মহিলা ঢাকির ঝাঁঝ (ধারাবাহিক উপন্যাস, পঞ্চম পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
664

তনিমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর কুহকের আবার স্বাভাবিক জীবন যাপন । কিন্তু শোরগোল বাধালেন তার বাবা শিবদাস মোড়ল । শিবদাস মোড়লের ধারণা, কুহক তনিমার বিয়েতে অনেক টাকা পয়সা ঢেলেছে । সুতরাং কুহক অতোগুলি টাকা পেলো কোথায় ? নিশ্চয় বাড়ি থেকে সরিয়েছে । আর টাকা সরানোর ইন্ধন জুগিয়েছে ঐ বেশরম হতভাগা শিবু বায়েন । শিবু বায়েনের উপর তিনি ক্ষেপে লাল । ছেলেকে শুনিয়ে শুনিয়ে ইতিমধ্যে মোড়লের কয়েকবার চিৎকার করা হয়ে গেছে, “শিবু বায়েনকে গ্রাম ছাড়া না করতে পারলে আমার শান্তি নেই । তার একটিই দোষ, বাপ-বেটি দুজনে মিলে তাঁর একমাত্র ছেলের মাথাটা চিবিয়ে খেয়েছে । যার জন্য ছেলেটা নাওয়া-খাওয়া ভুলে শিবু বায়েনের ছোট মেয়েটাকে নিয়ে দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে । বাদরামীর সীমা ছাড়িয়ে গেছে শিবু বায়েন । ওদের যদি গ্রাম ছাড়া না করতে পারি তবে আমার নাম শিবদাস মোড়ল নয় ।“ আরও অনেক অসাংবিধানিক কুৎসার কচলাকচলি ।
কুহক চুপচাপ ! বাবার মতো পূজনীয় মানুষের সাথে সরাসরি সংঘাতে যেতে নারাজ । সে বাবাকে বেশী ঘাটাতে চায় না । কুহক বাবার সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে বুঝতে পেরেছে, তার বাবা কিছুতেই খেমটিকে মেনে নেবেন না । তাঁকে বোঝালেও তিনি বুঝবেন না । তাই মায়ের মাধ্যমে বাবাকে রাজী করানোর প্রয়াস কুহকের অব্যাহত । কুহকের মা তাকে উৎসাহিত করার জন্যেই খেটিকে নিয়ে তার ঘর বাঁধার স্বপ্ন ! এছাড়া কুহকের যেটা উপলব্ধি সেটা হচ্ছে, খেমটির সঙ্গে তার ভাব ভালবাসা নিঃসন্দেহে সঙ্গত ও বাস্তবসম্মত । ভালবাসায় কখনও জাত নেই । ভালবাসায় জাত-পাত সম্পূর্ণ ঊহ্য । মনের মিল সর্বাগ্রে যাকে বলে প্রথম ও শেষ কথা । একে অপরের প্রতি নির্ভেজাল বিশ্বাস । হৃদয়ের গভীর ভালবাসাই মুখ্য । তার ভালবাসা ষোলোআনা খাঁটি । বাবার চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তে কুহক গররাজী । তাই বাবার তর্জন-গর্জনেও কুহক তার সিদ্ধান্তে অবিচল ।
কুহক সর্বদা তাদের মেলামেশার খুঁটিনাটি মাকে জানিয়ে রাখে । সেইজন্য কুহকের মা খেমটির সাথে তার অবাধ বিচরণ সমস্তটাই অবগত ।
“কুহক, তুমি এখন কোথায় চললে ?” কথাটা শুনে কুহক তার বাবার দিকে তাকালো । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে শিবদাস মোড়ল আবার বললেন, “সকাল ৯টাও বাজেনি । অথচ কাজকর্ম ফেলে তুমি বাড়ি থেকে সাত-সকালে বের হচ্ছো ? আমি কী তোমার গুরুত্বপূর্ণ রাজকার্যে যাওয়ার কারণ জানতে পারি ?”
“বাড়িতে আমার কাজকর্ম কোথায় ?” কুহক বরং তার বাবার কাছে জানতে চাইলো ?
কেন ? তুমি বললে চাকরির পরীক্ষার কোচিং নেবে ?
বাড়িতে বসে কিভাবে চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার কোচিং নেবো ?
বহরমপুরে যাতায়াত করে অনেকেই চাকরির পরীক্ষার কোচিং নিচ্ছে ! তাহলে তোমার আপত্তি কোথায় ?
বহরমপুরে চাকরির কোচিং সেন্টার ভাল নেই । যেগুলি রয়েছে, সেগুলি বরং স্কুল মাস্টা রির ক্ষেত্রে উপযুক্ত । তাতে আমার কোনো লাভ হবে না । তার চেয়ে কলকাতায় থেকে সেখানে কোচিং নিলে সর্বভারতীয় পরীক্ষাগুলোতে বসা অনেক সহজ হোতো ।
তবে আর কী ? বাড়ি থেকে বেরিয়ে বায়েন পাড়ায় গেলে তোমার কী চাকরির জন্য কোচিং সম্ভব, এটা আমি জানতে চাই ?
এখন আমি বায়েন পাড়ায় যাচ্ছি না ।
“তবে সেজেগুজে সকাল সকাল কোথায় যাওয়া হচ্ছে ?” শিবদাস মোড়ল কুহকের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন ।
চৌরিগাছা ।
হঠাৎ চৌরিগাছা কেন ?
আমি বহরমপুরে যাবো ।
তাই বলো তুমি বহরমপুরে যাবে ! বহরমপুরের যাওয়ার হেতু একটু খোলসা করে বলবে কী ?
বহরমপুরের খাগড়া বাজারে ঢাক-ঢোলের রিপেয়ারিংয়ের দোকানে রয়েছে । খেমটিদের ঢাকটা সারাতে হবে ।
“বায়েন পাড়ায় না গিয়ে বায়েন পাড়ার মানুষের জন্য বহরমপুরে যাওয়া একই ব্যাপার ! যাদের ঢাক মেরামত করা দরকার, তাদের বাড়িতে কী লোকজন নেই যার জন্য তোমাকে যেতে হচ্ছে ?” খানিকটা ব্যঙ্গচ্ছ্বলে শিবদাস মোড়ল বাঁকা চোখে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন ?
আমি খেমটিকে কথা দিয়েছি, তার সঙ্গে আমি যাবো ।
“বলিহারি তোমাদের আদিখ্যেতা ! এবার দয়া করে আমাকে বোঝাও, ঢাক সারানোর টাকা কোথায় পাচ্ছো ?
মা দিয়েছেন ।
“এবার বুঝেছি । গোপনে গোপনে তোমার মা তোমাকে টাকা পয়সা যোগান দিয়ে যাচ্ছেন । তাই তো বলি, শিবু বায়েনের বড় মেয়ের বিয়েতে এত রোশনাইয়ের বাহার কেন ? এখন বুঝলাম, তাদের পরের ধনে পোদ্দারি ?” মোড়ল কর্কশ ভাষায় কথাগুলি বললেন ।
আমার ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছে । খেয়া নৌকায় ওপারে যেতে এখন অনেক সময় লাগে । একটু দেরী হলে ট্রেনটা পাওয়া মুস্কিল হবে ।
তবে আর কী । যাও, ঘরের খেয়ে বনের মহিষ তাড়ানো ! বাড়ির কোনোকিছুর প্রতি কোনো নজর নেই, অথচ পরের বাড়ির উপকারের জন্য উদার হস্ত । তাদের জন্য রাত-দিন খাটাখাটুনি ।
ঘোড়াডাঙ্গা গাঁয়ের খেয়া নৌকা কেবলমাত্র এপার থেকে ছেড়েছে অমনি কুহকের ডাক, “মাঝি কাকা ! মাঝি কাকা ! নৌকাটা কিনারে ভিড়াও । এই খেয়া নৌকাটায় না উঠলে ১১টার ট্রেন পাওয়া নৈব-নৈব-চ” ।
অগত্যা নৌকা পুনরায় তীরে ভেড়ালো মাঝি ।
তারপর খেয়া নৌকায় নদী পার হয়ে টোটো নিয়ে তারা ছুটলো চৌরিগাছা স্টেশনে । স্টেশনে পৌঁছে দেখে, ট্রেন তখনও প্লাটফর্মে ঢোকেনি । তারপর তারা টিকিট কেটে প্লাটফর্মে দাঁড়ানো মাত্রই ট্রেন ঢুকলো । তাদের গন্তব্যস্থল বহরমপুর, সুতরাং তাদের খাগড়াঘাট স্টেশনে নেমে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে হবে । ঢাক নিয়ে নিজেকে সামলাতে পারছিলো না খেমটি । তাই নিজে ঢাক কাঁধে নিয়ে ট্রেনের কামরায় উঠলো কুহক । যদিও ইতিমধ্যে খেমটি আগেই ট্রেনের কামরায় উঠে সিটে বসে পড়েছে” ।
ঢাকের চামড়া ফাঁটা । খেমটি জানে, ঢাকের দুপাশের আচ্ছাদন হল চামড়া । মারা যাওয়ার পর গরু মোষের ছাল দিয়ে মূলত ঢাকের দুপাশে বাঁধা হয় । আবার ঢাকের খোলে ছিলার টান পরানোটাও যথার্থ হওয়া বাঞ্ছনীয় । ছিলা সাধারণত ধনুকের গুণের মতো । এছাড়া ছাগলের চামড়াও ঢাকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । খোল তৈরী হয় সাধারণত আম গাছের কাঠের মোটা গুঁড়ি কুঁদে কুঁদে । ঐ আম কাঠ আবার গরুর চোনা, লঙ্কা মেশানো জল, রসুন তেল, ইত্যাদি মাখিয়ে রোদে পুড়িয়ে কাঠ তৈরী অর্থাৎ সিজন করা জরুরি । দীর্ঘ সময় লাগে সিজন করতে । তাই এক একটা ঢাক বানাতে পরিশ্রম যথেষ্ট । এখনও আগের প্রক্রিয়া চললেও ঢাক তৈরীতে খরচার পরিমান বেশী ।
তাদের ঢাক দেখে দোকানের মালিক বললেন, “এখনও বর্ষা পুরোপুরি থামেনি । মাঝে মধ্যে বৃষ্টির তান্ডব বর্তমান । কিন্তু ঢাক সারাইয়ের জন্য রৌদ্রোজ্জ্বল দিন দরকার । তাই সময় লাগবে ।“
“কিন্তু আমাদের বিশ্বকর্মার পূজোর দুদিন আগে ঢাক দরকার । বিশ্বকর্মা পূজোতে বায়না রয়েছে” । খেমটি জোর দিলো ।
আশা করছি তার অনেক আগেই হয়ে যাবে । ফোন নম্বরটি দিয়ে যান, সারানো ঠিকমতো হয়ে গেলেই আমরা ফোন করে জানিয়ে দেবো । তারপর ঢাকের দিকে তাকিয়ে দোকানের মালিক কিছুটা হেসে আবার বললেন, “আপনাদের ঢাকের খোল ( ঢাক পিপার মতো একটি কাঠের খোল বিশেষ, যার দুই মুখ খোলা ভিতরটা ফাঁপা । দুইদিকে চামড়া দিয়ে আচ্ছাদন দেওয়া । ঢাকের ক্ষেত্রে আম কাঠ যথোপযুক্ত । ) ভীষন মজবুত । এই জাতীয় খোলের এখন আকাল” ।
খেমটি দোকানের মালিকের কাছে জানতে চাইলো, “আচ্ছা কাকু ! নতুন ঢাক তৈরীতে এখন খরচা কেমন ?”
কুহক খেমটির কৌতুহলের প্রেক্ষাপটে তাকেই জিজ্ঞাসা করলো, “নতুন ঢাকের এখন প্রয়োজন কোথায় ? সুতরাং দাম জিজ্ঞাসা করে কাকুকে অযথা কেন বিরক্ত করছো ?”
তারা দোকানের মালিকের নাম জানতে পারলো, “ভজহরি ।“ ঐ ভজহরি কাকু তাঁর সবকটি দাঁত বের করে হেসে বললেন, “বিরক্ত হবো কেন ? এটাই তো আমাদের প্রধান পেশা । পারিবারিক বংশ পরস্পরার ব্যবসা । যাই হোক এক একটা ঢাক তৈরীর জন্য প্রায় পনের হাজার টাকা । ঢাকের গয়না অর্থাৎ পাখির পালকের স্ট্যান্ড দিয়ে ঢাকের দাম ষোলো হাজার টাকা ছুঁয়ে গেছে । তবে আপনাদের ঢাক বানানোর প্রয়োজন হলে আমাদের বলবেন, আমরা বাজার দরের চেয়ে কম দামে ঢাক তৈরী করে দেবো । আজকাল আবার ঢাক – ঢোলের কদর ক্রমশ বাড়ছে” ।
“এটা কেন বলছেন ভজহরি কাকা ?” কুহক জিজ্ঞাসা করলো ।
কেননা ঢুলিরা সাধারণত তর্জা, বোলান, আলকাপ, রামায়ন গান, কবি গান, কীর্তন, ইত্যাদিতে ঢোল বাজাতেন । কিন্তু বর্তমানে ঐসব গানের জনপ্রিয়তা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে ! আর তাছাড়া ঐসব গানের কদর কোথায় ? সেই কবি গানের কবিয়াল এখন কোথায় ? কবি গানের মাহাত্ন্য আজ লুপ্তপ্রায় ! কীর্তনীয়াদের অস্তিত্ব প্রায় নিস্প্রভ । তবে এটা ঘটনা, ঢাক-ঢোল বিভিন্ন ভাটিয়ালী গানের সঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে । এমনকি ভাল ভাল আধুনিক গানের ক্ষেত্রে ঢাক-ঢোল ব্যবহারের জনপ্রিয়তা ক্রমাগত বাড়ছে । এটা একটা আশার খবর । এটাই বরং সান্ত্বনার ।
এবার ভজহরি কাকা কুহকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনাদের জন্য একটু চা আনাই ?”
“তবে হাল্কা চিনি !” কুহক মনে মনে ভাবছিলো চায়ের কথা । কেননা তার চায়ের তেষ্টা অল্প হলেও পেয়েছে ।
খেমটি বললো, “বাবুর জন্য শুধুমাত্র এক কাপ । আমি চা খাবো না ।“
“হলধর কোথায় রে ?” ভজহরি কাকা তাঁর দোকানের কর্মচারীকে হাঁকলেন ।
যাই বাবু ।
চট্‌ করে হাল্কা চিনি দিয়ে খোকনের দোকান থেকে এক কাপ চা নিয়ে আয় ।
বাবু বিস্কুট আনবো ?
কুহক সঙ্গে সঙ্গে বললো, “বিস্কুটের আর দরকার হবে না । এক চা পেলেই যথেষ্ট । আকাশের অবস্থা ভাল না । আমাদের শিগগির স্টেশনে ছুটতে হবে । মনে হচ্ছে ঢেলে বৃষ্টি নামবে !“
ঢাকের মেরামতির ব্যাপারে সমস্ত কিছু দেওয়ার পর তাদের দুজনের বাড়ি ফেরার পালা । পরের দিন জন্মাষ্টমী । শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন । শ্রীকৃষ্ণের প্রতি কুহকের ভক্তি অবর্ণনীয় । তাই জন্মাষ্টমীর পূজোর জন্য কিছু বাজার করে তারা এবার খাগড়াঘাট স্টেশনের দিকে ধাবিতো । সারা দিন মেঘলা আকাশ । দুপুরে ঝিরঝির করে দু-পসলা বৃষ্টি পড়েছে, তবে সেটা কিছুক্ষণের জন্য । কিন্তু আকাশে হঠাৎ মেঘের গর্জন । অথচ জলের ট্যাঙ্কির নিকট থেকে সত্বর বাসে না উঠলে খাগড়াঘাট স্টেশন থেকে ট্রেন পাওয়া মুস্কিল । অথচ নিমেষের মধ্যে সারা আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল । আকাশ কালো মেঘে ঢাকার কারণে বহরমপুর শহরে মানুষের দৌড়ঝাঁপের ব্যস্ততা তুঙ্গে । কুহকের টেনশন বাড়ছে । আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখে কুহকের অনুমান, প্রচন্ড বৃষ্টি নামবে । বৃষ্টি নামার আগে তাদের টার্গেট, যেভাবে হোক খাগড়াঘাট স্টেশনে পৌঁছানো । নতুবা তাদের নির্ধারিত ট্রেন পাওয়া অসম্ভব ।
তারা বহরমপুরের জলের ট্যাঙ্কির পাশ থেকে স্টেশনগামী বাস ধরলো । গঙ্গার ব্রিজ পার হওয়ার সাথে সাথে মুষলধারে বৃষ্টি । বৃষ্টির ফোঁটা বড় বড় । এদিকে বাসে প্রচন্ড ভিড় । তিল ধারণের জায়গা নেই । দুজনে বাসের পেছনে ঠায় দাঁড়িয়ে । প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে বাসযাত্রীরাও উদ্বিগ্ন ! বাসযাত্রীদের চোখে মুখে আশঙ্কার ছায়া ! ধারাবর্ষণের কারণে তাঁরা ঠিকমতো গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারবেন কিনা সেই ধন্দেতে বিমর্ষ !
বাসটির গন্তব্যস্থল কান্দি । অগত্যা অতো বৃষ্টির মধ্যে তাদের খাগড়াঘাট স্টেশন স্টপেজে নামতে হোলো । বাস থেকে নেমেই ছুটে কাছাকাছি তেলে ভাজা দোকানের শেডের নীচে দাঁড়ালো । স্বল্প পরিসরের জায়গা । দোকানের মাসি সাধারণত বিকালে দোকান খোলেন । তিনি নাকি কড়াইতে গরম তেলে সিঙ্গারা কেবল ছেড়েছিলেন, ইত্যবসরে মুষলধারে বৃষ্টি । যাই হোক প্রবল বৃষ্টিতে ঐটুকু জায়গায় জিনিসপত্র নিয়ে মাসির হিমসিম । উপরে খড়ের ছাউনি । ছাউনির ফুটো দিয়ে আবার বৃষ্টির জল গড়াচ্ছে । মহা সমস্যা । এদিকে কুহক ও খেমটি ঐরুপ ভয়ংকর বৃষ্টির মধ্যে বাস থেকে নেমে ছুটে দোকানে পৌঁছাতে বৃষ্টির জলে ভিজে একশা । অথচ মাসির দোকানে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির জল থেকে রেহাই নেই । তাই তারা ঠিক করলো, দরকার হলে আরও একটু ভিজে স্টেশনের প্লাটফর্মে গিয়ে উঠবে । বড় রাস্তার খাগড়াঘাট স্টেশন স্টপেজ থেকে স্টেশন প্লাটফর্ম পর্যন্ত অনেকটাই রাস্তা । দৌড়ালেও পাঁচ-ছয় মিনিটের ধাক্কা ! তারপর স্টেশনের প্লাটফর্মে পৌঁছে শোনে, চারটে তিরিশ মিনিটের কাটোয়া লোকাল নির্দ্দিষ্ট সময়ে ছেড়ে গেছে ।
আবার সমস্যা । পরবর্তী ট্রেন অনেক পরে, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় । আজিমগঞ্জ – ব্যান্ডেল লোকাল । অগত্যা প্লাটফর্মে বসে থাকা । বৃষ্টির তেজ ক্রমশ কমতির দিকে । খেমটি কুহককে তাগাদা দিচ্ছে কাছাকাছি দোকান থেকে একটা গামছা কিনতে । গামছা দিয়ে মাথা ও শরীরের অন্যান্য জায়গায় মোছা দরকার, তাহলে সর্দি কাশি থেকে অন্তত রেহাই ।
খবর হোলো তাদের পরবর্তী ট্রেন বিলম্বে চলছে ।
সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টার ট্রেন খাগড়াঘাট স্টেশনে পৌঁছালো ঠিক সাতটায় । ট্রেনের কামরায় দুজনে মুখোমুখি বসা । টেনশনে দুজনের মুখ থেকে হাসি উধাও । বাড়িতে তারা কী জবাব দেবে ? বিশেষ করে কুহকের সমস্যা বেশী । তার মাকে নিয়ে সমস্যা নেই, যতো সমস্যা বাবাকে নিয়ে । কুহক বুঝতে পারছে, সে আজ নির্ঘাত বাবার অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের সম্মুখীন হবে । এইসব টেনশন ছাড়া তাদের পরনের জামা কাপড় এখনও ভালভাবে শুকায়নি । ভেজা কাপড়ে শারীরিক অশান্তির দুর্ভাবনা তাদেরকে গ্রাস করছে । দুজনে প্রাণ খুলে কথা বলবে সেখানেও তাদের এখন আড়ষ্ঠতা ।
প্রচন্ড বৃষ্টি হওয়ার কারণে চৌরিগাছা স্টেশনে নেমে বাবলা নদীর ঘাটে যাওয়ার কোনো টোটো পাওয়া যাচ্ছে না । অন্যান্য সময়ে ট্রেনের প্যাসেঞ্জার নেওয়ার জন্য টোটোদের মারামারি ! বরং টোটোদের “লাইন-প্রথা” না থাকায় নিজেদের ধুমধড়াক্কার কচলাকচলি । কে কার আগে প্যাসেঞ্জার তুলবে । অথচ আজ বাবলা নদীর খেয়া ঘাটে যাওয়ার জন্য কোনো যানবাহন মিলছে না । তাদের হাঁটা ছাড়া অন্য কোনো গতি নেই । কপালকেই দোষারোপ করছে খেমটি । সারাদিনের ধকলের পরে এমনিতেই তারা ক্লান্তিতে বিপর্যস্ত । তার উপর হাঁটার কথা ভেবে খেমটি বিরক্তিতে মূহ্যমান ।
খেয়া ঘাটে পৌঁছে দেখে মাঝি নদীর ওপারের পারে নৌকা দাঁড় করিয়ে সম্ভবত প্যাসেঞ্জারের আশায় বসে রয়েছে । কুহক মাঝিকে এপার থেকে ডাকলো । তার চিল্লানোতে কাজ হোলো । মাঝি ডাক শুনতে পেয়ে ওপার থেকেই সাড়া দিলো, সে আসছে । ভরা নদী পার হয়ে যখন তারা ঘোড়াডাঙা গ্রামে অবতরণ করলো, তখন রাত্রি সাড়ে ৯টা ।
খেমটিদের বাড়িতে ভীষণ দুশ্চিন্তা । বাড়ি থেকে ফোনে লাইন পাচ্ছে না । চিন্তায় খেমটির মা একবার ঘর আর একবার বাহির করছে । মেয়েটা বাড়ি না ফেরার জন্য তার মন ভীষণ উতলা । খেমটি ফেরার পরে তার মা জানতে পেরেছিলো, তাদের দুজনের কারও ফোনে চার্জ ছিলো না । ফলে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি ।
রাত্রি অনেক । প্রবল বর্ষণের কারণে রাস্তাঘাট সুনসান । গ্রামের মানুষ সাধারণত রাত্রি ৯টার মধ্যে শুয়ে পড়েন, কেননা তাদের আবার ভোর রাতে উঠে গৃহস্থালির কাজকর্মে মনোযোগ দিতে হবে । চাষির বাড়িতে হালের জোড়া বলদ ছাড়া গাই গরুও একটি বা দুটি রয়েছে । ভোরবেলায় ঐসব গেরস্থালির মানুষ গোয়াল ঘর থেকে গরু বের করে এবং ছোট করে কাটা বিচালি ( খড় ), খইল দিয়ে মিশিয়ে খাওয়ায় । সূর্য উঠবার আগেই চাষিরা কাঁধে লাঙ্গল ও জোড়া বলদ সঙ্গে নিয়ে মাঠের জমিতে চাষের উদ্দেশ্যে ছোটেন । ঐ মাঠে ঋতু অনুযায়ী ফসলের চাষবাস । ঘোড়াডাঙা গ্রামে চাষবাসে অধিকাংশ মানুষ কাজ করেন । তাই তাদের ভোরে উঠা । ভোরে উঠা তাদের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ ।
রাস্তা সুনসান । বায়েন পাড়ার চল্লিশ ঘর বাসিন্দাদের মাঝখানে খেমটিদের বাড়ি । তাই খেয়া ঘাট থেকে খেমটিদের বাড়ি অনেকটা দূর । গাঁয়ের রাস্তা ধরে দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে । অনেক রাত্রিতে গাঁয়ের কানাই কাকা দুজনকে হাত ধরাধরি করে রাস্তায় হাঁটতে দেখে অবাক ! ঝড় জলের রাত্রিতে এরা দুজন কোথা থেকে আবির্ভূত হোলো । তাই কৌতুহল চেপে না রেখে কানাই কাকা কুহককে জিজ্ঞাসা করলেন, “অন্ধকার রাত্রিতে কোথায় চললে বাছাধন ?”
একটু বায়েন পাড়ার দিকে যাচ্ছি ।
আড় চোখে কুহকের দিকে তাকিয়ে কানাই কাকা আবার বললেন, “শুনেছি তুমি নাকি ঘন ঘন বায়েন পাড়ায় যাচ্ছো । কথাটা কী সত্যি ?”
হ্যাঁ কাকা ।
বায়েন পাড়ায় এত রাত্রিতে কাদের বাড়ি ?
শিবু বায়েনের বাড়ি ।
তা হঠাৎ বামুনের ছেলে হয়ে বায়েনদের মেয়ের সাথে ভাব ভালবাসা কেন ঘটলো আমার মাথায় ঢুকছে না বাপু ? শুনেছি শিবু বায়েনের ছোট মেয়েটা ভীষণ চালু । কথাবার্তায় চৌকশ । যে কোনো সুপুরুষ ছেলেকে বধ করা তার কাছে তুচ্ছ ! যাকে বলে বা-হাতের খেল ! সাবধানে থেকো বাছাধন ! নতুবা বায়েন পাড়ার মানুষেরা জোর করে ঐ বায়েন মেয়েকে তোমার ঘাড়ে গছিয়ে দেবে । কথাগুলি বলার পরে কানাই কাকার কী হাসি ! সেই হাসির মাহাত্ম্য বোঝা খুব কঠিন ।
কানাই কাকার ধানাই পানাই গতিবিধি লক্ষ্য করে কুহক বললো, “এবার আসছি কাকা । অনেকটা পথ যেতে হবে ।“
আবার বাঁকা চোখে খেমটির দিকে তাকিয়ে কানাই কাকা বললেন, “পাশে কাকে যেনো দেখছি । চিনতে পারলাম না ?”
“পাশে আমার ভালবাসার মানুষ, খেমটি । শিবু বায়েনের ছোট মেয়ে ।“ কুহক রাখঢাক না করে খোলসা করে কানাই কাকাকে জানিয়ে দিলো ।
পুনরায় খেমটির দিকে তাকিয়ে কানাই কাকা বললেন, “তুমি রাগ করো না । আমি অযথা তোমার নামে কয়েকটা কটু কথা বলে ফেলেছি । আসলে গাঁয়ের লোকজন মোড়ল মশায়ের ছেলের সঙ্গে তোমার মেলেমেশা নিয়ে নানান কথা পথে ঘাটে আলোচনা করছেন । তাই তাদের কথার উপর ভিত্তি করে আমার মন্তব্য । এতে তুমি রাগ করো না প্লীজ ।“
তারপর আবার বললেন, “এবার চলি । অনেক রাত হয়েছে । আমার আবার শোওয়ার আগে প্রেসারের ঔষুধ খেতে হবে ।“ বলেই কানাই কাকা হনহন করে স্থান ত্যাগ করলেন ।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো কুহক !
খেমটিকে পৌঁছে দিয়ে কুহক বাড়ি ফিরে দেখে তার মা খাবার নিয়ে বসে রয়েছেন । চটজলদি হাত মুখ ধুয়ে রাত্রির খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লো কুহক ।
পরেরদিন এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে কুহক একটা ইন্টারভিউ কল পেলো । পাশের গ্রামের জুনিয়র হাই স্কুলের করণিক পদে । সেখানকার বর্তমান করণিক সুখময় স্যানাল বাবু অবসর নেওয়ার কারণে পদটি ফাঁকা । সেই স্কুলে করণিক পদের ইন্টারভিউয়ের জন্য কল । তবে ইন্টারভিউ হবে দুর্গা পূজার পর । এখনও অনেক সময় বাকী । ইন্টারভিউয়ের কথা সে ইচ্ছা করে বাড়িতে জানালো না । বাড়িতে তার বাবা জানতে পারলে এখন থেকেই আদাজল খেয়ে চাকরিটা পাওয়ার জন্য লড়বেন । কিন্তু এইসব তদবির তদারকি কুহকের একেবারে না-পসন্দ । নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেলে ভাল, না পেলে আরও ভাল । তার মুখ্য লক্ষ্য, খেমটিকে ঠিকমতো দাঁড় করানো । অথচ খেমটি না দাঁড়াতে পারলে তাদের পরিবার আর্থিক দুর্দশায় ভেঙ্গে পড়বে । তাই নিজের চাকরির ব্যাপারে উদাসীন !
বিশ্বকর্মা পূজা আসন্ন । ভাদ্র সংক্রান্তি । ঐদিন বায়েন পাড়ার কয়েকটি ঘরে মা মনসা পূজা অনুষ্ঠিত হয় । খেমটিরাও মা মনসা ঠাকুরের ভীষণ ভক্ত । সুতরাং বিশ্বকর্মা পূজোর দিন খেমটিদের পাড়ায় মা মনসা পূজার ঘনঘটা । যদিও কুহক জানে, ওপার বাংলার মানুষেরা শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে মনসা পূজা করেন । যাই হোক বিশ্বকর্মা পূজোতে ঢাক বাজানোর বায়না রয়েছে । ইতিমধ্যে শিবু বায়েন বহরমপুরে নিজে গিয়ে ঢাকটা নিয়ে এসেছে । শিবু বায়েনের যাওয়ার আরও একটা কারণ, ঢাকের খুঁটিনাটি সারাই নিজের চোখে দেখে নিতে পারবে । যাই হোক শিবু বায়েন ঢাকের মেরামত দেখে ভীষণ খুশী । তার মতে, ঢাকের যা কাজ হয়েছে তাতে নিশ্চিন্তে দুবছর ঢাক বাজালেও কিচ্ছু হবে না ।
দ্বীপশিখা হঠাৎ খেমটিদের বাড়ি এসে হাজির !
দ্বীপশিখা নৃত্যে ভীষণ পারদর্শী । তার নাচের প্রোগ্রাম ভরতপুরে । খেমটিকে নাচের প্রোগ্রামে থাকার জন্য দ্বীপশিখার আগমন । খেমটিকে দ্বীপশিখার আবদার, “তোকে কিন্তু আমার নাচের অনুষ্ঠানে থাকতেই হবে ।“
কবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে তোর নাচের প্রোগ্রাম ?
আগামী শনিবার বিকেল চারটেয় । ভরতপুর ব্লক অফিসের কাছাকাছি । আর একটা কথা, ভরতপুর যাওয়ার রাস্তা এখন অনেক উন্নত । সাইকেলে দিব্যি পৌঁছে যেতে পারবি । আমার নাচের অনুষ্ঠানে তোর উপস্থিত অবশ্যই থাকা চাই । “না যাওয়ার” কোনোরকম বাহানা শুনবো না ।
ঠিক আছে । আমি কথা দিচ্ছি, তোর নাচের প্রোগ্রামে আমি উপস্থিত থাকছি । তবে ……।
তবে কী ?
তবে আমার সঙ্গে কুহক যাবে ।
যথা আজ্ঞা !
তারপরে দ্বীপশিখার সঙ্গে অনেক গল্প । ব্রাম্মণের ছেলের সাথে টকঝাল অভিজ্ঞতা । এই প্রসঙ্গে আরও অনেক গল্প ।
দ্বীপশিখা খেমটিদের বাড়ি সাইকেল চালিয়ে এসেছে । যদিও সে সব ধরনের গাড়ি যেমন, স্কুটি, বাইক, চার চাকা, ইত্যাদি চালাতে অভ্যস্ত । গাঁয়ে সে খুব ফরোয়ার্ড মেয়ে । সবাই জানে দ্বীপশিখা আধুনিক চালচলনে বিশ্বাসী । ঘোড়াডাঙা গ্রামের মেয়েরা দ্বীপশিখার ভক্ত । তার চালচলন, রুপচর্চা, শিক্ষা অনেকেই অনুসরণ করে । দৈনন্দিন জীবন যাত্রা যথেষ্ট মার্জিত ও ভদ্র । সকলের সঙ্গে তার সুমিষ্ট ব্যবহার । গাঁয়ে সকলেই জানে, খেমটি দ্বীপশিখার ভাল বন্ধু । দুজনের মধ্যে খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক । দুজন ভিন্ন জাতির হলেও দুজনের মধ্যে মধুর সম্পর্ক । তাদের দুজনের মধ্যে ভেদাভেদের চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণভাবে দুর্লভ ।
শনিবার বিশ্বকর্মা পূজো । ঐদিন আবার দ্বীপশিখার নাচের অনুষ্ঠান । খেমটির বাবা যাবে হেমাতপুরে গাঙ্গুলি বাড়ি ঢাক বাজাতে । বাবার শরীর ততোটা ভাল নয় । এইজন্য খেমটির চিন্তা অহরহ । ইদানীং সন্ধ্যাবেলা জ্বর আসছে । বাবার কেন প্রত্যেক সন্ধ্যায় জ্বর আসছে, গাঁয়ের হাতুড়ে ডাক্তার ধরতে পারছেন না । জ্বরের ট্যাবলেটে সাময়িক আরগ্যলাভ, তারপর যে-কে-সেই । অর্থাৎ রোজ সন্ধ্যাবেলায় বাবার জ্বর নিয়ম করে আসছেই । তাতেই খেমটির দুশ্চিন্তা । জ্বরের কারণটা জানতে পারলে, চিকিৎসা ঠিকমতো চলতো । এখন যা অবস্থা বাবাকে হাসপাতালে নেওয়া দরকার । ইতিমধ্যে খেমটির মা তাকে বলেছে, “তোর বাবার ভাবগতিক বেশী সুবিধার নয় । সন্ধ্যাবেলায় নিয়মিত জ্বর । সর্দি, কাশি অনবরত । বহরমপুরে গিয়ে নামকরা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বাবুকে দেখালে বোঝা যেতো সন্ধ্যাবেলায় কেন জ্বর আসছে । তুই বাবার এই ধরনের জ্বরটাকে হাল্কাভাবে নিস্‌ না । বেশীরকম অসুস্থতা হলে তখন তোর বাবার চিকিৎসা আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাবে !”
মায়ের কথাগুলি শোনার পর খেমটি কুহকের সঙ্গে কয়েকবার পরামর্শ করলো । খেমটির সঙ্গে কথা বলার পর কুহক বহরমপুরের ডাক্তার বাবুদের খোঁজখবর নিলো । একজন নামকরা জেনারেল ফিজিসিয়ানের খোঁজ পেলো কুহক । ডাক্তার বাবু সপ্তাহে একদিন কলকাতা থেকে বহরমপুরে রোগী দেখতে আসেন । তিনি নাকি ইতিপূর্বে মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পোস্টিং ছিলেন । ট্রান্সফার হওয়ার পর এখন কলকাতায় । আটশো টাকা ভিজিট । খরচের কথা ভেবে গড়িমসি করছে খেমটি । সদ্য দিদির বিয়ের জন্য বাজারে অনেক ধার দেনা । মাছের টাকা এখনও পুরোপুরি দেওয়া হয়নি । ডাক্তার দেখালে ডাক্তার বাবু্র যেমন ফি, তেমনি ঔষধের খরচা ! বাবাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য মোটা টাকা দরকার ।
খেমটি খুব নিবিড়ভাবে আপনমনে ভাবছে, নিজেদের সংসারের প্রয়োজনে কুহকের কাছে কতোবার হাত পাতবে ? নেহাত কুহকের মা হাত খরচের জন্য কুহককে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে এক গুচ্ছ টাকা দেন, তার জন্য সেখান থেকে সে খেমটিকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করে । খেমটি এটাও জানে, কুহক তার মায়ের কাছে খেমটিদের প্রয়োজনে টাকা চাইলে তিনি কুহককে নিরাশ করেন না । তাই খেমটির চোখে কুহকের মা একজন সাক্ষাৎ দেবী ।
বিশ্বকর্মা পূজোর দিন গলায় মাফলার জড়িয়ে শিবু বায়েন সকাল সকাল হেমাতপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো । গাঙ্গুলি বাড়ির পুরোহিত মশায় খুব সকালে পূজোয় বসবেন । আগেভাগেই গাঙ্গুলি বাবু শিবু বায়েনকে জানিয়ে রেখেছিলেন পুরোহিত মশায়ের পূজোয় বসার সময়ের কথা । এরপর শিবু বায়েন তার ছোট মেয়ে খেমটিকে ডেকে বললো, “সন্ধ্যাবেলায় তোকে হেমাতপুরে যাওয়ার দরকার নেই । আমি একাই সামলাতে পারবো । এক রাত্রির মামলা । তুই আমাকে নিয়ে অযথা চিন্তা করিস না । আমি ঠিকমতো বাড়ি ফিরে আসবো ।“
খেমটি শিবু বায়েনকে বললো, “তা হয় না বাবা । আমি ভরতপুরে দ্বীপশিখার নাচের অনুষ্ঠানে যাচ্ছি । ফেরার সময় হেমাতপুর হয়ে ফিরবো । আমার সঙ্গে কুহক থাকছে । তুমি বরং সাবধানে থাকবে । কোনোরকম অসুবিধা বুঝলে আমাকে সত্বর জানাবে । আমাকে জানাতে যেনো এতটুকু সময় দেরী না হয় ।“
অগত্যা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে শিবু বায়েন ঢাক কাঁধে নিয়ে হেমাতপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো । সেই সময় খেমটি লক্ষ্য করলো, মা জোরহাতে মুখে আওয়াজ করলো “দুর্গা, দুর্গা” ।
বাবা বের হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে কুহকের আবির্ভাব । খেমটি তাকে দেখামাত্র আড়চোখে বললো, কী ব্যাপার ! আজ এত সকাল সকাল !
কেন ? এত সকালে আসতে নেই বুঝি ?
নিশ্চয়ই আসতে আছে । কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা । কুহক বাবু কোনোদিন এতটা সকালে আসেন নি, তাই কোনো সমস্যা কিনা ?
সমস্যা আবার কী ? বাবার সেই ঘ্যান ঘ্যানানী । নীচু জাত ! ওরা রবি দাস ভক্ত । তার উপর বায়েনদের গায়ে গরুর চামড়ার গন্ধ !
“তুমি থামবে ?” চোখ কটমট করে খেমটি কুহককে ধমক দিলো । বাবার উপর কথা বলার মুরদ নেই, তার আবার বাহাদুরি ! বড় বড় কথা !
বাহাদুরি আবার কী দেখালাম ?
বাবার উপর একবারও জোর দিয়ে বলতে পেরেছো, “বাবা, আমি খেমটিকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসি । ভালবাসার মানুষকে যখন তখন অপমান করা বন্ধ করুন । তারাও রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ । সমাজের আর দশটা মানুষের মতো তাদেরও মান-সম্ভ্রম-মর্যাদা সমান । খেমটি যথেষ্ট শিক্ষিত ও বুদ্ধিমতী । তাদের অপমান করাটা আপনার নিজের কাছে অসম্মানজনক ।“
এর আগে ঠিক এই কথাগুলি বলে আমাকে বাবার কাছে অসংখ্য বকুনি খেতে হয়েছিলো । কাহাতক এই বয়সে গালিগালাজ খেতে ভাল লাগে । তাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম । কচুরি ও ছোলার ডাল নিয়ে এসেছি, গরম গরম খেলে বাধিত থাকবো ।
হঠাৎ বাবার কাছে তখন বকুনি খাওয়া কেন ?
যেই তোমাকে শিক্ষিত মেয়ে বলে সওয়াল করেছি অমনি বাবা তেড়ে এসে বললেন, কোটায় পাশ । তপশীলি উপজাতি হওয়ার সুবাদে কোটায় ডিগ্রি । সে আবার কিসের শিক্ষিত ?
তুমি কী বললে তোমার বাবার কথা শুনে ?
আমি বললাম, “ভর্তির সময় কোটা চলে । কিন্তু পরীক্ষায় পাশ ফেলের ক্ষত্রে কোনো কোটা চলে না । সুতরাং তোমার “কোটায় পাশ” ধারণা ভুল ।“
তোমার মুখে কথা ফুটেছে, বোঝা যাচ্ছে । ঠিক বলেছো । তোমার যুক্তি ষোলোআনা সঠিক । অতঃপর তোমার বাবা কী বললেন ?
তিনি রেগে আমার উপর চোটপাট ! তারপর বিশ্রি ভাষায় বললেন, “কোটায় ভর্তির অর্থ রাস্তার অখাদ্য ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি । তাই বেশী শিক্ষিতের বাহাদুরি ! ঐ মেয়ে বায়েন পরিবারের মেয়ে । জুতো সেলাই যাদের পেশা । ছি ছি । আমি কুলীন ব্রাম্মণ হয়ে বায়েনের মেয়েকে আমি ঘরের বৌমা বানাবো ! ভাবতেই পারছি না ।“
তুমি একটা আস্ত গবেট ! বাবাকে এত ভয় পেলে এই জীবনে আর আমাকে বিয়ে করতে পারবে না । এবার চুপটি করে বসো । কচুরি আর চা আসছে । সকালে বাড়িতে নিশ্চয় খাবার জোটেনি । গোসা করে বাড়ি থেকে বের হলে কী আর খাওয়া জোটে ?
মাথা নাড়ে কুহক ।
চা খাওয়ার সময় কুহক খেমটিকে জিজ্ঞাসা করলো, “ভরতপুরে কখন যাবে ?”
বিকাল তিনটের সময় বাড়ি থেকে যাত্রা শুরু । অনুষ্ঠান চারটে থেকে । তুমি কিন্তু বাড়ি থেকে নির্দ্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই আসবে । আবার বাবার ভয়ে লেজ গুটিয়ে থেকো না ।
আমি আর বাড়ি যাচ্ছি না ।
তার মানে………!
তার মানে স্নান-খাওয়া দাওয়া সমস্তকিছু এখানে ।
এখানে লাউ দিয়ে মসুরির ডাল । আর বিভিন্ন সবজি দিয়ে নিরামিষ তরকারি । তোমার মুখে রুচবে তো ?
আলবত রুচবে ।
তারপর ঘড়ি ধরে বিকেল তিনটের সময় সাইকেলের পেছনের সিটে খেমটিকে বসিয়ে দুজনে ভরতপুরের দিকে রওনা দিলো ।
পথের মধ্যে সিস্‌গ্রামে ঢোকার মুখে হঠাৎ অনলের সঙ্গে দেখান । অনল কাঁধে ঢাক নিয়ে উল্টোদিক থেকে হেঁটে আসছিলো । অনলকে কুহক চেনে । কুহক জানে, অনল ও খেমটি একসঙ্গে এক কলেজে পড়েছে । সেই থেকে তাদের দুজনের মধ্যে ভাল বন্ধুত্ব ।
সাইকেল থামিয়ে সরাসরি অনলকে কুহক জিজ্ঞাসা করলো, “ঢাক কাঁধে নিয়ে কোথায় যাচ্ছো ভায়া ?”
আরে ভাইয়া, জরুরি তলব ।
“জরুরি তলব, মানে ?” খেমটি পেছন থেকে সম্মুখে এসে অনলকে জিজ্ঞাসা করলো ।
এবার খেমটির দিকে তাকিয়ে অনল বললো, “তুমি সম্ভবত হেমাতপুরের গাঙ্গুলি বাবুকে চিনবে । গাঙ্গুলি বাবুর বাড়িতে আজ বিশ্বকর্মা পূজা । তিনি গ্রামে অবস্থাপন্ন মানুষ । জাকজমকভাবে পূজার ঘনঘটা । সেখানে একজন ঢাকি বাজাতে গিয়েছেন । তবুও গাঙ্গুলি বাবুর ইচ্ছা, সন্ধ্যা আরতির সময় দুজন ঢাকি থাকুক । তাই আমাকে জরুরি তলব” ।
কিছুটা কৌতুহলবশতঃ কুহক জানতে চাইলো, “তোমার মতো একজন শিক্ষিত ছেলেকে গাঙ্গুলি বাবু ঢাকি হিসাবে ডাকলেন কেন, আমার মাথায় ঢুকছে না ?”
এই ঘটনা তোমার অজানা !
সেটা কী রকম ?
এম-এ পরীক্ষা দিয়ে আমার মাথায় ঢুকলো, আমি একটা ঢাকের বাজনার টীম তৈরী করবো । যেমন ব্যান্ড পার্টি, তাসা পার্টি, সেইরকম । তাছাড়া তোমরা সম্ভবত জানো, আমার বাবার বাজারে বিভিন্ন বাদ্য সংক্রান্ত দোকান রয়েছে যেখানে ঢাকের খোলেও চামড়া দিয়ে ছিলার টান পরান বাবা । প্রয়োজনে পুরো ঢাকের অর্ডার নিয়ে ঢাক সরবরাহ করেন । বাবার সঙ্গে কথা বলে আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে একটা ঢাকের বাজনার টীম তৈরী করলাম । পাঁচ বন্ধু একই মুচি সম্প্রদায়ের । আমরা বিভিন্ন পূজা অর্চনায় অর্ডার নিই । এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেমন উপনয়ন, বিয়ে, অন্নপ্রাশন, রাজনৈতিক দলের মিছিলে, ইত্যাদিতে ঢাকের বাজনা পরিবেশন করি । আমাদের ইচ্ছা, পাঁচ জন মেয়েকে নিয়ে আমাদের টীমটাকে দশ জনের টীম বানাবো । তারপর খোশ মেজাজে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন কায়দায় রুচিসম্মত ঢাকের বাজনা পরিবেশন করার আকাঙ্ক্ষা । আরও একটা ইচ্ছা, ভবিষ্যতে আমরা ঢাকের বাজনাকে দেশের ভিতরে অন্যান্য বাজনার সঙ্গে অন্যতম বাজনা হিসাবে জনপ্রিয় করতে চাই ।
অনল আরও বললো, “আমাদের পাঁচজনের টীমের বিজ্ঞাপন নানান জায়গায় দেওয়া রয়েছে এমনকি আমাদের ওয়েবসাইটও খোলা হয়েছে এবং সেখানে ফোন নম্বর, ঠিকানা, ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেওয়া । গাঙ্গুলি বাবু বিজ্ঞাপন দেখেই সেখান থেকে ফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করেছেন । আমি নিজেই ঢাক কাঁধে নিয়ে ছুটছি যাতে আমাদের দলের বদনাম না হয় ।
শুনে আস্বস্ত হলাম । তবে ভাইয়া তোমাদের ঢাকির দলের হালহকিকৎ পরে সময়মতো আরও শুনবো । আজ তাড়া আছে । তবে তুমি নিশ্চিত থাকো, সন্ধ্যা আরতির সময় আমরা তোমার ঢাকের বাদ্য শুনতে হেমাতপুরে উপস্থিত হচ্ছি ।
কেন রসিকতা করছো কুহক ?
রসিকতা নয়, সত্যি ?
আবার পাগলামী ! তোমরা দুজনে কোথায় যাচ্ছো, জানতেই পারলাম না ? খেমটির দিকে তাকিয়ে অনল বললো, তোমরা হন্তদন্ত হয়ে পড়ন্তবেলায় কোথায় ছুটছো ?
“ভরতপুরে । সেখানে একটা নৃত্যানুষ্ঠান রয়েছে ।“ অনলের কথার উত্তর দিয়ে খেমটি কুহককে বললো, “এবার আমাদের যাওয়া যাক্‌ ।“
তাহলে আমরা এগোই অনল ।
কিন্তু…………।
কিন্তু কী ?
কিন্তু আমার ঢাকের বাজনা শুনতে তোমাদের অবশ্যই হেমাতপুরে আসতে হবে । কথা দিয়েছো কুহক ।
কথা যখন দিয়েছি, তখন যথাসময়ে পৌঁছে যাবো ।
তারপর ভরতপুরে দুজন পৌঁছে দেখে নৃত্যানুষ্ঠানের বিশাল আয়োজন । প্রথমেই নৃত্যানুষ্ঠান, তারপর নামী-দামী গায়ক গায়িকাদের গান । শেষে নাটক মঞ্চস্থ হয়ে অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি । কলকাতা থেকে শিল্পিরা এসেছেন, অনুষ্ঠানে গান গাইতে । তবে নৃত্যে যোগদানকারিরা স্থানীয়, বর্ধমান ও কল্যাণীর ।
তিন নম্বরে দ্বীশিখার নাম । খেমটি দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে, দ্বীপশিখা নৃত্যের ড্রেসে মঞ্চের বাদিকে দাঁড়িয়ে । মঞ্চে তখন অংশগ্রহণকারি দ্বিতীয় জনের নৃত্য পরিবেশন চলছে । হঠাৎ তাকিয়ে দেখে, তার পাশে কুহক দাঁড়ানো নেই । সাইকেল আগেই স্ট্যান্ডে রেখে এসেছে । তাহলে কুহক গেল কোথায় ? অনেক লোকের সমাগম । তাকে আলাদা করে খোঁজাও খুব কষ্ট । খেমটি চিন্তান্বিত । সে বেচারা আচমকা বেপাত্তা হয়ে গেল ।
কুহককে খোঁজার উদ্দেশ্যে খেমটি এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি শুরু করলো । তারপর মঞ্চের বা-দিকে কয়েকজন অল্প বয়সী ছেলেমেয়ের দিকে তাকাতেই খেমটির নজরে পড়লো কুহককে । মঞ্চের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে মঞ্চে চলাকালীন নৃত্যের দৃশ্য মনোযোগ সহকারে সে দেখছে । কুহকের ঐ দৃশ্য দেখে খেমটি ভাবছে, সে দিব্যি দূরে দাঁড়িয়েও নৃত্যানুষ্ঠান দেখতে পারতো । তাহলে হঠাৎ কুহকের এইরকম ভীমরতি ধরলো কেন যার জন্য তাকে সটান মঞ্চের কাছাকাছি দাঁড়াতে হোলো ? কুহকের নৃত্যের প্রতি এইরকম ঝোঁক দেখে খেমটি অবাক !
কুহকের নাচ দেখার আগ্রহ প্রসঙ্গে উলটপালট ভাবছে খেমটি । কুহকের নাচের প্রতি এতটা মনোযোগ খেমটি কোনোদিন বুঝতে পারেনি । সে সাদামাটা ব্রাম্মণ পরিবারের সন্তান । পড়াশুনার গন্ডির মধ্যেই সে এতদিন আবদ্ধ ছিলো । তারপর বাড়ি ফিরে খেমটির সঙ্গে মেলামেশা । ঘূণাক্ষরেও খেমটি দেখেনি কুহকের নৃত্যের প্রতি অনুরাগ । তাই সে আজ ধন্দে !
খেমটি গুটিগুটি পায়ে কুহকের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো । ততক্ষণে নৃত্য শেষ । কুহক ঐ নৃত্য শিল্পীকে অনুসরণ করে ঘরে ঢুকলো । খেমটি কুহকের পেছনে গিয়ে দন্ডায়মান ।
নৃত্যশিল্পী এক গাল হেসে কুহককে বললো, “আমার কী সৌভাগ্য ! তুমি সশরীরে হাজির ।“
“কাকতালীয়ভাবে দেখা । তুমি কেমন আছো সুরভী ?” কুহক জানতে চাইলো ।
“খবর নিতে হলে একদিন বাড়িতে আসতে হবে । এখানে কোনো কথা নয় । বুঝলেন মশায় ।“ সুরভী আহ্লাদিত কন্ঠে কুহককে কথাটা বলেই আবার তার মনভোলানো হাসি ।
“অবশ্যই যাবো । তোমার মোবাইল নম্বরটা দাও ।“
সুরভী মোবাইল নম্বর পাশের টেবিলে গিয়ে লিখলো । ঠিক সেই মুহূর্তে খেমটি কুহকের পিঠে হাত দিয়ে বললো, “কে এই সুন্দরী ?”
খেমটির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে খানিকটা উদাস্‌ মনে বললো, “তুমি !”
“হ্যাঁ আমি । এখনও বললে না, মেয়েটি কে ?” খেমটি কুহকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো ।
“সুরভী । একই কলেজে দুজনের পড়াশুনা ।“ কুহকের নরম সুরে উত্তর ।
ইতিমধ্যে নম্বরটা এগিয়ে দিয়ে সুরভী কুহককে বললো, “পরে অবশ্যই ফোন করবে । তোমার সাথে অনেক কথা আছে । তাছাড়া অনেক কথা জমেও রয়েছে ।“ এরপর সুরভী খেমটির দিকে তাকিয়ে কুহককে জিজ্ঞাসা করলো, “ম্যামকে তো চিনতে পারলাম না ।“
“ম্যাম নয়, খেমটি । আমার প্রিয় বান্ধবী ।“
“প্রিয় বান্ধবী” বিশেষ অলংকার শুনে সুরভী ক্ষণেকের জন্য অন্যমনস্কভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো ।
তারপর কুহকের হাসির শব্দ পেয়ে সুরভী সম্বিৎ ফিরে পেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে খেমটির দিকে দুহাত জড়ো করে বললো, “নমস্কার ।“
হঠাৎ মাইকে ঘোষণা, এরপর নৃত্য পরিবেশন করছেন দ্বীপশিখা ।
কুহক ও খেমটি, দুজনে বাইরে দর্শকাসনের শেষদিকে এসে দাঁড়ালো । খেমটি এমনকি কুহকও এই প্রথম দ্বীপশিখার নাচ দেখছে । অতীতে খেমটিকে কয়েকবার দ্বীপশিখা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো তার নৃত্যে পরিবেশন দেখার জন্য । কিন্তু বিভিন্ন কারণে তার আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়া সম্ভব হয়নি । আজ নিজের চোখে দ্বীপশিখার নাচ দেখে খেমটি রীতিমতো অবাক ! দুর্দান্ত পারফর্মেন্স । নজরকাড়া তার নৃত্য পরিবেশন ।
তাল, লয় সমন্বিত তার নৃত্যের প্রকাশ । নিঃসন্দেহে নৃত্যে ভাব ও রস’এর সম্পর্ক বিদ্যমান । খেমটি এটা ভালভাবে জানে, “ভাব হ’তে রসের উৎপত্তি । যেখানে ভাব সেখানে রস সৃষ্টি ।“ সুতরাং নৃত্যে ভাব ও রস’এর অভাব ঘটলে দর্শককে আনন্দ দেওয়া কঠিন । সেখানে দ্বীপশিখা পুরোটাই সঠিক । খেমটি আরও শুনেছে, রস ভাবব্যঞ্জক যে অঙ্গভঙ্গী, তাহাই নৃত্য বলে কথিত । নট্‌ ধাতু থেকে নৃত্য শব্দের অর্থ যাহা নাট্যের মাধ্যমে নিস্পন্ন করা যায়, তাহাই নৃত্য । নৃত্য, গীত ও বাদ্য এই ত্রয়ী কলার ঐক্যতান সৃষ্টি হয় নৃত্যে । নৃত্যের সময় মুখে থাকিবে গীত, হাতে থাকিবে ভাবব্যঞ্জক বিভিন্ন প্রকার হস্তকর্ম যাহা হইবে গীতের ভাবার্থক প্রকাশক ভাষা , চোখে থাকিবে ভাবের অভিব্যক্তি এবং পায়ে রাখবে তাল, লয় । সবদিক দিয়ে দ্বীপশিখার নৃত্য পরিবেশন প্রশংসনীয় ।
নৃত্য শেষে শ্রোতাদের মধ্যে ভীষণ হাততালি ।
খেমটি ছুটে গিয়ে দ্বীপশিখাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “ফাটাফাটি নৃত্য প্রদর্শন । তোর দুর্ধর্ষ পারফর্মেন্সের জন্য আমি গর্বিত ।“
সূর্য ডুবতে বসেছে । খেমটি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে, সময় খুব কম । সন্ধ্যা লাগার আগে যেভাবে হোক তাদের হেমাতপুরে পৌঁছাতে হবে । অনলকে কথা দেওয়া রয়েছে, সন্ধ্যা আরতির সময় তার ঢাকের বাজনা শোনার । তাছাড়া তার বাবার শরীরটা এখন কেমন, সেই খোঁজটা আগে নেওয়া দরকার । অন্যদিকে খেমটি তার মাকে কথা দিয়ে এসেছে, বাড়ি ফেরার পথে বাবার খবর নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরবে । তাই কুহককে ধাক্কা দিয়ে তাগাদা দিলো, “আর দেরী নয়, শিগগির হেমাতপুরে চলো ।“
আবার সাইকেলের পেছনের সীটে উঠলো খেমটি । জোরে সাইকেল চালাচ্ছে কুহক । সময় কম । যার জন্য সাইকেলের দ্রুত গতি ।
সাইকেল চালাতে চালাতে কুহক খেমটির সাথে আলাপচারিতায় মশগুল । স্পষ্টতই কুহক বললো, নৃত্যের অনুষ্ঠান দেখে সে ভীষণ উৎফুল্ল । তার হৃদয়ের আনন্দোচ্ছ্বাসের কথা খেমটিকে বলতে গিয়ে সে বললো, “আজ তোমার সঙ্গে না এলে এক অভূতপূর্ব মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান মিস্‌ করতাম । দ্বীপশিখার নাচ দেখে আমি ভীষণ খুশী ।“
আর সুরভীর নাচ দেখে তোমার কী প্রতিক্রিয়া ?
তার নাচও ভাল লাগলো ।
“কার নাচ ভাল লাগলো, সুরভীর না অন্য কারও ।“ মস্করা করে খেমটি জানতে চাইলো ।
কুহক ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নির্দ্বিধায় বললো। “তোমার বান্ধবীর “
তারপর দুজনের প্রাণ খোলা হাসির উচ্ছ্বাস্‌ !
ভরতপুর থেকে হেমাতপুর যেতে অনেকটাই রাস্তা । তবে একটা বাঁচোয়া, সমস্ত রাস্তাটাই পাকা । যার জন্য কুহককে সাইকেল চালাতে বেশী বেগ পেতে হচ্ছে না । খুব দ্রুত সে সাইকেল ছোটাচ্ছে ।
গাঙ্গুলি বাবুর বাড়িতে পৌঁছে দেখে সেখানে পূজো উপলক্ষ্যে গাঁয়ের মানুষের প্রচন্ড ভিড় । তিল ধারণের জায়গা নেই । তবে সন্ধ্যা পূজা সমাপ্তির পথে । সম্ভবত কিছুক্ষণের মধ্যে আরতি শুরু হবে । পুরোহিত মশায় পঞ্চ প্রদীপের সলতেগুলি ও সরষের তেল ঠিকঠাক করে সলতেতে আগুন জ্বালছেন । এরপর পুরোহিত মশায় হাঁকছেন, “কোথায় গেলে গো শিবু বায়েন ? এবার তোমার ঢাক বাজাও ?”
শিবু বায়েন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “বাবু, আমি তৈরী ।“
“আমিও তৈরী ।“ অনল কোমড়ে গামছা বেঁধে ঢাক কাঁধে নিয়ে পুরোহিত মশায়ের দিকে এগিয়ে বললো ।
অনল তখনও টের পায়নি, কুহক ও খেমটির গাঙ্গুলি বাড়ি পৌঁছানোর খবর । অনলের ঢাক নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কায়দাকানুন দেখে খেমটি কিছুটা ভীতো ও আতঙ্কিত । কেননা অনলের সাথে তার বাবার ঢাক বাজাতে ভীষণ কষ্ট হবে । তাই সময় নষ্ট না করে সোজা বাবার কাছে গিয়ে খেমটি একরকম বাবার কাছ থেকে ঢাকটা কেড়ে নিয়ে নিজের কাঁধে তুললো । অন্যদিকে উপস্থিত আমন্ত্রিত গ্রামবাসী ও অতিথিরা সন্ধ্যা আরতি দেখার জন্য উদগ্রীব ! হঠাৎ মহিলা ঢাকিকে দেখে তাঁদের মধ্যে বিস্ময়, “এই বয়স্থা মেয়ে কী ঠিকমতো ঢাক বাজাতে পারবে ?”
গাঁয়ের বয়স্ক মানুষ নরহরি দত্ত উৎকন্ঠা নিয়ে বলেই ফেললেন, “মেয়ে ঢাকি কী বিশ্বকর্মা পূজার সন্ধ্যা আরতির ঢাক বাজাতে পারবে ?” তিনি আবার বললেন, “আমার তো মনে হয়, উল্টোদিকে তাগড়াই পুরুষ ঢাকির সাথে পাল্লা দিয়ে মেয়ে ঢাকির ঢাক বাজানো প্রায় অসম্ভব !”
তাৎক্ষণিক জবাবে পুরোহিত মশায় বললেন, “মেয়ে ঢাকি ঢাক বাজাতে জানলে, অবশ্যই সে ঢাক বাজাবে । আমার তাতে আপত্তি নেই ।“
“আরে তুমি !” খেমটিকে দেখে অনল অবাক ! ভুত দেখার মতো চমকে গেল অনল ।
হ্যাঁ আমি । তোমার সঙ্গে ঢাক বাজাতে চাই ।
“আমি মনেপ্রাণে এটাই চাই, মেয়েরাও আজকের দিনে পুরুষ ঢাকিদের সঙ্গে সমানভাবে পাল্লা দিয়ে ঢাক বাজাক্‌ । সাধারণ মানুষ সেটা উপ লব্ধি করুক ।“ অনল কথাগুলি খুব জোরের সঙ্গে বললো ।
তারপর ঢাকে কাঠি দিতেই ঢাকের একটা মিষ্টি আওয়াজ !
আওয়াজ পেয়েই খেমটির হঠাৎ মনে পড়লো, তাদের ঢাক সদ্য সারানো । কাঠের বডি ছাড়া ঢাকের সমস্ত কিছু পাল্টাতে হয়েছে । ঢাক সারাইয়ের দোকানদার তখন বলেছিলেন, আপনার ঢাক সারাতে আমাকে অনেক কসরত করতে হবে । তারপর বাবা যখন ঢাকটা নিয়ে বাড়ি ফিরলো তখন বাবার মুখেই শোনা, ঢাকের দোকানদার ঢাকটার পেছনে অনেক খেটেছেন । গরুর (মরা গরুর) চামড়া গাবের জল দিয়ে ঠিকমতো সিজন্‌ করতে অনেক সময় লেগেছে । তাঁদের দোকানের বৈশিষ্ট্য, তাঁরা আগেকার দিনের পদ্ধতিতেই ঢাক তৈরী করেন । বাবার মুখেই খেমটির আরও শোনা, আম কাঠের ঢাকের খোল হলে বাজনার মিষ্টতা অতীব মধুর । বাজনার অপূর্ব তাল উঠে । তাদের ঢাক আম গাছের কাঠ দিয়ে তৈরী এবং সম্প্রতি ঢাকে লাগানো গরুর চামড়া গাব জল দিয়ে সিজন্‌ করা এবং খোলে ছিলার টান ঠিকঠাক, সেইজন্য খেমটি ঢাকে কাঠি দিতেই মিষ্ট আওয়াজের ধুমধড়াক্কা । ঢাকের মিষ্টি বাজন অবলোকন করে খেমটি ভীষণ চনমনে । তার উপর তার বিপরীতে অনলের মতো শিক্ষিত ঢাকি, খেমটি স্বাভাবিকভাবে উৎফুল্ল ।
পুরোহিত মশায় প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ বিশ্বকর্মা ঠাকুরের সামনে দিয়ে নেচে নেচে ঘোরাচ্ছেন এবং তালে তালে ঢাক বাজছে । ঢাকের বাজনার মিষ্টতায় উপস্থিত অতিথিরা অবাক ! সকল অতিথিরা খুব মনোযোগ সহকারে ঢাকের বাজনা দেখছেন । দুইজন যুবক ও যুবতীর উৎকৃষ্ট ঢাক বাজনায় মোহিত হয়ে দর্শকদের মধ্যে হর্ষধ্বনি, মহিলাদের উলুধ্বনি । বাড়ির মানুষের শঙ্খধ্বনি । তারপর বিশেষ করে অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে চলছে মোবাইলে ফটো তোলার হিড়িক । খেমটি আরও বুঝতে পারছে ছেলে মেয়েদের ভিডিও রেকর্ডিংয়ের সোৎসাহ । তার ধারণা, সোসাল মিডিয়ায় ঢাকের বাদ্য ভাইরাল হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় !ঢাকের বাজনার তালে তালে পুরোহিত ঠাকুরের সন্ধ্যা আরতির অনুষ্ঠান জমজমাট ।
ঢাকের বাজনা যখন তুঙ্গে, তখন খেমটি বুঝতে পারলো অনল ঢাকের বোল তুলছে ঃ-
হরে হরে দুর্গা
হরে হরে দুর্গা ।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খেমটির বোল ঃ-
ব্যোম ব্যোম ভোলানাথ
অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ ।
অনল খেমটির ঢাক বাজানোর পারদর্শীতা দেখে যারপরনাই অবাক ! খেমটি রীতিমতো ঢাকের বোল সম্বন্ধে সম্যকভাবে অবহিত । তাদের ঢাকের বাজনা শুনে দর্শকদের মধ্যে মুহুর্মুহু হাত তালি ! অন্যদিকে উপস্থিত মহিলাদের উলুধ্বনি । অনল আবার ঢাকে বোল তুললো ঃ-
“ছয় ভাই দিচ্ছে সাড়া” ।
খেমটিও তেমনি । সঙ্গে সঙ্গে ঢাকের বাজনার কাঠিতে তার জবাব ঃ
“গদিতে গোসাই দাঁড়া” ।
আবার খেমটির বোল ঃ –
“হরে হরে দুর্গা” ।
অনলও সেই বোলে তাল দেয় ঃ “হরে হরে দুর্গা” ।

প্রায় এক ঘন্টা টানা ঢাকের বাজনা । খেমটি রীতিমতো ঘামছে, অথচ একটানা ঢাক বাজানোর জন্য ঘাম মোছার অবকাশ নেই । অনলও তেমনি । ঠাকুর মশায় প্রদীপ ছেড়ে ধরলেন শঙ্খ, তারপর তালপাতার পাখা, তারপর কোশাকুশি, ইত্যাদি ঠাকুরের মুখের সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নৃত্য করছেন । চারিদিকে উলুধ্বনি । বিশ্বকর্মা ঠাকুরের জয়ধ্বনি । সেইসঙ্গে কিছু মানুষের একটানা ভিডিও রেকর্ডিং ।
গাঙ্গুলি বাবুদের বাড়ির বিশ্বকর্মা পূজোতে গাঁয়ের মানুষের ঢল । বয়স্ক থেকে কচি-কাঁচা পর্যন্ত সন্ধ্যা আরতি দেখতে দন্ডায়মান । মাঝে মাঝেই দর্শনার্থীদের হাততালি ।
এক টানা এক ঘন্টা পনের মিনিট ঢাক বাজিয়ে দুইজনেই নিজ নিজ কাঁধ থেকে ঢাক নামিয়ে রাখলো । অনল সোজা ফ্যানের নীচে দাঁড়ালো । ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরমে তারা কাহিল । খেমটি তার বাবাকে বললো, “রাত্রি বাড়ছে । আমাদের এবার বাড়ি ফেরার পালা ।“
শিবু বায়েন আপত্তি করলো না । তবে শিবু বায়েন মেয়ের ঢাক বাজানোর বোল তোলার ভঙ্গিমায় ভীষণ খুশী । খেমটির মাথায় হাত রেখে বললো, “আমার শেখানো শিক্ষা আজ সার্থক । ঈশ্বর তোকে অনেক বড় করুক ।“ তারপর খেমটি ও কুহককে বাড়ির উদ্দেশ্যে সত্বর রওনা হওয়ার জন্য তাগাদা দিলো ।
বর্তমান যুগটা ডিজিটাল যুগ । ফেসবুক, হোয়াটসআপ, টুইটার, মেসেঞ্জার, টাইমলাইন, ইত্যাদি ব্যাহারের যুগ । জানা গেল, তাদের দুজনের ঢাক বাজানো সোসাল মিডিয়ায় ভাইরাল । নিমেষের মধ্যে আশে পাশের গাঁয়ে গঞ্জে মেয়ে ঢাকির ঢাক বাজানোর খবর চাউর হয়ে গেছে । খবরের এহেন বিস্তারতার বিন্দুবিসর্গ খেমটি এমনকি অনলও টের পায়নি । সোসাল মিডিয়ায় মেয়ে হওয়ার সুবাদে খেমটির ঢাক বাজানো ভীষণভাবে প্রচার পেল ।
খেমটি ও কুহক সাইকেল নিয়ে রওনা দেবে এমন সময় গাঙ্গুলি বাবু খেমটির কাছে এসে বললেন, “বেঁচে থাকো মা । তুমি যথেষ্ট সুন্দর ঢাক বাজিয়েছো । আমি তো ঢাকের বোল, তাল কিছুই বুঝি না, কিন্তু গাঁয়ের অধিকাংশ মানুষ তোমাদের বাজনা শুনে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন । এটাই আমার কাছে বড় শান্তির বার্তা । আমার আশীর্বাদ রইলো । এতকাল বাদে বুড়ো বয়সে একটা মেয়ে ঢাকির ঢাক বাজনা প্রথম শুনলাম । সত্যিই আমি খুব খুশী ।“
গাঙ্গুলি বাবুকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো খেমটি ।
বাড়ি ফেরার জন্য তারা সাইকেল নিয়ে গাঁয়ের রাস্তার উপরে ওঠামাত্রই অনল পেছনে ডাকলো, “চলে গেলে হবে ? আজ তোমার যেমন ঢাক বাজানো দেখলাম তাতে তুমি অচিরেই “মহিলা ঢাকি” হিসাবে জনপ্রিয়তা পাবে । তোমার ঢাক বাজানোতে উৎফুল্ল হয়ে আমি শীঘ্রই মহিলা ঢাকির টীম গড়তে চাই এবং সেই টীমের তুমিই হবে মধ্যমণি” ।
এই ব্যাপারে তোমার সাথে বিশদে পরে আলোচনা হবে ।
এই মুহূর্তে তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যাতে তুমি ভবিষ্যতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে পারো ।
অনল আজ এই পর্যন্ত থাক । বাকীটা পরে ভাবা যাবে । তবে এটাও ঠিক, তুমি আমার ভাল বন্ধু । সুতরাং তোমার প্রস্তাবে আমার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে । তুমি তো জানো, গবেষণা আমার ধ্যান জ্ঞান । তুমি মহিলা ঢাকির টীম গড়ার প্রস্তাব দিলে । সুতরাং এই নিয়ে তোমার সঙ্গে পরে টীম গড়ার খুঁটিনাটি আলোচনা হবে । অনল এবার আমরা আসি, নতুবা বাড়ি পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে যাবে ।
তাদের সাইকেল ছুটছে ঘোড়াডাঙার দিকে । ঘোড়াডাঙা গ্রামে ঠিক ঢোকার মুহূর্তে বটকৃষ্ণ ব্যানার্জীর সঙ্গে দেখা । গাঁয়ে তাঁর মনোহারির দোকান । চালু দোকান । বাড়িতেই দোকানঘর । বটকৃষ্ণ ব্যানার্জীর মনোহারি দোকানে মাছ-মাংস ছাড়া প্রায় সব ধরনের জিনিস পাওয়া যায় । সম্ভবত তিনি কাজের জন্য অন্যত্র যাচ্ছিলেন । কুহক ও খেমটিকে দেখতে পেয়ে খেমটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “খেমটি একটু দাঁড়াও । তোমার সাথে কথা আছে ।“
“কিছু বলবেন কাকু ?” খেমটি জিজ্ঞাসা করলো ।
“হ্যাঁ “ । বটকৃষ্ণ ব্যানার্জী উত্তর দিলেন ।
দুজনে সাইকেল থেকে নামলো । তারপর ঠিক বটকৃষ্ণ দোকানদারের সামনে গিয়ে খেমটি জানতে চাইলো, “কাকু এবার বলুন ?”
চারিদিকে তোমার ঢাকের বাজনার সুনামের হুলস্থুল !
কাকু, সেটা কী রকম বুঝলাম না ?
সন্ধ্যাবেলায় হঠাৎ দেখি, দোকানের খরিদ্দারদের মধ্যে তোমাকে নিয়ে বিস্তর আলাপ আলোচনা । তোমার নাম শুনে আমি কান্‌ খাড়া করলাম । তারপর তাদের মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া ! কৌতুহল ধরে রাখতে না পেরে আমি জানতে চাইলুম, “মোবাইলের ভিতর কী এমন বড় খবর, যার জন্য আপনারা ছেলে-বুড়ো সকলেই মোবাইল নাড়াচাড়া করে ভীষণ উৎফুল্ল !”
তারা তখন উত্তর দিলেন, “বায়েন পাড়ার শিবু বায়েনের মেয়ে হেমাতপুরে বিশ্বকর্মা পূজায় ঢাক বাজিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে । ঢাকের বাজনার বোল, তাল অভুতপূর্ব ও অতীব সুন্দর । বাজনার মিষ্টতা উপস্থিত মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে । যার জন্য খেমটির ঢাকের বাজনা সোসাল ভিডিওতে ভাইরাল । অচিরেই খেমটি মহিলা ঢাকি হিসাবে স্বীকৃতি পাবে । “ বটকৃষ্ণ দোকানদার আরও বললেন, “তোমার ঢাক বাজানোর সুনাম এখন চতুর্দিকে ।“
অবাক হয়ে আনন্দে খেমটির চোখ ছল ছল করে উঠলো । তারপর সে বললো, “তাই নাকি । আমরা এসবের বিন্দুবিসর্গ জানি না ।“
ঢাকের বাজনার ভিডিও চারিদিকে শেয়ার হয়ে গেছে । প্রত্যেকের একটাই প্রশ্ন, “খেমটি ঢাক বাজানো শিখলো কবে ?” আবার কয়েকজনের বিভ্রান্তকর মন্তব্য, “মেয়েরা কী পূজা অর্চনায় ঢাক বাজানোর ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য ?” গাঁয়ের কাঠি বাবু আর একটা ধাপ এগিয়ে বিদ্রুপ করে বললেন, “বায়েনের মতো নীচু জাতের মেয়ে কী পূজোতে ঢাক বাজানোর ক্ষেত্রে শাস্ত্রসম্মত ?” নানান জনের নানান কথার ফুলঝুরি । তারপর বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন মত ।
“আপনার মত কী কাকু ?” কুহক সরাসরি বটকৃষ্ণ কাকুকে জিজ্ঞাসা করলো ।
আমতা আমতা করে বটকৃষ্ণ ব্যানার্জী বললেন, “আমি ব্রাম্মণ পুরোহিতদের নির্দেশমতো পুজা অর্চনা করি । আমাদের গাঁয়ে গঞ্জে এটাই রীতি । অনাদিকাল থেকে এই রীতির পরম্পরা অনুযায়ী পুরুষ-ঢাকি এতকাল ঢাক বাজিয়ে এসেছে । যাকে বলে পুরুষ ঢাকির বাদ্য প্রচলিত । শোনা যায়, নারীদের আবার শুচি অশুচির প্রসঙ্গ । সুতরাং এই ক্ষেত্রে সামাজিক বৈধ্যতার প্রয়োজন সর্বাগ্রে” ।
তারপর আবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে বটকৃষ্ণ কাকু বললেন, “আজ আমার একটু তাড়া আছে । আমাকে পাশের গাঁয়ে ধার দেওয়া টাকা তুলতে যেতে হবে । রাতে না গেলে তাদের ধরা যায় না । এসব নিয়ে পরে আরও কথা হবে ।“ তারপর মনোহারি দোকানদার কুহকদের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচলেন ।
কুহক বটকৃষ্ণ কাকুর কথায় বুঝতে পারলো, তিনি ব্রাম্মণদের তৈরী বস্তাপচা শাস্ত্রীয় প্রসঙ্গ মেনে চলতে চান । নিজের আধুনিক মনস্কের চিন্তাভাবনায় উজ্জীবিত নন । নীচু জাতগ্রস্থ মানুষের পূজোয় সার্বিক অংশগ্রহণের বিপক্ষেই বটকৃষ্ণ কাকু তাঁর মতামত পোষন করেন । এবার খেমটির দিকে তাকিয়ে কুহক বললো, “এসবে ডরালে চলবে না । নিজের করণীয় কাজে মনোসংযোগ দেওয়াটা সময়োচিত । প্রকৃত বিদ্বজনকে কেউ রুখতে পারবে না । জাতপাত নিয়ে যারা যতোই চিৎকার করুক, তোমার প্রতিভা বিকশিত হবেই । এই বিশ্বাসে আমি কিন্তু অনড়” ।
আবার একটু থেমে খেমটির দিকে তাকিয়ে বললো, “এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ঝিমিয়ে যাওয়া ঢাকিদের মনোবল শক্ত করার দায়িত্ব তোমার । কেননা তোমাকে প্রমাণ করে দেখাতে হবে, ঢাক ও ঢোল বাজনা দেশের অন্যান্য শিল্পকলার মধ্যে অন্যতম । এটা তোমার আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ ।“
এতক্ষণ খেমটি কুহকের দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে তার কথাগুলি শুনছিলো । এখন মুখ ফুটে বলেই ফেললো, “তুমিই আমার চলার পথের অনুপ্রেরণা । তোমার প্রাণঢালা ভালবাসা আমার সাহস ও শক্তি ।“
তারপর দুজনে খেমটিদের বাড়ি ঢুকলো ।
খেমটির মা অতো রাত্রিতেও জেগে রয়েছে । রাত্রি অনেক হয়েছে । খেমতির মা তখন পর্যন্ত রাতের খাবার খায়নি । খেমটির মা কুহককে রাতের খাবার খেয়ে যেতে বললো । উত্তরে কুহক বললো, “এখানে খেয়ে গেলে বাড়িতে রাতের খাবার খেতে পারবো না কাকীমা । তাছাড়া খেয়ে গেলে মা অসন্তুষ্ট হতে পারেন । কেননা সেখানেও আমার মা আপনার মতো রান্না করে আমার পথের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন । বরং আমি শিগগির বাড়ি ফিরি ।“
ততক্ষণে টর্চ লাইট কুহকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে খেমটি বললো, “টর্চটা কিন্তু পথ চলার সময় জ্বালিয়ে চলার জন্যে । সুতরাং টর্চের আলোতে রাস্তা দেখে সাইকেল চালাবে” ।
মাথা নেড়ে “ঠিক আছে” বলে বিদায় নিলো কুহক । তারপর বাড়ি ফিরে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো কুহক ।
তারপর অনেকদিন কুহক বাড়িতে চুপচাপ ।
ছেলেকে চুপচাপ দেখে কুহকের মা জিজ্ঞাসা করলেন, “চুপচাপ বেজার মুখে বাড়িতে বসে কেন ? তোর চনমনে ভাবটা একেবারে উধাও ।“
আমি বেশ ঠিক আছি মা ।
উঁহু ! নিশ্চয় খেমটির সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছে ।
খেমটির সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ার প্রশ্ন নেই । আমি ভাবছি …?
কী ভাবছিস ?
ভাবছি, খেমটি ভাল ঢাক বাজায় । ঢোল সম্বদ্ধে অনেক অভিজ্ঞতা । তাছাড়া খেমটি যে কোনো অনুষ্ঠানে ঢাক বাজাতেও স্বচ্ছন্দ ।
তাহলে সমস্যা কোথায় ?
সমাজের কিছু মানুষ খেমটির ঢাক বাজানোকে কোনোভাবেই মানতে চাইছেন না । পূজোতে তার ঢাক বাজানোর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে ?
কেন এই রকম হচ্ছে ? তাঁদের কী অজুহাত ?
তারা বোঝাতে চান, গ্রামে গঞ্জে বারো মাসের পূজা পার্বনে ব্রাম্মণ পুরোহিতদের চিরাচরিত প্রথা আজও চলমান । ব্রাম্মণ পুরোহিত ছাড়া যেমন পূজা সম্ভব নয়, তেমনি পুরুষ ঢাকি ছাড়া ঢাকের বাজনা অশাস্ত্রীয় । মহিলা ঢাকি অচ্ছুত ! শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-অভিজ্ঞতা তাদের কাছে অধর্তব্য । মহিলা ঢাকির বাজনার গুণগত মান তাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে । অথচ আজকের দিনে খবরের কাগজে আমরা প্রয়শই দেখি এমনকি দেশের মহামান্য উচ্চ আদালত জানিয়েও দিয়েছে, ব্রাম্মণ পুরোহিত ছাড়াও জাত পাত নির্বিশেষে যে কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ যে কোনো দেবতার পূজা করার আইনগত অধিকারি । সম্প্রতি খবরের কাগজের মাধ্যমে তুমি নিশ্চয় শুনেছো, একজন উপজাতির মেয়ে স্কুলের সরস্বতী পূজা নিষ্ঠা সহকারে সম্পন্ন করেছে এবং তার পূজায় উৎসাহ জুগিয়েছেন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সহ অন্যান্য শিক্ষক মহাশয়গন । এমনকি স্থানীয় মানুষেরা উপজাতি মেয়ের পূজোকে মান্যতা দিয়েছেন । সুতরাং মানুষ এখন অনেক বেশী আধুনিক মনস্ক । অনেক বেশী চেতনাসম্পন্ন । তবে এই এলাকার গ্রামে গঞ্জে খেমটির ঢাকের বাজনার ক্ষেত্রে মানুষের ন্যক্কারজনক বিরুদ্ধাচারণ কেন ?
তুই কিভাবে অনুমান করলি, খেমটি একজন মহিলা ঢাকি হিসাবে যোগ্য মর্যাদা পাচ্ছে না ?
হ্যাঁ মা । প্রশ্নটা ভীষণ প্রাসঙ্গিক ! খেমটি ঢাকি হিসাবে গ্রামে গঞ্জের সমাজে যোগ্য মর্যাদা পাচ্ছে না । বিশ্বকর্মা পূজোতে খেমটি ও তার বন্ধু অনল মিলে হেমাতপুরে অসাধারণ উৎকৃষ্ট মানের ঢাকের বাজনা বাজিয়েছিলো । যেমনি ঢাকের বোল, তেমনি তাল । তেমনি দুজনের ঢাক বাজানোর মেলবন্ধনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া । সেটা সোসাল মিডিয়ায় ভীষণভাবে ভাইরাল । সোসাল মিডিয়ায় তাদের ঢাকের বাদ্য অবলোকন করে গ্রাম্য সমাজে তুমুল হইচই । তাদের মধ্যে গুঞ্জন, এই বুঝি এতদিনের ব্রাম্মণদের তৈরী পরম্পরা ভেঙ্গে গেল । ব্রাম্মণ পুরোহিত ছাড়া বিয়ে, শ্রাদ্ধ, পূজো, ইত্যাদি অনুষ্ঠান যেমন অসম্ভব, তেমনি পুরুষ ঢাকি ছাড়া ঢাকের বাজনা শাস্ত্র-বিরোধী । আরও একটা অত্যন্ত ঘৃণ্য কথাবার্তা চারিদিকে চাউর হয়েছে, ঢাকি-মেয়ে ঋতুবতী হলে যে কোনো শুভ অনুষ্ঠান যেমন পূজা, ইত্যাদি অশুচিতে পরিণত হবে । এটা কী ধরনের আচার অনুষ্ঠান, আমার মাথায় ঢুকছে না । তাছাড়া নিম্নবর্গীয় বায়েন সম্প্রদায়ের মেয়েদের পূজোর মতো পবিত্র স্থানে ঢাকের বাজনা গ্রামের কিছু মোড়ল মাতবরদের অসহ্য । মহিলা ঢাকির ঢাকের বাজনার তাঁরা ঘোর বিরোধী ।
তোর বাবাও ভিডিওটা দেখেছেন । গাঁয়ের সনাতন মাস্টার নিজে এসে তোর বাবাকে ভিডিওটা দেখিয়ে বলেছেন, “এটা কী ধরনের অনাচার ! মহিলা ঢাকি, তার উপর নিম্নবর্গের বায়েনদের মেয়ে, সে কোন্‌ সাহসে বিশ্বকর্মা পূজায় ঢাক বাজাচ্ছে ? আপনারা ব্রাম্মণ সমাজের মাথা, গায়ের মোড়ল । আপনারা এর সুষ্টু বিহিত করুন । নতুবা নীচু জাতের মানুষেরা আস্কারা পেয়ে মাথায় চেপে বসবে । তখন ঠ্যালা সামলানো ভীষণ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে ।”
এখানে ঢাকি হিসাবে খেমটির দোষ কোথায় ?
না বাবা ! খেমটির দোষ নেই । খেমটি শিক্ষিত মেয়ে । তার প্রথম পরিচয় “সে একজন দেশের সুস্থ ও সচেতন নাগরিক” । যে কোনো পেশায় তার বড় হওয়ার অধিকার রয়েছে । এটা সংবিধান স্বীকৃত । পূজোতে ঢাকের বাজনা বাজাচ্ছে, এটা কোনোমতে দোষের নয় । মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ যতোই নীচু জাত হিসাবে তাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করুক, সেটা হবে অন্যায় । যারা এই জঘন্য কাজে সরাসরি লিপ্ত, তারা সাংবিধানিক নিয়ম কানুন লঙ্ঘন করছেন । এটা আইনের চোখে অপরাধ । তবে একটা ইতিবাচক দিক লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ইদানীং অনেক ব্রাম্মণেরা জাতিগত দোহাই দিয়ে নীচুজাতের মানুষদের পূজার মন্ডপ থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন না । বরং পূজা অর্চনায় সহযোগিতা করছেন । এইসব নিয়ে অহেতুক চিন্তা করিস না বাবা । সামনে দুর্গা পূজা । সম্ভব হলে কাটিহারের মাসির বাড়ি থেকে ঘুরে আয় । দেখবি তোর মনটা অনেক হাল্কা হবে ।
কুহক তার মাকে আবার বললো, “খেমটিকে নিয়ে আমার বাবার কুরুচিকর মন্তব্য আমাকে খুব ভাবায় মা ?”
“এটা একটা কঠিন প্রশ্ন” ? মা উত্তর দিলেন ।
( চলবে)