ভগবানও কী ভক্তের ভালোবাসা চান? : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।।

0
970

ভক্ত যেমন ভগবানকে ভালোবাসেন, ভগবানকে সেবা করতে চান , তেমন কী ভগবানও ভক্তের ভালোবাসার কাঙাল হয়ে তাঁকে পেতে চান? ভগবানও বুঝি বা ভক্তের সঙ্গছাড়া হতে চান না, ভক্তের থেকে দূরত্ব পছন্দ করেন না, ভক্তের থেকে পাওয়া অবহেলা তাঁর প্রাণেও ব্যথা দেয় ! তিনিও কষ্ট পান! পাঠক বন্ধুরা আসুন, এমনই এক ঘটনা আমরা আজ জানবো।

শ্রীনিত্যানন্দের পার্ষদ , দ্বাদশ গোপালের অন্যতমজন হলেন শ্রীসুন্দরানন্দ ঠাকুর। তিনি ছিলেন ব্রজলীলার সুদাম সখা। সেই সুন্দরানন্দের শিষ্য হলেন পানুয়া গোপাল । পান বিক্রি করে বিগ্রহ সেবা দিতেন ও সংসার নির্বাহ করতেন বলে সকলে তাঁকে পানুয়া বা পর্নি গোপাল নামে সম্বোধন করতো। ওই নামেই প্রসিদ্ধ ছিলেন তিনি। তাঁর আসল নাম শ্রীগোপালচন্দ্র। পিতার নাম ছিল শ্রীমনসুখ। ভগ্নি মাধবী ও পত্নী লক্ষ্মীপ্রিয়াকে নিয়ে তাঁর সংসার। কোন সন্তানাদি ছিল না।

একদিন এক সন্ন্যাসী গোপালচন্দ্রের গৃহাঙ্গনে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি মস্তকে করে বয়ে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর সেবিত অপূর্ব দর্শন বিগ্রহ এক। বিগ্রহের ভুবন মোহন রূপ দর্শন করে গোপালচন্দ্র মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সন্ন্যাসী নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে যা জানালেন তা হচ্ছে এই— দ্বাপর যুগে ক্ষুধার্ত শ্রীশ্রীবলরাম-কৃষ্ণকে অন্ন দিয়েছিলেন যে যজ্ঞপত্নীরা , তাঁদেরই একজনের কুলের সন্তান তিনি।সেইসব যজ্ঞপত্নীদের বংশের আরাধ্য ছিলেন শ্রীশ্রীবলরাম-কৃষ্ণ। সন্ন্যাসীর বংশের কোনো এক মহাজন সর্বদা আক্ষেপ করতেন যে শ্রীকৃষ্ণের কালে জন্ম না হওয়ায় কানাই-বলাইকে চাক্ষুষ দর্শন করা সম্ভব হল না তাঁর। জন্মই বৃথা এ কথা ভেবে প্রতিদিন তিনি যমুনার তীরে বসে অশ্রুজল ফেলতেন আর মা যমুনাকে মনে মনে প্রার্থনা জানাতেন এই বলে যেভাবে হোক একবার অন্তত কানাই-বলাইকে দর্শন করার সৌভাগ্য প্রাপ্ত করিয়ে দেবার জন্য।
একদিন যমুনাদেবী প্রসন্ন হলেন। বললেন, “তোমার প্রার্থনায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি‌। যে কারণে তুমি আমায় ভজনা করো প্রতিদিন ,তা আমি পূরণ করবো অবশ্যই। তবে একালে তো শ্রীশ্রীরাম-কৃষ্ণের লীলা তাঁদের সশরীরে আর হবে না, তাই তাঁদের তুমি বিগ্রহ রূপে দর্শন করবে । দ্বাদশ বন পরিক্রমা কর। পরিক্রমা কালে পথেতেই তুমি বিগ্রহ প্রাপ্ত হবে।”
বিপ্র ভাবলেন,”আমাকে তো গোপেশ্বরও একই কথা বলেছিলেন, বিগ্রহ সেবা দিতে। তবে তো দু’জনের আজ্ঞা মিলে গেল। আমি আগামীকাল প্রভাতেই পরিক্রমা শুরু করে দেব তাহলে।”

এরপরই ৮৪ক্রোশ ব্রজপরিক্রমা শুরু করলেন তিনি । পথে সত্যিই একদিন বিগ্রহ প্রাপ্তি হল বনের মধ্যে। প্রবেশ অতি দুর্গম, কিন্তু স্নিগ্ধ, শীতল, ছায়া সুনিবিড় ,মনোরম বনের মধ্যে বৃক্ষকোটরে ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায় মনোরম ঠামের সুদর্শন শ্যামচাঁদ ও বলরাম বিরাজ করছিলেন‌ । যমুনা দেবীর কথামতো বিগ্রহ নিয়ে চলে এলেন উল্লসিত বিপ্র। নিজগৃহে সেবা দিতে শুরু করলেন তিনি।

তারপর ৮১ পুরুষ ধরে সেই বিগ্রহ সেবা চললো । এখন কাম্যবনবাসী এই সন্ন্যাসী , নাম– ‘ধ্রুবানন্দ গোস্বামী’, বিগ্রহকে মস্তকে নিয়ে ভ্রমণ করে বেড়ান আর মাধুকরী করে সেবা দেন।

ধ্রুবানন্দ গোস্বামীর ইতিহাস জেনে পুলকিত হলেন গোপালচন্দ্র। তিনিও নিজের বংশ পরিচয় দিলেন ও জানালেন যে ঠাকুর সুন্দরানন্দের শিষ্য তিনি। সন্ন্যাসী ও গোপালচন্দ্রের মধ্যে বেশ মিত্রতা গড়ে উঠলো। ধ্রুবানন্দ ভাবলেন—“এই গোপালচন্দ্র তো বৈষ্ণব। তাঁকে বড় ভাল মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। যদি এর কাছে বিগ্রহ রেখে আমি তীর্থ করতে যাই তবে কেমন হয়!”

তিনি বললেন—-“গোপালচন্দ্র ,তুমি যদি কিছু দিনের জন্য আমার বিগ্রহদের তোমার কাছে রাখো , তবে আমি নীলাচলে শ্রীজগন্নাথ দর্শন করে আসতে পারতাম।”

গোপালচন্দ্র সাগ্রহে রাজি হয়ে গেলেন এমন প্রস্তাবে। তিনি যে প্রথম দর্শনেই মন দিয়ে ফেলেছেন শ্যামচাঁদের চরণে। এ যে তাঁর মনের লালিত আশা পূরণ হবার সুযোগ এল—–শ্যামচাঁদকে বুকে আগলে ধরার, তাঁকে একটু সেবা করার,কাছে পাবার ।

সন্ন্যাসী বললেন—-“শোনো, আমি কিন্তু বড় জোর চার মাস পরেই ফিরে আসবো । তখন কিন্তু আমার বিগ্রহ আমায় ফিরিয়ে দিও।”

গোপালচন্দ্র লাজুক মুখে সম্মতির মাথা নাড়লেন হেসে; ভাবখানা তাঁর এমন—“কী যে বলেন! আপনার বিগ্রহ আপনাকে ফেরৎ না দিয়ে পারি!”

সন্ন্যাসী—“তবে একটা কথা বলবো, কিছু যদি মনে না করো?”

গোপালচন্দ্র—“নিশ্চিন্তে বলুন”।

সন্ন্যাসী—“তুমি তো দেখছি পরম বৈষ্ণব ! কিন্তু তোমার সেবা নেই কেন এখনও?”

গোপালচন্দ্র—“আমার শ্রীগুরুদেব যখন আমায় দীক্ষা দিয়েছিলেন তখনই সেবার জন্য নিবেদিত করেছিলেন আমায় । বলেছিলেন, দৈবক্রমে আমি নাকি নিজেই একদিন সেবার অধিকারী হব। তার জন্য আমায় কোন প্রচেষ্টা করতে হবে না। ভগবান নিজেই সেবা নিতে হাজির হবেন আমার কাছে। শ্রীগুরুদেবের বাক্য অনুসারে তাই আমি এখনও পর্যন্ত কোন উদ্যোগ নেইনি সেবা স্থাপনের।”

গোপালচন্দ্রের মুখে সে কথা শুনে কেমন যেন মৌন হয়ে গেলেন সন্ন্যাসী। তিনি যেতে যেতে ভাবলেন—“আমার ভাগ্য আবার বিরূপ হবে না তো ! আমি আবার আমার শ্যামচাঁদকে ফিরে পাবো তো!”
তিনি কিছুদুর গিয়ে আবার ফিরে এলেন বিগ্রহ নিতে। গোপালচন্দ্র সন্ন্যাসীর দ্বিধার কথা জেনে আশ্বস্ত করলেন তাঁকে; বললেন—-“আপনি কোন সংশয় রাখবেন না মনে । নিশ্চিন্তে তীর্থ ভ্রমণ করুন । আমি আপনার বিগ্রহ আপনাকে ফেরত দিয়ে দেবো ,কথা দিচ্ছি।”
সন্ন্যাসী তখন হৃষ্ট চিত্তে রওনা হলেন নীলাচলের উদ্দেশ্যে।

গোপালচন্দ্র প্রেমসেবা শুরু করলেন শ্যামচাঁদের। শ্যামচাঁদকে সুন্দরভাবে সেবা দেবার জন্য এবার তো একটু বেশি অর্থ উপার্জন করার দরকার‌। তাই তিনি গ্রামের নৈঋত কোনে পানের বরজ তৈরি করলেন। একটু বেশি পান বিক্রি করার দরকার‌। কিন্তু, কী আশ্চর্য! যেদিন পান চাষ শুরু করেছেন, তার ঠিক মাত্র ১৫দিনের মাথাতেই বরজ ভরে গেল সুন্দর-সুন্দর , বড়-বড়, সবুজ , রসালো ,তাজা-তাজা পানে। গ্রামের লোকেদের বিস্ময়ের সীমা রইল না এমন অসম্ভব ঘটনা কী ভাবে ঘটলো ভেবে‌। সেই বরজের পান প্রতিদিন এক ঝুড়ি করে ভরে বহু দূরে অন্য গ্রামে বিক্রি করতে যেতেন গোপালচন্দ্র । বিগ্রহ সেবার কোন ত্রুটি যাতে না হয় ,তার জন্যই তাঁর এত পরিশ্রম। শ্যামচাঁদের কোন কষ্ট তিনি হতে দেবেন না এই তাঁর পণ। ২৫ ক্রোশ দূরের পঞ্চকোটের পথ তিনি পায়ে হেঁটে যেতেন, সব পান বিক্রি করে আবার ফিরে আসতেন ওই দিনই অবলীলায়। কিভাবে যে অতখানি পথ যাওয়া-আসা করেন তা ভেবে সকলে বিস্মিত হত। তখন থেকে লোকে তাঁকে পানুয়া গোপাল, পর্ণি গোপাল বা পানু—এসব বলে ডাকতে থাকলো। ধীরে ধীরে লোকে বুঝলো যে পর্ণি গোপাল হেঁটে যান আর তাঁর মাথার পানের ঝুড়িটি বহন করেন স্বয়ং শ্যামচাঁদ । কারণ, অনেকেই লক্ষ্য করলো যে পানুয়া গোপালের মস্তকের বোঝা তাঁর মস্তককে স্পর্শ করে না , সামান্য একটু ওপরে থাকে। অথচ গোপালচন্দ্র তো দু’হাতে ঝুড়ি ধরে থাকেন । আর, তিনি চলেন, সাথে সাথে ঝুড়ি চলে । গোপালচন্দ্র ভাবেন তিনি বইছেন। তবে মাঝে মধ্যে মনে মনে অবাক হন এই ভেবে যে, যত বেশি করেই পান ভরেন না কেন ঝুড়িতে, ঝুড়ি যেন ভারীই হয় না ,একই রকম হালকা মনে হয়। আবার পান বিক্রি করে তিনি যে ধন পান তা দিয়ে সেবার দ্রব্যসামগ্রী কিনে যখন ঝুড়িতে বোঝাই করেন তখন তা দ্বিগুণ পরিমাণ হয়ে যায়, পথে যেতে যেতে চতুর্গুন হয়, আর যখন ঘরে ঝুড়ি নামান তখন শতগুণ পরিমাণে দাঁড়ায় যেন! পত্নী লক্ষ্মীপ্রিয়া সেসব দিয়ে ভোগের আয়োজন করেন। ফল,মিঠাই, দুধ,দই,ছানা, ঘি,মাখনে ঘর ভরা থাকে সবসময়। সকাল বেলায় ঘুম ভাঙার পর ছানা, সন্ধ্যাবেলায় শীতলভোগ ,নানা ধরনের মিষ্টি,বিবিধ ব্যঞ্জন সহ মধ্যাহ্নভোগ , শেষে কর্পূর সহ পান ইত্যাদি নানা প্রকার আয়োজন করেন শ্যামচাঁদের জন্য লক্ষ্মীপ্রিয়া। সেবা দিতে একটু দেরি হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি ঠাকুর ঘরে এসে দেখেন ক্ষিদেয় শ্যামচাঁদের মুখ শুকিয়ে গেছে না তো! তিনি কষ্ট পাচ্ছেন না তো খাবারের জন্য! কখনো আবার শ্যামচাঁদ নিজেই স্বপ্নে এসে এটা-সেটা খেতে চেয়ে বায়না করেন। “মা ,কাল সকালে কিন্তু ক্ষীর খাওয়াবে আমায়, বলে দিলাম”—এভাবে আবদার করেন আর পরম সুখে লক্ষ্মীপ্রিয়াও যোগান দেন।

দেখতে দেখতে সন্ন্যাসী ফিরে আসার চার মাসের জায়গায় চার বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল সময় । হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাকালে সন্ন্যাসী ফেরৎ এলেন । গোপালচন্দ্র এবং তাঁর পরিবারের সকলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। ব্যাকুল ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন তাঁরা। শ্যামচাঁদ ছাড়া তাঁরা বাঁচবেন কেমন করে ভেবে! সন্ন্যাসী অত্যন্ত রুষ্ট হলেন তাঁদের সকলের অমন দুঃখে ভেঙ্গে পড়া দশা দেখে। ক্রোধবশতঃ তিনি সেদিন রাত্রে কিছুই নিলেন না মুখে। শত অনুরোধেও নিলেন না প্রসাদ। জল পান করে সারা রাত পার করলেন। আর, ঘোষণা করে দিলেন যে প্রভাত হলেই শ্যামচাঁদকে নিয়ে রওনা হয়ে যাবেন তিনি।
প্রভাতকালে গোপালচন্দ্র অনুনয়ের সুরে ,মিতা বলে ডেকে অনেক সাধলেন সেই সন্ন্যাসীকে যাতে আর কয়েকটা দিন অন্ততঃ তিনি তাঁদের গৃহে থেকে যান। তাহলে সে কটা দিন অন্তত নয়নভরে তাঁরা দর্শন করে নেবেন শ্যামচাঁদকে আর, আরও একটু সেবা করে নিতে পারবেন । কিন্তু, প্রচণ্ড অসন্তুষ্ট হলেন সন্ন্যাসী ধ্রুবানন্দ এ অনুরোধে । কোন কথাই শুনলেন না। নির্মম , নির্দয়ের মত আচরণ করে শ্যামচাঁদকে মাথায় নিয়ে হাঁটা লাগালেন তিনি। পানুয়া গোপাল ও তাঁর পরিবার সন্ন্যাসীর পিছন পিছন যেতে থাকলেন। শেষে শ্যামচাঁদের বিরহ ভার আর হৃদয়ে ধারণ করতে না পেরে পানুয়া গোপাল সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন । পরিবারের সকলে তাঁকে নিয়ে তখন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ।আর এদিকে সন্ন্যাসী অনেকটা হেঁটে যাবার পর শ্যামচাঁদসহ দৃষ্টিপথের আড়াল হয়ে গেলেন।

ব্রজতে যখন অক্রুর শ্রীকৃষ্ণ-বলরামকে নিয়ে মথুরা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন , সেসময় গোপিনীদের ,ব্রজবাসীদের যে দশা হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণ-বলরামের বিচ্ছেদে, তেমন দশা হল পানুয়া গোপাল ও তাঁর পরিবারের । মাটিতে পড়ে থেকে অশ্রু ত্যাগ করেন, কখনো বা উদাস নয়নে পাগলের মত বসে থাকেন স্থির দৃষ্টিতে। রান্না-খাওয়া সব শিকেয় উঠলো।

ভক্ত দুঃখে দুঃখী হলেন ভগবান । ভক্তের কষ্ট তো তাঁকে লাঘব করতেই হবে। ভক্ত বিনোদনের জন্যই তো তাঁর যাবতীয় প্রচেষ্টা ! আর ,তাই করলেন এক অপূর্ব লীলা। হঠাৎ প্রচন্ড ভারী হয়ে গেলেন বিগ্রহ । সন্ন্যাসী আর বইতেই পারছিলেন না মাথায় করে। তিনি ভাবলেন–“গোপালচন্দ্রের গৃহে ঘি, দুধ ,ছানা, মাখন খেয়ে বিগ্রহ এমন ভারী হয়ে গেছেন বুঝি! কি অবস্থা চলতেই তো পারছি না! অথচ, এই বিগ্রহ মাথায় করেই তো চিরটাকাল ভ্রমণ করলাম!” তাঁর কাছে মাত্র দুই ক্রোশ দূরত্বও যোজন-যোজন মনে হল যেন। রাত্রে তিনি স্বপ্নে দেখলেন শ্যামচাঁদ বলছেন ,”ওরে ,এবার আমায় গোপালের কাছে দিয়ে আয়। তারা আমার জন্য অন্নজল ত্যাগ করে বসে আছে। আমি কি করে থাকবো তাদের ছেড়ে । তাদের প্রেমডোরে আমার দু-পা এখন বাঁধা পড়েছে, দ্যাখ।” নিদ্রা ভেঙে গেল সন্ন্যাসীর । তিনি ভয়ে কাঁপতে থাকলেন । আবার ভাবলেন ,বুঝিবা নিজের মনের দোষ । কিন্তু, একই স্বপ্ন তিন-তিনবার দেখলেন । এবার সন্ন্যাসী বুঝলেন যে , না , আর তো শ্যামচাঁদকে নিজের কাছে আগলে রাখা যাবে না । শ্যামচাঁদের মন পানুয়া গোপালকে চায়, তাঁকে নয়। প্রভাত হতেই তিনি আবার ফেরত যাত্রা করলেন মঙ্গলডিহির উদ্দেশ্যে।

রাত্রে শ্যামচাঁদ স্বপ্ন দেখালেন পানুয়া গোপাল ও তাঁর স্ত্রী লক্ষীপ্রিয়াদেবী দু’জনকেই। পানুয়া দেখলেন শ্যামচাঁদ বলছেন, “গোপাল আমি তোমার কাছে ফেরত যাচ্ছি । কাল সকালে এগিয়ে এসো পথেতে, আমায় নিতে। একে মিথ্যা স্বপ্ন ভেবো না । আমি কিন্তু সত্য বচন বলছি ;বিশ্বাস করো!” আর লক্ষ্মীপ্রিয়াকে শ্যামচাঁদ বললেন , “মাগো, আমি আজ কদিন ধরে উপবাসী রয়েছি। তোমার হাতের রান্না আর পানুয়ার উপার্জিত ধন ছাড়া আমার আর অন্য কারোর সেবা ভালো লাগে না ।সন্ন্যাসী আমায় জোর করে এতদিন ধরে রেখেছে। আমি এবার ফিরছি তোমাদের কাছে । তোমার পতিদেবকে কাল সকালে আমায় আনতে পাঠাবে পথে।”

পানুয়া গোপাল আর তাঁর স্ত্রী চোখের জল ফেলতে ফেলতে ভূমিতে পড়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন রাত্রে। দু’জনাই স্বপ্ন দেখে জেগে বসলেন। একে অপরকে নিজেদের স্বপ্নের কথা বললেন। আর, তারপর সকাল হবার অপেক্ষায় বাকি রাত জেগে কাটালেন তীব্র উত্তেজনা আর উৎকন্ঠায়।

সকালবেলায় স্নান সেরে নতুন বস্ত্র পরে গোপাল এগিয়ে গেলেন পথে । হাঁটতে থাকলেন । সত্যিই ওদিক থেকে শ্যামচাঁদকে নিয়ে সন্ন্যাসী ফেরৎ এলেন। পানুয়া গোপালের হাতে বিগ্রহ সমর্পণ করে দিলেন সন্ন্যাসী ধ্রুবানন্দ। তারপর নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করতে করতে, অশ্রুজল ফেলতে ফেলতে ফেরৎ গেলেন কাশীপুরে। ৮১ পুরুষের সেবিত বিগ্রহ কোলছাড়া করে অন্যকে রাখতে দিলেন—তাই বুঝিবা এমন দুর্দশা হল! বিগ্রহ অন্যের হয়ে গেলেন—এসব ভেবে ধিক্কার দিতে লাগলেন নিজেকেই তিনি।

শ্যামচাঁদকে ফিরে পেয়ে মহোৎসব করলেন পানুয়া গোপাল । আনন্দের হাট বসলো মঙ্গলডিহিতে। লক্ষ্মীপ্রিয়াদেবী শ্যামচাঁদের চরণে পড়ে মিনতি জানালেন— প্রভু, আর কখনো যেন এ গৃহ ছেড়ে তুমি যেওনা কোথাও। যদি ভবিষ্যতে আমাদের দ্বারা তোমার সেবা-পূজায় কোন ত্রুটি হয় ,তবে তুমি শাসন করবে, চরম শাস্তি দেবে । কিন্তু, এই গৃহের বাইরে তুমি কখনো যাবে না । এই প্রতিজ্ঞা তোমায় করতেই হবে আজ আমার কাছে । বলো , না হলে মাথা কুটে তোমার চরণেই মরবো।” শ্যামচাঁদ হাসিমুখে সম্মতি জানালেন ভক্তের কথার । তখন থেকে সেখানেই তিনি। তবে শ্রীবলরাম বিগ্রহ রয়েছেন বীরভূমের খয়রাশোলে। তাঁর প্রতিমূর্তি সেবিত হচ্ছেন এখন পানুয়া গোপালের শ্রীপাটে ।

আশ্বিনী শুক্লা সপ্তমী তিথিতে পানুয়া গোপালের তিরোভাব হয়। পানুয়া গোপালের কোন সন্তান না থাকায় , তাঁর শিষ্য গড়গড়ের বাসিন্দা কাশীনাথ ঘোষের পুত্রদের পোষ্যপুত্র রূপে গ্রহণ করেন। সেবার দায়িত্ব নেন কাশীনাথের পঞ্চপুত্র—অনন্ত, কিশোর, হরিচরণ, লক্ষ্মণ আর কানুরাম। বর্তমানে তাঁদের উত্তরসূরিরাই শ্রীবিগ্রহ ও দেবালয় সম্পদের অধিকারী। আর, অনন্তের বংশজরাই শ্রীবলরাম বিগ্রহকে বীরভূমের খয়রাশোলে নিয়ে যান। এই শ্রীপাট মন্দিরে শ্যামচাঁদ বিগ্রহের সাথে আছেন ৫২টি শালগ্রাম শিলা। রাস, ঝুলন, জন্মাষ্টমী প্রভৃতি উৎসব মহাসমারোহে পালিত হয়। পানুয়া গোপালের তিরোভাব উৎসবও অনুষ্ঠিত হয়।

মন্দিরের পূর্বকোণে পুরুয়া নামে একটি পুষ্করিণী আছে। কথিত যে, এই পুষ্করিণীর ঘাটের কাছে কদম্বখন্ডীতে সুন্দরানন্দ দীক্ষা দেন পানুয়া গোপালকে। ওই স্থানেই সেসময়ে অনেক বৈষ্ণবদের সঙ্গে সুন্দরানন্দ ১২ দিন ধরে মহোৎসব করেছিলেন । সেই ঘটনার স্মৃতি রক্ষার্থে প্রতি বছর নন্দোৎসবের দিন ভক্তেরা সমবেত হন‌ । পুষ্করিণীতে স্নান সেরে চিড়ে,দই, মিষ্টি দিয়ে ভোগ লাগিয়ে প্রসাদ পান। তাঁরা ঠাকুর সুন্দরানন্দ ও পানুয়া গোপালের কৃপা প্রার্থনা করেন।

নিশ্চয়ই মনে প্রশ্ন জাগছে যে, পানুয়া গোপালের শ্রীপাটটি তাহলে কোথায় ? অথবা, কোথায় আছেন এই শ্যামচাঁদ বিগ্রহ এখন ?—-সে উত্তরও জানবো।
হাওড়া স্টেশন থেকে বর্ধমান-বরাকরের মধ্যবর্তীতে পড়ে খানা স্টেশন । খানা-সাঁইথিয়ার মধ্যবর্তী বোলপুর স্টেশন। বোলপুর থেকে সিউড়িগামী বাসে উঠে পারুই স্টপেজে নামতে হবে। সেখান থেকে বাসে বা রিকশায় ৫কি.মি. পথ গেলেই পড়ে মঙ্গলডিহি। বাতিকার, কূর্মিধার, হাঁসরা বা ইলামবাজার যে কোনও বাসেই যাওয়া যায়‌। সিউড়ি থেকে মঙ্গলডিহির দূরত্ব ২২কি.মি. । এখানেই মঙ্গলডিহির ঐতিহাসিক মন্দিরে বিরাজমান রয়েছেন দ্বাপর যুগের শ্যামচাঁদ বিগ্রহ ,যিনি মহাভক্ত পানুয়া গোপালের প্রেমে বাঁধা পড়ে সেবা নিচ্ছেন আজও।

পানুয়া গোপালের একটি গাভীকে একবার এক বাঘ ধরে নিয়ে যায়। তিনি গাভীটিকে বাঘের মুখ থেকে তো উদ্ধার করে আনেনই , উপরন্তু বাঘটির কানে দীক্ষামন্ত্র প্রদান করে সেটিকে নিরীহ প্রাণীতে পরিণত করেন। যবনের পাঠানো অশুচি খাবারও তাঁর ভক্তির গুণে পুষ্পে পরিণত হয়েছিল। তাঁর ধন চুরি করে পালাবার পর পথেতেই চোরেরা অন্ধ হয়ে যান । পানুয়া গোপালের শ্যামচাঁদ বিগ্রহ প্রাপ্তির এই সত্য কাহিনী বড় আকর্ষণীয় ও হৃদয়স্পর্শী—তাই না !

পরিশেষে শ্রীশ্যামচাঁদ বিগ্রহ ও পানুয়া গোপাল মহাজনের কাছে আশীর্বাদ ভিক্ষা করি আমিও যেন এমন প্রেমপূর্ণ সেবা আমার শ্রীবিগ্রহকে করতে পারি। কখনো যেন তাঁদেরকে নিজের থেকে দূরে না করি। হৃদয়ের ধন করে তাঁদেরকে রাখতে পারি পরম যত্নে।

——-
ভক্তকৃপাভিখারিণী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here