আ-মরি বাংলা ভাষা : পৃথা ব্যানার্জী।

0
422

“মোদের গরব ,মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা … মাগো তোমার কোলে, তোমার বোলে কতই শান্তি ভালবাসা” ।
বাংলা ভাষা বঙ্গ অঞ্চলের বাঙালি অধিবাসীর মাতৃভাষা। স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ, ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত। এছারা ভারতের অসম রাজ্যের দক্ষিনাংশেও এই ভাষা বহুল প্রচারিত। ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের অধিকাংশ অধিবাসী বাংলা ভষায় কথা বলে থাকেন।
বাংলা ভাষা দক্ষিন এশিয়ার বঙ্গ অঞ্চলের স্থানিয় ভাষা। এই অঞ্চলটি বর্তমানে রজনৈতিক ভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে গঠিত। এছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, অসম রাজ্যের বরাক উপত্যকা এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জেও বাংলা ভাষাতে কথা বলা হয়। এই ভাষার লিপি হল বাংলা লিপি। এই অঞ্চলের প্রায় বাইশ কোটি স্থানীয় মানুষের ও পৃথিবীর মোট ৩০ কোটি মানুষের ভাষা হওয়ায় এই ভাষা বিশ্বের সর্বাধিক প্রচলিত ভাষাগুলির মধ্যে চতুর্থ স্থান অধিকার করেছে। বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত এবং ভারতের জাতিয় স্তোত্র এই ভাষাতেই রচিত এবং তা থেকেই দক্ষিন এশিয়ায় এই ভাষার গুরুত্ব বোঝা যায়।
বিভিন্ন শব্দ ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ হয়ে বাংলা ভাষার মধ্যে এসেছে বিবিধতা। বাংলা ভাষায় লিখিত ও কথিত দুই ধরনের পদ্ধতি আছে। সাধুভাষা বাংলা ভাষার এক লিখিত রুপ, যেখানে সংস্কৃত ও পালি ভাষা থেকে উদ্ভুত তৎসম শব্দ ভাণ্ডার দ্বারা প্রভাবিত লম্বা ক্রিয়া বিভক্তি ব্যাবহার হয়ে থাকে। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দির প্রথমে এই ভাষা খুব ব্যাবহৃত হলেও এখন আর হয়না। চলিতভাষা ভাষাবিদদের নিকট মান্য চলিত বাংলা নামে পরিচিত, বাংলার এক ধরনের লেখরুপ যেখানে মানুষর কথ্য বাগধারা স্থান পায়। এই শৈলিতে ক্রিয়া বিভক্তি ছোটো আকারে ব্যাবহার হয়। বর্তমান বাংলা সাহিত্যে এই ধরনের শৈলি ব্যাবহার হয়। উনবিংশ শতাব্দির মধ্যভাগে প্যারীচাঁদ মিত্রের < আলালের ঘরের দুলাল> প্রভৃতি রচনা গুলিতে ঐ ধরনের শৈলি স্থান করে নেয়। এই শৈলি নদিয়া জেলার শান্তিপুর অঞ্চলের প্রচলিত কথ্য উপভাষা থেকে গঠিত হয়েছে বলে এই ভাষাকে অনেক সময় শান্তিপুরী বাংলা বা নদিয়া উপভষা বলা হয়ে থাকে।
কলকাতা সহ দক্ষিন-পশ্চিম পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীরা মান্য চলিত বাংলায় কথা বলে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলগুলির কথ্য ভাষা মান্য চলিত বাংলার থেকে অনেকটাই ভিন্ন। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের কথ্য ভাষার সঙ্গে মান্য চলিত বাংলার খুব সামান্যই মিল রয়েছে। তবে অধিকাংশ বাঙালি নিজেদের মধ্যে ভাব আদানপ্রদানের সময় মান্য চলিত বাংলা সহ একাধিক উপভাষায় কথা বলতে সক্ষম বলে মনে করা হলেও অনেক ভাষাবিদ তা স্বীকার করেন না। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত বাংল ভাষার মধ্যে ব্যাবহার, উচ্চারন ও ধ্বনিতত্ত্বের সামান্য প্রার্থক্য রয়েছে। বর্তমানে বাংলা ও তার বিভিন্ন উপভাষা বাংলাদেশের প্রধান ভাষা এবং ভারতের দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা।
বাংলাদেশ ছাড়াও ১৯৫০-এর দশকে ভারতের বিহার রাজ্যের মানভুম জেলায় বাংলা ভাষা আন্দোলন ঘটে। ১৯৬১ খ্যিষ্টাব্দের ভারতের অসম রাজ্যের বরাক উপত্যকায় এইরকম ভাবে বাংলা ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয়। ১৯ মে, শিলচরে বাংলা ভাষার দাবীতে আন্দোলনরত ১১ জন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন।
১৯৫১-৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জনগণের প্রবল ভাষা সচেতনতার ফলস্বরূপ বাংলা ভাষা আন্দলোন নামক একটি ভাষা আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনে পাকিস্তান সরকারের নিকট বাংলা ভাষার সরকারি স্বীকৃতি দাবী করা হয়। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বহু ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মি নিহত হন। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন দিবস পালিত হয়। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো এই দিনটিকে আন্তর্যাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা প্রদান করে।
এই ভাষা বাংলার নবজাগরনের ফলে সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধ, ঐতিহ্য নির্মাণ ও বাংলার সাংস্কৃতিক বিবিধতাকে এক সুত্রে গ্রথিত করেছে। শুধু তাই নয়, এই ভাষা বাঙালি জাতীয়তাবাদ গঠনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলা – আমার ভাষা… আমার অহংকার… আমার গৌরব…
মৃত্যুঞ্জয়ী ভাষা শহীদদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা…