রামকৃষ্ণের বাণীর প্রাসঙ্গিকতা (একটি পর্যালোচনা) :: দিলীপ রায়।।

0
1166

ঠাকুর রামকৃষ্ণের বাণীর ব্যাখা নানানভাবে প্রচলিত । বর্তমান সমাজব্যাবস্থার প্রেক্ষাপটে, আমার মতে, ঠাকুর রামকৃষ্ণের “যত মত তত পথ” বাণীটি মানব কল্যাণের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে তাৎপর্যপূর্ণ । এর ব্যাখায় বিভিন্ন বিদগ্ধজন তাঁদের উৎকৃষ্ট চিন্তার বিকাশ ঘটিয়েছেন । তবুও বাণীটি নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী । ঠাকুর রামকৃষ্ণ অকপটে বলেছেন, “বিভিন্ন পথ দিয়ে পৌঁছানো যায় ঈশ্বরের কাছে” । ভক্তি,ব্যকুলতা, ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসা, ইত্যাদি প্রকৃত পথ । তাঁর মতে, মানবজীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ, আর তারই উপায় সহজ কথায় তিনি তুলে ধরেছিলেন তাঁর “যত মত তত পথ” বাণী দিয়ে । এটা স্পষ্ট যে, অভীষ্ট সাধনের লক্ষ্যে বাণীটির তাৎপর্য বলা যেতে পারে সঠিক ও বাস্তবসম্মত ।
শ্রীরামকৃষ্ণের একটি প্রধান বার্তা হচ্ছে সর্বধর্মসমন্বয়ের বার্তা । কিন্তু অনেকের মতে, শ্রীরামকৃষ্ণ শুধুমাত্র সর্ব ধর্মের সমন্বয় করেননি, তিনি সর্ব মতের, সর্ব পথের, সর্ব কর্মের, সর্ব ভাবের, সর্ব চিন্তার সমন্বয়সাধন করেছিলেন । যার জন্য বড় বড় মনীষির মতে, শ্রীরামকৃষ্ণকে সর্ব ধর্মের প্রবক্তা বললে তাঁকে ছোট করে ফেলা হয় । ‘যত মত তত পথ’ সব কিছুর মধ্যে সমন্বয়ের বার্তা দেয় । শুধুমাত্র সব ধর্মের বার্তা নয় । শ্রীরামকৃষ্ণ সব মতকে প্রাধান্য দিতে বলেছেন । এটি নাকি গণতন্ত্রের ভিত্তি । আরও জানা যায়, ২০০২ সালে আগরতলার সভায় তদানীন্তনকালের বামপন্থী নেতা ও ত্রিপুরা সরকারের উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক অনিল সরকারের (তিনি আবার কবি ও সাহিত্যিক) বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, “যারা বলেন ‘যত মত তত পথ’ বলে শ্রীরামকৃষ্ণ সর্ব ধর্মের মিলনের বার্তা দিয়েছেন, তাঁরা ঠিক বলছেন না । তাঁর ‘যত মত তত পথ’ আসলে গণতন্ত্রের কন্ঠস্বর । তিনি সব মতকে, সব পথকে সম্মান জানিয়েছেন । সুতরাং এটা এক ধরনের মিলনের বার্তা । সর্ব ক্ষেত্রে, সর্ব পথে, সর্ব কর্মে, সর্ব ধর্মে, সর্ব চিন্তায়, সর্ব ভাবে মিলন বা সমন্বয়ের বাণী ।
ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছেন, সংসারে থেকেও ঈশ্বর লাভ করা যায় । যার জন্য প্রয়োজন সর্বদা ঈশ্বরের প্রার্থনা । বৈদ্যের কাছে না গেলে কিন্তু রোগ ভাল হয় না । আবার তিনি বলেছেন, সাধুসঙ্গ করলে ঈশ্বর প্রাপ্তি ঘটে । ঈশ্বরের কাছে কাঁদলে মনের ময়লাগুলি যেমন কাম, ক্রোধ, লোভ, ইত্যাদি ধূয়ে গেলে ঈশ্বর দর্শন দ্রুত সম্ভব । আবার ধর্ম বিষয়েও অন্তত তিনটি বিষয়ে প্রচলিত ধর্মগুলির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই – (১) ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস, (২) উপাসনা, (৩) প্রেম ও সৎকর্ম । তাই ধর্মের প্রেক্ষাপটে ঈশ্বর সমন্ধে মৌলিক ধারণা এক ও অভিন্ন । ঠিক সকল ধর্মেই ঈশ্বর উপাশনায় বিশ্বাসী । যত গন্ডগোল পদ্ধতি নিয়ে । কিন্তু যেভাবেই যে-কোনো প্রকারে উপাসনা করুক না কেন, সব উপাসনার লক্ষ্যস্থল সেই অনাদি অনন্ত ঈশ্বর (তথ্যসূত্র ঃ উদ্বোধন, অগ্র/১৪২৫) । “যত মত তত পথ” বাণী দিয়ে ঠাকুর রামকৃষ্ণ বুঝিয়েছেন, জগতের ধর্ম মতগুলো সত্য । তাঁর কাছে ধর্ম ছিলো প্রত্যক্ষানুভূতি । ধর্ম মানে ঈশ্বরোপলব্ধির একটা পথ ।
এটা ঠিক, ধর্ম মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য । অথচ ধর্মের ভিত্তি হচ্ছে — ঈশ্বর, আল্লাহ্‌, দেবতা ও সৃষ্টিকর্তা । আর সেই সৃষ্টিকর্তা বা স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসে ধর্ম প্রবর্তকের নিয়মের আলোকে বিশ্বাস স্থাপনের নামই হচ্ছে ধর্ম মতকে মেনে নেওয়া বা ঐ ধর্ম গ্রহন করা । এক ঈশ্বর বহু ঈশ্বর নিয়ে শুরু হয় প্রাথমিকভাবে ধর্মের বিভক্তি । গুণিজনদের বিশ্বাস, সৃষ্টকর্তার বিশ্বাসের সাথে সাথে যোগ হয় সৃষ্টিকর্তার বাণী প্রচারক হিসাবে যুগে যুগে মহামানবদের মানব কল্যাণে নব-নব ধারা । একজন স্রষ্টার ব্যাখাকে নিজস্ব ভাবনায় গড়ে তোলেন স্ব-স্ব ধর্মীয় বলয় । তৈরী হয় নিজস্ব চলার পরিসীমায় নব মতবাদ । ফলে ধর্মগ্রহনের ক্ষেত্রেও ঠাকুর রামকৃষ্ণের “যত মত তত পথ” ভীষণভাবে প্রনিধানযোগ্য ।
রামকৃষ্ণের কয়েকটি কথা বাস্তব জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ । ভগবান প্রত্যেক জায়গায়, বলা চলে, সর্বত্র আছেন । কিন্তু তিনি মানুষের মধ্যে অধিক থাকেন । তাই এইজন্যই ভগবানরুপী মানুষের সেবা করাই যথার্থ ঈশ্বরের সেবা । তিনি আবার বলেছেন, শুদ্ধ জ্ঞান ও শুদ্ধ প্রেম একই জিনিস । জ্ঞান ও প্রেমের মাধ্যমেই লক্ষ্যকে পূরণ করা যেতে পারে, আর এখানে প্রেম নামক রাস্তাটি বেশী সহজ । সাংসারিক বিষয়ের উপর জ্ঞান মানুষকে বেশী জেদী বানিয়ে তোলে । জ্ঞানের অভিমান হোলো একটি বন্ধন । আবার জ্ঞানের অর্থ হোলো, কাম ও লোভ থেকে মুক্তি । তাই ভগবানের প্রেম ও ভক্তি ছাড়া কোনো কাজকে সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয় ।
পরিশেষে, ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছেন ধর্মকে আশ্রয় করে সেবা করার কথা । জ্ঞান, ভক্তি, যোগ, ধর্ম, আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোন থেকেও জীবসেবা করা যায় । শিব জ্ঞানে জীবসেবা । আর জীবসেবা হয়ে উঠে সাধনা (তথ্যসূত্র ঃ উদ্বোধন – শ্রা/১৪২৫) । সুতরাং মানবসেবাও ধর্মের আর একটি স্তম্ভ । সেইজন্য স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর” ।
এ১০ক্স/৩৪, কল্যাণী (নদীয়া-৭৪১২৩৫) / মো-৯৪৩৩৪৬২৮৫৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here