আমি প্রতুল বন্ধ্যোপাধ্যায়| ক্যারিয়ার গড়তে প্রবাসে কর্মসূত্রে| তবু ভুলিনি শস্য শ্যামল বাংলাদেশের কথা , ভুলিনি মিষ্টি বাংলা ভাষা| আমার বর্তমান পরবাসে হাই- হ্যালো, গুডমর্নিং – গুডনাইটের ঠ্যালায় সপ্তাহের আদ্যভাগ কেটে যায়| তা যাক, হাতে গোণা দুটো দিন খরচা করি বাংলায় দেশের মানুষ জনের সাথে বাংলা নিয়ে চর্চায়| জীবনের পঁয়ত্রিশ বছর কেটেছে রূপসী বাংলায়| রূপসার ঘোলাজলের সাঁতরানো স্মৃতি আজো মনের মাঝে|
আজ জানলার হাওয়ায় দেয়ালে পতপত করে ওড়াওড়ি করে ক্যালেন্ডারের পাতা| জানুয়ারির পাতা উল্টে দিয়েছে আমার বেটার হাফ| এখানে কর্মস্থলে ইঁদুর দৌড়ে মাস- তারিখের হিসাব থাকে না| স্ত্রী কে প্রতি সপ্তাহেই জিজ্ঞেস করতে হয় উইক- এন্ড কবে? আমার বিদেশিনী স্ত্রী হাসে, ” oh! You are waiting for your Facebook and WhatsApp chat?” আমি লজ্জা পাই, আমার বাংলা ভাষার প্রতি দুর্বলতা ধরা পড়ে গেছে ওর কাছে. তাতে কি? বাংলা আমার মাতৃভাষা|
দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক| আমি পঁচিশে বৈশাখ সাতসাগর পারে বসে পালন করি ঠাকুর বাড়ির প্রচলিত রান্না নিজের হাতে রেঁধে আর বাঙালি বন্ধু বান্ধব দের খাইয়ে| সেদিন নিজের বিদেশিনী স্ত্রীকে বাঙালি ঘরানায় শাড়ি পরতে সাহায্য করি|সেদিন আমার বাড়ির জমায়েতে কেউ একটাও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে না|
আজ ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখ ষোলই ফ্রেবুয়ারী| হিসেব মতো বসন্ত কাল|
ব্রাসেলসের আবহাওয়ার সাথে লন্ডনের আবহাওয়ার মিল আছে| কখনো মেঘ, কখনো রোদ্দুর| মন খারাপের দিস্তা কাগজ সবসময় মেঘপিওনের ব্যাগে ভরা| কখন যে আবহাওয়ার ডাকবাক্সে পোস্ট করে দেবে কেউ জানে না| এখানেও তো টিউলিপ ফুটছে| কিন্তু বসন্ত বসন্ত আবহাওয়ার অনুপস্থিতি| চোখ পড়ল একুশ তারিখের ওপর| মানে একুশে ফেব্রুয়ারি| শুরু হয় ভাষা আবেগের ইতিহাস রোমন্থনের ঘোড়দৌড় | এখন এই একুশে ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের সৌজন্যে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস| আমার মতো বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে শহীদ দিবস ও বটে |১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ভাষা আন্দোলনে পুলিশের হাতে প্রাণ যায় আব্দুস সামাদ, রফিক উদ্দিন আহমেদ, আবুল বরকত আব্দুল জব্বর ও অহিউল্লাহ নামে এক বালকের|এই শহীদদের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পক্ষ থেকে পালন করা হয় এই শহীদ দিবস বা ভাষা দিবস.. “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙা একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি..” আমরা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান| আমাদের নিজস্ব বাংলা ভাষা ও নিজস্ব বর্নমালা আছে| পৃথিবীতে এখন প্রায় পাঁচহাজার ভাষা| কিন্তু কারো কারো নিজস্ব বর্নমালা নেই| অন্য বর্নমালা ধার করে কাজ চালায়| আদিম যুগে মানুষ যখন কাঁচা মাছমাংস খেতো, তখন আভাসে ইঙ্গিতে মনে ভাব প্রকাশ করতো| ভাবি কি কষ্ট! আজ প্রবাসে বাংলা বলার চাষ না থাকায় আমার প্রাণ ওষ্টাগত| তবুও তো স্ত্রী মারিয়া এতদিন আমার সাথে থাকা ও বাংলা ভাষার প্রতি আমার এত প্রীতি দেখে বাংলা বলাটা ভালো করে রপ্ত না করতে পারলেও বুঝতে পারে|ব্রাক্ষী লিপি থেকে ভাষার যে জয় যাত্রার শুরু, বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজ সারা পৃথিবী জুড়ে নানা ভাষার সম্ভার| বাংলা তার মধ্যে অন্যতম. আজ তেইশ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা| বাংলা কবিতা, গান, গদ্য, ছড়া, নাটকের উৎকর্ষের বনেদীয়ানা আজ স্বীকৃত| আমি সব ভুলে যাই, তা’ও ভুলি না বাংলা মায়ের বোল|জয়তু বাংলা ভাষা দিবস|
ভাষা দিবস : ডঃ অশোকা রায়।

Leave a Reply