মহিলা ঢাকির ঝাঁঝ (ধারাবাহিক উপন্যাস; সপ্তম পর্ব ) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
521

ইতিমধ্যে অনল ফোন করেছিলো, তার ঢাকের বাদ্যের টীম ঘোড়াডাঙা বারোয়ারি দুর্গা পূজা প্রাঙ্গনে বাজানোর বরাত পেয়েছে । এখন তারা ঘোড়াডাঙ্গা গ্রামের পূজা প্রাঙ্গনে ঢাক বাজাতে মত্ত । তাই পূজার মাঝখানে ফাঁকা সময়ে অনল খেমটির সাথে দেখা করতে চায় । তারা সংখ্যায় পাঁচজন ঢাকি । অন্যদিকে খেমটি দ্বীপশিখার কাছে আগেই খবর পেয়েছে, অনলেরা পাঁচজন মিলে ইতিমধ্যে ঢাক বাজিয়ে গোটা গ্রাম প্রদক্ষিণ করেছে । তাই ফোনে খেমটি অনলকে তাদের বাড়িতে আসতে নিষেধ করলো । খেমটিই বরং অনলের সঙ্গে পূজা প্যান্ডেলে দেখা করবে ।
খেমটিকে নিয়ে অনলের ঢাক বাজনার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর খেমটি অনলের সঙ্গে সমঝে চলতে চায় । অনল তার ভাল বন্ধু । অনলের মিষ্টি ব্যবহার খেমটির খুব ভাল লাগে । অনলের সঙ্গে মিশে খেমটি বুঝতে পেরেছে, অনল সাংগঠনিক ক্ষমতায় যথেষ্ট দক্ষ । যে কোনো ভাল কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবণতা তার মধ্যে ষোলোআনা । সদাহাস্যময় প্রাণচঞ্চল যুবক । দেখতে সুপুরুষ । তবুও অনলকে খেমটি ভালবাসতে পারেনি তার একটাই কারণ অনলের নারীদের প্রতি সম্ভ্রম কম । নারীর স্বাধীনতা অনল একদম পছন্দ করতো না । আবার নানান নারীসঙ্গে তার ভীষণ উৎসাহ । নারীদের আত্মনির্ভরতা প্রসঙ্গে অনলের সঙ্গে একটা সময় অনেক বাগবিতন্ডাও হয়েছে । সেই সময় অনলের খুব কাছে থেকে মিশে যেটা বুঝেছিলো, “অনল চায় স্ত্রী গৃহকর্তী হবে । বাড়িতে বাবা-মা ও সন্তানের ভাল সঙ্গী হবে । সংসারের প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মাথা ঘামাবে । সংসার শক্ত হাতে এমনভাবে বেঁধে রাখবে যাতে সংসারের শান্তি অটুট থাকে” ।
কিন্তু ইদানীং বিশেষ করে বিশ্বকর্মা পূজায় ঢাক বাজানোর পর থেকে অনলের সঙ্গে মিশে যতোটুকু বুঝেছে, তাতে তার চারিত্রিক আমূল পরিবর্তন । নারীদের প্রতি সে অনেক বেশী উদার, উচ্চ ধারণার বশবর্তী । যে কোনো শিল্প-কলা সৃষ্টির নিরিখে নারীদের প্রতি তার অঢেল সম্মান । যার জন্য খেমটির ঢাকের বাদ্য অবলোকন করে অনল খেমটিকে সরাসরি প্রস্তাব দিয়েছে, মহিলা ঢাকির টীম তৈরী করতে এবং সেই টীমের মধ্যমণি হবে খেমটি নিজে । অনলের কাছ থেকে এই প্রস্তাব পেয়ে খেমটি যারপরনাই আনন্দিত । অথচ একদিন কোনো মেয়ের সৃষ্টিমূলক কাজের প্রশংসা করা অনলের ধাঁচে ছিলো না । তাই তার জীবনের আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করে খেমটি ভীষণভাবে উৎফুল্ল । অনলের বাস্তব জীবনের বর্তমান অবস্থান অতীতে তার মধ্যে দেখতে পেলে খেমটির হৃদয় বিগলিত হতে বাধ্য । সবটাই অদৃষ্ট !
তারপর কুহককে সঙ্গে নিয়ে অষ্টমী পূজার সন্ধ্যায় খেমটি ঘোড়াডাঙ্গা পূজা প্যান্ডেলে উপস্থিত । উদ্দেশ্য, ঠাকুর দর্শন ও অনলের সঙ্গে সাক্ষাৎ ।
পূজা প্যান্ডেলে যখন তারা পৌঁছালো, তখন মহাষ্টমীর সন্ধ্যারতির জমজমাট অনুষ্ঠান । পাঁচজন ঢাকি মনের আনন্দে ঢাক বাজাচ্ছে । অনল আবার কোমরে গামছা বেঁধে ঘুরে ঘুরে ঢাকের বাজনা বাজাতে ব্যস্ত । তাকে মনের খুশীতে ঢাক বাজানো অবস্থায় দেখে খেমটি ভীষণ খুশী । কুহক ও খেমটি মৃদুমন্দ পায়ে ঢাকের বাদ্যের কাছাকাছি । ঠিক অনলের ঢাকের বাজনার কাছাকাছি ।
প্যান্ডেলে ঢোকার সময় খেমটির নজর এড়ালো না, কুহকের বাবা মা মহাষ্টমীর সন্ধ্যারতি দেখতে পূজা প্যান্ডেলে উপস্থিত । কুহকের মা ও বাবা, পাশাপাশি চেয়ারে বসে রয়েছেন এবং মনোযোগ সহকারে সন্ধ্যারতি উপভোগ করছেন ।
হঠাৎ খেমটিকে দেখামাত্র অনল খেমটির হাত ধরে টেনে সোজা পুরোহিত ঠাকুরের কাছাকাছি, যেখানে ঢাক বাজানো চলছে । অনলের ইশারায় তাদের টীমের একজন ঢাকি তার ঢাকটা খেমটিকে তুলে দিলো । তারপর খেমটিকে ঢাক বাজাতে অনলের অনুরোধ । যেহেতু পুরোহিত মহাশয় প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ নিয়ে মা দুর্গার মুখের সামনে নৃত্যে করছেন, সেইজন্য ঢাক বাজানো সমানে চলছে । পুরোহিত ঠাকুরের সন্ধ্যারতির সময় কিছুতেই ঢাক বাজানো বন্ধ করা চলবে না । অবশেষে অনলের আকুতি মিনতির পর খেমটি ঢাক কাঁধে তুলে নিলো । পরনে তার শাড়ি । শাড়ির জন্য কিছুটা অসুবিধা বটে, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে ঢাক বাজানো শুরু করলো । খেমটির ঢাক বাজানো শুরু করার পর অনলের টীমের অন্য চার জন তাদের ঢাক বাজানো বন্ধ রাখলো । নিজের গাঁয়ের বারোয়ারি পূজা মন্ডপে ঢাক বাজানো খেমটির এই প্রথম । সেই কারণে খুব মার্জিতভাবে তার ঢাকের বাজনা এবং বাজনার বোল তোলা । পালটা বোল অনলের । কয়েক মিনিটের মধ্যে ঢাকের বাজনার প্রেক্ষাপটে পূজা প্যান্ডেলে দর্শনার্থীদের হর্ষধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, মহিলাদের উলুধ্বনি । তারপর প্রচন্ড হাততালি !
ঢাকের বাজনার মিষ্টতা অনুভব করে স্বয়ং পুরোহিত ঠাকুর আনন্দোচ্ছ্বাসে বললেন, “অনেকদিন পর মধুর মিষ্টতায় ঢাকের বাজনা । বাজনাটা আমার হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে । মা দুর্গা তোমাদের মঙ্গল করুন । মনের আনন্দে ঢাক বাজাও । আমিও মনের আনন্দে মায়ের সম্মুখে নৃত্য করি । মা দুর্গা আমাদের সন্ধ্যারতিতে বরং প্রীতো হবেন । তাতে গ্রামের মানুষের মঙ্গল ।“
বাইরে মহিলাদের সমানে উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি আর দর্শনার্থীদের উল্লাস্‌, “দুর্গা মা কী, জয় !”
খেমটির ঢাক বাজনা দেখে শিবদাস মোড়লের চোখ ছানাবড়া ! তিনি এক ঝটকায় চেয়ার থেকে উঠে সোজা ঢাকির কাছে এসে অনলকে চিৎকার করে বললেন, “ঢাক বাজানো বন্ধ করো । এক্ষুণি বাজনা থামাও” !
নিমেষের মধ্যে নিজের ঢাক বাজানো বন্ধ করে দিলো অনল । যদিও টীমের অন্যেরা ঢাক বাজনা চালু রাখলো । তারপর সে শিবদাস মোড়লের দিকে তাকিয়ে বললো, “পুরোহিত মশায় মা দুর্গার সামনে পঞ্চ প্রদীপ জ্বালিয়ে সন্ধ্যারতি করছেন, এখন ঢাক বাজানো বন্ধ রাখা ঘোরতোর শাস্ত্রবিরোধী” ।
দুদিনের ছোকরা, তুমি আমাকে শাস্ত্র শেখাচ্ছো ? মায়ের পূজায় কোনো মেয়েছেলের ঢাক বাজানো চলবে না । মেয়েছেলের ঢাক বাজানো অশাস্ত্রীয়” ?
ততোক্ষণে ঢাকের বাজনা বন্ধ করে ঢাকটা মন্ডপে নামিয়ে রেখে খেমটি কাঁদতে কাঁদতে পূজোর স্থান ত্যাগ করে সোজা বাড়ি ।
চোখের জল ফেলতে ফেলতে খেমটি পূজা মন্ডপ ত্যাগ করায় অনল দৃশ্যতই শিবদাস মোড়লের উপর খুব ক্ষিপ্ত ! তাই অনল আবার শিবদাস মোড়লের দিকে তাকিয়ে বললো, “কাজটা আপনি ভাল করলেন না । আপনি শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাম্মণ মানুষ, আপনি দেখান তো কোন্‌ শাস্ত্রে লেখা আছে মহিলা ঢাকি ঢাক বাজাতে পারবে না । অসম্মানজনক শব্দ “মেয়েছেলে” বলে গোটা মহিলা সমাজকে আঘাত করবেন না প্লীজ । বরং মেয়েদের আত্মমর্যাদাকে সম্মান দিতে শিখুন । আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, “ঐ মহিলা পুনরায় ঢাক বাজাবে । বাধা দিলে গোটা মহিলা সমাজে আপনার বিরূদ্ধে বিরূপ বার্তা যাবে যে “আপনি মহিলাদের আত্মবিশ্বাস” ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছেন ।
এই গাঁয়ের পূজা-প্যান্ডেলে আমার কথাই শেষ কথা । টাকা নিয়ে ঢাক বাজাতে এসেছো, নতুবা………।
নতুবা কী করবেন ?
তোমাদের মতো বায়েনদের কিভাবে শায়েস্তা করতে হয় সেটা আমার ভালভাবে জানা এবং আমি সেই কাজটাই করে দেখাবো ।
শিবদাস মোড়লের অপমানজনক ভাষা শুনে ঢাকিরা মর্মাহত । তাই তারা সঙ্গে সঙ্গে ঢাকের বাজনা বন্ধ করে দিলো । এরপর তল্পিতল্পা গুটিয়ে প্যান্ডেল ছেড়ে চলে যেতে উদ্যত । অনল শিবদাস মোড়লকে বললো, “আপনি গাঁয়ের কে আমার জানা নেই । আপনি মা দুর্গা মায়ের সন্ধ্যারতির সময় দেশের গোটা বায়েন সম্প্রদায়কে অসম্মান করেছেন । অপমান করেছেন । তার প্রতিবাদে আমরা ঢাকের বাজনা বন্ধ রাখছি । আমাদের পারিশ্রমিক আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবেন” । আর একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন, “এখানে কোনো এলাকার কোনো ঢাকি পূজোতে বাজাতে আসবে না ।“
পাঁচ জনের ঢাকির টীম ঐ ভর সন্ধ্যায় পূজা প্যান্ডেল ছেড়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো । নিমেষের মধ্যে শিবদাস মোড়লের বদরাগী কর্মকান্ডের খবর সারা গ্রামে ছড়িয়ে গেল । ছুটে এলেন গাঁয়ের বিদগ্ধজন । সামিল হলেন গাঁয়ের যুবক জওয়ানেরা । পূজোর কটাদিন গাঁয়ের সমস্ত মানুষ বাড়িতে পূজোর আনন্দে ব্যস্ত । ফলে খবর পাওয়া মাত্র ছেলে-বুড়ো সকলেই পূজার মাঠে উপস্থিত । স্বাভাবিকভাবেই পূজোর মাঠে গাঁয়ের মানুষের ঢল । সকলের মুখে এক কথা, “শিবদাস মোড়লকে ক্ষমা চাইতে হবে । তিনি অন্যায়ভাবে ঢাকিদের তাড়িয়ে দিয়েছেন । সার্বজনীন পূজার ভাল-মন্দের ক্ষেত্রে তিনি একা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না । যেটা করেছেন, অত্যন্ত গর্হিত ও অন্যায় । গ্রামের মান-সম্মান নিয়ে তিনি ছিনিবিনি খেলতে পারেন না । গ্রামের মানুষের কাছে এটা লজ্জাজনক ।
ইতিমধ্যে গাঁয়ের বিশিষ্ট কয়েকজন মানুষ ছুটে গিয়ে অনলদের বুঝিয়ে পূজা প্যান্ডেলে ফিরিয়ে আনলেন ।
শিবদাস মোড়ল কিছুতেই ক্ষমা চাইতে রাজী নয় । তাও আবার সমাজের কতকগুলো মুচির কাছে । তিনি গাঁয়ের মানুষদের উদ্দেশ্যে বললেন, “বায়েনেরা শাস্ত্রবিরোধী কাজ করেছে । মেয়েছেলে দিয়ে সন্ধ্যারতির সময় ঢাক বাজিয়েছে বলেই আমি তাদের তাড়িয়েছি । সুতরাং কতকগুলি মুচির ছেলের কাছে আমি মাথা নীচু করতে পারবো না । তারা ঢাক না বাজালে অন্য ঢাকির ব্যবস্থা করুন । এটাই শিবদাস মোড়লের নির্দেশ” !
গাঁয়ের হা-ডু-ডু খেলার ক্যাপ্টেন মদ্‌না সোজাসাপ্টা বলেই দিলো, “পূজোটা কী তাঁর নিজের ব্যক্তিগত ? যা খুশী তাই সিদ্ধান্ত নেবেন ? হয় মোড়ল মশায় ঢাকিদের কাছে ক্ষমা চাইবেন, নতুবা তাঁর বিরুদ্ধে আজ বিচার সভা বসবে । প্রয়োজনে মোড়লের পরিবর্তন হবে । আমরা এই ধরনের এক গুঁয়ে বদরাগী মোড়ল আর চাই না ।“
দাপুটে মদ্‌নার কথা শুনে আরও উৎসাহী হয়ে গ্রামবাসীরা একযোগে চিৎকার করে উঠলেন, “গাঁয়ের মদ্‌না ঠিক বলেছে । আমরা এই ধরনের গোয়ার্তুমির তীব্র নিন্দা করছি” ! গাঁয়ের মানুষের ক্ষিপ্ততা অবলোকন করে শিবদাস মোড়ল সেখান থেকে গুটিগুটি পায়ে পালিয়ে বাঁচলেন ।
কুহকের মা বাড়ি ফিরে কুহকের বাবাকে স্পষ্টভাবে বোঝালেন, “সবাই কিন্তু শিবু বায়েন নয় । আপনার বেহায়াপনা হজম করে নেবেন । আজকালকার ছেলেমেয়েরা যে জাতির হোক না কেন, তুমি মানো আর না মানো তাদের একটা নিজস্ব সম্মানবোধ রয়েছে । তাদেরও একটা মানবিক দিক আছে । সেই মানবিক দিককে সম্মান জানাতে না পারলে অন্তত অসম্মান করবেন না । তাতে হিতে বিপরীত হতে বাধ্য । তুমি কিনা গাঁয়ের মোড়ল, অথচ তোমার সিদ্ধান্তের পাশে কেউ নেই ভাবা যায় ! তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সাতবার ভাবতে হবে, চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক হচ্ছে কিনা ? নতুবা গণধোলাই থেকে নিজেকে বাঁচানো ভীষণ কঠিন । যেমন আজ অসম্মানের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হওয়ায় রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে বাঁচলে !
তুমি থামবে ?
আমাকে থামিয়ে লাভ নেই । তুমি কী পারলে, তোমার নিজের বিরুদ্ধে ওঠা জনরোষ থামাতে ? বলা চলে গাঁয়ের ডানপিটে মদ্‌না সেখানে হিরো হয়ে গেল । এবার বরং আমাকে ধমকানো বন্ধ রেখে চুপ করে বসো । শান্ত হও ।
“হুঁম ।“ রাগে গজরাতে গজরাতে বাড়ি থেকে পুনরায় বের হয়ে গেলেন । তবে মোড়ল মশায়ের যে রাগ কমেনি, সেটা স্পষ্ট । কুহকের মায়ের ধারণা খেমটি ঢাক বাজানোর জন্য তাঁর এত রাগ ! এত তেজ !
পূজা মন্ডপ থেকে কুহকও খেমটির পেছন পেছন তাদের বাড়ি । কেননা ঢাকিদের প্রতি বাবার অসম্মানজনক ব্যবহারে কুহক ভীষণভাবে ব্যথিত । তাই পূজা মন্ডপে না থেকে খেমটির সাথে সোজা খেমটিদের বাড়িতে ।
তারপর নবমীর সন্ধ্যারতির সময় শিবু বায়েনের হঠাৎ পেটে ব্যথা ! সপ্তমী ও অষ্টমীর সন্ধ্যারতির বাজনা সুন্দর বাজিয়েছে । কিন্তু মহানবমীর সন্ধ্যারতির সময় শিবু বায়েন পেটের ব্যথায় কাতর ! পূজো কমিটির কর্মকর্তাকে বললো, “আমার পেটে ভীষণ ব্যথা । দয়া করে আমার মেয়েকে খবর দিন । সে এসে ঢাক বাজাবে । পেটের প্রচন্ড ব্যথার জন্য আমি আর ঢাক বাজাতে পারছি না” ।
ফোন পাওয়ার সাথে সাথেই এক রাশ উদ্বিগ্নতা নিয়ে খেমটি ও কুহক ছুটলো আকন্দপুর ।
পৌঁছে দেখে খেমটির বাবা চুপচাপ চেয়ারে বসা । পেটে যন্ত্রণার জন্য তার ডান হাত পেটের উপর রাখা ।
রাত্রি ক্রমশ বাড়ছে । কাছাকাছি কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই । এমনকি ভাল পাশ করা ডাক্তার নেই । অথচ খেমটির বাবাকে সত্বর ডাক্তার দেখানো দরকার । দুশ্চিন্তায় কুহকের কপালে ভাজ !
ঢাক বাজাতে শুরু করলো খেমটি । পুনরায় জমে উঠলো আকন্দপুরের পূজা মন্ডপ । মহানবমীর সন্ধ্যারতি । পুরোহিত ঠাকুর আরতি করছেন আর খেমটি ঢাক বাজাচ্ছে । উপস্থিত মানুষের হর্ষধ্বনি, মহিলাদের উলুধ্বনি । গাঁয়ের মানুষের ঢল । পুরোহিত মশায়ের আরতির পর গাঁয়ের ছেলে-মেয়েদের ধুনুচি নাচের রমরমা । ছেলেমেয়ে একসঙ্গে ধুনুচি নাচের ঘনঘটা । গাঁয়ের বৌ-ঝিরা পর্যন্ত ধুনুচি নাচে অংশ নিলেন । তালে তালে একনাগাড়ে ঢাক বাজিয়ে যাচ্ছে খেমটি । মুহুর্মহু হর্ষধ্বনি । শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনি । ঠিক রাত্রি এগারোটায় নৃত্যানুষ্ঠান বন্ধ হোলো । ঢাক নামিয়ে খেমটি পূজা মন্ডপ থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো । একনাগাড়ে বাজানোর জন্য প্রচন্ড ঘেমে গেছে খেমটি । পূজোর এই কটাদিন ছেলে-মেয়ে-বৌ স্বাভাবিকভাবে পূজোর আনন্দে মেতে ওঠেন । গাঁয়ের দুর্গাপূজাতে ধুনুচি নাচ গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি বিশেষ অঙ্গ । অনেক সময় পূজা মন্ডপে ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতাও দেখা যায় । এক একজন তিনটি ধুনুচি অর্থাৎ দুই হাতে দুটো ধুনুচি এবং মুখে কামড় দিয়ে তৃতীয় ধুনুচি । ধুনুচি নিয়ে তাঁদের নানান কায়দার নৃত্যে । প্রত্যেকটা ধুনুচিতে নারকেলের ছোবড়া ও ধূপ জ্বালানো থাকে । ধুনুচি নৃত্যানুষ্ঠান উপস্থিত দর্শনার্থীরা খুব উপভোগ করেন । ধুনুচি নাচের সাথে অনবরত ঢাক বাজানোর রেওয়াজ দীর্ঘ দিনের । অনেক রাত্রিতে মন্ডপে ঢাক বাজানো বন্ধ হওয়ার পর বাইরে এসে সতেজ বাতাসের মধ্যে চেয়ার নিয়ে বসলো খেমটি । এমন সময় পূজা মন্ডপে উপস্থিত গ্রামের বয়স্ক বলহরি কাকা খেমটিকে বললেন, “তুমি একটু তাড়াতাড়ি এসো মা । তোমার বাবা কেমন যেনো শারীরিক অস্বস্তিতে ভূগছে । তার শরীর ভীষণ আনচান !”
হ্যাঁ, শিগগির চলুন ।
বাবার অবস্থা দেখে খেমটির চক্ষু চড়কগাছ !
বাবা পেটে হাত দিয়ে যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে । শ্বাস প্রশ্বাস নিতেও তার কষ্ট । শারীরিক যন্ত্রণায় অস্থির । যন্ত্রণায় বাবার কাতরানোর দৃশ্য দেখে খেমটি আরও ঘাবড়ে গেলো । ঐখান থেকে চিৎকার করে কুহককে ডাকলো । পূজা কমিটির কর্মকর্তারা গাঁয়ের সুখহরি হাতুড়ে ডাক্তারকে ডাকতে লোক পাঠালেন । তিনি সত্বর এসে খেমটির বাবাকে সরেজমিনে ভাল করে দেখে ডাক্তার বাবু বললেন, বায়েন দাদার শরীর আমার ভাল ঠেক্‌ছে না । বায়েন দাদাকে এই মুহূর্তে সোজা কলকাতার নামী হাসপাতালে ভর্তি করাটাই যুক্তিযুক্ত । তার শরীরের যা অবস্থা তাতে কলকাতা এক্ষুণি নিয়ে যাওয়া দরকার । কেননা এলাকায় ভাল ডাক্তার নেই । বেলডাঙ্গা হাসপাতাল এখান থেকে দূরে । আর তাছাড়া পূজোর ছুটিতে বেলডাঙ্গা হাসপাতালের ডাক্তারেরা বেশীর ভাগ বাড়ি যান । সুতরাং এত রাত্রিতে সেখানে ডাক্তার পাওয়া দুস্কর । তার চেয়ে বরং সোজা কলকাতার বড় নার্সিং হোম কিংবা হাসপাতালে নিয়ে গেলে বায়েন দাদা সুস্থ হয়ে উঠবেন । তার শারীরিক পরিস্থিতি ভীষণ উদ্বেগজনক ।
কুহক ভূপতিকে ডাকলো । দুজনে মিলে অ্যাম্বুলেন্সে শিবু বায়েনকে তুললো । ইতিমধ্যে খেমটির মা এসে উপস্থিত । সে খেমটির বাবাকে ছাড়তে চাইছিলো না । তাই একরকম জোর করে অ্যাম্বুলেন্সে উঠলো খেমটির মা । ঢাক বাজানোর বায়না নেওয়ার জন্য পুরো পূজোর দিনগুলিতে ঢাক বাজানো তাদের দায়িত্ব । সেই কারণে কুহক খেমটিকে পূজা মন্ডপে থাকতে বললো । কলকাতার সমস্ত দায়িত্ব সে সামলে নেবে । পূজো শেষ হলে তবেই তাকে কলকাতা যেতে বললো কুহক । কেননা এই পূজোর মুহূর্তে বদলী হিসাবে কোনো ঢাকিকে পাওয়া যাবে না । সবাই দুর্গা পূজার ঢাক বাজাতে বিভিন্ন জায়গায় অগ্রিম বায়না নিয়ে ঢাক বাজাতে এখন ব্যস্ত ।
তারপর খেমটিকে পূজা মন্ডপে রেখে ভূপতি, কুহক ও খেমটির মা কলকাতা ছুটলো শিবু বায়েনের চিকিৎসার জন্য । সুখহরি ডাক্তার বাবুর ঔষধ খেয়ে শিবু বায়েন সাময়িকভাবে সুস্থ ।
৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক । রাত্রির জন্য তাদের অ্যাম্বুলেন্স একবার ধুবুলিয়ায় পুলিশ আটকিয়ে তল্লাশি চালিয়েছিলো । পূজোর সময়ের দরুন নাকি অতিরিক্ত সতর্কতা । জাতীয় সড়ক ধরে জাগুলি, বারাসাত হয়ে সোজা কলকাতা ।
রাত তিনটের সময় মাণি স্কোয়ার সপিং মলের সন্নিকট অ্যাপোলো হাসপাতালে শিবু বায়েনকে ঢোকালো । শুরু হোলো তার পরীক্ষা নীরিক্ষা । অ্যাপোলো হাসপাতাল কতৃপক্ষকে কুহক জানিয়ে দিলো, ভাল চিকিৎসা যেনো রোগী পায় । তারপর সকাল আটটার সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে খবর দিলো, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক রোগীর বাড়ির লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন । ভুপতি, কুহক ও খেমটির মা ডাক্তার বাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেলে ডাক্তার বাবু প্রথমে সকলের সঙ্গে পরিচিত হলেন । তারপর সকলকে তাঁর সম্মুখের চেয়ারে বসতে বললেন । তিনজনেই ডাক্তার বাবুর মুখোমুখি বসলো । ডাক্তার বাবু শুরু করলেন, “শিবু বায়েনের ক্যানসার হয়েছে । ক্যানসার রোগের জায়গাটা ঠিক লিভারের নীচে । যার জন্য সত্বর শিবু বায়েনের কেমোথ্রাপী শুরু করা প্রয়োজন । অবস্থা সিরিয়াস । যেটা করবেন, সেটা খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে করবেন । বেশী সময় নষ্ট করা যাবে না, তাতে রোগীর ক্ষতি ।“
ক্যানসারের কথা শোনার পর কুহক চটজলদি ডাক্তার বাবুকে বলেই দিলো, “আমরা রোগীকে ঠাকুরপুকুরের ক্যানসার হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে চাই ।“
ঠিক বলেছেন । এটা সঠিক সিদ্ধান্ত । সেখানে নামী দামী ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বাবু রয়েছেন । খুব ভাল প্রস্তাব । সম্ভব হলে আজই ভর্তি করে দেন । তাহলে আশা করছি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেমোথ্রাপি শুরু করে দিতে পারবেন ।
বেহালা পার হয়ে ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতাল । ভর্তি করানো হোলো শিবু বায়েনকে । অন্যদিকে অ্যাপোলো হাসপাতালে কয়েক ঘন্টা চিকিৎসার জন্য মোটা টাকার বিল । পুরো পেমেন্ট করে তারা ঠাকুরপুকুর হাসপাতালে । সমস্তরকম অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে চিকিৎসা । নামকরা ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বাবুরা রয়েছেন । শিবু বায়েনকে ভর্তি করানোর সাথে সাথেই চালু হয়ে গেল তার সঠিক চিকিৎসা । প্রথম কেমোথ্রাপির তোড়জোড় । ডাক্তার বাবুরা স্পষ্টতই বললেন, “রোগীকে ভর্তি করাতে অনেক দেরী হয়ে গেছে । ক্যানসার রোগটা মারাত্মক পর্যায়ে” ।
তারপর শিবু বায়েনকে হাসপাতালে ভর্তি করে তারা তিনজনে মিলে হাসপাতালের বাইরে এসে একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চের উপর বসলো । খেমটির মা চিন্তায় চিন্তায় নাজেহাল । প্রচন্ড টেনশনে তার সময় কাটছে । ভগবানের কাছে একটাই প্রার্থনা, “মানুষটা ভাল হয়ে বাড়ি ফিরুক ।“
সন্ধ্যা গড়িয়ে এল । ডাক্তার বাবু যিনি শিবু বায়েনের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি এসে বলে গেলেন প্রথম কেমো কিছুক্ষণ আগেই প্রয়োগ হয়েছে । রোগী ভাল আছে । তবুও আপনারা কাছাকাছি থাকবেন । রোগীর অবস্থা সঙ্কটজনক । এরপরে আমরা কয়েকজন ডাক্তার মিলে শিবু বায়েনের পরবর্তী চিকিৎসা নিয়ে আলোচনায় বসবো । সেখানে কী সিদ্ধান্ত হয় সেটা জানিয়ে দেবো । তবে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, আমরা মরিয়া প্রয়াস চালাচ্ছি রোগীকে সুস্থ করে তোলার । এই মুহূর্তে আপনারা ঈশ্বরকে ডাকুন, তিনি নিশ্চয় মুখ তুলে চাইবেন ।
কুহকেরা সিদ্ধান্ত নিলো, তারা তিনজনে মিলে হাসপাতালে রাত্রি কাটিয়ে দেবে । আলাদা করে হোটেলে রুম ভাড়া নেবে না । ভুপতি যদিও ইতস্ততঃ করছিলো, তার শাশুড়ি মাকে হাসপাতালে তাদের সঙ্গে কষ্ট করে একসঙ্গে থাকাটায় । কিন্তু খেমটির মা ভূপতিকে আস্বস্ত করলো, “দেখো বাবা, তোমার শ্বশুর মহাশয়কে রেখে দূরে কোথাও আমার থাকাটা বিষম কষ্টদায়ক । সুতরাং সকলে একসঙ্গে হাসপাতালে থাকাটাতেই আনন্দ । ডাক্তার বাবুদের প্রয়োজনে আমরা সঙ্গে সঙ্গে হাজিরা দিতে পারবো ।“
এরপরে ভূপতি তার শাশুড়ি মাকে অন্যত্র থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করেনি । তারা রাতের খাবারের উদ্দেশ্যে হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে কাছাকাছি ছোটখাট খাবারের দোকান থেকে রুটি তরকারি খেয়ে রাত্রির আহার সারলো ।
***************************************
তারপর দশমীর পূজা শেষ ।
আকন্দপুরের দুর্গা ঠাকুরের দশমী পূজার অঞ্জলি দিতে গাঁয়ের মহিলাদের প্রচন্ড ঠেলাঠেলি ।
অঞ্জলির পর শুরু হোলো সিদূঁর খেলা । বেশীর ভাগ গাঁয়ের বধুরা লাল পেড়ে শাড়ি পরিহিত । অনেকে পূজোতে কেনা দামী শাড়ি পরেই সিদূঁর খেলায় মত্ত । উপস্থিত মহিলাদের সিদূঁর খেলায় তুমুল উত্তেজনা । আনন্দোচ্ছ্বাসে তাঁরা ভরপুর ।
গাঁয়ের মা-বোনদের হাতে রেকাবিতে ফুল, তুলসীপাতা, দুব্বা, পান, গোটা সুপারী, মিষ্টির প্যাকেট, সিদূঁর, ইত্যাদি । প্রথমেই তাঁরা একে একে মা দুর্গাকে বরণ করছেন, বরণ করার প্রক্রিয়া গতানুগতিক হলেও অন্যরকম । বারোয়ারী দুর্গা পূজা । তাই দুর্গা ঠাকুরের প্রতিমা অনেক উঁচু । হাতের নাগালের মধ্যে না পেয়ে প্রতিমার পাশে কাঠের জলচৌকি রেখে, তার উপর দাঁড়িয়ে মাকে বরণ করছেন । দুহাতে গোটা পান ধরে হাত দুটো কিছুটা নৃত্যের ঢঙে মা দুর্গার মুখের সামনে ঘুরিয়ে তারপর মাকে সিদূঁর পরিয়ে মিষ্টিমুখ করিয়ে তাঁদের নীচে নেমে আসা । প্রত্যেক মহিলাই একই ঢঙে মাকে সিদূঁর পরিয়ে বরণ করছেন ।
এদিকে খেমটি সমানে ঢাক বাজিয়ে যাচ্ছে । বিসর্জনের বাজনা । হৃদয়বিদারক বাজনার বোল । খেমটির মনটা এমনিতেই বাবার জন্য ভারাক্রান্ত, তার উপর শারদোৎসবের শেষদিনে বিসর্জনের বাজনার বোল তুলে তার হৃদয় আরও বিষন্ন । চোখে জল আসার মতো অবস্থা ।
ততোক্ষণে মহিলাদের নিজেদের মধ্যে সিদূঁর খেলার ঢল । একজন অন্যজনের গালে, কপালে সিদূঁর মাখিয়ে মুখমন্ডল লাল করে দেওয়ার মুহূর্ত । এই মুহূর্তক্ষণে উপস্থিত সকল দর্শনার্থীরা আনন্দোচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা । কিছুক্ষণ পরেই মন্ডপ থেকে ঠাকুর বের হবে । তারপর বাবলা নদীতে বিসর্জনের জন্য এগিয়ে যাবে । অন্যদিকে খেমটির ঢাক বাজছে অনবরত । ঢাকের বোল তোলার জন্য খেমটির ঢাকের বাজনা ভীষণ শ্রুতিমধুর । দর্শকদের হর্ষধ্বনি । মহিলাদের উলুধ্বনি । দর্শকেরা খুব মনোযোগ সহকারে ঢাকের বাজনা শুনছেন । মিষ্টিমধুর বাজনা সকলে উপভোগ করছে্ন । তার সঙ্গে চলছে দর্শনার্থীদের মোবাইলে ভিডিও রেকর্ডিং । সেটা সোসাল মিডিয়ায় শেয়ারও হয়ে যাচ্ছে । মহিলা ঢাকির ভিডিও, ফটো, সোসাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পেলো । খেমটি বোল তুলে নিরলস তার ঢাক বাজাচ্ছে । এতটুকু বিশ্রাম নেই । খেমটির ঢাকের বোল ঃ
ঢ্যা, ঢ্যানা ঢ্যাগ
ঢ্যা, ঢ্যানা ঢ্যাগ
ঢ্যা-ঢ্যা-ঢ্যা—-ঢ্যাগ ঢ্যাগ
ঢিনি না কিতা
ঢিনি না কি তা
কুররর…………
খেমটির ঢাকের মিষ্টি বাজনার বোল শ্রবণে উৎফুল্ল হয়ে উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে প্রচুর হাততালি ! ঢাকের বাজনার তালে তালে কয়েকজন অল্প বয়সী মহিলাদের নৃত্য পরিবেশন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ।
ক্ষণেকের বিরতি । তখন বেলা দুটো । স্নান খাওয়া সেরে খেমটি তৈরী হচ্ছে ঠাকুরের বিসর্জনের শোভাযাত্রায় ঢাক বাজাতে । দুর্গা প্রতিমা মন্ডপ থেকে বের করা হোলো । এবার লরিতে প্রতিমা তোলার প্রস্তুতি । ইত্যবসরে গাঁয়ের মানুষেরা বিসর্জনের শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়ার জন্য উপস্থিত । অনেক মানুষের সমাগম ।
হঠাৎ খেমটির মোবাইলে আওয়াজ !
অনলের ফোন !
“হ্যালো অনল” । খেমটি মোবাইল হাতে তুলে নিয়ে বললো ।
“শুনলাম, তোমার বাবার চিকিৎসার জন্য কুহক ও তোমার মা কলকাতার হাসপাতালে গেছে” ? অনল ফোনে খেমটিকে জিজ্ঞাসা করলো ।
হ্যাঁ ঠিক শুনেছো ।
“তুমি আমাকে একটুও জানাও নি । জানতে পারলে, তোমার পূজা মন্ডপে আমার লোক গিয়ে বদলী ঢাকি হিসাবে ঢাক বাজাতে পারতো । এবার বলো, তোমার বাবার কী হয়েছে ? হঠাৎ কলকাতা নিতে হোলো কেন” ? অনল জানতে চাইলো ।
অনলের কথা শুনে খেমটি কেঁদে ফেললো । কান্না অবস্থায় বললো, “বাবার ক্যানসার ধরা পড়েছে এবং বাবার অবস্থা আশঙ্কাজনক” !
ফোনে বেশী কথা বললো না অনল । সে বুঝতে পারলো খেমটি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে । তাই অনল সান্ত্বনা দিয়ে খেমটিকে বললো, “তুমি সাবধানে কাজ করো । বিসর্জনের পালা মিটে গেলে রাত্রিতেই তোমার সঙ্গে আমি দেখা করছি । তারপর আমি ভাবছি, আমিও কলকাতায় তোমার বাবাকে দেখতে ছুটবো । তোমার বিপদে আমি সর্বক্ষণ পাশে আছি । টাকা পয়সা থেকে লোকবল, কোনোটার জন্যে তুমি হায় হুঁতাশ করবে না । কুহকের সঙ্গে আমিও তোমার পাশে রইলাম” ।
তারপর……………।
তারপর রাত্রি ৯টা । বাবলা নদীতে মা দুর্গার বিসর্জনের পালা শেষ । এখন ঘরে ফেরার পালা । কিন্তু আকন্দপুর গ্রামের বারোয়ারী পূজা কমিটির পক্ষ থেকে কর্তাব্যক্তিরা খেমটিকে অনুরোধ করলেন, একাদশীর দিন দুপুর পর্যন্ত ঢাক বাজিয়ে বাড়ি ফিরতে । খেমটি তাঁদের কথা ফেলতে পারে নি । আকন্দপুর গ্রামের মানুষ শিবু বায়েনের পরিবারকে নিজেদের আপনজন হিসাবে ভাবেন । সেই কারণে তার দশমীর রাত্রি আকন্দপুরে কাটিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ।
অন্যদিকে খেমটি আরও একটা সিদ্ধান্ত নিলো, সে আকন্দপুর থেকে সোজা কলকাতার ট্রেন ধরবে যাতে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে পৌঁছাতে পারে । পূজা কমিটির সেক্রেটারি খেমটিকে বললেন, সে আকন্দপুর থেকে সোজা কলকাতা গেলে তার ঢাক সযত্নে তাঁর বাড়িতে রাখা থাকবে ।
গাঁয়ের মানুষ ঠাকুর বিসর্জনের পর যে যার বাড়ি ফিরে গেলেন । পূজা মন্ডপ ফাঁকা । রাত বাড়ছে । ফাঁকা মন্ডপেই তার রাত্রি যাপন । অন্যান্যদিন রাত দুপুর পর্যন্ত পূজা মন্ডপ জমজমাট থাকে । কখনও ধুনুচি নাচ, কখনও নৃত্যানুষ্ঠান, কখনও গান, আবার কখনও বাচ্চাদের আবৃতি, নানান ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেমন মোমবাতি জ্বালানো প্রতিযোগিতা, মেয়েদের শঙ্খ বাজানো প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি । সুতরাং রাত কাটানো সমস্যা থাকে না । কিন্তু বিজয়া দশমীর রাত্রিতে ঠাকুর বিসর্জনের পর সব ফাঁকা । লোকজনহীন পূজা প্যান্ডেল । পূজা মন্ডপের আশপাশটা নিস্তব্ধতায় ভরা । একটা গা ছম ছম অনুভূতি । যদিও বাড়ির কম্বল, বিছানার চাঁদর, রয়েছে তবুও একেবারে ফাঁকা প্যান্ডেলে রাত্রিযাপন খেমটির কাছে কিছুটা আতঙ্কের, নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি । কিন্তু এছাড়া উপায়ও নেই । তাই খেমটি আর সাতপাঁচ ভাবলো না । ইতিমধ্যে তার রাত্রির খাবার খাওয়া শেষ । খাওয়ার পর একাকী নিরিবিলিতে তার মন-প্রাণ বাবার জন্য উতলা হয়ে উঠলো । বাবার জন্য তার উদ্বিগ্নতা কিছুতেই প্রশমিত করতে পারছে না । ঘুরেফিরে বাবার করুণ মুখখানা তার চোখের সামনে ফুটে উঠছে । বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো খেমটি । সারাদিনের ধকলে সে বড্ড ক্লান্ত । চারিদিকে ফাঁকা । ঘুমোতে চেষ্টা করছে খেমটি । ঠান্ডা হাওয়া । সামনে কার্তিক মাস । তাই শীতের আমেজ । কিছুক্ষণ আগে পূজা কমিটির সেক্রেটারি এসে এক বোতল খাওয়ার জল রেখে বলে গেছেন ঘুমিয়ে পড়তে । সারাদিন অনেক পরিশ্রম হয়েছে । তাই বিশ্রাম নিতে বলেছেন । এখানকার পূজা কমিটির সেক্রেটারি ঠিক তার বাবার মতো । মেয়ের মতো তাকে ভালবাসেন । খেমটির মতে, বর্তমান ডিজিটাল যুগে এই ধরনের মানবিক লোকের বড্ড অভাব । যাই হোক ঘুমিয়ে পড়লো খেমটি ।
অন্যদিকে কুহক খেমটিকে আর ফোন করেনি । কেননা সে জানে রাত পোহালেই খেমটি কলকাতায় পৌঁছাবে । কারণ বাবার এই অবস্থায় সে কিছুতেই ঘোড়াডাঙার বায়েন পাড়ায় ফিরে যাবে না । সুতরাং তার সঙ্গে সাক্ষাতে কথা হবে । সন্ধ্যারাত্রিতে শিবু বায়েনের চিকিৎসাধীন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বাবু কুহকদের ডেকে বলে দিয়েছেন, “রোগীর অবস্থা মোটেই সুবিধার না । চিকিৎসায় রোগী ঠিকমতো সাড়া দিচ্ছেন না । ক্রমশ সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মধ্যে চলে যাচ্ছেন । আমরা দুজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রোগীর সর্বক্ষণের চিকিৎসক । আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত । আরও ছয় মাস আগে রোগীকে হাসপাতালে আনতে পারলে আমাদের পক্ষে চিকিৎসায় অনেক সুবিধা হোতো, যেটা এখন বেগ পেতে হচ্ছে ! লিভারের নীচ থেকে ক্যানসার এখন শরীরের নানান জায়গায় ছড়িয়ে গেছে । নিয়ন্ত্রণে আনাটাই বিপদজনক । তবুও আমাদের প্রয়াসের খামতি নেই । আমরা রোগীর সুস্থতার স্বার্থে সতত তৎপর । এখন ঈশ্বর ভরসা ! দেখা যাক্‌ কতোটা কী করা যায় ! তবে আপনারা এই মুহূর্তে বেশী দূরে কোথাও যাবেন না । অবশ্যই কাছাকাছি থাকবেন । আমরা জানি, আপনাদের থাকা নিয়ে অনেক সমস্যা । তবুও আমাদের অনুরোধ, রোগীর স্বার্থে কাছাকাছি থাকুন । কখন আপনাদের প্রয়োজন হবে আমরাও নিশ্চিত না । কিন্তু দরকার হলে আপনাদের ডাকলে যেনো পাওয়া যায় । নমস্কার ।“
ডাক্তার বাবু খেমটির মায়ের চোখের জল অবলোকন করে বললেন, “মা, আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি । ঈশ্বরকে ডাকুন, রোগী নিশ্চয় ভাল হয়ে উঠবেন ।“
ডাক্তার বাবুর কাছে রোগীর বিবরণ শুনে কুহকের মনটা অজানা শঙ্কায় অস্থির হয়ে উঠলো । তার মনের ভিতর অস্তিরতার উথাল পাতাল, “তবে কী খেমটির বাবাকে সুস্থ করে আমরা বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবো না ?” অন্যদিকে খেমটির মায়ের অনবরত কান্না । তার চোখের জল দেখা বড় কষ্ট । ডাক্তার বাবুর কথায় খেমটির মা আরও ভেঙ্গে পড়লো । ঐদিকে বাবার শারীরিক অবনতির কথা শুনে তনিমা ভোরের ট্রেনে কলকাতায় আসছে । কুহক মানসিক দুশ্চিন্তায় আরও জর্জরিত হয়ে পড়লো । কুহক নিজেও বুঝতে পারছে না, “রোগীর সুস্থতার স্বার্থে তার এখন কী করণীয় ?
শিবু বায়েনের শারীরিক অবস্থার অবনতির খবরে বায়েন পাড়ায় সামগ্রিকভাবে মানুষের মধ্যে বিষন্নতার ছায়া ।
তারপর…………।
তারপর ঘোড়াডাঙার শিবদাস মোড়ল শিবু বায়েন ও তার পরিবারকে যথোপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার জন্য ওত পেতে সুযোগের অপেক্ষায় জাল পেতেছেন । রাগে রীতিমতো জ্বলছেন । তাঁর এখনও একই সুর, “মুচি-মেথর জাতের মেয়েকে বাড়িতে বৌমা হিসাবে ঠাঁই দেওয়া, কিছুতেই না” । তিনি সরেজমিনে খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছেন, “কুহক এখন তার ভাবী শ্বশুরকে নিয়ে কলকাতার হাসপাতালে । শিবু বায়েনের বৌ নাকি শিবু বায়েনের সঙ্গে গেছে । খেমটি ঢাক বাজাতে আকন্দপুরে । অর্থাৎ খেমটিদের বাড়ি ফাঁকা । সুতরাং এই সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগাতে শিবদাস মোড়ল চাঙা । গাঁয়ের সনাতন মাস্টার মোড়লের কুচক্রের সর্বক্ষণের সঙ্গী । সনাতন মাস্টার ও শিবদাস মোড়ল দুজনে মিলে বিজয়া দশমীর সন্ধ্যারাত্রিতে সিদ্ধান্ত নিলো, “খেমটিকে আগে পৃথিবী থেকে সরানো” । মেয়েটাকে সরাতে না পারলে মোড়ল মশায়ের একমাত্র ছেলের জীবনে মুচির মেয়েটা ঢুকতে বাধ্য । তাছাড়া বায়েনদের মেয়ের অতো তেজ তাঁর অসহ্য । ব্রাম্মণের ছেলের পেছনে মেয়েকে লেলিয়ে দেওয়ার শিক্ষাটাও শিবু বায়েনদের পাওয়া উচিৎ । শিবু বায়েনের কতো আস্পর্ধা ! বার বার নিষেধ করা সত্বেও মেয়েকে তাঁর ছেলের পেছনে লেলিয়ে দেওয়া । যার জন্য তাঁর একমাত্র ছেলেটা বাড়ি ঘর ভুলে কলকাতার হাসপাতালের মেঝেতে রাত কাটাচ্ছে । ঐসব বেয়াদপদের উপযুক্ত শাস্তি না দিতে পারলে শিবদাস মোড়লের গায়ের জ্বালা মিটছে না । সনাতন মাস্টারের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে শিবদাস মোড়ল খেমটিকে মারার ও শিবু বায়েনদের পরিবারকে ভিটে ছাড়া করার দুরভিসন্ধিমূলক নোংরা খেলায় মেতে উঠলেন ।
“পরে সনাতন বাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে শিবদাস মোড়ল তাঁর সিদ্ধান্ত কিছুটা বদল করলেন । বিজয়া দশমীর দিন খেমটিকে পৃথিবী থেকে বিদায় করা হবে, কিন্তু একেবারে তাকে না মেরে নারী পাচারকারীর দলের দালালের হাতে তুলে দেওয়া । যাতে অন্ধকার জগতে সারাজীবন পচে মরতে পারে ।“ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাঁরা দৃঢ়বদ্ধ । শিবদাসের মোড়লের অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, “ঠাকুর বিসর্জনের পর সাধারণত এলাকা শান্ত হয়ে যায় । প্রত্যেক মানুষ টানা পূজোর কদিন আনন্দোচ্ছ্বাসের পরে ঠাকুর বিসর্জনের পর ঘরে ফিরে বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা আদান প্রদানের সামাজিক রীতি নীতির পরম্পরায় মেতে ওঠেন । তখন অন্যত্র জায়গাগুলি থাকে সুনসান । কলকোলাহীন জনশূণ্য রাস্তাঘাট । তার উপর বেশী রাতে গাঁয়ের চারিদিকটা তখন চুপচাপ ও নিঝুম ।
রাত্রি তখন একটা । রাস্তাঘাট সুনসান । নিস্তব্ধ ও নীরব । মুষ্টিমেয় কয়েকটা কুকুরের আনাগোনা । গাছগাছালিতে পাখির কিচিরমিচির বন্ধ । কয়েকদিন পূজোর ব্যস্ততার পরে গেরস্ত বাড়ির মানুষজন ঘুমে বিভোর । শিবদাস মোড়ল তিনজন ষন্ডামার্কা গুন্ডা ছেলেকে আকন্দপুরে পাঠালেন খেমটিকে তোলার জন্য । অজ্ঞান অবস্থায় খেমটিকে বাবলা নদীর ভাটিতে রাখা নৌকায় উঠিয়ে সেই নৌকা চলে যাবে কাটোয়ার অভিমুখে । গঙ্গায় পৌঁছানোর আগে দাঁড়িয়ে থাকবে নারী পাচারকারীর দলের কিংপিন, পুন্ডরীকাক্ষ ও তার দলের সাঙ্গপাঙ্গ । তাদের হাতে খেমটিকে তুলে দিয়ে ঐ তিনজন ষন্ডামার্কা ছেলের ছুটি । এই কাজের জন্য মোটা টাকার বখরার চুক্তি । সমগ্র প্রক্রিয়াটির ছক সাজিয়েছেন সনাতন মাস্টার । বাইরে থেকে আনা হয়েছে আরও পাঁচজন গুন্ডাকে । তাদের দায়িত্বে, বায়েন পাড়ায় শিবু বায়েনের বাড়িসহ পাশাপাশি যতোগুলি বাড়ি সম্ভব কেরোসিন তেল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া । দায়িত্ব বুঝে নিয়ে দুটো টীম দুই জায়গায় ছুটলো । আড়ালে কলকাঠি নাড়তে রইলেন শিবদাস মোড়ল ও সনাতন মাস্টার ।
গভীর রাত্রি । ঘড়ির কাটায় তখনও দুটো বাজে নি । দাও দাও করে জ্বলছে বায়েন পাড়ার বাড়িঘর । চারিদিকে আগুনের লেলিহান । চিৎকার চেচামেচি । হৈ হট্টগোল । বাঁচাও, বাঁচাও ধ্বনি । আগুনের ধোয়া চারিদিকে ছড়িয়ে গেল । আগুন দাও দাও করে সমানে জ্বলছে, নিভবার লক্ষণ নেই ।
নিমেষের মধ্যে ঘোড়াডাঙা গ্রামবাসীদের কানে পৌঁছে গেল বায়েন পাড়ার বাড়িঘর পুড়ে যাওয়ার খবর । খবর পেয়ে কাঁচা ঘুম থেকে উঠে মানুষ বায়েন পাড়ার দিকে ছুটছে । কী ভয়ানক আগুন ! নেভবার লক্ষণ নেই । বায়েন পাড়ার মানুষ ভয়ে, ভীতিতে কুকড়ে গেছে । তারা কপাল চাপড়াচ্ছে ।
অনল দশমীর রাতে বাড়ি ফেরেনি । ঘোড়াডাঙাতেই ছিলো । তার কানে খবর পৌঁছালো । খবর পেয়েই ছুটলো বায়েন পাড়া । অনল পৌঁছে দেখে, তখনও আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে ! বায়েন পাড়ার বৌ-ঝিরা বালতি বালতি জল ঢালছে । আগুন নেভাতে তাদের ঘামঝরা প্রয়াস । বায়েন পাড়ার অধিকাংশ বাড়ির মরদ পূজার ঢাক বাজিয়ে ঘরে ফেরেনি । ফলে বৌ-ঝিরা কাঁদতে কাঁদতে বালতি বোঝাই জল দিয়ে আগুন নেভানোর প্রয়াস সমানে চালাচ্ছে । তাদের সঙ্গে ঘোড়াডাঙার মানুষজনও জল ঢালতে যোগ দিয়েছেন । তা সত্বেও আগুন আয়ত্বে আসছে না । খেমটিদের বাড়ি পুড়ে ছারখার । পাশাপাশি গোটা পাঁচেক বাড়ি ভস্মসাৎ । গ্রামবাসীদের সমানে জল ঢালা । প্রচুর মানুষের ঢল । সকলের চোখে মুখে কৌতুহলি ছাপ । এই ধরনের নোংরা কাজ কারা করলো । সরল সোজা মানুষদের আগুনে পুড়িয়ে মারার কাদের ষড়যন্ত্র ?
তারপর বেশী সংখ্যায় মানুষ জল ঢালার জন্য অবশেষে আগুন নিয়ন্ত্রণের পথে । পাশের বাড়ির গৃহ বধু কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে । ক্রন্দনরত অবস্থায় জনসমাগমকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বললো, “তাদের এই সর্বনাশ কারা করলো ? তারা নীচু জাতের বলে সমাজে কী তারা মানুষ নয় ? আমরা এই সর্বনাশের বিচার চাই” ?
অনল ভাবছে, “মায়ের মতো বয়স্কা মহিলা যেভাবে কাঁদছে সেই কান্না অরণ্যে রোদনের মতো দাঁড়াবে কিনা ? তাদের উপকারে ঘোড়াডাঙা গ্রামের অধিবাসীরা সোচ্চার হবে কিনা ?” এতসব ভাববার তার সময় নেই । যদিও তার টীমের অন্য চারজন আগুন নেভাতে সমানে জল ঢালায় ব্যস্ত । একটাই ভাল লক্ষণ, খেমটিদের বাড়ির বাদিকে ও ডানদিকের দুটো-দুটো চারটি বাড়ি বাদ দিয়ে অন্যান্য বাড়িগুলি কিছুটা অংশ বাদ দলে পুরোটাই অক্ষত । অনল নিশ্চিত, আগুন লাগানোর পেছনে কোনো দূরভিসন্ধিমুলক মানুষের হাত রয়েছে । এই ধরনের আগুন দুষ্টুচক্রের হাত ছাড়া অসম্ভব !
এখন একটাই লক্ষ্য, যেনতেনপ্রকারেনো আগুন নেভানো । যদিও আগুনের তেজ থেমে গেছে, এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে । ঘোড়াডাঙা গ্রামের প্রায় সমস্ত গ্রামবাসী বিভৎস অগ্নিকান্ডের খবরে বায়েন পাড়ায় এসে হাজির । তাঁদের সকলের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ । উদ্বিগ্নতায় ভরা তাদের মুখমন্ডল । গাঁয়ের একজন পুরানো আমলের বয়স্ক মানুষ স্পষ্টতই বললেন, “তাঁর নব্বই বছর বয়সের মধ্যে এই প্রথম ন্যক্কারজনক আগুন লাগানোর কান্ড তাঁদের গাঁয়ে দেখলেন । ইতিপূর্বে এইরকম ভয়াবহ অগ্নিকান্ড তিনি দেখেন নি” । তাঁর মতে, “ঘোড়াডাঙার বায়েন পাড়ার মানুষেরা গরীব । ঢাক ঢোল বাজানো মূলত তাদের পেশা । তারা অনেক কষ্ট সহিষ্ণুতার মধ্যে দিয়ে সংসার অতিবাহিত করে । কিন্তু তারা কোনোদিন ঘূণাক্ষরেও কারও ক্ষতি করেনি । বন্যায় তারা সর্বসান্ত হয়েছেন, কিন্তু চুরি করে খাওয়া কোনোদিন শেখেনি । জাতিতে নীচু হলেও মানবিক মর্যাদায় তারা অনেক উঁচুতে । সুতরাং কারা এইরূপ জঘন্যতম কাজ করলো তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া ভীষণ জরুরি । নতুবা গরীব মানুষগুলো নিরাপত্তাহীনতায় ভূগবেন ।“
অনলের খেমটির কথা মনে পড়তেই ঐ রাত্রিতেই ছুটলো আকন্দপুর । তার ধারণা, আগুন লাগানোর পেছনের দুষ্টুচক্রের দুর্বৃত্তরা খেমটিকেও ক্ষতি করতে পারে । তাই যতো দ্রুত সম্ভব ততো দ্রুত সাইকেল চালাচ্ছে অনল । তার এটাও ধারণা, খেমটি তাদের বাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা কিছুই জানে না । অনল কয়েকবার ফোনে খেমটির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে কানেকশন পায়নি । খেমটি অনলকে আগেই বলেছিলো, সে একাদশীর সকালে আকন্দপুরে ঢাক বাজিয়ে বাড়ি ফিরবে । অথচ এই মুহূর্তে খেমটিকে বাড়ি থাকা দরকার । আগুন লাগার ঘটনা থানায় জানাতে হবে এবং সেই ক্ষেত্রে খেমটির স্বাক্ষর জরুরি । অনল আগুন লাগার ব্যাপারটায় সন্দিহান । সে পুরোপুরি নিশ্চিত, আগুন লাগার পেছনে কোনো চক্রান্ত কাজ করছে । অনল গভীরে যতো ভাবছে, ততোই সে তাতছে । যেই ঘটনা ঘটাক, তাকে অনল খুঁজে বার করবেই । এটা তার চ্যালেঞ্জ । নিরপরাধ মানুষদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে তাদের শাস্তি দেওয়ার ধরন কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না ? এটা কী ধরনের বেলেল্লাপনা ? দুবৃত্তরা জেনেশুনে এই সময়টাকে বেছে নিয়েছে । কেননা পূজোয় ঢাক বাজাতে সকলে বাইরে । আগে খেমটিকে নিয়ে বাড়ি ফিরুক্‌ তারপর দোষীদের ধরতে অনলের চলবে চিরুনি তল্লাসী । আসল দোষীকে যেভাবে হোক সে খুঁজে বের করবেই ।
এই মুহূর্তে অনল ভাবছে অন্য কথা । খেমটি তাদের বাড়ি পুড়ে যাওয়ার ঘটনা শুনলে তার মনের অবস্থা কী দাঁড়াবে, এটা ভেবেই দুশ্চিন্তায় অনল ? তবুও তার বিপদের সময় অনল চায় সবসময় তার পাশে থাকতে । এই মুহূর্তে তার পাশে থাকাটা ভীষণ দরকার ! তারপর খেমটি বাড়ি ফিরলে, অনলের শুরু হবে দোষীকে খুঁজে বের করার নিরলস প্রয়াস ।
সাইকেল চালাতে চালাতে ভাবছে, তার সন্দেহের তীর অনেকের উপর । আগুন নেভানোর সময় গাঁয়ের প্রায় সমস্ত মানুষ ঘটনাস্থলে উপস্থিত, কিন্তু শিবদাস মোড়লকে দেখা যায়নি । নিশ্চয় তিনি হৈ-চৈ শুনেছেন । সুতরাং শিবু বায়েনের বিপদের সময় তাঁর হাজির থাকা উচিৎ ছিলো । কেননা তিনি আবার গাঁয়ের মোড়ল । অনলের সন্দেহের তীর ক্রমশ শিবদাস মোড়লের দিকে ঝুঁকছে ।
পৌঁছে গেল আকন্দপুর । গাঁয়ে ঢোকার মুখে কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ ! কুকুরগুলো অনলকে দেখতে পেয়ে তার দিকে তেড়ে আসছে । অনলের পালাবার জো নেই । দ্রুত সাইকেল চালিয়ে সোজা ঠাকুরের মন্ডপে । মন্ডপ ফাঁকা । মন্ডপের এক কোনে শুধুমাত্র খালি বিছানা পড়ে রয়েছে । অথচ খেমটি নেই । শুরু হোলো অনলের চিৎকার, “খেমটি কোথায়” ? দিশেহারার ন্যায় অনল খেমটির নাম ধরেই ডাকা শুরু করলো । অনলের আর্ত চিৎকারে আকন্দপুর গাঁয়ের লোক জড়ো হয়ে গেল ফাঁকা পূজা মন্ডপে । কিন্তু খেমটি কোথায় ? ঢাক পড়ে রয়েছে, কিন্তু খেমটি ? সে কোথায় ? বিছানা অগোছালো । বিছানায় ধ্বস্তাধ্বস্তির চিহ্ন । অনলের মাথায় হাত ! সে আন্দাজ করতে পারছে, ঘোর বিপদের ঘনঘটা । কিন্তু ঐ মুহূর্তে তার কী করণীয় অনল বুঝতে পারছে না, সে কী করবে ? অতো রাত্রিতে উপস্থিত মানুষের কাছে আকুতি-মিনতি, কেউ খেমটিকে দেখেছে কিনা ? পূজা কমিটির মানুষদের উদ্দেশ্যে অনল চিৎকার করে বললো, “খেমটিকে খুঁজে পাওয়া না গেলে তার জন্য দায়ী থাকবেন আপনারা । কিছুতেই আপনাদের দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না” ।
গাঁয়ের অল্প বয়সের বাচ্চা মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে ছুটতে ছুটতে মন্ডপে এসে পূজা কমিটির সেক্রেটারিকে বললো, “সে কালো কাপড় দিয়ে মাথা-মুখ ঢাকা কয়েকজন দুষ্টু মানুষকে নদীতে ডিঙি নৌকায় উঠতে দেখেছে” । বাচ্চা মেয়েটির মা বললেন, “ষন্ডামার্কা গুন্ডাদের দেখে তাঁর মেয়ে ভয়ে সিটিয়ে রয়েছে” ।
অনলের মাথায় হঠাৎ খেয়াল হোলো দুস্কৃতিরা খেমটিকে নিয়ে নৌকায় পালাতে পারে । সময় নষ্ট না করে ঝটপট পূজা কমিটির সেক্রেটারিকে সঙ্গে নিয়ে গাঁয়ের পল্লব কর্মকারের মোটর লাগানো ডিঙি নৌকা ছোটালো নদীর ভাটির দিকে । তার আন্দাজ, দুস্কৃতিদের বেশীদূর যাওয়া সম্ভব নয় । পূজা কমিটির সেক্রেটারি বললেন, “তিনি রাত্রি এগারোটার পর খেমটিকে খাবার জল দিয়ে গেছেন । সুতরাং অপহরণ যদি হয়ে থাকে সেটা নিশ্চয় রাত্রি বারোটার পর । কেননা তিনি নিজেও প্রায় রাত্রি সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত জেগে ছিলেন । তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে বাবলা নদী প্রবাহিত । শুতে যাওয়া পর্যন্ত নদীতে কোনো নৌকা ঘোরাফেরা করতে দেখেননি ।“
অনল মাঝিকে চাপ দিয়ে বললো, “আরও জোরে ভাই । আরও দ্রুতগতিতে নৌকা চালাও” ।
নদীতে অনেক জল । বর্ষার জল এখনও নদীতে । পুরো জল নীচে নেমে যায়নি । যার জন্য নদীতে জল যেমন বেশী, তেমনি নদীর জলে সাংঘাতিক স্রোত ।
বাজারসৌ স্টেশন পার হলেই মিঁয়া হল্ট স্টেশন । ঠিক টেঁয়া স্টেশনে ঢোকার আগে আগে বাবলা নদীর উপর রেল ব্রিজ । ঠিক সেই জায়গায় অনল লক্ষ্য করলো, একটি নৌকা ক্রমশ ভাটির দিকে দ্রত যাচ্ছে । যতোটা বোঝা যাচ্ছে, নৌকায় তিন চার জন লোক । এত রাত্রিতে জেলেরা থাকতে পারে না । অনলের সন্দেহ, দুস্কৃতিদের নৌকা ভাটার দিকে ছুটছে । অন্ধকারে নৌকার সওয়ারিদের বিড়ি খাওয়ার দৃশ্য তার চোখে পড়লো । তার বদ্ধ ধারণা, নৌকাটা দুর্বৃত্তদের । তাই নদীর জলের স্রোতের ভাটার দিকে নৌকা দেখতে পেয়ে অনল মাঝিকে বললো, “আরও জোরে প্লীজ !”
বাবলা নদীর উপর রেল ব্রিজ । মিঁয়া হল্ট স্টেশন ও টেঁয়া স্টেশনের মাঝামাঝি ব্রিজ । সেই ব্রিজ পার হওয়ার পর অনলেরা দুস্কৃতিদের নৌকার প্রায় কাছাকাছি । হঠাৎ অনলদের নৌকা লক্ষ্য করে দুস্কৃতিরা বিস্ফোরক মারণাস্ত্র বোমা প্রয়োগ করলো । তাদের নৌকা তাক্‌ করে ছুঁড়ে মারলো বিধ্বংসী বোমা । ভয়ে পিছপা হওয়ার পাত্র অনল না । তার শক্তিশালি তাগড়াই চেহারা । ভয়ডর কম । পূজা কমিটির সেক্রেটারিকে ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া দেখে অভয় দিয়ে অনল বললো, “আপনি অযথা ভয় পাবেন না । চুপচাপ বসে থাকুন । খেমটি ওদের নৌকাতে আছে” । তারপর দুস্কৃতিদের নৌকার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে অনল বললো, “তোরা জানে মরতে না চাইলে খেমটিকে ফেরত দে । নতুবা সব কটাকে জ্যান্ত জলে চুবিয়ে মারবো” ।
ঐ নৌকা থেকে দুস্কৃতিদের পাল্টা হুঙ্কার, “পারলে খেমটিকে নিয়ে পালা । তোর হিম্মত কতোটা দেখি !”
সাতপাঁচ ভাবার সময় নেই অনলের । খেমটিকে বাঁচাতে হলে যেভাবে হোক তাদের নৌকায় উঠতে হবে । তাই এক দন্ড অপেক্ষা না করে নিমেষের মধ্যে নদীর জলে ঝাঁপ দিলো অনল । একডুবে দুস্কৃতিদের নৌকা ধরে ফেললো । দুস্কৃতিদের কোনো কিছু বোঝার আগেই অনল আচমকা নৌকায় উঠে তিনটকে বেধড়ক মার । ওরা তিনজন, অথচ সে একা । ছাড়বার পাত্র নয় অনল । গাঁয়ে গঞ্জের খেটে খাওয়া জওয়ান । তার কাছে ধানাই পানাই না-পসন্দ । এলোপাথারি মেরে তিনটেকে কব্জায় এনে ফেললো । তাদের কাবু করে অনল ঐ নৌকার মাঝিকে বললো, “নৌকা ঘোরাও” ।
মাঝির নৌকা ঘোরানোর কেরামতির মাঝখানে তিনজন দুস্কৃতিই একসঙ্গে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে গেল । দুস্কৃতিদের অনল আর আটকাতে পারলো না । সেক্রেটারি ততোক্ষণে নৌকায় উঠে খেমটির মুখের, হাতের ও পায়ের বাঁধন খুলে দিলো । খেমটি অনলকে দেখামাত্র তার চোখে জল । মুখে ভাষা নেই । শুধু কাঁদছে । অনল খেমটির কাছে গিয়ে বললো, “তুমি এখন বিপদমুক্ত । নিশ্চিন্তে নৌকায় বসে থাকো” ।
পূজা কমিটির সেক্রেটারি বললেন, “আজ অনলের জন্য তোমাকে বাঁচানো সম্ভব হোলো । অনল দুস্কৃতিদের চোখ রাঙানী উপেক্ষা করে যেভাবে তোমাকে বাঁচালো, সেটা একথায় দুর্ধর্ষ” ।
এবার উজানের দিকে নৌকা ছুটছে ।
আকন্দপুর থেকে দুখানি নৌকা বোঝাই গ্রামবাসীরা অনলদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তড়িৎ বেগে এসে উপস্থিত । খেমটিকে অক্ষত অবস্থায় দেখে তাঁদের কী উল্লাস ! সেই দৃশ্য দেখে খেমটির চোখে আনন্দাশ্রু । খুশীতে গদ্‌গদ । ঢাকিদের প্রতি গ্রামবাসীদের মনবিক দিক অবলোকন করে অনল খুব গর্বিত ।
তারপর ঘোড়াডাঙার বায়েন পাড়ার ঘাটে নৌকা যখন থামলো, তখন সূর্য পূর্ব আকাশে রক্তিম আভায় পরিপূর্ণ । আলোকোজ্জ্বল সূর্যের উদয় । ঠিক সেই মুহূর্তে বায়েন পাড়ায় খবর পৌঁছালো, “শিবু বায়েন আর ইহলোকে নেই” । ভোর পাঁচটায় এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে ।
খেমটিকে সামলানো দায় ! খেমটি তখনও জানে না, তাদের বাড়ি ঘর আগুনে পুড়ে ছারখার ! অনল আগুন লাগার খবর জানাবার অবকাশ পায়নি । তার পূর্বেই বাবার মৃত্যু’র খবর ।
কুহক অনেক চেষ্টা করেও খেমটির সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে পারেনি । তাই বাধ্য হয়ে দ্বীপশিখাকে মৃত্যু’র খবরটা জানিয়ে বলেছিলো, “তুমি সত্বর আকন্দপুরে গিয়ে খেমটিকে খবরটা দিয়ে বলবে সে যেনো কলকাতায় আর না আসে । আমরা মৃত দেহ নিয়ে সকালেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছি” ।
“খেমটিদের বাড়ি আগুনে পুড়ে ছারখার” একথাটা দ্বীপশিখাও কুহককে ঐ সময়ে টেলিফোনে জানাতে পারেনি । তবে খেমটিকে কিডন্যাপিংয়ের ঘটনা তার অজানা ছিলো । মানুষ কতো নির্দয় হতে পারে, ‘খেমটিকে অপহরণ ও তাদের বাড়িতে আগুন লাগানো’ তার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ । অনল না থাকলে খেমটির হদিস পাওয়া ভগবানেরও অসাধ্য ছিলো । তাই নিজের অজান্তে দ্বীপশিখার অন্তরে গভীর ভাবনা এসে যাচ্ছে, “দেশে শিক্ষিত নারীদের নিরাপত্তা আজও তলানীতে ? নারী শিক্ষা, নারীর বিশ্বায়নের ও উন্নয়নের আন্দোলন, সবই কাগজে কলমে । বাস্তবে সবটাই অধরা । এসব কথা যতো ভাবে ততোই দ্বীপশিখা বিষন্নতায় ভোগে” ।
খেমটিকে শান্ত করার চেষ্টা করছে দ্বীপশিখা ।
দ্বীপশিখা খেমটিকে নিয়ে তাদের বাড়িতে তুললো । অনলও সঙ্গে রয়েছে । আকন্দপুরের পূজা কমিটির সেক্রেটারি তাদের সঙ্গে রয়েছেন । তিনি খেমটিদের প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল । দ্বীপশিখাদের বাড়ি আসার পথে যেভাবে হোক খেমটির কানে যায় তাদের বসত বাড়ি ঘর আগুনে পুড়ে ভস্মসাৎ । বাড়ি ঘরের খবর নেওয়ার প্রতি অযথা কৌতুহল বেড়ে গেল খেমটির । সঙ্গে সঙ্গে দ্বীপশিখাকে জিজ্ঞাসা করলো, “তাদের বাড়ির হালহকিকৎ কী ?”
একদিকে বাড়ি পুড়ে ছারখার হওয়ার খবর, অন্যদিকে বাবার মৃত্যু’র খবর । দুটোই অপ্রীতিকর খবরে খেমটির চোখে জলে । কান্নায় তার বুক ভেসে যাচ্ছে । কান্না থামানো যাচ্ছে না । এতক্ষণ অপহরণকারীদের চোখ রাঙানীতে ভয়ে সিটিয়ে নৌকায় বসেছিলো । নিজেকে বাঁচানোর মরিয়া প্রয়াস করে শেষ পর্যন্ত বিফল হয়ে ধরেই নিয়েছিলো, দুস্কৃতিদের হাত থেকে তার নিস্কৃতি নেই । অসহ্য মানসিক জ্বালা যন্ত্রণায় ছিলো বিহ্বল । তারপর অনলের অতিরিক্ত সাহসিকতার জন্য তার উদ্ধার । জন্ম ভিটায় পৌঁছানোর আগেই একের পর এক দুঃসংবাদ । দুঃসংবাদের খবরে ব্যথা, বেদনায়, মানসিক বিষন্নতায় খেমটি বিপর্যস্ত । অন্যদিকে কুহকের মা খবর পেয়েই ছুটে এসেছেন খেমটির পাশে । তিনিও সস্নেহে খেমটির মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন । খেমটি তখনও ক্রন্দনরত ।
ইতিমধ্যে অনল গ্রামের পাঁচ – ছয়জন মানুষকে নিয়ে থানায় ছূটলো । থানার বড় বাবু তখন থানার অন্যান্য পুলিশ আধিকারিকদের নিয়ে মিটিংয়ে ব্যস্ত ।
কিছুক্ষণ পর থানার বড় বাবু যখন নিজের চেম্বারে ঢুকলেন তখন অনল গ্রামবাসীদের নিয়ে বড় বাবুর চেম্বারে ঢুকে খেমটিদের বাড়ি ও পাশের আরও চারটে বাড়ি আগুনে পুড়ে ছারখার এবং খেমটিকে অপহরণের ঘটনা সবিস্তারে স্যারকে জানালো । কিন্তু থানার বড় বাবু অনলের কথা শুনে নির্বিকার । তিনি ভাবলেশহীন, খানিকটা এইরকম “ঐসব মুচি মেথরদের পাড়ায় এইসব ঘটনা অহরহ ।“ তিনি কোনো লিখিত রিপোর্ট নিলেন না বা কোনোরকম সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন না । উল্টে অনলকে শাসালেন, “তুমি কে হে ছোকড়া ! “যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়া পড়শির ঘুম নেই” । যাদের বাড়ির ঘটনা, তারা কেউ না এলে আমরা অন্য কারও কথায় আমল দিই না ।“
অনল বুঝতে পারলো, সম্ভবত দুষ্টুচক্রের সঙ্গে কিছু একটা বোঝাপড়া হয়েছে । যার জন্য বড় বাবুর শারীরিক ভাষা বুঝিয়ে দিচ্ছে, এরকম অভিযোগ আসবে সেটা তার জানা । অনলের বয়স হাল্কা হলে কী হবে, পোড় খাওয়া ছেলে । জীবনে চলার পথে অনেক প্রতিকুলতার সঙ্গে লড়াই করে তার বেড়ে ওঠা । তাছাড়া তার দুর্দান্ত প্রখর বুদ্ধি । মানুষের সঙ্গে কথাবার্তায় সেই মানুষটার ব্যাপারে ভাল-মন্দ অনেক কিছু আন্দাজ করতে পারে । আইন মোতাবেক বড় বাবু ঠিক বলেছেন । কিন্তু তাঁর ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি মধুর ছিলো না ।
অগত্যা অনলেরা ফিরে গেল ঘোড়াডাঙা ।
শিবু বায়েনের মৃতদেহ বিকেল পাঁচটায় এসে পৌঁছালো । শ্মশানে অন্ত্যেষ্ঠিক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে রাত্রি এগারোটা । শ্মশান থেকে ফিরে কুহক ও অনল পরবর্তী আলাপ-আলোচনায় বসলো । তাদের চোখ থেকে ঘুম উধাও । যতোক্ষণ পর্যন্ত আগুনের রহস্য উদ্ঘাটন হচ্ছে, ততোক্ষণ তাদের ভিতরের ক্ষোভ প্রশমিত হবে না । খেমটিকে অপহরণের সাথে আগুন ধরার গন্ধ পাচ্ছে অনল । সেকথা সে কুহককে জানালো । এদিকে পুড়ে যাওয়া বাড়িতে আপাতত বায়েন পাড়ার অন্যান্য বাসিন্দারা ত্রিপল টাঙিয়ে বসবাসের মতো করে দিলেন । খেমটির মা সেই ত্রিপলের ভিতর অসহায়ের মতো কেঁদেই চলেছে ।
পরেরদিন সকালে থানায় নালিশ জানাতে বায়েন পাড়ার মানুষ সদলবলে থানায় উপস্থিত । কিন্তু সেখানকার কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল জানালেন, বড় বাবু অন্যান্য পুলিশ আধিকারিকদের নিয়ে কোথায় গেছেন তাঁরা কেউ জানেন না । আর তাছাড়া এফ-আই-আর নেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের নেই । কখন বড় বাবু দলবল নিয়ে ফিরবেন, তাঁদের জানা নেই । সুতরাং তিনি দুঃখিত, কারণ তাঁর দ্বারা কোনো সহযোগিতা কুহকদের জন্য করা সম্ভব হচ্ছে না ।
পুনরায় থানায় রিপোর্ট না করে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে অনল ও কুহক প্রমাদ গুণতে থাকলো, “অতঃপর কী করণীয়” ?
( চলবে )