বাংলাদেশ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বর্ষ পূর্তি (একটি পর্যালোচনা) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
3728

আমরা জানি, ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের প্রাক মুহূর্তে হিন্দু ও মুসলমানদের রাষ্ট্র হিসাবে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয় এবং বাংলার পূর্ব অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয় । পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম দুই অংশের ভৌগলিক দূরত্ব ছিল দুই হাজার মাইলের অধিক । দুই অংশের মানুষের কেবল ধর্মে মিল থাকলেও জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিতে প্রচুর অমিল । পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ আনঅফিসিয়ালি (যদিও পরে আনুষ্ঠানিকভাবে) “পশ্চিম পাকিস্তান” এবং পূর্ব অংশ প্রথম দিকে “পূর্ব বাংলা” ও পরবর্তীতে “পূর্ব পাকিস্তান” হিসেবে অভিহিত হয় । রাজনৈতিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রিভূত থাকে । ফলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষেরা অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত হতে থাকে । ক্রমশঃ প্রশাসনে মতানৈক্য শুরু হয় । ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল “আওয়ামী লীগ” জয়ী হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী মেনে নেয়নি । নির্বাচনে জয়লাভের পর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠনে মত দিতে অস্বীকার করেন । একটি রাজনৈতিক দল জনগণের ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের জনাদেশ পেয়েছে । সুতরাং তারা সরকার গঠন করবে, এটাই ছিল বাস্তবতা। কিন্তু সামরিক শাসকগণ সরকার গঠন বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া পুরোপুরি বাদ দেয় । তাই জাতীয় সংসদের নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ১লা মার্চ ১৯৭১ দেশব্যাপী অসহযোগের আহবান জানান । সর্বস্তরের জনগণ একবাক্যে বঙ্গবন্ধুর এই আহবানে সাড়া দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অচল করে তোলে। ২রা মার্চ ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা প্রদর্শিত হয়। ৩রা মার্চ ১৯৭১ এ রমনা রেসকোর্স (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ এর পক্ষ থেকে ‘স্বাধীনতার ইসতেহার’ পাঠ করা হয়। এই ইসতেহারে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় । তারপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পরিচালিত সরকার জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে কোন সমাধান না দেওয়ায়, ৭ই মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু রহমান রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সমগ্র বাঙালি জাতিকে এক দিকনির্দেশনী ভাষণে সর্বপ্রকার পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হতে আহবান জানান। এই ভাষণে তিনি বলেন, ”আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল । ……… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দের ভাষণগুলির মধ্যে অন্যতম একটি হিসাবে বিবেচিত । ৭ই মার্চের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ কোন দলীয় নেতার নির্দেশ ছিলো না । ছিলো একজন জাতীয় নেতার নির্দেশ । এই নির্দেশ দেশের সর্বস্তরের ছাত্র, জনতা ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে বাঙালি সামরিক, বে-সামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী সকলকেই সচেতন করে তোলে । এর ফলস্বরুপ পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্ট রাজনৈতিক অসন্তোষ ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ অবদমনে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে নৃশংস গণহত্যা ঘটায় যা জনজীবনে “অপারেশন সার্চলাইট” নামে পরিচিত । পাকিস্তানের নির্মম অত্যাচার ও আক্রমণের পর ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেন, “এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা । আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন । বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারির মোকাবিলা করার জন্যে আমি আহ্বান জানাচ্ছি । পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে” ।
তারপর পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ যুদ্ধের সূচনা করে । তাছাড়া তদানীন্তন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সেনাবাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্টার নির্দেশ দিলে যুদ্ধ তীব্র রূপ ধারণ করে ।
বাঙালি সামরিক, আধা-সামরিক ও বে-সামরিক নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রাম থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করে । ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা । জেনারেল ও ১১টা সেক্টর কমান্ডারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে । নবগঠিত বাংলাদেশ বিমানবাহিনী পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলির উপর হামলা চালায় । ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে অস্থায়ী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শপদ নেয় এবং কলকাতা থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে । ভারতের প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রয়োজনীয় কুটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করেন । উত্তর ভারতে পাকিস্তানের বিমান হামলার পর ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে যোগদান করে । ফলশ্রুতিতে উপর্যুপরি বিমান হামলা ও বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর তৎপরতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোনঠাসা হয়ে পড়ে । অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে নয়মাস দীর্ঘ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে । দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে বিশ্বের জনবহুল দেশ হিসাবে বাংলাদেশের উত্থান ঘটে ।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বহু ত্যাগ-তিতীক্ষার বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের পর সেদিন মানুষ হাঁফ ছেড়ে নিঃশ্বাস নিয়েছিল । যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জন-স্বজনদের জন্য কেঁদেছিল চিৎকার করে । কারণ যুদ্ধের ৯ মাস তাঁদের কান্না করারও অধিকার ছিল না । এই জয়ের পেছনে রয়েছে বাঙালির বহু ত্যাগ ও নির্যাতনের ইতিহাস । তবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সেই স্বজন হারানো, সম্ভ্রম হারানোর শোক ও লজ্জাকে শক্তিতে পরিণত করে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে দেশের মানুষ । এর মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি ছিল মানুষের সৃষ্টি নানা সংকট । তবুও পিছু হটেনি । জয়ী হয়েছে শত বাধা পেরিয়ে । বাধাবিঘ্নকে পেছনে ফেলে সৃষ্টি করেছে নতুন ইতিহাস, নতুন গল্পের, নতুন জীবনের, নতুন প্রেরণার ।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন ও ভারত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন স্বাধীনতার মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার, বাংলার সবচেয়ে সমাদৃত মানুষ, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । তারপর তিনি আত্মনিয়োগ করেন দেশ গড়ার কাজে ।
শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তাভাবনা এবং তাঁর বিচার বিশ্লেষণ আজও প্রাসঙ্গিক । ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তা হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অগ্রগণ্য । ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে বাংলাদেশ অনেক উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু বঙ্গবন্ধু ধর্মবিরপেক্ষতার প্রসঙ্গে ছিলেন পরিস্কার । যার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্ম-বিরোধিতা হিসাবে দেখবার চিন্তাধারাকে মুজিবুর রহমান বিশেষ মূল্য দেন নি । ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে তিনি ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকায় বাংলাদেশের আইন সভায় ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের সংবিধান গ্রহণের সময় তিনি বলেছিলেন, “আমরা ধর্মাচরণ বন্ধ করব না………মুসলমানরা তাঁদের ধর্ম পালন করবেন………হিন্দুরা তাঁদের ধর্ম পালন করবেন……বৌদ্ধরা তাঁদের ধর্ম পালন করবেন……খ্রিস্টানরা তাঁদের ধর্ম পালন করবেন……… আমাদের আপত্তি শুধু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে ।“ বঙ্গবন্ধুর কাছে যেটা গুরুত্ব পেয়েছিলো, “ধর্মকে রাজনৈতিক কারণে বা প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে না ।“ (সূত্র ঃ আ-ব-প, ৫/২/২১)।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে সেখ মুজিবুর রহমান, তোমাকে জানাই প্রণাম ।
—————–০—————–
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী-৭৪১২৩৫ (ভারত)