দিনক্ষণ দেখে চলে না সংস্কৃতি চর্চা। এটি একটি চলমান জীবনাচার। মানুষের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক যা অবজ্ঞা অবহেলা করার সুযোগ নেই। জীবনের পরিপূর্ণতা আসে সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে দিয়ে। ঠিক তেমনই যাত্রাশিল্পও সংস্কৃতি চর্চার একটি অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম। বাঙালির হাজার বছরের নাট্য চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই যাত্রা শিল্পের মাধ্যমে। যা আজও বহন করে চলেছে সামাজিক শিক্ষা। দেয় বিনোদনের অফুরন্ত রসদ।অথচ এই যাত্রা শিল্পের মজ্জায় ঢুকে গেছে মারণব্যাধির বিষবাস্প। বর্তমানে গভীর সংকটে সংস্কৃতি চর্চার এই মাধ্যমটি।কিন্তু আমার মনে হয়,সংকট হয়নি যাত্রা শিল্পের,সংকট হয়েছে আমাদের মনের, আমাদের চিন্তার। তাই যাত্রাশিল্প আজও তার নিজের ছন্দেই বিরাজমান।তবে পূর্বের কাহিনীর সাথে বর্তমান কাহিনী- উপস্থাপনার বিস্তর ফারাক।
আমাদের জীবনে ঘটে চলা ঘটনাকে নিয়েই নাট্যকাররা তাদের গল্প সাজান।সেই গল্পের সংলাপ,ভাষা- বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনের উপর নির্ভর করে যাত্রাশিল্পের ভবিষ্যৎ।
বর্তমান সময়ে মানুষ যতটুকু যাত্রাকেন্দ্রিক তার বেশির ভাগটাই সামাজিক যাত্রাপালা।
ঠিক সেইরকমই এক সামাজিক যাত্রাপালা “ভালোবাসার শেষ ঠিকানা”। নাট্যকার সমীর ঘোষের অনবদ্য লেখনী।যা ১৪২৮ সালে এ্যামেচার যাত্রামঞ্চে আলোড়ন ফেলে দেবে। নাট্যকার তার “ভালোবাসার শেষ ঠিকানা” পালায় সমাজিক পটভূমির পেক্ষাপটে শ্রোতাদের সামনে উপস্থাপনা করেছেন।সমীর ঘোষ পূর্বেও বেশ কিছু নাটক লিখেছেন,যা আপামর শ্রোতা সাদরে গ্রহণ করেছেন।
শিল্পতো মানুষই সৃষ্টি করে এসেছে যুগের পর যুগ ধরে। বর্তমান সময়ে যাত্রায় যে অনাসৃষ্টি অশ্লীলতার অভিযোগ এসেছে তাও মানুষের সৃষ্টি। মানুষ যখন এই সুন্দরতম শিল্প সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে, তখন এই অনাসৃষ্টি অশ্লীলতাকে দূর করতে হবে।এখানেই নাট্যকার সমীর ঘোষের এক অনন্য সৃষ্টি “ভালোবাসার শেষ ঠিকানা” যাত্রাপালাটি।
এই পালায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের একমাত্র মেয়ে পারমিতার ভালোবাসার কথা উঠে এসেছে ধনী ব্যবসায়ীর একমাত্র ছেলে সৎ-নির্ভীক অয়নের সাথে। যদিও অয়নের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেনি পারমিতা।সেখানেও জড়িয়ে আছে ধনী ব্যবসায়ী কুকীর্তির নায়ক অয়নের বাবা গোবিন্দ চাকলাদার।
নাট্যকার তার এই অসামান্য বইটিতে যেভাবে কাহিনী- সংলাপের পুনর্বিন্যাস, উপস্থাপনা করেছেন,যা আপামর যাত্রা পিপাসু মানুষজন অনেকদিন পর আবার নতুন করে যাত্রার রস আস্বাদন করতে পারবে।
পালা উপস্থাপনায় ধরা পড়েছে সন্তানের জন্য মায়ের হাহাকার,ফুটে উঠেছে পিতাকে কন্যাদায় থেকে মুক্ত করার জন্য বাধ্য হয়ে প্রতিবন্ধী জয়ন্ত’কে স্বামী হিসাবে মেনে নিতে।গল্পে সরমা ও পারমিতার যে পুনর্বিন্যাস নাট্যকার তৈরী করেছেন তা দর্শক মনে আঁচড় কাটবে এটুকু বলার অপেক্ষা রাখে না হাসি-কান্না,ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা আমাদের জীবনের সাথে সম্পর্ক রেখে নাট্যকারের অনবদ্য সৃষ্টি”ভালোবাসার শেষ ঠিকানা” যাত্রা মোদী দর্শকদের মনকে নাড়া দেবে তা অনস্বীকার্য।
সর্বশেষে একটা কথা বলতেই হয়,বর্তমান যাত্রা শিল্পের দুরবস্থা বলি বা আমাদের মনের দুরবস্থা ই বলি,যাই হোক না কেনো নাট্যকার সমীর ঘোষের এই অসামান্য সৃষ্টি যাত্রা শিল্পকে আবার তার হারিয়ে যাওয়া গৌরব ফিরিয়ে দেবে।
বর্তমান সময়ে যে সমস্ত যাত্রা পালা অনুষ্ঠিত হচ্ছে,তার বিপরীতে গিয়ে নাট্যকার আবার ষাট কিংবা সত্তরের দশকে স্বামী-স্ত্রী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বাবা-মা , সন্তান-সন্ততিসহ সপরিবারে সকলে মিলে এক সঙ্গে যাত্রা উপভোগ করার দিকটি লক্ষ্য রেখে কাহিনী বিন্যাস করেছেন।এক কথায় মা অনবদ্য।