আগের লেখাটিতে লিখেছিলাম যে—-গৌরীদাস পন্ডিত আবার যেভাবে নিতাই-নিমাইকে কালনায় নিজের গৃহে প্রেমবন্ধনে আটকে রেখেছেন , সেও বড় আনন্দদায়ক ও আশ্চর্য উপাখ্যান। প্রভু কৃপা করলে আগামী সংখ্যায় জানবো আমরা।
সুধী রসিক পাঠকবৃন্দ আসুন আস্বাদন করি সেই প্রাণস্পর্শী প্রসঙ্গ।
শ্রীমন্ মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করে নীলাচলে বাস করছেন এখন। তিনি যাবেন বৃন্দাবন ধাম দর্শন করতে ।পথে গৌড়দেশ হয়ে যাবেন। রওনা হলেন ১৫১৪খ্রিষ্টাব্দের বিজয়া দশমীর দিন। ১৮ দিন পর উপস্থিত হলেন পানিহাটিতে । সেখানে ভক্তপ্রবর রাঘব পন্ডিতের ভবনে একদিন থেকে পরদিন নৌকায় করে উত্তরের দিকে যাত্রা শুরু করলেন।কুমারহট্ট , কাঞ্চনপল্লী ,কুলিয়া , শান্তিপুর হয়ে এলেন মালদহের রামকেলিতে। কিন্তু, শ্রীসনাতন এবং শ্রীরূপ অর্থাৎ, নবাব হোসেন শাহের মন্ত্রী ‘সাকর মল্লিক’ ও উজীর ‘দবির খাস’ তাঁকে পরামর্শ দিলেন অত লোকের সাথে বৃন্দাবনে না গিয়ে বরং একাকী যেতে । তাহলে বৃন্দাবনের পূর্ণরূপে রসাস্বাদন সম্ভব হবে ।
পরামর্শ মনে ধরল মহাপ্রভুর ।তিনি কানাইয়ের নাটশালা থেকে ফেরত যাত্রা করলেন গঙ্গাপথে দক্ষিণে।এলেন শান্তিপুরে অদ্বৈত-গৃহে। এখানে কয়েকদিন সংকীর্তনানন্দে ভক্তসঙ্গে কাটালেন ।এবার সেই স্থানও ত্যাগের সময় এল। কিন্তু ,আর কিছুদিন পর অদ্বৈত প্রভুর শ্রীগুরুদেব তথা মহাপ্রভুর পরমগুরু মাধবেন্দ্র পুরীর নির্যাণ তিথি। সেই উপলক্ষ্যে বিরহ মহোৎসব হবার কথা । অদ্বৈত আচার্য অনুরোধ করলেন মহাপ্রভুকে তাই সে কটাদিন রয়ে যেতে শান্তিপুরে। মহাপ্রভু সম্মত হলেন।
শান্তিপুর আর কালনা গঙ্গার এপার আর ওপার। এই কদিনের মাঝেই একদিন হঠাৎ করে শ্রীমন্ মহাপ্রভু নিত্যানন্দকে নিয়ে দ্বিতীয় বারের জন্য হাজির হলেন অম্বিকা কালনায়। সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বে একবার গৌরাঙ্গ তাঁর প্রাণের দোসর নিতাইসুন্দরকে নিয়ে শান্তিপুর থেকে এসেছিলেন এখানে। তবে এখন তো আর গৌরাঙ্গ নন, এখন তিনি সন্ন্যাসী শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ভারতী।
গৌরীদাস পন্ডিতকে অর্থাৎ ব্রজের সুবল সখাকে না পেয়ে যেন পরিপূর্ণ রসাস্বাদন হচ্ছিল না মহাপ্রভু ও নিত্যানন্দের । তাই, গৌরীদাসের সঙ্গ পেতে তাঁর গৃহপ্রাঙ্গণে হাজির হলেন তাঁরা। হঠাৎ, নিজের প্রাণারাম নিতাই-গৌরের আগমন হওয়ায় গৌরীদাস যেন মেঘ না চাইতেই জল পেলেন । আনন্দ আর ধরে না প্রাণসখাদের নয়নসম্মুখে পেয়ে। যদিও মহাপ্রভুর বৈরাগ্য আর সন্ন্যাসীরূপ ব্যাথা দিল প্রাণে তাঁর , তবু এ কষ্ট মেনে নেওয়া ছাড়া যে উপায় নেই আর!
মহাপ্রভু ও নিতাইয়ের আগমন আনন্দে একদিন গৌরীদাস তাঁর গৃহে মহোৎসবের আয়োজন করলেন ।মহানন্দের হাট বসল তখন । মহাপ্রভুর অপূর্ব নর্তন-কীর্তনে আর নিত্যানন্দের ‘হরি-হরি’ ধ্বনিতে মুখরিত হলো চতুর্দিক ।প্রেমাপ্লুত গৌরীদাস প্রভুদের চরণে পড়লেন, বললেন , “প্রভু কৃপা করো !তোমরা কথা দাও আমায় ছেড়ে কোথাও যাবে না। চিরকাল থাকবে আমার গৃহে, কথা দাও ।আর, যদি আমায় ছেড়ে যাও তবে কিন্তু আমি প্রাণে মরবো; এই বলে দিলাম। হে গৌরহরি ,তোমার পতিতপাবন নাম তবেই সার্থক হবে যদি তুমি আমায় ছেড়ে না যাও, বলে দিলাম। নাহলে জানবো সব মিথ্যা।”
মহাপ্রভু হেসে বললেন,” তা কি হয় গৌরীদাস !যেতে তো আমাকে হবেই। আচ্ছা, এক কাজ করো ।তুমি বরং প্রতিমূর্তি সেবা করো আমাদের ।কথা দিচ্ছি সেই বিগ্রহে আমরা সর্বদা প্রকট থাকবো,দেখো। ”
একথায় গৌরীদাস একটুও স্বস্তি পেলেন না ।তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ক্রন্দন করতে থাকলেন । কোন মতেই তাঁর ক্রন্দন থামে না । তাঁর মনে যেন তখন একটাই ভাব –“তোমায় হৃদমাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবো না। ছেড়ে দিলে সোনার গৌর আর তো পাবো না।” নিত্যানন্দ ও মহাপ্রভু অনেক বোঝালেন তাঁকে। কিছুতেই কিছু হল না। শেষে তাঁরা স্থির করলেন গৌরীদাস পন্ডিতের গৃহেই থেকে যাবেন চিরকালের মতো।
মহাপ্রভু আদেশ দিলেন তাঁর প্রিয় সখা গৌরীদাস পণ্ডিতকে নবদ্বীপ থেকে বৃক্ষ ছেদন করে আনতে। নবদ্বীপে যে বৃক্ষের তলায় শচীমাতা গৌরকে কোলে নিয়ে বসে ষষ্ঠী পূজা করেছিলেন ,যার ওপর কোন পাখি বসতো না, যার ছায়ায় সন্ন্যাস গ্রহণের আগে পর্যন্ত গৌরাঙ্গ কত না মনোহর, চিত্তহারী লীলা করেছেন সেটি ছেদন করে আনা হল।তারপর তা থেকে অপূর্ব নয়নজোড়ানো দুই বিগ্রহ নির্মিত হল নিতাই-গৌরের । ভুবন মোহন রূপ সেই বিগ্রহদ্বয়ের ।
এরপর, অলৌকিক লীলা করে নিত্যানন্দ ও মহাপ্রভু প্রমাণ দিলেন যে , তাঁরা আর দুই বিগ্রহ অভিন্ন। তাঁরা প্রবিষ্ট হলেন সেই বিগ্রহদ্বয়ের মধ্যে । কিন্তু ,তাতেও গৌরীদাসের মন মানে না।আকুলপ্রাণে কেবল নয়নাশ্রু ফেলে চলেছেন । তিনি গৌর-নিতাই ছাড়া বাঁচবেন না যে। মহাপ্রভু বললেন , “তুমি এমন অবুঝ হয়ো না, গৌরীদাস। দেখো ,আমরা আর আমাদের প্রতিমূর্তিরা যে একই তার প্রমাণ তুমি পাবে।আমাদের চারজনের মধ্যে যে দুজনকে ইচ্ছে রেখে বাকি দু’জনকে যেতে আজ্ঞা দিও আজ,কেমন। তুমি এক কাজ করো , রন্ধন করে এনে আমাদের খেতে দাও।চারটে থালায় পারস (খাবার বেড়ে দেওয়া )করে আনো চারজনের জন্য আলাদা আলাদা করে।”
বিগ্রহদের পুষ্প-মাল্য-বস্ত্র অর্পণ করে সর্ব অঙ্গে চন্দন লেপে দিলেন গৌরীদাস ।তারপর মহাপ্রভুর কথানুযায়ী অন্ন বেরে এনে ভোগ নিবেদন করলেন। আর অত্যাশ্চার্য হয়ে গেলেন দেখে যে মহাপ্রভু ও নিত্যানন্দ যেমন যেমন আহার করছেন তাঁদের প্রতিমূর্তিরাও অনুরূপ ভোজন করছেন । জীবন্ত বিগ্রহ।ভোজন শেষে মহাপ্রভু বললেন, “এবার আমাদের বিদায় নেবার সময় । মন থেকে আমাদের বিদায় দাও গৌরী ,সকল দুঃখ ভুলে ।” গৌরীদাস বললেন, “না ,না, তোমাদের আমি ছাড়ছি না । যেতে হয় ওই দারুবিগ্রহরা যাক্। তোমরা এখানেই থাকবে আমার কাছে ।” প্রভু বললেন, “বেশ তো ,তোমার যা ইচ্ছা তাই হবে না হয়!”
মহাপ্রভু ও নিত্যানন্দ রয়ে গেলেন আর বিগ্রহরা সচল হয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। চমৎকৃত গৌরীদাস দেখলেন তাঁর গৃহের নিত্যানন্দ-মহাপ্রভু বিগ্রহরূপ ধারণ করেছেন আর দারুবিগ্রহ দুটি সচল নিত্যানন্দ-মহাপ্রভু হয়ে গেছেন। গৌরীদাস ছুটে বেরিয়ে আসলেন অঙ্গনে। তিনি ধরলেন পেছন থেকে তাঁর নিতাই-গৌরকে ; বললেন, “না,না ,প্রভু তোমরা চলো ফিরে। তোমরা থাকবে আমার কাছে ।আর, ঘরের মধ্যে যে নিতাই-গৌরাঙ্গ বিগ্রহ আছেন তাঁরা চলে যাবেন। ”
মহাপ্রভু বললেন, “ঠিক আছে ,ঠিক আছে। তুমি যা বলবে তাই করব।” নিজের নিতাই-গৌরকে নিয়ে গৌরীদাস গৃহের মধ্যে আসলেন। তাঁর প্রাণে স্বস্তি এল যে, জীবন্ত দু’জনকে ধরে আনতে পেরেছেন ভাগ্যিস! প্রতিমূর্তিরা বরং চলে যাক্। নিতাই-গৌর এসে দাঁড়ালেন ,প্রতিমূর্তিরা বেরিয়ে গেলেন হেঁটে। কিন্তু এ কী! অঙ্গনের ওপর দিয়ে নিত্যানন্দ-মহাপ্রভু সশরীরে হেঁটে চলে যাচ্ছেন ।আর যাঁদের ধরে আনলেন তাঁরা তো আবার বিগ্রহরূপ ধারণ করে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় গৌরীদাস হতচকিত হয়ে এক ছুটে বেরিয়ে এলেন । প্রাঙ্গণ পার করে পথে উঠবেন তখন মহাপ্রভু ও নিতাইসুন্দর ।গৌরীদাস এসে ধরে বললেন ,”প্রভু, তোমার চলো , তোমরা চলো ।তোমরাই আসল ,বুঝতে পেরেছি আমি ।”
বাধ্য ছেলের মতো দুইভাই ফেরৎ এলেন । বিগ্রহরা বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু এবারও সেই একই কান্ড ঘটল। মন মানে না । গৌরীদাস এবারও ফিরিয়ে আনলেন তাঁর নিতাই-গৌরকে। এভাবে ২৬ বার (ভক্ত-মহাজন মুখে শোনা) মহাপ্রভু ও নিতাই এলেন আর গেলেন । গৌরীদাস পরিশ্রান্ত হয়ে শেষে বসে পড়লেন। শরীর আর দিচ্ছে না। কোন দু’জন যে আসল ছিলেন আর কোন দু’জন বিগ্রহ ছিলেন প্রথমের, তা তিনি নিজেই গুলিয়ে ফেলেছেন এতক্ষণে। ভক্তের কষ্ট, পরিশ্রম আর ভগবানের প্রাণে সহ্য হল না। মহাপ্রভু বললেন, “গৌরীদাস, তোমার এতক্ষণে বোঝা উচিত যে আমরা তোমার কাছেই রয়েছি জীবন্ত হয়ে। কেবল, বিগ্রহ রূপ ধারণ করেছি ।তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে মনে কোন সংশয় না রেখে আমাদের সেবা দিও ।আমরা তোমায় ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না। তুমি যখন যেমন ভাবে দেখতে চাইবে সেভাবেই পাবে আমাদের, দেখো।”
গৌরীদাস বুঝলেন যে ,হ্যাঁ ,সত্যিই তাই ।সত্যিই জীবন্ত গৌরনিতাই-ই রয়েছেন তাঁর কাছে বিগ্রহ রূপে ।এবার তিনি হৃষ্টমনে বিদায় জানালেন তাঁর অপর দুই নিতাই-গৌরকে।ভক্তাধীন ভগবান এভাবে বাঁধা থাকলেন ভক্তের ভবনে।
বর্তমানে কালনায় মহাপ্রভুর বাড়ী নামে যে মন্দির আমরা দর্শন করতে যাই , সেটিই হল গৌরীদাস পন্ডিতের গৃহ। পাঠক, ভাবছেন নিশ্চয়ই যে তাহলে মহাপ্রভুর বাড়ী বলছে কেন? মহাপ্রভুর বাড়ী তো নবদ্বীপে! … তাই না ?
আসলে গৃহকর্তার নামেই তো বাড়ী হয়।এখন, গৌরীদাস পন্ডিতের প্রাণারাম কর্তা যে অভিন্নাত্মা নিতাই-গৌরাঙ্গ। আবার নিতাইয়ের হৃদয়ের পূজ্য ধন হলেন মহাপ্রভু । তাই বাড়ী তো মহাপ্রভুরই হল। তাই নয় কী !
যাঁরা কালনায় গেছেন , দেখেছেন নিশ্চয়ই যে , সেখানে একভাবে তাকিয়ে বিগ্রহ দর্শন করা যায় না। কিছুক্ষণ পর পরই আড়াল করে দেওয়া হয় শ্রীবিগ্রহদের । যাকে বলে ঝাঁকি দর্শন , তা করানো হয় । একটু শান্তি করে অপলকে থেকে বেশ অনেকক্ষণ ধরে বিগ্রহ দেখবো , সে সুযোগ নেই। কিন্তু, কেন এমন নিয়ম ? কি কারণে এমন অতৃপ্ততা নিয়ে ফিরতে হয় ? তা জানবো আগামী কোন সংখ্যায় । আর সেই সাথে নিতাই-গৌরের আরও কিছু লীলারও আস্বাদন করবো আমরা ।
——ভক্ত কৃপা ভিখারিনী
দীনা
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক

লেখিকা : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।
Leave a Reply