মাটিতে মেঘ আঁকতে পারে এমন অক্ষরের আলোকসজ্জা : কলমে, শুভঙ্কর দাস।

0
513

মাটিতে মেঘ এঁকে বৃষ্টি নামাতে
পারে,এমন কবিতা লিখতে পারিনি বলে
মাঠের ওপর পান্ডুলিপির পাতার
মতো শুয়ে থাকি
যদি কোনো ভারতবর্ষরঙা চাষি
কপালের ঘাম মুছতে মুছতে
ছুঁয়ে ফেলে
তাহলে নিজের দেশ ফিরে পাবো একদিন

যেখানে অমরত্বের জন্য নয়, আকাশের জন্য
পাখির ডানা ভরে যায়,বীজধানে

গরম ভাতের গ্রাস মুখে তুলে
যদি মনে পড়ে স্বর্গের রঙ ভাতের মতো সাদা

তাহলে বুঝবে প্রতিটি কবিতার মানে…

সে মাটি হোক বা মেঘ, সে পাখি হোক বা হৃদয়ে

যেখানেই লেখা হোক…(ভাতের কবিতা-শুভঙ্কর দাস)

যেকোনো ক্ষুধার্তের সামনে যখন এক থালা গরম ভাত বেড়ে দেওয়াই যেমন সর্বোচ্চ জীবনের জয়,তেমনই কোনো অক্ষরকর্মীর সামনে ‘কবিসম্মেলন’ এর মতো পত্রিকা তার বোধের হাতে ধরিয়ে দেওয়া একই ব্যাপার।
সেই সংখ্যাটি যদি শারদীয়া হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে সে অমরত্ব ছেড়ে আকাশনির্মাণের কলাকৌশল শিখতে ও জানতে পারবে।
অমরত্ব যদি চেয়ে নাও,তাহলে তা হবে একার এবং স্বার্থময়।কিন্তু যদি আকাশ তৈরি হয়, তাহলে কত মন-প্রাণ পাখি হয়ে উড়তে পারবে মুক্তপ্রাণতায়..
হ্যাঁ,আমি এমন একটি শারদসংখ্যার মাঠ-মেঘ-আকাশ এবং ধানশস্যের কথা বলতে বসেছি,এই আলোচনা পাঠ-প্রতিক্রিয়ায়, শেষে নিশ্চিত দেখবেন,আপনার মনের গোলা নবান্নের উৎসবে পরিণত হবে।
প্রথমেই একটি মহাকাব্যসম সাক্ষাৎকারের কথা বলে শুরু করব।এখানেই মনে পড়ে যায়,প্রবাদপ্রতিম কবি শঙ্খ ঘোষের একটি আলোকময় বাণী,’কবিতা ছুঁতে চায় ভাঙাচোরা মানুষের সমগ্র অস্তিত্বটুকু।আর সেই সমগ্রের মধ্যে আছে কতরকমের অনুভব, কতরকমের স্মৃতি আর আশার,কত প্রকাশ্যের আর প্রচ্ছন্নের বেণিবন্ধন। সেই মানুষের কাছে যেতে পারেন কে? পারেন তিনি যিনি তত্ত্ব দিয়ে দেখেননি জীবনকে,যিনি সর্বতোভাবে বেঁচে ছিলেন জীবনের মধ্যে’
কী আশ্চর্য কথন, পড়লে বুকের ভেতরে বিদ্যুৎ চমকে ওঠে,সত্যি তো কটা মানুষের বুকের পাটা থাকে,সমগ্র অস্তিত্বকে প্রকাশ্যে দিবালোকের মতো তুলে ধরতে!ক’জন কবির কবিতা সত্যিকারের অকৃত্রিম আত্মজীবনী হয়ে ওঠে!ক’জন কবি যা লেখেন,তা বিশ্বাস করেন,যা বিশ্বাস করেন,তাই পালন করেন!
সেই পরমপুরুষের আকাশছোঁয়া নির্দেশ, মন ও মুখ এক করার সাধনা।
যদি বলি কবির বাণীকে এবং পরমপুরুষের আলোককে এই মহাসংকটময়কালে একজন পেরেছেন এবং তাঁর সাক্ষাৎকার বলা যেতে পারে, এই সময়ের সবচেয়ে অত্যাশ্চর্য আশ্রয়। সত্যিকারের সর্বতোভাবে বেঁচে থাকার সাহস দেখানো..
তিনি জয় গোস্বামী। কবি জয় গোস্বামী।
কবিতার জীবন এবং কবির জীবন নিয়ে এতোখানি অকপট সত্যি বলার সাহস অদৃষ্টপূর্ব।সমগ্র অস্তিত্বের আলো ও অন্ধকারকে নিজের কবিময় হাতে যেন তুলে তুলে ধরেছেন শারদ কবিসম্মেলন পত্রিকায়..
এই রকম একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করার জন্য সেতু শ্যামলকান্তি দাশ সম্পাদক হিসেবে এই মুহুর্তের পত্র-পত্রিকার ইতিহাসে একচ্ছত্র সম্রাট হিসেবে প্রতীয়মান করে তোলে।
কবি ও সম্পাদকের যুগ্ম দুঃসাহসিক অভিযান মনকে এবং মনের চারিপাশে বোধকে বিমূঢ়, বিপন্ন এবং বিদীর্ণ করে তোলে, একটিমাত্র শব্দের বাণে,তা হল সত্যি-কথন।
কতদিন আগে কৃত্তিবাসী কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলে গেছিলেন,যে সাহিত্য রচনায় সৎ নয়, সে উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচনা করতে পারে না!
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে যিনি বলেছিলেন,সেই শঙ্খ ঘোষেরও শেষ কথা,কবিতার একমাত্র কাজ সত্যি বলা।
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, কবির?কবির কাজ কী?
কবির কী করা উচিত?
তিনি যা কবিতায় লিখছেন,তার উৎস, ক্রিয়াশীল সকল অনুভব তুলে ধরা কি যায়!
কবিতায় যে প্রেমের কথা,অপ্রেমের কথা,যে আঘাতের কথা এবং যে আত্ম বিস্ফোরণের কথা উঠে আসে,তা কি শেষপর্যন্ত কবি নিজের মুখে স্বীকারোক্তি করতে পারেন!
ভারতবর্ষের সীমানার ওদিকে কথা বলতে পারব না,ভারতবর্ষ তথা বঙ্গদেশে তথা বঙ্গসাহিত্যে তা হয়েছে।
একজন কবি তাঁর সৃজনশীলতা প্রতিটি পাতার কথা এমন রক্তমাংসের আবেদনে তুলে ধরেছেন,তা পড়ে মনে হয়, কবির কবিতা এবং কবির জীবন যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ!
হ্যাঁ,এই বিস্ময়কর কান্ড ঘটেছে,শারদীয়া কবিসম্মেলন পত্রিকার এই সাক্ষাৎকারে,যেখানে কবি জয় গোস্বামী উচ্চারণ করেছেন, কবিতার কাছে আমি আজীবন কোনো সত্য গোপন করিনি।
এই কথামুখের প্রতিটি কথা আগুনের মতো তপ্ত এবং শানিত ছুরির মতো ধারালো।
এই ধরণের সাক্ষাৎকার পাঠক হিসেবে আমি ব্যক্তিগত জরিমানা রেখে বলতে পারি, কোনোদিন কোনোকালেই পড়া হয়নি!
বঙ্কিম থেকে রবীন্দ্রনাথ,নজরুল থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়,মাণিক থেকে তারাশংকর,সমরেশ বসু থেকে হুমায়ুন আহমেদ ,শক্তি থেকে সুনীল, এমন কি নীরদচন্দ্র চৌধুরী থেকে ঝুম্পা লাহিড়ী,তে এই ধরণের বিস্ময়কর আত্মবাক্যলিপি গোচর হয়নি!
প্রত্যেক মহাজনই নিজেকে প্রকাশ করেছেন,অসংখ্য রূপক চরিত্রের মধ্যে দিয়ে অথবা একাধিক ছদ্ম-ঘটনার মাধ্যমে। অবশ্য পরে তার কোনো পাথুরে বা প্রামাণিক স্বীকারোক্তি পাওয়া যায় না!
কিন্তু আপনি যখন পড়বেন,একালের জনপ্রিয় এবং প্রভাবদুত্যিময় কবি জয় গোস্বামী বলছেন,আমি নিজেকে কোনোদিন কবি বলে দাবি করিনি,আমি কবিতা-লেখক মাত্র, আমার যা কিছু,সে কবিতা হোক বা কাব্য, তা আসলে আমার কনফেশন।
অর্থাৎ উলঙ্গ স্বীকারোক্তি।
স্বীকারোক্তি সামনে আমি সচেতনভাবে উলঙ্গ শব্দটা বসিয়েছি।কারণ আমাদের বোধের জন্মদিনের অনেক আগে আমরা জন্মাই,কোনো এক নারীর গর্ভে।প্রসবের পর থেকে সেই নারীর সামনে আমরা উলঙ্গ হয়েই বড় হই।তখন যেকোনো কথাই অকৃত্রিম এবং আলোকময়। তাই মায়ের সামনে উলঙ্গ হয়ে স্নান করতে বা বক্তব্য করতে কোনো লজ্জা বা ভয় থাকে না।কবিতা সেইরকম।যার সামনে কবি উলঙ্গ স্বীকারোক্তি করেছেন,প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে…
কী সেই স্বীকারোক্তি?
এক
রানাঘাট লোকাল ট্রেনের যেকোনো ডেলি প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে একজন কবির কোনো পার্থক্য নেই।সংগ্রামে এবং ক্ষুধায় এক প্লাটফর্মের যাত্রী। শুধু কবি নামক লোকটির শান্তিনিকেতনী ব্যাগে তাঁরই হৃদয়ের রক্তমাংস রাখা। যা লোকে কৌতুক করে পদ্য বলে।সেই কবি একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার দৌড়, যাঁকে সংসারের হাল ধরার জন্য কখনো ঘু্ঁটে বিক্রি বা বাড়ি বাড়ি দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে, সেই কবিই কি না পরবর্তী জীবনে তিন- তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট সম্মানে ভূষিত।

দুই
যখন ঘুঁটে বিক্রি করে বা দুধ বেচে সংসার চলছে না,কারণ গরুর দুধ দেওয়া বন্ধ আর বর্ষার জন্য ঘুঁটে দেওয়া কষ্টকর, তখন সেই কবি লিখলেন–
“পেটের মাটি বুকের মাটি মাংসমদরুটি
খেয়েই বড় হলাম,আমি গোলাম নই তোর
দুদিন বাদে অসুখে পড়ি,দুদিন বাদে উঠি
এখানে খুন ওখানে খুন দুদিন অন্তর”
সেই দুঃসময়ে ইলেকট্রিক বিল না দেওয়ার জন্য কবির বাড়ির কারেন্ট কেটে দেওয়া হয়। তাই কবিকে মাথায় মনে মনে লিখে রাখতে হত!
মোম পুড়িয়ে কবিতা লেখার বিলাসিতা বড়দাদার অসহ্য , তাই অসহায় কবিকে সন্ধে নামলেই অন্ধকারে বসে থাকতে হত, শেষপর্যন্ত থাকতে না পেরে নিজের পান্ডুলিপি সাহস করে কবি শঙ্খ ঘোষের কাছে পড়তে দিয়ে আসেন,লোকাল ট্রেনে চড়ে।কবি শঙ্খ ঘোষ কবির কবি।তিনি নিদারুণ অবস্থার সবটস বুঝতে পেরে, সেই ঘুঁটেবিকিয়েকবিকে ২০০০ টাকা হাতে তুলে দেন,সেই টাকাই কবিকে বাঁচিয়ে দেয়।কবির সংসারকেও..
এই প্রসঙ্গে একটি কথা মনে হল, প্রতি বছর শারদসংখ্যায় কবিসম্মেলন এর সূচী নির্মিত হয়, কবি শঙ্খ ঘোষের লেখা দিয়ে..
যিনি শুধু কবি হিসেবে নন, মানুষ হিসেবেও মহৎ তাঁর অক্ষরফুল দিয়ে এই পত্রিকার পথচলা শুরু হয়, তা তো পুণ্যতোয়া কাজ।
সেই কাজটি সম্পাদক শ্যামলকান্তি সহজ সুন্দর এবং সত্যিকারের একটি আলোক পত্রিকা প্রকাশের জন্য সম্পন্ন করেন।এটাও এই সাক্ষাৎকারে বোঝা গেল।

তিন
কবির জীবনে একাধিক নারীর আগমন ঘটেছে। তাও সরল সহজ এবং পবিত্র চিত্তে উচ্চারণ করেছেন।কিন্তু এরকম কোথায় পড়েছেন কি?
একজন কবি বলছেন,তাঁর কাব্যগ্রন্থ “ঘুমিয়েছো,ঝাউপাতা?
এর ঘুমিয়েছো অর্থাৎ এমন এক নারীকে নিয়ে লেখা যে,কবিকে আাঘাত করেছিল প্রেমে, আবার সেই ছুরি বসানো প্রেমিকার বান্ধবী কবিকে বুকে তুলে নেয়,তখন তৈরি হয়, ঝাউপাতা?
অর্থাৎ একটি কমার ভেতর কবির জীবনে আলোড়ন করে তোলা দুই নারীকে পার্থক্য করেছিলেন।
আশ্চর্য! এমন কাব্যিক রহস্য আগে কি আমরা পড়েছি!!

চার
আবার সেই ‘ঘুমিয়েছো,ঝাউপাতা?’ এর জন্য কবি পেলেন আনন্দ পুরস্কার। সেটাও অদ্ভুত ঘটনায় পরিপূর্ণ। পুরস্কারের আগে আনন্দবাজারে কবির ছবিসহ প্রকাশিত পুরস্কারের সংবাদ।তখন কবির রানাঘাটের বাড়িতে প্রতিদিন পেপার নেওয়া ভয়ংকর খরচবহুল ভাবা হত।তাই নেওয়া হত না!
যেদিন খবরটা ছেপে বেরোল,সেদিন কবির প্রতিবেশীরা অবাক হয়ে পেপারের ছবির সঙ্গে মেলাতে গিয়েছিল কবির মুখ,কারণ তারা জানেই না,যে লোকটা বস্তায় বস্তায় ঘুঁটে ভরে বিক্রি করে বেড়ায় এবং গরুর দুধ বাড়ি বাড়ি দিয়ে সংসার চালায়, সে লোক কী এমন কবিতা লিখল,একেবারে আনন্দ পুরস্কার!!
এটা কি দিবাস্বপ্ন!!!

পাঁচ
জয় গোস্বামী কীরকম কবিতা লেখে?
তিনি যে কবিতা লেখেন,তার গভীরতা কতদূর?
অথবা নিদেনপক্ষে জয় গোস্বামী নামক কবির কয়েকটা কাব্যগ্রন্থের নাম!
এসব না জানলেও, লোকে এই নিন্দাটিকে একেবারে নন্দনকানন করে নিয়েছিল ,জয় গোস্বামীর নামে কবি লোকটা অন্য লোকের বউ নিয়ে পালিয়ে এসেছে!
এমন কি যে জীবনে জয়ের তো দূরের কথা কোনো কবিতা কস্মিনকালেও পড়েনি,সেও সহস্র আগ্রহ ভরে এখবর রেখেছিল!
পৃথিবীর খবর বলতে পারব না,বাঙালির মতো নিন্দুক জাত আর একটা নেই,বলা যেতে পারে,ঈশ্বর বাতাস তৈরি করেছেন,আর বাঙালি তৈরি করেছে নিন্দা।
যা মাঝেমধ্যে গতিতে বাতাসকেও হারাতে পারে! সেই রবীন্দ্রনাথ থেকে বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর থেকে নজরুল, জীবনানন্দ থেকে বিনয় মজুমদার, সবাই নিন্দা নিয়েই পরলোকগমন করেছেন!
কিন্তু যখন পড়বেন কবি নিজেই বলছেন,হ্যাঁ,আমি আমার বন্ধুর বউকে নিয়ে থাকি।তাকেই বিবাহ করি।তার নাম কাবেরি এবং তার একটি মেয়েও আছে,বুকুন।
তখন আমাদের নিন্দার রাক্ষুসে দাঁত দড়াম করে পিচ রাস্তায় কিড়মিড় করতে থাকে।
কিন্তু এই বিবাহের জীবন কি সত্যি খুব সহজ ছিল!
নিচুতলার কথা আগেই বলেছি,এবার বলি অপর আলোর কথা।বিখ্যাত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় জয় গোস্বামীকে বলেছিলেন, “তোমার কাছে আমি এরকম আচরণ আশা করিনি”
আবার দেখা গেল,সেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সেরা বাঙালির পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন কবি জয় গোস্বামীর হাতে!
সাগরময় ঘোষ বকলেন এই বলে,”তোমার জীবন নিয়ে তুমি কী করছ,তা তুমিই ঠিক করবে,আমাকে ওসব বলো না”
সেই সাগরময় ঘোষ ‘দেশ’ এ জয় গোস্বামীর গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করে বাংলা কাব্যের অলকানন্দাকে জাগ্রত করেন।
আর কবি জয় কী করছেন
প্রচন্ড নিন্দা-গালিগালাজের মধ্যে তিনি যে বন্ধুর বউকে নিয়ে ঘর করছেন,সেই বন্ধু কতখানি আঘাত পেল,সেই চিন্তায় লিখলেন —

“যেন কাল থেকে,তোমার আগের স্বামীর দেওয়া
সব দুঃখ বনে-বনান্তরে জোনাকি হয়ে মিলিয়ে যায়
যেন সেও, আমার দেওয়া অতবড় দুঃস্বপ্নটাকে
রুলামে বেঁধে সামনের পুকুরে ফেলে দিতে পারে!”

এই বিস্ময়কর আগুন স্বীকারোক্তি আগে কেউ পড়েছে!
সেই কবির প্রিয়তমা নারী,কাবেরী!
তাকে নিয়ে লেখা কাব্য, ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’
সেও নির্ভেজাল নিমগ্ন নগ্ন আত্মোপম আলোর প্রকাশ।সেইজন্য সেই কাব্যগ্রন্থের জন্য এল সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার।
অথচ অনেকেই জানেন না,এই “পাগলী, তোমার সঙ্গে” বইটি নাম আগে ছিল,’ সবচেয়ে উঁচু তারাকে আমি বলি’
কবিও এটাই দিতে চেয়েছিলেন, কারণ জয়ের জীবনে সবচেয়ে উঁচু তারা হল কাবেরি। কবির প্রেমিকা।
তাহলে নাম পরিবর্তন!!
সেই কাবেরি নাম্নী নারী কবির জীবনে আসতেই যে দোলাচল, যে নিন্দার ঝড় বয়ে গেল,তাই কবি লিখেছিলেন অকপট সত্যি —
” পাগলী,তোমার সঙ্গে জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি জীবন কাটাব”

এমন কথা, এমন কবির কবিতা আগে আসেনি!এই সাক্ষাৎকার কবিসম্মেলন পত্রিকাকে সবচেয়ে উঁচু তারা করেছে এবং মোট পাতার সংখ্যা বাষট্টি। নিয়েছেন সাক্ষাৎকারটি কবি অভিরূপ মুখোপাধ্যায়। মোট দশদিন ধরে,এতেই অভিরূপের অন্তর্গত ধ্যানস্থ প্রজ্ঞার সন্ধান পাওয়া যায়।
এত দীর্ঘ সাক্ষাৎকার আজ পর্যন্ত বিরল ঘটনা।
পাতার পর পাতা পড়তে পড়তে সহসা উদ্ভাস এসে যায়!
শুধু এই কথাগুলো মনে হয়–
সরস্বতী
তোকে চিনতে পারিনি বলে
হৃদি ভেসে যায়
জয় গোস্বামী জলে…

একটা সাক্ষাৎকারের পর আবার কবিতার সাক্ষাৎকার।এবার বিখ্যাত চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী। তাঁর সাক্ষাৎকার পড়ে মনে হল, ছবিও একধরনের রঙের কবিতা।অক্ষরে ও রঙে আছে প্রচন্ড প্যাশন।
যা সিনেমায় নেই।
আমি লেখার মাধ্যমে গোলাপের গন্ধ ফুটিয়ে তুলতে পারি একজন পাঠকের মনে, যেটা সিনেমা পারে না।
একথা কথাকার তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
যা বিশ্বাস করেন যোগেন চৌধুরী।
তাই তিনি লিখেছেন—
“গভীর উত্তাপ ও নীহারিকা ও তার উজ্জ্বলতা
আমার পথের দিক নির্মীত হয়ে আছে সম্মুখে
মেঘ ও জলের সৌকুমার্য, মাতা ও পিতা মত আপন
আমার নক্ষত্র, পাড়ি দেব দিন ও সময়ের বৎসর ঘুরে”
এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দেবাশিস চন্দ এবং সঞ্জয় ঘোষ।
সেতুকবি ও সম্পাদক শ্যামলকান্তি দাশ শারদসংখ্যার সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেছেন এক আশ্চর্য তথ্য।কবিসম্মেলন এর এই বছর হল ১৬ তম।
একেবারে শুরুর দিকে যখন কবিসম্মেলন বের হচ্ছে, তখন বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক বৈঠকে শ্যামলকান্তি দাশকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে বলে উঠেছিলেন,কবিতার পত্রিকা, তাও আট ফর্মার।করছ কি! চালাতে পারবে না,দু-তিনটে সংখ্যার পরই বন্ধ হয়ে যাবে,এই দেখো না,কৃত্তিবাস এর অবস্থা, সময়মতো বের করতে পারি না,শুধু ভালো কবিতাবিষয়ক গদ্যের অভাবে”
তারপর মাসের পর মাসে কবিসম্মেলন বের হতে লাগল।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মনোযোগ দিয়ে, প্রতিটি সংখ্যা দেখতে লাগলেন এবং পড়তে লাগলেন।মুগ্ধ হতে লাগলেন।
এবং একদিন সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদক শ্যামলকান্তি দাশকে কাছে ডেকে প্রশংসা করে বলে উঠলেন,”শোনো,আমার আগের কথা আমি ফিরিয়ে নিলাম,বেশ বুঝতে পারছি,তোমাদের কাগজ অনেকদিন চলবে,আর হ্যাঁ,কবিসম্মেলনই এখন শ্রেষ্ঠ কবিতার পত্রিকা, এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।”
জাতকবির ভবিষ্যতবাণী একটি কবিতার কাগজ নিয়ে,
তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়ে যাচ্ছে।
এটাই তো কবির জয়, কবিতার জয়।
কবিতা যারা পড়েন না, তার দুর্ভাগা,অথচ দুঃখের বিষয় একথা তারা জানে না!
একথা কবি সুনীলেরই।
এই কথাটি ঘুরিয়ে বলা যায়,এবারের শারদীয়া কবিসম্মেলন ১৪২৭ যারা সংগ্রহ করতে পারেননি,তারা সেই কবিতা না পড়া লোকদের মতোই…
সবিনয়ে তাঁদের সঙ্গে আশ্চর্য পাঠের আনন্দ ভাগ করে নিলাম
আবার যদি সূচীপাতায় চোখ যায়,দেখা যায়,জাক দেরিকাকে নিয়ে লিখেছেন ভাষাবিদ সুভাষ ভট্টাচার্য, শক্তি ও সুনীলকে নিয়ে অনবদ্য স্মৃতিচারণা করেছেন তপন বন্দ্যোপাধ্যায়।
কবি মৃদুল দাশগুপ্ত স্বরান্ত কবি শম্ভু রক্ষিতের জীবন ও কবিতা মরমী ভাষায় তুলে ধরেছেন,বোঝা যায়,কবিকে আগুন পোড়াতে পারে না!
কবি বীতশোক ভট্টাচার্যের কবিতার আশ্চর্য আলোকপাত করেছেন সুপ্রাবন্ধিক নিতাই জানা।
বাঙালি বীর মুজিবর রহমান এবং একটি কবিতার ইতিহাস অঙ্কন করেছেন প্রবণ চৌধুরী।
একদিকে আর্যনীল মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পো সম্পর্কের নতুন রসায়ন প্রকাশিত, অন্যদিকে কবি কীটসের লেখা প্রেমিকাকে সকাতর চিঠির অনুবাদ যেন কবিতার চেয়ে সুউচ্চ কারুকার্য।
আরও আছে কবিতার সাতসমুদ্র, তার ঢেউ,গভীরতা,অভিযান এবং অসংখ্য সভ্যতা সৃষ্টির অনাবিল সূর্যোদয়।
সেই সূর্যালোক থেকে কবি ও সম্পাদক শ্যামলকান্তি দাশ যখন লেখেন—
“রইল তোমার শরীর
রইল তোমার ভোগলিপ্সা…
মানুষের সঙ্গে আমি ডানা মেলালাম
উড়ে গেলাম সন্ধ্যার ওপারে
তুমি হিমশিম খেয়ে যাবে,দিগন্তের
বর্ণালী মিলিয়ে যাবে,তবু তুমি আমাকে
কিছুতেই ধরতে পারবে না”

সত্যি তাই,এই ধরণের আকাশনির্মাণকারী একটি অক্ষর আলোর বোধযাত্রী পত্রিকা যদি সঙ্গে থাকে,কিছুতেই ধরতে পারবে না!
পুনশ্চ। এবার কবিসম্মেলন এর প্রচ্ছদ এঁকেছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী ধ্রুব এষ।
এই করোনাকালীন অতিমারীর কালে শুধু মানুষ মরছে না,প্রতিদিন একে-অপরের অসহযোগিতা-অসচেতনায় মনুষ্যত্ব মরে যাচ্ছে!
সবকিছুর ভেতর যেন লাল লাল রক্তের হাড়মাস দৃশ্যমান।
সে পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হোক বা ব্রিফকেসের ওপর ঘুমন্ত ছোট্ট শিশুর জীবনযাত্রা হোক অথবা করোনা আক্রান্ত কোনো রোগীকে সকলের অমানবিক অসহযোগিতা সবই যেন সেই মনুষ্যত্বহীনের রক্তজালিকা।
তাই বোধহয় সময়ের সূচককে লাল সিঁদূর ঢেকে রেখেছে।তবুও এত ভয়ংকর লালরঙের মধ্যেও শ্বেতশুভ্র শঙ্খ আছে এবং আকাশে পূর্ণ চাঁদ।
এতো মরতে মরতে বেঁচে থাকার কাব্যিক সম্মেলন।
তাই প্রচ্ছদ এককথায় অনবদ্য আশার আয়না।

যে আশাই আমাদের সভ্যতার জিয়নকাঠি।

————————–//——————