কপাল : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
573

ঘোতন খুড়ো গাঁয়ের সজ্জন ব্যক্তি । গাঁয়ের মোড়ল মাতবর আরও পাঁচজন তাঁকে মান্যগণ্য করেন । তাই ঘোতন খুড়ো পোশাক পরিচ্ছদে টিপটপ্‌ । আর পাঁচটা বর্ধিষ্ণু চাষি পরিবারের মতো তাঁর সংসার । বাড়িতে দুজন কাজের মহিলা, একজনের কাজ শুধুমাত্র রান্না করা, থালা বাসন মাজা, ঘর-দোর মোছা, ইত্যাদি । আর শেষজন হচ্ছে বৈষ্ণবী । তার বৈষ্ণব আর এক বৈষ্ণবীর সাথে পালিয়ে যাওয়ায় সে এখন ঘোতন খুড়োর বাড়িতে সর্বক্ষণের কাজের মহিলা । তার বাড়ির অন্দরের কাজ ছাড়াও মাঠের ফসল ঝাড়াই বাছাই করে ঘরে তোলা । তবে খুড়োর আবার বৈষ্ণবীর উপর নজর । খুড়িমা সেটা জানতে পেরে ঘোতন খুড়োকে প্রচন্ড বকাঝকা । “বুড়ো বয়সে ভীমরতি” বলে গালিগালাজ । এমনকি “বৃদ্ধ বয়সে বুদ্ধি ভ্রংশ” বলেও তিনি ক্ষান্ত হননি, তাই খুড়িমা খুড়োকে চোখে চোখে রাখছেন । তবুও খুড়িমার চোখ ফাঁকি দিয়ে খুড়ো মাঝে মধ্যে বৈষ্ণবীর সোহাগে মত্ত হন । খুড়ো শেষ বয়সে বৈষ্ণবীর ঢঙ তামাশার খুনসুটিতে বেশ আলাদা মজা পান । মনের গহন গাঙে তাঁর আলাদা ফাগুনের অনুভূতি । বৈষ্ণবীও তেমনি । সময় পেলেই ঘোতন খুড়োর চারপাশে ঘোরাঘুরি । তখন বৈষ্ণবীর পরার শাড়ির বাঁধন ঠিক থাকে না । শাড়ির আঁচল ঠিক করার অছিলায় ঘোতন খুড়োর কাছাকছি এসে দাঁড়ায় । তারপর ঘোতন খুড়োর চোখ দুটি ছানাবড়া ! জোড়ে জোড়ে শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার আওয়াজ ! এই দৃশ্য খুড়িমার চোখ এড়ায় না । ঘরে ডেকে তাঁকে খেঁকিয়ে বললেন, “সাবধান না হলে ভবিষ্যতে বৈষ্ণবীর জন্য তোমাকে মাশুল গুণতে হবে” ?
দুই মেয়ের পর এক ছেলে । দুই মেয়েকে কাছাকাছি গ্রামে বর্ধিষ্ণু চাষি পরিবারে বিয়ে দিয়েছেন । তাঁর খুব আশা, ছেলেকে শিক্ষিত করবেন । ছেলেকে শিক্ষিত করার তাগিদে ঘোতন খুড়োর প্রয়াসের অন্ত নেই । কিন্তু গোপলাটার মেধাশূন্য কপাল । যার জন্য পড়াশুনায় নাকানি-চোবানি । টেনেটুনে কোনোরকমে বি-এ পাশ । গোপালের কথায়, মিষ্টি কলেজে একসঙ্গে না পড়লে তার দ্বারা বি-এ পাশ সম্ভব হোতো কিনা সন্দেহ ! মিষ্টির ধমকানিতে তার প্রত্যেহ কলেজের ক্লাস করা । মিষ্টিকে গোপাল ভালবাসে । সমস্যা একটাই । মিষ্টি গাঁয়ের মেয়ে । বি-এ পাশ করার পর মিষ্টির বাবা-মা উঠে পড়ে লেগেছেন তাকে অন্যত্র বিয়ে দিতে । অন্যদিকে গোপালের কপাল খারাপের জন্য একটি চাকরিও জুটছে না । এই নিয়ে মিষ্টির সাথে নিত্য অশান্তি । মিষ্টি গোপালকে একদিন চোখ গরম করে বললো, চাকরি জোটাতে না পারলে স্টেশন বাজারে চায়ের দোকান দিতে । সেই থেকে গোপালের মন খারাপ একটি কারণে, তার কপাল খারাপ ।
সেদিন বুধবার । মিষ্টি স্বয়ং গোপালদের বাড়িতে হাজির । এসে দেখে বৈষ্ণবী ঘোতন খুড়োকে হুঁকো টানার জন্য তামাক দিয়ে কলকে সাজিয়ে দিচ্ছে । বৈষ্ণবী কলকেতে তামাক দিয়ে তার উপর কাঠের আগুনের টুকরো দিয়ে খুড়োকে হুঁকো এগিয়ে দিয়ে বললো, “এবার টানুন” । হুঁকো এগিয়ে দেওয়ার কায়দা কানুন দেখে মিষ্টির সন্দেহ, “বৈষ্ণবীর মধ্যে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য বিরাজ করছে” !
মিষ্টি ঘোতন খুড়োর সামনে দাঁড়িয়ে হাঁকলো, “গোপাল, বাড়িতে আছো” ?
বৈষ্ণবী উত্তর দিলো, “খোকা তো বাড়ি নেই” ।
ঘোতন খুড়ো মিষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, মেয়েটি খাসা । তাঁর ছেলের বৌ হিসাবে ভীষণ মানানসই । তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমাকে তো চিনলাম না মা” ?
আমি মিষ্টি । গোপাল আমার বিশেষ বন্ধু । গোপালকে আমার ভীষণ দরকার ? গোপাল আমাকে বিয়ের ব্যাপারে এড়িয়ে যাচ্ছে । তারপর বৈষ্ণবীকে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি কাকুর সাথে কী করছেন” ?
দেখছো না, ছিলিম সাজিয়ে দিচ্ছি ?
হ্যাঁ দেখছি । তবে বাড়িতে কাকীমা থাকতে আপনি কেন ছিলিম সাজাচ্ছেন ?
তিনি গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ত ।
ভিতরে গিয়ে কাকীমাকে ডেকে দিন । গিয়ে বলুন, মিষ্টি এসেছে ।
তোমার এত ঝাঁঝালো কথা কেন বাপু ?
যা বলছি শুনুন ।
তারপর বৈষ্ণবী ঘরে ঢুকে গেলো । সেই মুহূর্তে গোপাল এসে উপস্থিত ।
ঘোতন খুড়ো গোপালকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মিষ্টি যেটা বলছে সেটা কী সত্যি” ?
কী বলছে, বাবা ?
তুই নাকি কথা দিয়েছিস, মিষ্টিকে বিয়ে করবি ?
চাকরি না পেয়ে কিভাবে বিয়ে করবো ?
এই মিষ্টি মেয়েকে বাড়ির বৌ করে আনলে আমি খুব খুশী হতাম ।
তোমার বৌমাকে কী খাওয়াবো ?
আরে আমার বাঁদর ছেলে ! মাঠে এখনও ত্রিশ বিঘে চাষের জমি । ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং তুলে খেলেও তোদের কোনোদিন অভাব হবে না ।
বাবার সিগন্যাল পেয়ে গোপাল ভীষণ উৎফুল্ল !
বৈষ্ণবীর কার্যকলাপের কুফলের দিকটা আন্দাজ করতে পেরে সেটা গোপালের কানে কানে ফিসফিস করে বলে দিলো মিষ্টি । বৈষ্ণবীর আচরণের কথা শুনে গোপাল ফ্যাল ফ্যাল করে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলো ।
তারপর ঘোতন খুড়োর বড় মেয়ে পোয়াতি । এক সপ্তাহ পরেই বাচ্চা প্রসবের দিন । তাই খুড়িমা ছুটলেন বড় মেয়ের বাড়িতে । অন্তত দুই সপ্তাহ তাঁকে সেখানে থাকতে হবে । অন্যদিকে গোপালের চাকরির ইন্টারভিউ । দুদিনের জন্য তাকে কলকাতায় ছুটতে হোলো ।
বাড়ি ফাঁকা । রাত্রিবেলায় বৈষ্ণবী ও ঘোতন খুড়ো । দুজনে দুই ঘরে ।
হঠাৎ দুপুর রাত্রিতে বৈষ্ণবী ঘোতন খুড়োর দরজায় কড়া নাড়লো, “কর্তা উঠুন”।
ঘোতন খুড়ো দরজা খুলে দিলেন । ঘরে ঢুকে বৈষ্ণবী বললো, “আমি আপনার ঘরে থাকবো । ঐ ঘরে একা শুতে ভয় করছে” ।
ঘোতন খুড়ো বাধা দিলেন না । অনেকদিন পর বৈষ্ণবীর আদর ভালবাসায় খুড়ো বিছানায় শুয়ে আনন্দে আহ্লাদিত । তারপর বৈষ্ণবী তাঁকে কী খাওয়ালো বুঝতে পারলেন না, অথচ তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন । বৈষ্ণবী যেখানে যেখানে সই-সাবুদ করতে বললো, সব জায়গায় ঘোতন খুড়ো তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় সই করে দিলেন । ঘোর নিদ্রায় শুধু বললেন, “আমাকে দিয়ে কী সই করাচ্ছো” ? উত্তরে বৈষ্ণবী কী বলেছিলো সেটা তাঁর মনে নেই ।
পরের দিন রেজিস্ট্রি অফিসে নকল ঘোতন খুড়ো একজনকে দাঁড় করিয়ে ত্রিশ বিঘা চাষের জমি বৈষ্ণবী তার নামে রেজিস্ট্রি করে নিলো ।
বৈষ্ণবী উধাও !
দুমাস পরে পাশের গাঁয়ের ইদ্রিশ চাচা ঘোতন খুড়োকে খবর দিলেন, “আপনার জমিতে তিলগ্রামের গদাই চাষি লাঙ্গল দিচ্ছে” !
সর্বনাশ ! কপাল চাপড়াচ্ছেন ঘোতন খুড়ো ।
—————০————–
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী-৭৪১২৩৫ (ভারত)