বাংলার সংস্কৃতিতে বাহ্যিক অলংকরণে আজকের আধুনিক সময়ে অনেক ঝলক বাতির সংযোজন হয়েছে..তবুও সেই শীতের রাতে গ্রামীণ জনপদের শিশির ভেজা ঘাসে জবুথুবু হয়ে বসে যাত্রা দেখার দৃশ্যটা তৎকালীন আপামর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জন্য এক অসাধারণ সুখের বিনোদন ছিলো বৈকি..! ‘না না না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাবো না’- মান্নাদের কণ্ঠে বিখ্যাত গানটির জনপ্রিয়তা বুঝিয়ে দেয় সাধারণ বাঙালিদের নিকট, নাট্যশিল্পে যাত্রা এবং অধুনা মঞ্চ নাটকের মনপ্রিয়তা এবং একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসাবে যাত্রার রাজকীয় পরিচিত..!
বাংলার সংস্কৃতির এই সম্বৃদ্ধ মাধ্যমের একজন একনিষ্ঠ পূজারী, পশ্চিম বাংলার পালা ও মঞ্চ নাটকের নাট্যকার নাট্যব্যক্তিত্ব বিশ্বজিৎ পুরকায়স্থ আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য তার অসাধারণ সব সৃষ্টি রেখে সকলের অলক্ষ্যে নিভৃতে চলে গেলেন গত ২৯ শে অগ্রহায়ন ১৪২৮ বৃহস্পতিবার…!
নাট্যকার বিশ্বজিৎ পুরকায়স্থ বাংলা ২১শে পৌষ ১৩৪৪ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মথুরাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন..! পিতা বিজয় কৃষ্ণ পুরকায়স্থ মাতা নিভা রানী দেবীর একমাত্র পুত্র শ্রী বিশ্বজিৎ পুরকায়স্থ এর স্কুল জীবন থেকে ছিল নাটক লেখার নেশা.. পরবর্তী জীবনে যিনি নাটক লেখাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এই শিল্পকে ভালোবেসে..! তিনি ছিলেন পেশাদারী মঞ্চে অনেক সফল নাটকের স্রষ্টা…!
এই প্রচার বিমুখ নাট্যকারকে পশ্চিমবঙ্গের যাত্রা-মোদি মানুষ তার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে চিরদিন স্মরণ করবে তার কাজের মাধ্যমে..!
পাঁচ জন সফল পালাকারের নাম করতে বললে মানুষ অবশ্যই ব্রজেন দে, সুনীল চৌধুরী, ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের পর বিশ্বজিৎ পুরকায়স্থকেই উল্লেখ করবেন…!
উনার বিখ্যাত যাত্রাপালা গুলির মধ্যে ছিলো, দক্ষযজ্ঞ, অসুর নিধন যজ্ঞ, বিদ্রোহী সন্ন্যাসী ,
কালাপাহাড়, ধাত্রী পান্না, সোনারগাঁয়ের সোনা মেয়ে, রক্তনদীর ধারা, মরা মানুষের মিছিল, নাদির শাহ, শার্দুল জারাক খান প্রভৃতি… যা একসময় সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই সাধারণ মানুষের মন প্রিয় হয়ে নাট্যজগতে আলোড়ন তুলেছিল…!
এইরকম একজন মহান নাট্যব্যক্তিত্ব বার্ধক্যজনিত দীর্ঘ রোগ ভোগের পর গত ২৯ শে অগ্রহায়ণ ১৪২৮বৃহস্পতিবার এই ধরাধাম এর মায়া ত্যাগ করে নিজেও সাধনাচিত ধামে গমন করেন..! মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর..মৃত্যুর পর তিনি রেখে গেলেন তার বিশাল নাট্য সম্ভার, স্ত্রী মহাশ্বেতা দেবী, তিন কন্যা (বিবাহিত) ও তিন পুত্রকে..! উল্লেখ্য যে উনার পুত্রদের মধ্যে বড় পুত্র রজত পুরকায়স্থ চোখ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক, চোখ সংস্কৃতি মঞ্চ চোখ শিক্ষা নিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা ও সময়ের একজন সুযোগ্য সাহিত্যিক…! অন্য দুই পুত্র আশিস ও শিলাদিত্য পুরকায়স্থ উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকতায় প্রতিষ্ঠিত..!
যে সকল যাত্রার নায়ক নাট্যকার শ্রী বিশ্বজিৎ পুরকায়স্থ এর লেখা নাটক অভিনয় করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শান্তিগোপাল ( পালার নাম “বিদ্রোহী সন্ন্যাসী” স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে লেখা ) , শিবদাস ভট্টাচার্য্য ( শার্দুল জারাক খান ), রাখাল সিংহ ( কালাপাহাড়, নাদীর শাহ, পিশাচ বক্তিয়ার, দক্ষযজ্ঞ, অসুর নিধন যজ্ঞ ), নিরঞ্জন ঘোষ ( মরা মানুষের মিছিল ), পশুপতি ভট্টাচার্য্য ( বাদশা ), শ্যামসুন্দর গোস্বামী ( বিরহিনী রাই ), যাত্রাসম্রাট স্বপন কুমার ( স্ত্রী ) ইত্যাদি…!
প্রত্যেকটি পালা পশ্চিমবঙ্গের যাত্রা-মোদী মানুষের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল..!
নাট্যকার বিশ্বজিৎ পুরকায়স্থের স্ত্রীর নাম – মহাশ্বেতা পুরকায়স্থ..যাকে তিনি তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবন ও সংসার জীবনে পাশে পেয়েছিলেন যোগ্য সাথী হিসেবে..!
যুগ বদলেছে.. বিনোদনের রকমসকম বদলেছে..গ্রামেগঞ্জে পুজোর সময় যাত্রাপালা টিভি সিরিয়াল বা চলচ্চিত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখনও মাটি ধরে রেখেছে শক্ত শিকড় দিয়ে…! আজও বিভিন্ন এলাকার পুজোকমিটির কর্মকর্তারা মনে করেন , একটা দিন যাত্রাপালা না হলে পুজোটা যেন সম্পূর্ণ হল না বলে মনে হয়…!
পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘থিয়েটারে লোকশিক্ষা হয়’…! যাত্রা ও থিয়েটার এক অভিন্ন মাধ্যম হয়ে টিকে থাক বাংলার সংস্কৃতিতে..!
বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে যাত্রা পালা ও মঞ্চ নাটকের একজন সম্বৃদ্ধ নাট্যকার হিসেবে আমাদের কাছে চিরকাল স্মরণীয় থাকবেন শ্রী বিশ্বজিৎ পুরকায়স্থ…!
সৌগত রাণা কবিয়াল–
— কবি সাহিত্যিক ও কলামিস্ট)