বন্য পশুও কী দীক্ষা পেতে পারে ? : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
593

আজ আমরা জানবো এমন এক সত্য ঘটনার কথা , যার দ্বারা প্রমাণ হয় সদ্ গুরুর পদাশ্রয় করা আর তাঁর থেকে প্রাপ্ত মন্ত্রের কতখানি মহিমা হতে পারে । হ্যাঁ, মানুষ মহৎ , ভজনশীল হওয়া তো দূরের কথা ,বন্য পশু পর্যন্ত জান্তব স্বভাব ভুলতে পারে , গুরুসেবানিষ্ঠ হতে পারে যদি শ্রীকৃষ্ণমন্ত্র কোন সদ্ গুরুর থেকে প্রাপ্ত হয় সে। আসুন জানি সেই অবিশ্বাস্য আশ্চর্য ঘটনার কথা।
সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধের ঘটনা। শ্রীগোপাল দাস নামে এক হস্তী রসিকানন্দের শিষ‍্য ছিলেন। রাধানগরের অধিপতি আহম্মদ বেগ সুবা এই হস্তীকে পাঠিয়েছিলেন রসিকানন্দ প্রভুকে শায়েস্তা করতে। তিনি বলেছিলেন যদি বন্য হস্তীটিকে দীক্ষা দিতে পারেন রসিকানন্দ, তবে তার চরণাশ্রয় করবেন সুবা। সেসময় হস্তীটি ভীষণ উৎপীড়ন করতেন গ্রামের মানুষদের। ঘর-বাড়ি-ফসল সব তছনছ করে, মানুষের প্রাণ নিয়ে সকলের মনে ত্রাসের সঞ্চার করে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু, রসিকানন্দের সংকীর্তন শ্রবণ করে সেই দামাল হস্তী শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যান। রসিকানন্দ তাঁকে হিংসা ত্যাগ করতে বলেন। তিনি হস্তীটির কানে কৃষ্ণমন্ত্র দিয়ে দীক্ষিত করেন আর হস্তীর নাম দেন গোপাল দাস। তখন হস্তীটি রসিকানন্দের চরণে পড়ে প্রণামও করেন। মহাবৈষ্ণব হন তবে থেকে। লোক উৎপীড়ন করা ত্যাগ করে শান্ত স্বভাবের হয়ে যান ।
পরবর্তীতে আবার যখন রসিকানন্দ সেখানে আসেন, তখন গোপাল দাস হস্তী চরণ দর্শন করতে আসেন তাঁর। আঁখি নীরে ধৌত করে দেন তাঁর শ্রীগুরুদেবের চরণ। প্রণাম, পরিক্রমা করে শ্রদ্ধা ও স্তুতি জানান। এমন কী রসিকানন্দ সেখানে যখন কৃষ্ণকথা আলোচনা করছিলেন, তাও মন দিয়ে শোনেন। তারপর রসিকানন্দ সে স্থান ত্যাগ করে চলে যান যখন, হস্তীটি তীর্থ‍্য পর্যটনে বেরিয়ে পড়েন। ‘শ্যামানন্দ প্রকাশ’ গ্রন্থে লেখা যে হস্তীটি গত জন্মে নবাবের মুসুদ্দী ছিলেন। তাঁর নাম ছিল হরিহর। অভিশাপে হস্তীর দেহ পায়।
জাতিতে কায়স্থ হরিহর বানপুরবাসী ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণের হাত দিয়ে প্রতিদিন পাঁচ সের অন্নের ভোগ নিবেদন করাতেন। মহাপ্রভু বলেছিলেন, ব্রাহ্মণের প্রয়োজন নেই, নিজের হাতেই রন্ধন করে যাতে প্রসাদ পান হরিহর। কিন্তু হরিহর তা শোনেননি। সেই অপরাধেই হস্তীর জন্ম হয় হরিহরের। রসিকানন্দ ঠাকুরের করুণায় উদ্ধার হন তিনি। জনবসতি ছেড়ে চলে যান অরণ্যে। সেখানে নিরন্তন রসিকপদ ধ্যান করতে থাকেন।
একবার রসিকানন্দ বানপুরে আসেন আর পথ ভুল করে অরণ‍্যে প্রবেশ করে ফেলেন। এদিকে সন্ধ‍্যা ঘনিয়ে আসে। গ্রাম তখনও বহুদূরে। তাই বিপদ এড়াতে তিনি পার্ষদদের নিয়ে এক বৃক্ষের তলায় থেকে যান সে রাত্রের মত। স্বভাবতঃই, তাঁরা উপবাসী থাকলেন। এদিকে দূর থেকে গোপাল দাস হস্তী দেখতে পান নিজের শ্রীগুরুদেবকে। সমীপে এসে তৎক্ষণাৎ চরণ বন্দনা করলেন। আর, রসিকানন্দরা উপবাসী আছেন বুঝতে পেরে সোজা চলে যান গ্রামের ভিতর। গৃহস্থের বাড়ি থেকে তন্ডুল নিয়ে চলে আসেন। অন‍্যান‍্য সামগ্রী রসিকানন্দের গণের কাছে ছিল। তাঁরা তখন শয়নে। গোপাল দাস এসে প্রণাম করে জাগায় আর তন্ডুল অর্পণ করে বনের মধ‍্যে প্রবেশ করে যান।
রসিকানন্দের আজ্ঞায় রন্ধন করা হল। শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন করে সকলে প্রসাদ পেলেন। আর আশ্চর্যের কথা, যখন রসিকানন্দের প্রসাদ পাওয়া শেষ হল গোপাল দাস এসে দাঁড়ালেন। রসিক প্রভুর ভুক্তাবশেষ তাঁকে দেওয়া হল। মহানন্দে প্রসাদ পেলেন গোপাল দাস হস্তী। এরপর রসিকানন্দ তাঁর মাথায়-শুঁড়ে হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করলেন আর সাধু সেবা করতে বললেন।
যখন গোপীবল্লভপুরে মহোৎসব হয়, তখন খবর পেয়ে সেখানে হাজির হয় গোপাল দাস। একদিন রসিকানন্দ তাঁকে ডেকে পাঠালেন। আর তারপর এক আদেশ করলেন তার শুঁড়ে হাত বোলাতে বোলাতে।বললেন –“কাঁথির যে ম্লেচ্ছ অধিপতি, তিনি পরম দুর্জন। তিনি আমার অলৌকিক ক্ষমতা, প্রভাব দেখতে চান। তুমি এক কাজ করো। দশ-বিশ জন সাথী নিয়ে তাঁর প্রাসাদের দ্বারে গিয়ে ডাকাডাকি, হাকাহাকি করবে। তবে প্রবেশ করবে না।”
নির্দিষ্ট দিনে কাঁথির ম্লেচ্ছ রাজার ভবনে গেলেন রসিকানন্দ। আর সেদিন চৌদ্দজন হস্তীকে নিয়ে গোপাল দাস হাজির হলেন প্রাসাদের দ্বারে। তাঁদের ডাকাডাকিতে প্রাসাদের সকলে ত্রস্ত হলেন। তখন রসিকানন্দ এসে হস্তীকুলের সম্মুখে দাঁড়ালে , তাঁকে দর্শন‌ করে সকল হস্তীরা শান্ত হল। এরফলে ,ম্লেচ্ছ রাজা রসিকানন্দের প্রভাব দেখে চমৎকৃত হলেন ও চরণাশ্রয় করলেন তাঁর।
হস্তীর জন্ম নিয়েও উদ্ধার হলেন গোপাল দাস নিজের ভক্তি বলে। তিনি রসিকানন্দের পার্ষদরূপে পরিগণিত হন। তাকে আমার শ্রদ্ধামিশ্রিত প্রণাম জানাই ও কৃপা করুণা প্রার্থনা করি তাঁর ।

——- ভক্তকৃপা ভিখারিণী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here