গল্প : দৃশ্যান্তর।

0
556

বিনা লাভে তুলোও বয়না উমাপদ! এ কথাটা ভালো করেই জানে ওর পরিচিত লোকজন। বাজারের এক কোনায় তার চায়ের দোকানে যে খদ্দেররা আসে, তারা তো আরো ভালো করেই জানে। তাই আড়ালে আবডালে উমাপদকে অনেকেই ডাকে ‘কিপটে-পদ’ নামে !

রোজের কোনো দুধওয়ালা টানা একমাস কারবার করতে পারেনি উমাপদ’র সঙ্গে। বাকি পড়তে পড়তে বকেয়াটা যেই একটু ভারী হয়, অমনি দোকানের সামনে ভিড় জমে যায় পথচলতি মানুষজনের। ঝগড়া শোনার ভিড় ! দুধওয়ালার হিসাবকে নস্যাৎ করে দিয়ে নিজের শতছিন্ন ময়লা খাতায় নিজের লেখা হিসাবকে গলার জোরে প্রতিষ্ঠা করতে চায় উমাপদ। শেষ পর্যন্ত সফলও হয়। ‘যা পাচ্ছি, তাই লাভ’-এই সান্ত্বনা নিয়ে সেই হিসাবকেই শেষপর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হয় দুধওয়ালা। তারপরও কিছুদিন কিস্তিতে কিস্তিতে পাওনা পয়সা নিয়ে, ভুলেও আর এ পথ না বাড়ানোর শপথ নিয়ে দোকান ছাড়ে। গোয়ালা তো দূরের কথা, ভিখিরিরাও উমাপদ-র নাক-মুখ খিঁচনোর ভয়ে তার চায়ের দোকানের ছায়া মাড়ায় না ! রাস্তার কুকুরগুলোও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় বুঝে গেছে যে, তার দোকানের সামনে দাঁড়ালে বরাদ্দ হিসাবে ভাগ্যে জুটবে গরম জল !

এ হেন উমাপদ একটা মুমূর্ষু ভিখিরিকে ক্যানেল অফিসের কলতলা থেকে পাঁজাকোলা করে নিজের দোকানে তুলে এনেছে! এমন দয়ার অবতার হলো কবে থেকে ! মরণাপন্ন বৃদ্ধ মানুষটাকে দোকানের একপাশের খাটিয়ায় পড়ে থাকতে দেখে লোকজন তাই অবাক হচ্ছিল। পরের বোঝা ঘাড়ে তুলে নেওয়ার জন্য ঘনিষ্ঠদের কেউ কেউ অবশ্য উমাপদকে দোষারোপও করছিল। বলছিল,
–“অসুস্থ বুড়ো ভিখিরি ! কিছু হয়ে গেলে হ্যাপা সামলাতে পারবে তো?”

জবাব দিচ্ছিল উমাপদ,
–“তোরা তো আছিস সবাই। সবাই মিলে চাঁদা তুলবি, সৎকার করবি, পূণ্যি হবে..”

উমাপদ এসব কথা বলছিল আর দোকানটা ফাঁকা হবার অপেক্ষা করছিল। দোকানের খদ্দেরগুলো সরে পড়লেই লোকটার ব্যাগে থাকা টাকাগুলো গুনে দেখতে হবে ! সকালবেলায় এক এক করে খদ্দের জমা হওয়ায় আর খুলে দেখা হয়নি। চটজলদি ব্যাগটা মালপত্তরের গাদায় সরিয়ে রেখেছে উমাপদ।

কত হতে পারে? এক বান্ডিলই, নাকি ভিতরে আরও বান্ডিল আছে! শোনা যায়, কোনো কোনো ভিখিরি শেষ জীবনে মোটা অংকের টাকা রেখে মারা যায়। এ লোকটা কত জমিয়েছে কে জানে! উমাপদ’র ভেতরটা উসখুস করে সব টাকাগুলো গুনে দেখার জন্য। দোকানটা ফাঁকা না হওয়া পর্যন্ত সে সুযোগ সে পাচ্ছেনা।

সাতসকালে ক্যানেল অফিসের ভেতরের টিউবয়েলে জল আনতে গিয়ে পাশের বারান্দায় এই লোকটাকে যখন শুয়ে থাকতে দেখেছিল, ভেবেছিল কে না কে! মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। ওপাশে তখন লোকজন নেই বললেই চলে। উমাপদ দেখেছিল, বুড়োটার শ্বাস বইছে ঘনঘন, বুকের পাঁজরগুলো ওঠানামা করছে।
–‘কোথাকার কে, হাভাতে ভিখিরি, মরছে মরুকগে..’
নির্লিপ্ত ভাব দেখিয়ে জল নিয়ে চলে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ ওই ব্যাগটা নজরে পড়ে যাওয়াতেই সব হিসাব গন্ডগোল হয়ে গেল। অসুস্থ লোকটার মাথার কাছে রাখা ছেঁড়া থলের ভেতর থেকে উঁকি মারছিল একটা ময়লা ফোলিও ব্যাগ। থলের ভেতরের ময়লা হাবিজাবি কাপড়চোপড়ে জড়ানো। ব্যাগটার সেফটিপিন আঁটা মুখ দিয়ে দেখা যাচ্ছিল নোটের একটা বান্ডিল। সাতপাঁচ ভেবে আর সময় নষ্ট করতে চায়নি উমাপদ। ঝামেলা হয়তো একটু পোহাতে হবে হোক, কিন্তু এ মওকা ছেড়ে দেওয়া যায়না!

এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দেখেছিল কেউ নজর করছে কিনা! নিশ্চিত হয়ে থলে থেকে ব্যাগটা যেই টেনে বের করতে যাবে অমনি নিজের কোয়ার্টারের বারান্দা থেকে হাঁক শোনা গেছিল রায়বাবুর,
–‘ কে রে উমাপদ, লোকটা শুয়ে ওখানে ? অনেকক্ষণ থেকে দেখছি..’
ঘাবড়ে গিয়েও সামলে নিয়েছিল। চেঁচিয়ে বলেছিল,
–‘ বুঝতে পারছিনা দাদা। অচেনা রোগা বুড়োমানুষ একটা। ভিখিরি টিখিরি হবে। কষ্ট পাচ্ছে খুব, জ্ঞানই নেই ভালো মতো..’

–‘ একা পড়ে আছে, ব্যবস্থা করনা কিছু, একে ওকে ডেকে।’

মওকা পেয়ে গেছিল উমাপদ। থলেশুদ্ধ লোকটাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিজের দোকানের খাটিয়ায় এনে শুইয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকেই তো খদ্দের আসতে শুরু করলো দোকানে। হাজার জনের হাজার কৌতূহল, হাজার মতামত !

একটু বেলা হতেই খদ্দেরের ভিড়ভাড়াক্কা কমে এলো। দোকানটা ফাঁকা হতেই উমাপদ গিয়ে পিছন ফিরে বসলো মালপত্তরের গাদায়। সেফটিপিন খুলে ব্যাগের ভেতরটা না দেখা পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই। ব্যাগ খুলে টাকার বান্ডিল আর আছে কিনা খুঁজতে শুরু করলো উমাপদ। সব জিনিস এক এক করে বের করল। আর টাকার বাণ্ডিল বেরলো না। খুচরো পয়সা কিছু, ছেঁড়াখোঁড়া কাপড়চোপড়, স্টিলের গেলাস বাটি, একটা নড়বড়ে চশমা আর একটা মাঝারি মাপের পুরনো নোটবুক পাওয়া গেল। উমাপদ কিছুটা অবাক হল নোটবুকটা দেখে। লেখাপড়া তাহলে জানা আছে নিশ্চয়ই লোকটার! মনের গভীরে মৃদু একটা ধাক্কা অনুভব করল। কৌতুহলী হয়ে নোটবুকের জীর্ণ পাতাগুলি উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো উমাপদ। গোটাটাই প্রায় সাদা। মাঝের শুধু কয়েকটা পাতায় কিছু হিসাবপত্র লেখা আছে। অন্য একটা পাতায় গিয়ে কিন্তু চোখ আটকে গেল উমাপদ’র। পাকা হাতের লেখা একপাতার একটা চিঠি। উমাপদ’র যেটুকু লেখাপড়া শেখা আছে, তাতে পড়তে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। পড়লো উমাপদ আগাগোড়া,
–‘ বাবা সঞ্জয়,
বেশি কিছু লেখার ইচ্ছে নেই আজ। তোমার মায়ের মৃত্যুর পর তোমাদের নিয়ে শেষ জীবনটা সুখে কেটে যাবে ভেবেছিলাম। যে গেল আমাকে একলা ফেলে তার জন্য দুঃখ করে কি লাভ ! কিন্তু এক বছর কাটল না। এমন জীবন যে আমাকে একলা কাটাতে হবে ভাবি নি কোনোদিন। বৌমা পরের মেয়ে তাকে দোষ দিয়ে কি লাভ ? তোমাকেও তো মানুষ করার জন্য কত কষ্ট করেছি। সেই তুমিও আজ আমাকে সহ্য করতে পারছো না। বৌমা বাবলু মিতাকেও আসতে দেয় না আমার কাছে। সব জেনেও কোন কথা বলোনা তুমি। আমি কী নিয়ে থাকি তাহলে এই ঘরে ? তাই এখানে আর থাকছি না। একটা পেটের ব্যবস্থা নিশ্চয়ই ভগবান করবেন। দয়া করে খোঁজাখুঁজি কোরোনা। এতেই আমি ভালো থাকবো। তোমরা সুখে থাকো।
.. ইতি
তোমার হতভাগ্য বাবা

চিঠিটা স্তব্ধ হয়ে বার কয়েক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পড়ল উমাপদ। চিঠির উপরে তারিখটা উল্লেখ আছে। বছর পাঁচেক আগেকার তারিখ। জায়গার নাম নেই। যে পাতায় চিঠিটা লেখা হয়েছে সেটা আধছেঁড়া। তার মানে চিঠিটা লিখেও হয়তো দেওয়া হয়নি। কিংবা অন্য কোনো কপি করে দেওয়া হয়েছে। উমাপদ মনে মনে অনুমান করলো শুধু।
কী করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না সে। শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মৃত্যুপথযাত্রী লোকটার মুখের দিকে চাইল। খুব জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস বেরিয়ে আসছে মুখ দিয়ে। চোখ দুটো আধবোজা। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো উমাপদ’র।‌ চোখ দুটো বন্ধ করতেই বুকের কোন গভীর থেকে উঠে আসা, একটা চেনা চেনা অস্পষ্ট দৃশ্যের কাটাছেঁড়া অংশ বার বার ভেসে বেড়াতে লাগলো তার মনের পর্দায়।

উমাপদ চোখ বন্ধ করে দেখতে থাকল অনেক লোকের ভিড়েঠাসা একটা গেরস্থ বাড়ির ফিকে হয়ে যাওয়া চলমান কিছু ছবি। বাড়িটার মাটির দাওয়ায় শুয়ে আছে একজন হাড় জিরজিরে রোগী। অনেকেই তার বিছানা ঘিরে বসে আছে। বুকটা তার খুব জোরে ওঠানামা করছে। শ্বাস পড়ছে জোরে জোরে। একসময় ছোট্টো উমার হাত ধরে ভিড় ঠেলে কে যেন নিয়ে গেল সেই রোগীর বিছানার পাশে। একটা ছোট্ট চামচায় জল নিয়ে একজন মেয়েছেলে বলল,
–‘ বাবার মুখে জল দে উমা.. এই সময় দিতে হয়! ছেলের হাতের জল..’
হঠাৎ উমাপদ’র চোখ দিয়ে জলের ধারা বইতে লাগলো। টাকার ব্যাগটা ফেলে রেখে ছুটে গেল সে রাস্তায়। একটা চলন্ত রিকশাকে থামিয়ে বলল,
–‘ হাসপাতাল যাবি? চল ভাই, বড় বিপদে পড়েছি..যা চাইবি তাই দেব..’
রিক্সাওয়ালা রাজি হওয়ায় মরণাপন্ন লোকটার কাছে ছুটে এলো। তার মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে তার আধবোজা চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
–‘একটু জল খাবে ?…গরম দুধ একটু ?..’
———————–
কাজী নুদরত হোসেন
নলহাটি, বীরভূম (প.ব)
৯৫৪৭৬৩৭৪৩৭