জারোয়াদের দেশে : প্রীতম সরকার।

0
4893

আমার ছোটবেলায় সন্তু-কাকাবাবু-র সিনেমা ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’ দেখার পরেই ভারতের আদিম মানুষ ‘জারোয়া’দের নামের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। কিন্তু তাদের ‘দেশ’ আন্দামানে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ পেলাম অনেক পরে। যদিও ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে একবার যাওয়ার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু সেই সময় সারাদেশের ‘অস্থিরতা’র জেরে যাওয়া হয়নি। তাই গত পূজোর ছুটিতে জারোয়াদের দেশে যাওয়ার সুযোগকে হাতছাড়া করতে চাইনি। আমি, আমার মেয়ে আর স্ত্রী। তবে আমি বাদে জারোয়া নিয়ে আর কারো তেমন উৎসাহ ছিলনা। তবে আমার কলকাতার কলেজে পড়া মেয়ে, তাঁর বন্ধু মহলে শুনে এসেছিল, জারোয়ারা নাকি এখনও সাংঘাতিক আদিম রয়ে গিয়েছে। তাঁর সেই ধারনা নিয়ে আন্দামানের পোর্টব্লেয়ারে পৌঁছে, নর্থ আইল্যান্ডে ডিগলিপুর রওনা দেওয়ার আগে গাড়ির ড্রাইভার নাগেশ নটরাজন কে জিজ্ঞাসা করে বসেছিল, “ বারাটাঙ’ বা ‘মায়াবন্দর’ বাদ দিয়ে ডিগলিপুর যাওয়ার আলাদা কোন পথ রয়েছে কি না!” নর্থ  আইল্যান্ডে তাঁর আগ্রহ কারন সেখানকার সমুদ্রের  ‘ রোজ এন্ড স্মিথ ’ বিচ। অপূর্ব সুন্দর এই বিচে ‘হৃতিক রোশন’ এর প্রথম হিন্দি ছবি ‘কহো না প্যার হ্যায়’ এর একটি অংশের সুটিং হয়েছিল। পোর্টব্লেয়ার থেকে সেখানে যেতে হলে উত্তর আন্দামান থেকে দক্ষিন আন্দামান হয়ে তবেই যেতে হয়। আর যাওয়ার পথ ‘এটিআর’ অর্থাৎ আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড দিয়েই যেতে হয়। এই এটিআর গিয়েছে জারোয়া রির্জাভ ফরেস্টের মধ্যে দিয়েই। এছাড়া আর কোন আলাদা রাস্তা সেখানে নেই।
সুতরাং সেই এটিআর দিয়েই খুব ভোরে আমরা রওনা দিলাম ডিগলিপুরের উদ্দেশ্যে।
জারোয়াদের নিয়ে নানা কথা প্রচলিত কানে এসেছিল। সভ্য পৃথিবীর কাছে তাঁদের পরিচয় ভয়াল এক রহস্যের। জারোয়ারা নরখাদক। ওরা ক্ষমাহীন, নির্দয়, নৃশংস। জারোয়ারা উলঙ্গ থেকে। আদিম মানুষের মতো তাঁদের চালচলন। জারোয়াদের নিয়ে ত্রাসের এই ছবিগুলি নানাভাবে আমাদের সভ্য জগতে আজগুবি গাল-গপ্প তৈরি করেছে। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার নাগেশ জানালো, পোর্টব্লেয়ারের কিছু পরেই নাকি জারোয়া রিজার্ভ ফরেস্টের শুরু। সেখানে চেকপোষ্ট পেরিয়ে তবে গাড়ি যেতে পারে এই রাস্তায়। নাগেশ দক্ষিন ভারতীয় হলেও, পেশাগত কারনে ভালো হিন্দি  বলতে পারে। আমার শুধু নাগেশের কাছে জিজ্ঞাসা ছিল একটাই কথা। ‘তাঁদের দেখা যাবে তো !” চেকপোষ্ট যত এগিয়ে আসছিল, আমার মনে টেনসন তত বাড়ছিল। শুনে ছিলাম – সব সময় তাঁদের, মানে জারোয়াদের দেখা পাওয়া যায়না। চেকপোষ্টে পৌঁছনোর আগেই নাগেশ বারবার বলে দিয়েছিল, গাড়ির জানালার কাঁচ যেন ওঠানো থাকে, কোন জারোয়া গাড়ির কাছে চলে এলেও যেন তাঁদের কোন খাবার আমরা না দিই। আর অতি অবশ্যই যেন কোন ছবি তোলার চেষ্টা না করি। জারোয়াদের সম্পর্কে সব শুনে আমার মেয়ে বা স্ত্রী- দুজনেরই যেন ত্রাহিত্রাহি রব উঠে গিয়েছে। কতক্ষনে এই জারোয়া রিজার্ভ এলাকা পেরোনো যাবে, সেটাই সমানে জিজ্ঞেস করে চলেছে নাগেশকে। কিন্তু আমি তো জারোয়াদের দেখতে চাইছি। আমার স্ত্রীর কথা শুনে নাগেশ হাসতে হাসতে বলেছিল, “এই একবার নয় ম্যাডাম, এই রাস্তায় আরও একবার জারোয়া রিজার্ভ ফরেষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। ফিরতেও হবে এই পথেই। তবে আমি বলছি, ওরা খুব শান্ত। ওদের বিরক্ত না করলে ওরা কিছু করে না।” কথার মাঝেই গাড়ির স্টার্ষ্ট বন্ধ করে নাগেশ যখন বললো, ‘চেকপোষ্ট এসে গিয়েছে। জলদি আইকার্ড নিয়ে স্যর চলুন আমার সঙ্গে। এখান থেকেই পারমিশন করে তবেই ঢুকতে হবে জারোয়া রিজার্ভ এলাকাতে।
জায়গাটার নাম ঝিলকাটাঙ। জারোয়াদের রহস্যময় জীবনে ঢোকার গেটওয়ে। চেকপোষ্টের ওপাশেই সেই প্রাগঐতিহাসিক অরন্যে ঘেরা জগত। গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম সামনে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে বাস, লরি সহ আরও টুরিষ্ট নিয়ে লম্বা গাড়ির লাইন। নাগেশ জানালো, একসঙ্গে সামনে পুলিশ পাহারায় সব গাড়ি একসাথ চেকপোষ্ট খুললে ভিতরের রাস্তায় প্রবেশ করবে। তবে আমরা নাকি ভালো সময়ে এসেছি। সকালের দিকে রাস্তার ধারেই জারোয়াদের দেখা যায়। জারোয়া দেখা নিয়ে আমি যেন কোন টেনশন না করি।
হঠাৎ চালু হরে গেল গাড়ির ‘কনভয়’। আমাদের গাড়ি বেশ পিছনে রয়েছে। আকাশে তখনও সেভাবে রোদ ওঠেনি। রাস্তার দুপাশের জঙ্গল কেমন ভেঁজা ভেঁজা। পাহাড়ি সর্পিল পথে ছুটে চলেছে গাড়ির সারি। রাস্তার হাল খুব ভালো নয়। দুপাশের আকাশছোঁয়া কালচে, শ্যাওলাধরা বৃষ্টি অরন্য। ভোরের আলোয় নাকে আসছে বিচিত্র সোঁদা গন্ধে পৃথিবীর আদিম রহস্যময়তা। ড্রাইভার নাগেশের কথায় ঘোর কাটলেই শূনতে পেলাম, “ওই দেখুন ম্যাডাম, বাম দিকে দেখুন।” কিন্তু কোথায় কি ! বামদিকে তো একটা বাস। আর সেই বাস একটু এগোতেই চোখে পড়লো, বেশ কয়েকটি জারোয়া। মহিলাদের উর্দ্ধাঙ্গ অনার্বৃত। ছেলেদের কোমরের নীচে লাল রঙের কাপড় জড়ানো। তবে যে শুনেছিলাম জারোয়ারা উলঙ্গ থাকে ! নাগেশ হাসতে হাসতে জবাব দিল, “ওসব আগে ছিল। এখন ওরা অনেক স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে।” নাগেশের কথা শেষ না হতেই আবার সামনে একঝাঁক কালো পাথর কেটে বানানো ছোট চুলের দম্পতি নজরে এলো। তবে এ্দের কিন্তু অতি আধুনিক জারোয়া বলতে হবে। কারন মহিলা জারোয়াটির শরীর ঢাকা রয়েছে আমাদের সভ্য সমাজে ব্যবহৃত একটি নাইটি জাতীয় পোষাক। আর পুরুষ জারোয়াটির পড়নে রয়েছে আমার মতোই ‘বারমুডা’ বা ছোট প্যান্ট। ঝিলকাটাং এর রিজার্ভ এরিয়া শেষ হয়ে এসেছিল। সেখানে আর বেশী জারোয়ার দেখা আমরা পাইনি। তবে আন্দামানের সেই সুন্দর সী বীচ ‘রোজ এণ্ড স্মিথ’ থেকে পোর্টব্লেয়ার ফেরার পথে ‘মায়াবন্দর’ জারোয়া রিজার্ভ ফরেষ্টে প্রচুর জারোয়া দেখেছিলাম। কেউ শিকার করে সেটা দড়ি দিয়ে বাঁধছে, তো কেউ অস্ত্র নিয়ে পাতা কাটছে। ঝিলকাটাং এ জারোয়া দেখেছিলাম সকালে, আর মায়াবন্দরে জারোয়ার দেখা পেয়েছিলাম বিকালে। কাজের শেষে মানুষরা তৃপ্ত থাকে কাজ করে। জারোয়ারাও তো মানুষ। হোক না আদিম। তাই মায়াবন্দরের জারোয়াদের মধ্যে চোখে পড়েছিল এক স্বাভাবিক তৃপ্তি। মনের মতো কাজ করলে যাটা মেলে। যেভাবে আন্দামানের উপরে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসছে আজকাল, তাতে সন্দেহ থেকেই যায় আর কতদিন, আমরা দেখতে পাবো এই আদিম জারোয়াদের।।

[ছবি হোয়াটাপে পাঠাচ্ছি]