মৃত্যু যদি হরিণীর মতো নিমগ্ন হয় : নিমাই জানা।

0
462

কবি শুভঙ্কর দাস এর কাব্যগ্রন্থ “” মৃত্যুর দরজা ঠেলে””পাঠ করার পর যে কয়েকটি রেণু আমার চোখে লেগেছে, তার বাতাস আপনাদের সাথে ভাগ করে নিলাম ।

প্রতিটি আত্মা চিন্ময় । মৃত্যুর পর শুদ্ধ বৈষ্ণবের শরীর কখনো জড় পদার্থ হয়না । সম্পূর্ণ শুদ্ধ গুরুদেবের নির্দেশ পালনের পর যিনি মৃত্যুর কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করেন , তার দেহ ও শরীর চিন্ময়ত্ব প্রাপ্ত হয় । একথা শ্রীমৎ ভগবত গীতা তে ঈশ্বর নিজেই বলেছেন । মৃত্যু একটি অসীম গন্তব্য । মৃত্যু এক রঙিন কার্যক্রমের শেষ ধাপ আমি মনে করি মৃত্যু আসলে একটি নিঃশব্দ জন্মের সৃষ্টি । যার প্রতিভূ স্বরূপ নদী বয়ে যায় , কুকুরের হাই ওঠে , নদীর জলে স্তনের চিহ্ন থাকে , নদীকে বয়ে যেতে দিতে হয় সম্মোহনের কাছ পর্যন্ত । তবেই নদী একটি চাষী কন্যা হয়ে ওঠে । মুনিঋষি ধ্যান করলেও তিনি পরমায়ু খুঁজে চলেন বাল্মিকী হওয়ার আগে পর্যন্ত

কবি শুভঙ্কর দাস এর অনন্য বাস্তবধর্মী কবিতার কাব্যগ্রন্থ ” মৃত্যুর দরজা ঠেলে ” পড়তে পড়তে তাই মনে হয়েছে আমার ।দেবী যখন খড়ের মূর্তি হয়ে ওঠে তার মাটির স্তনের নিচে অনেক ইলোরা জন্মায় । যার মধ্যে ও তিনি সম্মোহন দেখেন । তার থেকে মৃত্যুকে কয়েক ডেসিমিটার দূরেই বসিয়ে রাখেন । চোখের নিচে মাখনের মত ভোরবেলা দেখেন । গভীর ঘুমের পর যখন ঘুম ভেঙ্গে উঠে পড়ে মানুষ ,গত জন্মের কথা ভুলে যায় । গত জন্মের মাহাত্ম্য ভুলে যায় । কিছুই মনে থাকে না ।পূর্ব জন্মের গর্ভস্থ কথা ।

ভিখারির হাতে জমানো মুদ্রার নিচে অনন্তকাল দেখতে পান । অনন্ত শয্যা । বিষ্ণুদেব শুয়ে থাকেন । দরজা তো আসলে চোখের উপ পল্লবের মত অথবা জমাট ঝাউ পাতার মত । যারা একটি কুরুক্ষেত্রের জন্য অপেক্ষা করে উপকূলে যদি দেখতে পাই সৃষ্টি অথবা উর্বরতা ঝাউ পাতার নিচে জাগ্রত কামনাকে বয়ে নিয়ে যায় , তবেই তো মৃত্যু দরজার প্রথম ধাপের উত্তরণ ঘটে যায় । নদীকে তাই নারী ভাবতে হবে । আবার কোন নারী যদি নিজের ভেতর পুরুষত্ব অথবা বীর্যবান মনে করে তখন সে নদ । তার পেটের তলায় অজস্র ক্রিয়াপদ । অজস্র গভীর রাত্রির কামনার শব্দবন্ধ বয়ে যায় মোহনায় ।

কবি মৃত্যুকে বড় স্পর্শকাতর’ করে তুলেন নি( ” আমি নিজেকে সংগ্রহ করি , করতে থাকি ইচ্ছা মৃত্যু পর্যন্ত “) । রাত্রির গভীরে একাকী মহাশূন্যকে দেখতে থাকেন নিজের নাভির উপর , যেভাবে সন্ন্যাসীরা উড়ে যায় আকাশের দিকে । (” প্রতিটি শিকলের দাগ কে রূপকথার নটে গাছ করে দেবে”) আমরা সকলেই আততায়ী । নিজেরাই পোশাক পরি । নিজেরাই পোশাক খুলে রাখি গাছের তলায় । নিজেরাই সম্রাট সাজি , নিজেরাই ভিক্ষুক হয়ে পড়ি মঞ্চের ওপর । নগ্ন হয়ে নিজেরা নিজেদের কাছে দোমেটে ঈশ্বরী অথবা জনৈক ঈশ্বর হয়ে পড়ি । নিজেরাই নিজেদের জ্যা কে টেনে যোণীরেখা তৈরি করি ।

মৃত্যু তিনি দেখেন না তিনি মৃত্যুকে সৃষ্টি করেন ।সৃষ্টির নাভিপদ্ম দেখেন উপবৃত্ত পথে । পালতোলা নৌকাকে নিয়ে গভীর সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে লক্ষ রাখেন ওয়াচ টাওয়ার থেকে গোপন সংকেতের জন্য । গুহা থেকে তিনি নিমগ্নতাকে অপেক্ষা করেন । কেউ ঈশ্বর ভাবেন এই একাকীত্ব কে ।যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কবিতা পাঠ করা যায় , যাকে রক্তমাংসের প্রতিবেশী অথবা সংসার সদস্য ভাবা যায় । কেন মৃত্যুর মতো নটে গাছ । নিজের আত্ম রেখা এটাই । আসলে শ্মশানের চৌকাঠ তো বিচিত্র রঙিন । যাকে নদীর সঙ্গমে নিয়ে যেতে হয় । চাঁদ থাকে । জ্যোৎস্না থাকে । ধান থাকে । মা থাকে ।( “”মৃত ক্রিয়াপদ জড়িয়ে ধরে পুরুষের হাত
নিজেই মায়া , হেসে ওঠে ঈশ্বর””)
জোনাকির জন্য এত পথ ‌ যে নিয়ে যায় স্পর্শ আর বেল পাতার পবিত্রতার কাছে ।নৌকা চলে মৃত্যুর জন্য অনুরক্ত প্রেম নিয়ে ।তবেই””( মৃত্যুকে খেলনা করেছি মাত্র “”)কবির কথায় মৃত্যু আসলে একটি জমাট লিপিড ক্ষেত্র । আরেক ক্ষেত্রে আবিষ্কারের অনন্ত বিন্দু শূন্যতার ভেতর বসিয়ে অনন্তের ভগ্নাংশ তৈরি করে যাওয়া । দরজাটি আবৃত ভগ্নাংশ হয়ে ওঠে । মুখোমুখি পান্ডুলিপি পড়তে পড়তে মৃত্যু নেমে আসে । মৃত্যুর অবান্তর সহবাসে শরীর জেগে ওঠে , জ্বর আসে , বিছানা থেকে উঠে পড়েন কৃষ্ণ ঠাকুর । হাতে ত্রিশূল অথবা বাঁশি যে শুধু সম্মোহন জানে । দরজাটির উপর কয়েকটি পাপড়ি পাশাপাশি শুয়ে থাকে উপ নারীর মতো । যাকে অতিক্রম করা যায় না, তাকে নিজের বুকপকেটে রাখতে হয় প্রিয় মানুষটির মতো । অনেক অনেক পথ পেরিয়ে যায় নিঃশব্দে । আর যে কেবল বুকের এক্স রশ্মি জমা রাখে কয়েকটি ছায়ার ভিতর । এই কি আসলে উত্তরণের জায়গা ।””( বসুধা দেখে যা ,আমি কেমন ঈশ্বর গড়েছি “”)

অসাধারণ একটি কাব্যগ্রন্থ পড়লাম । সত্যি মৃত্যুর দরজা ঠেলে যে তীর্থক্ষেত্র পাই তা তো অবিনশ্বর ৫১ তীর্থক্ষেত্রের মত । সকল পাঠক অবশ্যই বইটি সংগ্রহ করে পড়বেন এই কামনা করি ।

কাব্যগ্রন্থ :: মৃত্যুর দরজা ঠেলে
কবি — শুভঙ্কর দাস
প্রচ্ছদ দেবাশীষ সাহা
প্রকাশক:: দি সি বুক এজেন্সি
কলকাতা
মূল্য:: ৮০ টাকা