ম্যাথিউ ফার্নান্ডেজ” কে সঠিক মূল্যায়ন করাটা খুব সামান্য মনে হয়, যখন তার সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের সঠিক বিশ্লেষণে চোখ যায় …!
আমাদের মতো যুক্ত-রাজ্য অবকাঠামোগত একটি দেশে, রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন
” জর্জ ম্যাথিউ ফার্নান্ডেজ ” এর মতন সফল রাষ্ট্রনীতির দার্শনিকের অবদান সবসময় আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার…!
আজ ৩রা জুন দেশের এই সম্বৃদ্ধ প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শ্রী জর্জ ম্যাথিউ ফার্নান্ডেজের ৯০ তম জন্মদিবসে রইলো সব খবর পরিবার থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম….!!
সৌগত রাণা কবিয়াল…
— (কবি সাহিত্যিক ও কলামিস্ট)