গর্ভধারিণী : সমীর ঘোষ।

0
742

একজায়গায় ছেলে তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আছে তো কোথাও মায়ের কোলে মাথা রেখে শোয়ার ভঙ্গিমায় আবার কোথাও মা তার আধবুড়ো ছেলের মুখে নিজের হাতে খাবার খাইয়ে দিচ্ছেন।
ফেসবুক কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে পোস্ট করা এইরকম নানান ছবি। এসবের কারণ আজ মাতৃদিবস।
তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের এক একটা দিনকে বিশেষ বিশেষ দিন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কে বা কা রথরা করেছে? কেন করেছে? এই যেমন আজ মাতৃদিবস, এছাড়াও আছে ভ্যালেন্টাইন্স ডে, বই দিবস, নারী দিবস—-। কলেজের বান্ধবী মোনালিসা কে বলেছিলাম,
– সারা বছরে মাত্র একটা দিনই তোদের জন্যে। মোনালিসা জানতে চেয়েছিল,
– তার মানে!
– ওই যে নারী দিবস মাত্র একটা দিনই তো?
– তাহলে বাকি দিনগুলো সব কাদের?
সে যাই হোক আজ মাতৃদিবস।
পাঁচ বছরের সন্তানকে কোলে নিয়ে রাস্তায় হাঁটছে এক মা। পিছনে ভারী বস্তা কাঁধে সেই সন্তানের বাবা। এই মা জানেনা মাতৃদিবস কী। শুধু জানে সে একজন সন্তানের মা।
ওরা একটা কারখানায় কাজ করতো। নিজের গ্রাম ছেড়ে,রাজ্য ছেড়ে, ভিনরাজ্যে দিনগুলো ভালোই কাটছিল।
হঠাৎ লকডাউনে চারদিক স্তব্ধ। বন্ধ কল-কারখানা বন্ধ যানবাহন।
বন্ধ কারখানার কোন মালিক আর বসিয়ে-বসিয়ে শ্রমিকদের বেতন দেয়?
জমানো টাকায় বেশ কিছুদিন কষ্ট করে সংসার চালিয়ে পুঁজি প্রায় তলানিতে ।কে জানে এরকম বন্দিদশা আর কতদিন চলবে!কেউ শোনাতে পারেনি কোন আশার বাণী।
এইভাবে ভিন রাজ্যে পড়ে থেকে না খেতে পেয়ে বেঁচে থাকার আশা ক্ষীণ। তাই শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে সামান্য সম্পত্তি, যেমন থালা বাটি গ্লাস, পরনের পোশাক বস্তায় বেঁধে মাথায় নিয়ে ওদের রাস্তা হাঁটা শুরু।পাড়ি দিতে হবে প্রায় ন’শো কিলোমিটার পথ।ওরা হাঁটছে। ফিরতে হবে জন্মভূমির কোলে। কখনো চড়া রোদ্দুর, কখনো মেঘ ছায়া। পথের ক্লান্তি জুড়োতে গাছের ছায়ায় ক্ষণিক বিশ্রাম।
রাতের আশ্রয় রাস্তার পাশে ওয়েটিং রুম। সকালে আবার হাঁটা শুরু।সেই চার দিন ধরে বিস্তৃত পথ হাঁটতে হাঁটতে পায়ের জুতো গুলো কবেই ছিঁড়ে চলে গেছে।তপ্ত অমসৃণ পথে এখন খালি পায়েই হাঁটা।
কেউ কি জানে কতটা পথ হাঁটলে তবে পথিক হওয়া যায়?
মাথার উপর এখন প্রচন্ড দাবদাহ শিশু সন্তানের মাথায় মা তার মলিন কাপড়ের একখণ্ড আঁচল ঢাকা দিয়ে ক্লান্ত-অবসন্ন পায়ে হাঁটছে।
কোলের বাচ্চাটা অনেকক্ষণ থেকেই কাঁদছে,
– জল খাবো মা, জল খাবো—
এতক্ষণ হেঁটে এসে একটা পানীয় জলের কল দেখতে পেল। ধীরে ধীরে কলের কাছে গেল।
আগে ছেলেকে জল খাইয়ে তারপর নিজেরা আঁজলা ভর্তি করে জল খেয়ে খিদে- পিপাসার একটু নিবারণ করবে। কলের কাছে অচেনা লোক দেখতে পেয়ে সেই গ্রামের কয়েকজন রে রে করে তেড়ে এলো।
– এই একদম তোমরা কলে হাত দেবেনা এখন সব ছোঁয়াছুঁয়ি নিষেধ। তারপর তোমরা কোথা থেকে আসছো তার কোন ঠিক ঠিকানা নাই। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে কাতর কণ্ঠে বলল ,
-আমাদের না হয় না দেবেন এই ছেলেটাকে একটু জল দিন খুব পিপাসা পেয়েছে। একজন গ্রামবাসী বলল, -না না ওসব আব্দার রাখো এখানে জল খেতে দেয়া যাবে না। আর একটু এগিয়ে যাও সামনে নদী আছে। সেখানে গিয়ে যত ইচ্ছে জল খাও গায়ে মাখো কেউ কিচ্ছু বলবে না।
বাচ্চাটা কাঁদছে,
-মা জল খাবো, বাবা জল দাওনা—-
হায়রে মানুষ এরাই আবার পরিযায়ী শ্রমিক আখ্যা দেওয়া মানুষগুলোর দুঃখে কাতর!
হাঁটতে হাঁটতে নদীর কাছে এসে একটা গাছের তলায় বসল। তারপর নদী থেকে জল এনে ছেলেকে খাওয়াতে লাগলো। স্বামী-স্ত্রী দুজনের চার চোখে যেন আরো একটা নদী বয়ে যাচ্ছে যে নদীর জলের স্বাদ নোনতা।
যে দুটো পরিণত মনে ছিল ঘরে ফেরার টান এখন সে মনে একটাই গান বাজছে
“এই পথেই জীবন
পথেই মরন আমাদের সবকিছু পথের বুকেই—–”
যাইহোক,আজ মাতৃদিবস
হাসপাতাল জুড়ে এখন একটা হুলুস্থুলু ভাব। চিকিৎসক-নার্স সবার মধ্যেই একটা ব্যস্ততা। কিছুটা সুস্থ হওয়া রোগী এমনকি রোগীর পরিজনদের চোখে মুখে একটা কৌতূহল। কিছুক্ষণ আগে পুলিশ একটা সদ্যোজাতকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।
ফাঁকা মাঠে একটা পুকুর পাড়ে কাপড়ের পুঁটলিতে জড়ানো অবস্থায় পড়েছিল । কয়েকজন মহিলা সেই পুকুরে স্নান করতে গিয়ে ঝোপের ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে কাছে গিয়ে দেখে সদ্যজাতটা হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদছে।
চারটে কুকুর তাকে পাহারা দিয়ে ঘিরে বসে আছে ।
কুকুরেরও কান্ডজ্ঞান আছে। বাচ্চাটাকে খেয়ে না ফেলে নিরাপদে বাঁচার জন্য পাহারা দিচ্ছে। একজন মহিলা শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে শরীরে লেগে থাকা ধুলো-ময়লা গুলো নিজের কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছিয়ে, শিশুটার মুখে তার বুকের দুধটা পুরে দিতেই শিশুর কান্না থেমে গেল।
সঙ্গে থাকা অন্য মহিলারা শিশুটার গর্ভধারিনীকে গালমন্দ করতে থাকে। পুলিশ শিশুটিকে কে বা কারা ফেলে রেখে গেছে তার তদন্ত চালাচ্ছে।
এ তদন্ত রিপোর্ট হয়তো কোনোকালেই প্রকাশ হবে না।
হয়তো শিশুটা কোন কুমারী মায়ের অবৈধ সন্তান।নিজের লজ্জা ঢাকতেই নবজাতকের এই পরিণতি। যাকে পিতৃ-মাতৃ পরিচয় হীন হয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
আর এর জন্মদাত্রী, সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে তার কি কখনো মনে পড়বে ,তার প্রথম নাড়িছেঁড়া সম্পদের কথা?
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বসে শিশুটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরি করছেন।
যে মহিলাটা শিশুটাকে ঝোপের ভেতর থেকে কুড়িয়ে বুকে তুলে নিয়েছিল প্রশাসনের কাছে তার আর্জি,
– বাচ্চাটা আমাকে দেওয়া হোক ওকে আমি বড় করে তুলবো। কোনদিন মায়ের অভাব বুঝতে দেবো না। গর্ভে না ধরলেও ওর গলায় এখনো আছে আমার বুকের দুধ।
টিভির স্ক্রিনে বেকিং নিউজ চলছে,
আজ মাতৃদিবস। আজকের দিনে—– প্রতিদিনের মতো হাসপাতাল চত্বরে গান গেয়ে ভিক্ষা করা ভিখারি টা আজও থালা পেতে ভিক্ষা করছে।
এখন সে রামপ্রসাদের সেই গানটা গাইছে,
” মা হওয়া কি মুখের কথা মা হওয়া কি মুখের কথা শুধুপ্রসব করলে হয় না মাতা
যদি না বোঝে সন্তানের ব্যথা।”
যাইহোক,আজ মাতৃদিবস।
বৃদ্ধাশ্রমের সিঙ্গল খাট টাতে বসে বসে গায়ত্রী দেবী ঘরের দেয়ালে সাঁটা টিভিতে আজ দেখছেন, মা তার ছেলের গলা জড়িয়ে ধরে কত আদর করছে। পায়েস রান্না করে নিজের হাতে ছেলেকে খাইয়ে দিচ্ছে। মায়ের হাতে পায়েস খেয়ে ছেলের চোখে মুখে কী পরিতৃপ্তি। মায়ের মুখেও ফুটে উঠেছে খুশির অভিব্যক্তি।
গায়ত্রী দেবীর ছেলে একজন নামী ডাক্তার। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের এক বড় পদে কর্মরত। দামি গাড়িতে যাতায়াত। বৌমাও একজন সরকারি আমলা।দু’জনের রোজগার। অঢেল টাকা। বিলাসবহুল বাড়ি, গেটে দারোয়ান। বাড়ির ভিতরে কত ঐশ্বর্য ,সেখানে কত কিছুই মানায়, মানায় না কেবল গায়ত্রী দেবীর মত একজন বৃদ্ধা মাকে গায়ত্রী দেবী তার ছেলেকে মাঝে-মাঝেই টিভির স্ক্রিনে কত কিছু নিয়ে আলোচনা করতে দেখে বুঝতে পারেন ছেলে তার ভালোই আছে।
এই যেমন আজ মাতৃদিবসে আলোচনা করছে একজন মায়ের, সন্তান কে কিভাবে মানুষ করা উচিত। ছোটবেলায় সন্তানকে কী কী খাবার খাওয়ানো দরকার।
ছেলের কথাগুলো শুনে গায়ত্রী দেবী মনে মনে বলেন ,জানিস খোকন তুই যেগুলো বলছিস এগুলো আমি তোর ছোটবেলায় সব তোকে খাইয়েছি। তখন খুব অভাব ছিল রে তবুও কষ্ট করে সব যোগাড় করতাম।
ডাক্তার ছেলে আজ টিভিতে আলোচনা করছে মা আর ছেলেদের নিয়ে। গায়ত্রী দেবী বিভোর হয়ে তাকিয়ে আছে টিভিটার দিকে। কান পেতে আছেন যদি একবারও বলে তার নিজের মায়ের কথা! বৃদ্ধাশ্রমের কেয়ারটেকার যুবকটা হঠাৎ ঘরে ঢুকলো। গায়ত্রী দেবীকে মন দিয়ে টিভি দেখতে দেখে বলল,
– কী গো মাসি আজ মন দিয়ে টিভি দেখছো, শরীরটা ঠিক আছে তো? সম্বিৎ ফিরে পেয়ে গায়ত্রী দেবী কেয়ারটেকার যুবক টাকে বললেন,
– আমাকে আজ একটু ছানার পায়েস এনে দিবি বাবা?
– আজকের মেনুতে এখান থেকে ওসব অ্যালাও নাই মাসি। -এখান থেকে দিতে হবেনা আমি দাম দিয়ে দেবো বাবা।
গায়ত্রী দেবীর মুখ দেখে বোধহয় মায়া হয়েছিল তাই কিছুক্ষণ পরে দোকান থেকে একটা প্যাকেটে কিছুটা ছানার পায়েস নিয়ে এসে যুবকটা হাজির হলো।
-এই নাও মাসি তোমার—–
গায়ত্রী দেবী বললেন, – – -একটু দাঁড়া বাবা— তারপর যুবকটার কাছে এগিয়ে গিয়ে প্যাকেটটা খুলে কাঁপা কাঁপা হাতে ছানার পায়েস তুলে নিয়ে কেয়ারটেকার যুবকটার মুখে ধরলেন।
– এটা কি করছো মাসি— -নে খা,আজ যে মাতৃদিবস বাবা।
সেই কেয়ারটেকার যুবক টা কেমন যেন স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে। অপলকে গায়ত্রী দেবীকে দেখছে।
টিভিতে এখন কিশোরকুমারের একটা গান বাজছে।
‘ তুমি মা আমাকে, পৃথিবীর এই আলো দেখিয়েছিলে,
তোমারই আদরে, আমাকে শীতল তুমি করে দিলে—-