“ব্রজগোপী খেলে হোরি, হোরি রে/
খেলে আনন্দ নবঘন শ্যাম সাথে / পিরীতি ফাগ মাখা গোরীর অঙ্গে/ হোরি খেলে হরি উন্মাদ রঙ্গে…” হ্যাঁ, সামনেই আনন্দময় মোহনমুরতি শ্যামসুন্দরের সাথে শ্রীরাধাসহ ব্রজগোপীদের সেই হোরি খেলার দিন।ফাল্গুনী পূর্ণিমায় হোরি বা হোলি খেলা আদপে প্রেম প্রদানের উৎসব। প্রেমের বৈচিত্র্যময় ভাবের মূর্তিমন্ত রূপই হল যেন নানান রঙের আবীর আর ফাগ। মুঠো মুঠো ফাগ ছুঁড়ে ,রঙ মাখিয়ে যেন সেই প্রেমকেই নতুন করে নিবেদন করা মনের মানুষটিকে,কাছের জনকে । প্রাণ ভরে সারাদিন অক্লান্ত হোরি খেলে খানিক জিরিয়ে নিতে দোলনায় বসে দোল খান শ্রীরাধাকৃষ্ণ। তাই ,এ উৎসবের আর এক নাম দোলযাত্রা ,একথা মনে হলেও ,আদপে সেটি নয় । উত্তরায়ণের আগমনে নতুন বছরের সূচনা রূপে আর্য ঋষিরা এই ফাল্গুনী পূর্ণিমায় বিষ্ণুর পূজা করতেন। পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চারকারী সূর্যকে সৃষ্টিকর্তা বিষ্ণুরই প্রতিভূ মেনে তাঁরা সে পূজায় নারায়ণ শিলাকে উত্তর দক্ষিণে তিনবার ঘড়ির পেন্ডুলামের মত দোল দিতেন,যাতে আগামী বৎসরেও সূর্যের যাত্রা নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হয় উত্তরায়ণ-দক্ষিণায়নকে মাধ্যম করে।আর তাই নাম দোলযাত্রা। যা হোক,চলে আসি ব্রজের হোলিতে। এই প্রেমের উৎসবের আগমণী সুর কিন্তু ফুলেরা দুজের দিনই ধ্বনিত হয়ে যায় বৃন্দাবন আর মথুরায় । ‘ফুলেরা দুজ’ হল শ্রীরাধাকৃষ্ণের দোলযাত্রা-মঞ্চের তথা দোলনা প্রস্তুতির সূচনা দিবস ;যা ফাল্গুনের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়াতে পালিত হয়। এদিন ফুলের নয়নাভিরাম সাজে সজ্জিত হন বিগ্রহগণ। মন্দিরচত্বর থেকে শুরু করে সর্বত্র ফুলের সজ্জা।মন্দিরে-মন্দিরে ,গৃহে-গৃহে হোলির গীত,নৃত্য ,নাটকের অপূর্ব উপস্থাপনা শুরু হয়ে যায় এদিন থেকেই। এরপর চতুর্থীর দিন পালিত হয় লাড্ডু হোলি।
মথুরার রাভেলের ভূস্বামী তথা রাধারাণীর পিতা ‘বৃষভানু’ কংসের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে পাহাড়ের মাথায় সুউচ্চ স্থানে প্রাসাদ গড়লেন । নতুন জনপদ ‘বৃষভানুপুর’(এরই অপভ্রংশ বর্ষাণা)-এর পত্তন হল।সেসময় কংসের নানান অত্যাচারে একইভাবে অতিষ্ঠ নন্দগ্রামবাসীরাও।রাজা বৃষভানু আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর বন্ধু নন্দরাজা তথা শ্রীকৃষ্ণের পিতাকে; বললেন, নন্দগ্রামবাসীসমেত বৃষভানুপুরে এসে বাস করতে ।এই বসন্ত চতুর্থীর দিনেই নাকি গোপীগণের চিত্তহারী-চপল-চটুল- নওলকিশোর নন্দকুমার কৃষ্ণ তাঁর গ্রাম নন্দগাঁও থেকে রাধারাণীর গ্রাম বর্ষাণায় এসেছিলেন ।তখন তাঁদের আতিথেয়তা করা হয়েছিল লাড্ডু খাইয়ে।আর তাই,সেদিনের সেই আনন্দ দিবসের স্মরণে আজও বর্ষাণায় লাড্ডু তো খাওয়া হয়ই,তার সাথে চলতে থাকে একে অপরকে লক্ষ্য করে লাড্ডু ছোঁড়াছুঁড়ির পালা;যা লাড্ডু হোলিতে পর্যবসিত হয়।সত্যি,এহেন মিষ্টিমধুর আনন্দময় উৎসব ভারতভূমিতেই বুঝিবা সম্ভব।
ঠিক পরদিন, বসন্ত পঞ্চমী তিথিতে বর্ষাণায় পালিত হয় লাঠমার হোলি , অর্থাৎ লাঠি দিয়ে মারের হোলি। পড়তে অদ্ভুত লাগছে তাই না! যদি এমন পরিস্থিতি আসে যে পুরুষরা কোন বিশেষ কার্যে গ্রামে নেই, আর হঠাৎ,কংসের অত্যাচারী দুষ্টু পেয়াদারা এল বর্ষাণায়। তখন মহিলারা আত্মরক্ষা করবেন কীভাবে(!) –তার মহড়া শুরু হল সেখানে। গোপিনীরা লাঠি দিয়ে মেরে শক্তি প্রদর্শন করলেন ,আর মার খেলেন মাথায় বালির বস্তা ,হাতে ঢাল নিয়ে গোপেরা dummy সেজে। মহিলাদের সেই লাঠিখেলা আজও অব্যাহত হয়ে পালিত হয় এই লাঠমার হোলির দিন।তবে তাতে লেগেছে উৎসবের আবেশ,আমেজ আর আনন্দ। কারণ, শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর সখারা জোর করে রঙ মাখিয়েছিলেন শ্রীরাধাসহ তাঁর সখীদের। ছদ্ম প্রণয়কোপ প্রকাশ করতে প্রফুল্লিত গোপিনীরা হাতে তুলে নিয়েছিলেন লাঠি। সেই স্মৃতিতেই তো আজও নন্দগ্রাম থেকে পুরুষরা রঙ মাখাতে আসেন বর্ষাণার মহিলাদের। আর মহিলারা লাঠমার দেন মাথায় ছোট বস্তা বাঁধা,মাটির ঢাল হাতে সজ্জিত পুরুষদের।লাঠির ঘায়ে একজনের ঢাল ভেঙ্গে গেলে,অপরেরটা কেড়ে আত্মরক্ষা করে সে।এভাবে চরম হাসাহাসি,আনন্দ, উৎফুল্লতার মধ্য দিয়ে এই হোলি পালিত হয়।
তারপর ,মূল হোলির উৎসব আগত হয়;বসন্ত পূর্ণিমার শেষলগ্নের দিন তা পালিত হয়। কথিত আছে, নব-নীরদ-বরণ শ্রীকৃষ্ণকে সান্ত্বনা দিতে মা যশোদা তাঁর হাতে রঙ দিয়ে বলেছিলেন, গৌরবর্ণা রাধার গাত্রে লেপন করে তাঁকে নিজের মত এক বর্ণের করে নিতে। সবান্ধব শ্রীকৃষ্ণ লুকিয়ে ছুঁড়লেন রঙ রাধা ও তাঁর সখীদের লক্ষ্য করে। গোপিনীরাই বা দমবেন কেন! তাঁরাও কলসে কাদামাটি গুলে তৎক্ষনাৎ দিলেন ঢেলে কানু আর তার গোপসখাদের মাথায়। ব্যস,মাখামাখি ,হাতাহাতি আনলো হাস্য-পরিহাস আনন্দের বন্যা। সেই থেকে রঙ দেওয়া-নেওয়া খেলার শুরু হয়ে গেল।
ফাগু খেলিতে ফাগু উঠিল গগনে।
বৃন্দাবনের তরুলতা রাতুল বরণে ।।
আবীর ,রঙ,ফাগের স্নানে সমগ্র বৃন্দাবন রেঙে ওঠে । রঙ তো নয় ,যেন হাতভর্তি মুঠো মুঠো ভালোবাসা অর্পিত হয় একে অপরের প্রতি। বর্ণবিদ্বেষকে যেন এক লহমায় ধূলিসাৎ করে দেবার দ্যোতক এই দোল উৎসব। মানবের মহামিলনের ,মহানন্দের হাট বসে যেন। আবার ,এই ফাল্গুনী পূর্ণিমাতেই তো শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলিত বিগ্রহ তথা মধ্যযুগের বাঙলার নবজাগরণের নায়ক শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মহাবির্ভাব মর্ত্য মাঝে। সেটা ছিল ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে ফেব্রুয়ারী ,শনিবার। তাই, সব মিলিয়ে ফাল্গুনী পূর্ণিমা এক বিশেষ মাহাত্ম্যপূর্ণ মধুময় তিথি ভারতবর্ষের ইতিহাসে।
ভক্তকৃপাপ্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক