ক্যামেরার আড়ালে (অণু উপন্যাস, অন্তিম পর্ব) : মানস সরকার।

0
424

একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। অটোস্ট্যান্ডে বেশ কিছুক্ষণ ধরে যাত্রীর দেখা নেই। দুপুরের দিকে এখনও চন্দননগরের মতো জায়গায় লোকজনের সংখ্যা কমে আসে।
হসপিটাল মোড়ের বেশিরভাগ দোকানই এই সময়টা বন্ধ হয়ে যায়। ছেলে দু’টো সামনে এসে দাঁড়াতেই সোজা হয়ে বসল সমীর। প্রথমে মনে হল যাত্রী। কথা শুরু করতেই অলসভাবটা কেটে গিয়ে নিজের মধ্যে সঙ্কোচন টের পেল।
– তুই সমীর?

যে–ছেলেটি প্রশ্নটা করল, বেশ লম্বা। তামাটে শরীরের অধিকারী। চেহারাটা বেশ পেটানো। সাজ-পোশাকে একদম আজকের হিন্দি ফিল্মের প্রভাব আছে। মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলতেই প্রায় হুকুমের সুর ভেসে এল, নেমে আয়।
নেমে আসতেই আরও দু’জনকে চোখে পড়ল। একজন একটু বয়স্ক, একটি পরিচিত রাজনৈতিক দলের মিছিলে প্রায়ই দেখা যায়। অন্য আরেকজন একটু গোলগাল, ডান হাতে বালা। গোলগাল ছেলেটির মুখে চোখে পড়ার মতো একটা কাটা দাগ আছে। প্রথমে যে কথা বলেছিল, সেই-ই আবার শুরু করল।
– খুব বাড় বাড়ছিস। কিন্তু তুই। খচরামি হচ্ছে। কান দু’টো গরম হয়ে গেল সমীরের। এক সেকেণ্ডেই বুঝে ফেলল, যা হচ্ছে তা ভাল হচ্ছে না। এখুনি ব্যাপারটাকে ঠান্ডা মাথায় সামলাতে না পারলে বড় ঘটনা ঘটে যাওয়াও বিচিত্র নয়। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিল। ওর অটো ছাড়াও বাবলুটার দাঁড়িয়ে আছে। এই সময়টা বাবলু হসপিটাল মাঠে গাছের ছায়ায় তাস খেলতে যায়। নিজেকে শান্ত রেখে গম্ভীর মুখে বলে উঠল, কী ব্যাপার বলুন তো! কী বলছেন, কিছু বুঝতে পারছি না।
– লে, নাটক মারাচ্ছে। শুনলাম, আবার কোর্টে বলতে যাবি।
মনে পড়েছে। কোর্টে এবারের বলাটাই নাকি ফাইনাল। আর যাবার দরকার নেই। এমনটাই বলেছিল তমালী। সহজভাবে বোঝানোর চেষ্টা করল সমীর, তোমাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আমাকে কোর্টে আর ডাকবে না। কিন্তু কী বলতে চাইছ, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
হাতে বালাপড়া ছেলেটা এবার এগিয়ে আসে। অপর লোকটি দূরে যেমন দাঁড়িয়েছিল, তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। এই ছেলেটা খিস্তি দিল না। কিন্তু কথা বলার ধরন শুনে সত্যিকারের খুনি মনে হচ্ছিল।
– শোন ভাই, তোরা কিন্তু ফালতু ব্যাপারটাকে উস্কাচ্ছিস। এ সব ব্যাপার থেকে সরে আয়। আমরা খুন করলে কাক-পক্ষীও টের পায় না। আর কথাটা

ভালভাবে বুঝে নে।
সমীরের কানে বাজছিল ‘তোরা’ কথাটা। তার মানে এরা দেবাশীষদা, তমালী আর ইন্দ্রদাকেও ভয় দেখিয়েছে বা দেখাবে। মাথার মধ্যে দপদপানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। বুকের ভেতর ভয়ের ঢেউ। মাথা নীচু করে বলে উঠল, আমি কোর্টে আর যাব না।
হিরোমতো দেখতে ছেলেটার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। গেঞ্জিটা তুলে কোমরে রাখা জিনিসটা দেখবার সুযোগ করে দেয়। আসল কি নকল পিস্তল তা বোঝা শক্ত। কেননা, কোনওদিন দেখার সুযোগ হয়নি। তবুও পিছিয়ে আসতে হয়। ভোঁ ভোঁ করতে থাকে মাথাটা। বাইকে উঠে ওরা তিনজন চলে যায়।
অটো ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয় সমীর। যাত্রী বইতে আজ আর এতটুকু ভাল লাগছে না।

শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ইন্দ্র। গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে ঢুকল নীতা। অনেকদিন পর ওর মুখে গান শুনে অবাক হচ্ছিল। চোখেমুখে উদাসভাবটা দূর হয়ে যে দ্যুতি দেখা যাচ্ছিল, তা গানটার সুরের সাথে চমৎকার মানিয়ে যাচ্ছিল। এরকম ভাললাগায় এক ধরনের আবেশ এসে যায়।
খাটের সামনে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ইন্দ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল নীতা। রহস্যময় এই দৃষ্টি বেশ অচেনাই।
– ক’টা দিন একটু মায়ের কাছে গিয়ে থাকব ভাবছি। সহজ গলায় বলল নীতা।
– কী ব্যাপার, হঠাৎ, কথাটা বলেই অন্যদিকে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল ইন্দ্র, আসলে কেন কথাটা বলছি, বোঝই তো। হোমসার্ভিসের খাবার আমার ভাললাগে না।

– কয়েকটা মাস মানিয়ে নাও।
– কয়েক মাস!
– হ্যাঁ, মাস আটেক তো বটেই।
কিছুক্ষণের জন্য কোনও কথা বেরলো না।
এবার এগিয়ে এসে ইন্দ্রর দু’কাঁধে দু’টো হাত রাখে নীতা। মুখে রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে বলে ওঠে, আমায় রাখতে যাবে? – না যাওয়ার কী আছে! কিন্তু এতদিনের জন্য…। নিশ্চয়ই ইয়ার্কি মারছ।
– না মারছি না। কিন্তু যাব।
দু’হাত বাড়িয়ে খাটে বসে থাকা অবস্থাতেই নীতার কোমরটাকে দু’হাতের বেষ্টনির মধ্যে আনে ইন্দ্র। নাকটা এগিয়ে বুক ভরে ওর শরীরী গন্ধ নেয়। খাটের পাশে পড়ে থাকা একটা প্যাকেটকে হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় নীতা। সযত্নে তা থেকে বের করে গোলাপী বন্ধনী চিহ্নের একটা স্লাইডকে। একপলক দেখেই যা বোঝার বোঝা হয়ে যায়। নীতার হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়েই জিনিসটাকে দেখতেই সারা শরীর ঘিরে বিস্ময়ের ঝড়। এই মুহূর্তের এই আনন্দটুকু বহুদিন আগের আরেকটা মুহূর্তের সাথে তুলনা করলে অনেক বেশি ঘন, বহুমাত্রায় আবেগী। গলায় উচ্ছ্বাস মাখিয়ে ইন্দ্র বলে ওঠে, কবে করলে টেস্ট? মুখে পবিত্র হাসি ফুটিয়ে তোলে নীতা, আজকেই। – আর তুমি বলছ চলে যাবে! তোমাকে তো বলেইছি আগেরবারের সিদ্ধান্ত আমার ভুল ছিল। আমি অন্যায় করেছিলাম। তার জন্য ভেতরে ভেতরে আমি কম মূল্য দিইনি। এবার চলে গেলে বুঝব, তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না….।
– এভাবে বোলো না প্লিজ। ডিশিসনটা তোমার একার ছিল না। আমিও মত দিয়েছিলাম।
ভেতরে ভেতরে জোয়ারের জলের আঘাতে নদীর পার ভাঙার মতোই ভেঙে

যাচ্ছিল ইন্দ্র। মানানোর ক্ষমতা সংসারে মেয়েদেরই বোধহয় বেশি হয়। কারণটা কী! ওদের ধারণ ক্ষমতা বেশি বলে। সেবার ডাক্তারের ক্লিনিক থেকে ফিরে এসে অস্বাভাবিক নীরবতা পালন করছিল নীতা। তারপর রাতের খাবার খেয়ে দু’জনের শুয়ে পড়া। ভোররাতে ঘুম ভাঙতে বুঝেছিল, বিছানার পাশের অংশটা খালি। আলো জ্বেলে, বেডরুমের মেঝেতে তাকাতে চমকে উঠেছিল। মেঝেময় ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। উফ্‌, এর আগে এইভাবে রক্ত দ্যাখেনি। তারপর ভোরবেলা পর্যন্ত মেঝে পরিষ্কার করা। না কি নিজের শরীর থেকে একটা খুনির তক্‌মাকে খুলে ফেলার চেষ্টা। প্রায় একইরকম রক্ত সেদিন অটোর মধ্যেও দেখছিল। এই ক’মাসে পলে পলে বুঝেছে, প্রাণ আর রক্তের মূল্যকে। হিস্টোরিয়া রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে জড়িয়ে ধরে নীতাকে। – এই, এটা কী বাচ্ছামো হচ্ছে! আশ্চর্যভাবে ওর স্বর শান্ত, শোনো, আমি এখানে থাকলে তুমি অযথা টেনশড্‌ হবে। কোর্টের একটাই ডেট বাকি আছে। ওটার ঝামেলা মিটিয়ে নাও। এতদূর এগিয়ে এসে পিছিয়ে যেও না। আমি ক’টা দিন এই ফাঁকে মায়ের কাছ থেকে ঘুরে আসি। এই ক’মাসে একবারও ওর মুখে মৃত্যুর প্রসঙ্গ শোনেনি। ভুল করেছিল ইন্দ্র। প্রাণের মূল্য ওই তো সবথেকে ভাল বুঝতে পারবে। বুকের ভেতর আজ একটা অন্যরকম উত্তাপ। আঃ, কী আরাম। প্রাণের সৃষ্টি সত্যিই মানুষকে বোধহয় সাহসী করে তোলে।
মোবাইলটা বাজতে শুরু করেছে। হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে অন্‌ করতেই সমীরের গলা। – ইন্দ্রদা, আপনার সঙ্গে একটা খুব জরুরি কথা ছিল। কাল সকালে একবার আসব আপনার কাছে?

গন্ধটা ঠিক কীসের কিছুতেই বোঝা যাচ্ছিল না। একবার মনে হচ্ছিল, কদমফুলের, পরক্ষণেই মনে হচ্ছিল, চোলাই মদের। থানায় ঢোকার মুখেই কদমফুলের গাছটা দেখতে পেয়েছিল। চোলাই মদ থাকলেও তা থানার মধ্যে কোথায়, জানা একপ্রকার অসম্ভব। সকালেই ইন্দ্রদা সমীরকে ফোন করেছিল।
– কী রে, আজ থানায় যাবি তো? ভাবতে একটু সময় নিয়েছিল সমীর। তারপর বলে উঠেছিল, কোনও ঝামেলা হবে না তো? নতুন ওসিটা হেভি কড়া।
– সে কড়া হোক, খুন্তি হোক বা চাটু, তোকে দেখতে হবে না। তাছাড়া তুই তো যাবি আমার সঙ্গে। আর কড়া লোককেই তো চাইছি আমরা। এখন ইন্দ্রদাকে বেশ অদ্ভুত লাগে। দেবাশীষদা বা তমালী দু’জনকেই চাঙ্গা করেছে এই ইন্দ্রদাই। নিজে চোখে কিছু না দেখেও স্রেফ একটা অর্ধমৃত মানুষকে অটোতে বহন করলেও যে থ্রেট খেতে হয়, জীবনে প্রথম জানল। ওরা তিনজনে সরাসরি হয়তো কিছু দ্যাখেনি। কিন্তু উকিল বেশ কয়েকবার একথাটা শুনিয়ে দিয়েছে যে, কোর্টের সামনে ওইটুকু বলাতেই অনেক কিছু হতে পারে।
– কথাবার্তা কিন্তু তোমাকেই বলতে হবে, গলায় সন্দেহ ফুটিয়ে বলে উঠেছিল সমীর। গুছিয়ে কীকরে অত বলতে হয় আমি জানি না।
আওয়াজ করে হেসে ফেলেছিল ইন্দ্রদা। বলেছিল, আগে তুই আয় তো।
সেই ইন্দ্রদার সঙ্গেই এখন ওসি-র ঘরের সামনে। একজন কনস্টেবল সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যান্ত্রিক গলায় বলে উঠল, আসুন আপনারা।
ঘরটার মধ্যে ঢুকে বুকটা কেমন হালকা লাগছিল। পেলমেটে ভারী পর্দা। পেছনের র‍্যাকটার একগাদা মোটা মোটা ফাইল। ওসি-র দিকে তাকিয়ে অবশ্য বেশ ভাল লাগছিল। যথেষ্ট কম বয়স। সচরাচর পুলিশের যেরকম চেহারা হয়, মোটেও

সেরকম নয়। রীতিমতো পেশীবহুল চেহারা। মুখের অমায়িক হাসিটা ভরসা হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল।
ওদের দু’জনের দিকে তাকিয়েই সামনের দু’টো চেয়ারে বসতে বললেন। টেবিলের ওপরেও বেশ কয়েকটা ফাইল। খোলা জানালা দিয়ে আলো আসলেও টেবিলের ওপর রিডিং লাইটটা জ্বালানো। ইন্দ্রদাকে উদ্দেশ্য করে সহজ গলায় বললেন অফিসার, আপনাকে তো আগেও বলেছি, এ ধরনের কেসে থ্রেট ব্যাপারটা খুব কমন।
একটু অবাক লাগল সমীরের। কথা শুনে যা মনে হচ্ছে, তাতে ইন্দ্রদার সঙ্গে ওনার আগে থেকেই একটা চেনা-জানা আছে। নিশ্চিন্তিভাবটা ক্রমশই ফিরে আসছিল ওর মধ্যে। – ডেসক্রিপশনটা ডিটেলসে আরেকজন জুনিয়র অফিসার রেকর্ড করে নেবেন, বললেন ওসি।
ইন্দ্রদা বলল, তবুও আপনাকে আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে। ছেলেগুলোর বর্ণনা একটু ওর মুখ থেকেই শুনে নিন না। অবশ্য যদি আপনার খুব অসুবিধা না হয়।
কথার জবাব না দিয়ে ওসি টেবিলের পাশে রাখা বেল টিপলেন। বাইরে দাঁড়ানো কনস্টেবলটি উঁকি দিতে তাকে নির্দেশ দিলেন, সিন্‌হা সাহেবকে ডাকো।
ভেতরে চমকালো সমীর। তমালীর মুখে শুনেছে, কেসের ইনভেস্টিগেটিং অফিসার নাকি এই সিন্‌হা সাহেবেই। গলায় ক্ষোভ ফুটিয়ে বলে উঠেছিল তমালী, লোকটার দৃষ্টি ভীষণ খারাপ। আর ব্যবহারেও নোংরা, ইতর। তমালীর আরও সন্দেহ, কেসটাকে খুনিগুলোর ফেবারে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই লোকটার নাকি চেষ্টার অন্ত নেই।
সিন্‌হা সাহেব ঘরে ঢুকতেই নিজেকে একটু আড়ষ্ট লাগল। ইন্দ্রদার ভেতরে অবশ্য কী চলছে, বাইরে থেকে আন্দাজ করা খুব শক্ত। লোকটার দিকে একবার

তাকিয়েই মনে হচ্ছিল, তমালী খুব একটা ভুল কিছু বলেনি। কথা বলা শুরু করতেই সিনিয়র অফিসারের সামনে তা তেল মাখানো মনে হচ্ছিল। – হ্যাঁ, সিন্‌হা সাহেব, সমীরকে নির্দেশ করে দেখালেন ওসি, ওনার নাম সমীর। আপনার কেসের কারণেই ওনাকে হসপিটাল মোড়ে দু’দিন আগে একটা হেভি থ্রেট দেওয়া হয়। আমার সামনে এখুনি ওর স্টেটমেন্টটা রেকর্ড করুন।
এবার সমীরের দিকে ফিরে বেশ নরম গলায় বললেন ওসি, সেদিন ঠিক কী হয়েছিল, একবার ঠিকঠাক মনে করে বলুন তো ভাই।
গলা কাঁপছিল। কাঁধে একটা হাত উঠে এল। বুঝতে পারল, সেটা রেখেছে ইন্দ্রদা। বাবার মুখটা একবার মনে পড়ে গেল। সব বলতে শুরু করল সমীর।
শুনতে শুনতে ওসি-র মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল।

ইলেক্ট্রনিকস্‌ বোর্ডটায় গাড়ির নাম, সময় এবং প্ল্যাটফর্ম নম্বর ফুটে উঠছিল। সুরেলা কন্ঠে ট্রেনের ঘোষণাও শোনা যাচ্ছিল। দেবাশীষ আড় চোখে তাকালেন ইন্দ্রর দিকে। মুখটায় হতাশা আর বিষণ্ণতার ছাপ ফুটে উঠেছে। এই ক’দিনে ইন্দ্র অসংখ্যবার বুঝিয়েছে। শোনেননি দেবশীষ। শুনতে পারলেন না। পাপ খণ্ডণের একমাত্র রাস্তা প্রায়শ্চিত্ত। আর সেটাই করতে হবে। এটাই প্রায়শ্চিত্ত কি না জানা নেই। কিন্তু বিকল্প পথও নেই। একপ্রকার বাধ্য হয়ে বম্বেতে আবার ট্রান্সফার নিলেন। বিবেকের কাছে বাধ্য হয়ে। অফিসের কিছু মানুষ হাসাহাসি করেছে। কিছু মানুষ ফায়দা তোলার কথা বলেছে। নিজে অবশ্য মুচকি মুচকি হেসেছেন। হঠাৎ করে কেন এই সিদ্ধান্ত, নিজেও যে খুব বুঝিয়ে বলতে পারবেন–এমনটা মোটেও নয়। সত্যিকারের প্রেম বোধহয় যেকোনও বয়সেই আবেগ তুলতে পারে। ভালই হল। নিজের বয়স কমছে মনে হচ্ছে। সুমনার সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আদৌ আছে কি না খতিয়ে দেখেননি। তবু একটা অনিশ্চিত ভাবনাকে আশ্রয় করেই প্রায়

একা একা জীবনের আরেকটা অংশকে দেখতে চান ধূসর আরব সাগরের পাশে বসে, হ্যাংগিং গার্ডেনের সবুজ গালিচায়। এই শেষ ক’মাসে চন্দননগর অনেক কিছু ফিরিয়ে দিয়েছে ওনাকে। একটা ছোট্ট শহরের কাছে উনি কৃতজ্ঞ। এই মুহূর্তে ওনাকে তমালীর আর প্রয়োজনও নেই। চন্দননগর স্টেশনে সমীর আর তমালী দু’জনেই ছাড়তে এসেছিল আজ। এই ক’মাসে কেমন যেন একটা দল তৈরি হয়েছিল। চমৎকার লাগছিল সমীর আর তমালীকে। মুখ ফুটে বলতে পারেননি। কিন্তু মনেপ্রাণে চেয়েছেন ওদের দু’জনের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠুক। দু’জন যেন দু’জনের জন্যেই তৈরি। অবশ্য মেয়েটার আবার কার সঙ্গে যেন একটা সম্পর্ক-টম্পর্ক আছে। তবু মনে হয় সুস্থ জীবনযাপন করতে গেলে সম্পর্কের কম্বিনেশনটা ঠিক হওয়া দরকার। নাহলে সারাজীবন ধরে একটা মানুষকে মূল্য চোকাতে হয়।
– চলুন দেবাশীষদা, এবার এগোতে হবে, বড় কিট্‌সটা নিজের ডান কাঁধে তুলে নিয়ে বলল ইন্দ্র, আর জলের বোতলগুলো হ্যান্ডব্যাগে নিয়েছেন তো?
হ্যাঁ-সূচক ঘাড় নাড়লেন দেবাশীষ। নিজের ভাই নেই। এই ছেলেটাকে ছেড়ে যেতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। নিজের দাদার মতোই ওনাকে সম্মান দিয়ে এসেছে। এতবার বলা সত্ত্বেও শুনল না। অফিস কামাই করে হাওড়ায় তুলতে এল।
দেবাশীষ বললেন, আমার নম্বরটা শুধু ফোনে সেভ কোরো না। অন্য কোথাও লিখেও পৌঁছে আমি আমার অ্যাডড্রেস আর বেসফোনের নম্বরটা চিঠিতে হোক বা ই-মেলে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর সময়-সুযোগ পেলে বরঞ্চ চিঠিটাই লিখো। হারিয়ে যাওয়া শিল্প। তোমাদের ছোঁয়া পাব বেশি।
– ছোঁয়া বেশি বেশি করে পেতে চান বলেই তো আবার আপনাকে বম্বে যেতে হচ্ছে, বলুন?
দেবাশীষ খুব ভাল করেই জানেন এটা ইন্দ্রর কত বড় আবেগের কথা। এরকম মানুষের সংখ্যা আজকাল কমে আসছে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে এইসব

মানুষের দেখা পেয়েছিলেন। হালফিলের বাংলা সাহিত্যে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আর গৌর বৈরাগীর লেখায় এরকম কিছু কিছু চরিত্রের সন্ধান পেয়েছেন। পশ্চিম বাংলা থেকে বেশ কিছু বাংলা বই-ও নিয়ে গেলেন। সময় কাটানোর ন্যূনতম কিছু উপকরণ তো হাতের কাছে থাকা চাই।
খুব সহজেই নিজের কামরা আর সিট নম্বর খুঁজে পেলেন। সিটে বসিয়ে দিয়ে ইন্দ্র হাত রাখল ওনার হাতের ওপর, দাদা, সময়-সুযোগ পেলে আবার কিন্তু চলে আসবেন। আর অবসরের পর আপনার পার্মানেন্ট অ্যাডড্রেস কিন্তু চন্দননগরই।
চেষ্টা করেও কথা বলতে পারলেন না দেবাশীষ। বুকের ভেতর একটা মোচড়, যা উপলব্ধি করেছিলেন বম্বে থেকে চলে আসার সময়…।

বহুদিন বাদে আজকে নিজেকে অলস লাগছিল তমালীর। সারা শরীর জুড়ে নেমে আসছে একটা মিষ্টি পরশ। অনিমেষের সঙ্গে সম্পর্কটা হওয়ার পরের দু’-তিনটে দিন এই অনুভূতিটাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল সমস্ত মন আর শরীর জুড়ে। তারপর একদিন আবিষ্কার করল, শরীরটাই আছে, অনুভূতিটা কোথায় হারিয়ে গেছে। কথা দিয়েছিল অনিমেষকে, দু’জনে একসাথে পথ চলবে। সঙ্গী এগিয়ে গেছে কি পিছিয়ে গেছে, জানা নেই। নিজে নিজের মতো পথ হেঁটে চলেছে।
কাল বাড়ি এসে হঠাৎ করেই প্রস্তাবটা শুনিয়েছিল সমীর। শীতকাল। চারদিকে বেশ একটা আনন্দ আনন্দ গন্ধ। এর আগে দু’-একবার এলেও কালকের মতো অত উত্তেজিত ছিল না। তমালীকে বাইরে বের করে দেখিয়েছিল ওর উত্তেজনার কারণকে।
– এইটা নিলাম। একদম ক্যাশে।

সাদা রঙের মারুতি অমনিটাকে দেখে বেশ ভালই লেগেছিল। অনেকবারই সমীরের মুখ থেকে শুনেছে, নিজের গাড়ি কিনে সেটাকে ভাড়ায় খাটানোর কথা। ছেলেটার স্বপ্ন আজ সার্থক দেখে ভেতর থেকে খুশি হচ্ছিল। এরপরই খুব আন্তরিক হয়ে তমালীকে প্রস্তাব দিয়েছিল সমীর, মাকে ছাড়া এখনও অবধি কাউকে আর বসাইনি। আপনার কোথাও যাওয়ার থাকলে আপনাকে আমি নিয়ে যেতে পারি।
মাথা নেড়ে বলতেই হয়েছিল তমালীকে, গাড়ি ভাড়া করে কোথাও যাওয়ার মতো সামর্থ আমার নেই।
– ওঃ, আপনি এতক্ষণ ধরে এই কথা ভেবেছেন। ভুল ভেবেছেন। আমি আপনাকে কোথাও একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসার কথা বলছিলাম। আর সত্যি কথা বলতে গেলে কী এত ছোটাছুটি করার পর…., একটু থমকে গিয়েছিল সমীর। তারপর বলে উঠেছিল, চলুন তো, কালকে আপনাকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।
খুব খুশি হয়েছিল মা। উদার হয়েই বলে উঠেছিল, ছেলেটা তো ভালই। একটু ঘুরে-ফিরে আয় বরঞ্চ।
আর ‘না’ করা যায়নি।
প্রথমটা খুব একটা স্বাচ্ছন্দ অনুভব করছিল না। এখন বেশ ভালই লাগছে। সমীরের গাড়ি চালানোর হাতটাও চমৎকার। জোরেও নয়, আস্তেও নয়। গাড়ির কাঁচ নামানো ছিল, আর তা দিয়ে অনবরত ঝাপটা মারছিল শীতের বায়ু। চুলে দোলা লাগিয়ে তা কি মনের ভেতরেও চলে গেল!
‘ছুটি’ পার্কের ভেতরটায় আসা অবধি ভাললাগা যেন বেড়েই চলেছে। রুটিনের বাইরে এলে এরকম লাগে। না কি এ ভাললাগাটা বাড়তি। দু’হাত বাড়িয়ে রোদ্দুর, ঘাসের সবুজ রঙ আর শীতল হাওয়াকে হঠাৎ মুঠোবন্দি করতে ইচ্ছে করছে।

সমীরকে আজ একদম অন্যরকম লাগছে। হালকা ব্লু পুলওভার আর ব্ল্যাক জিন্সে রূপালী পর্দার ছোঁয়া। নিজের শাড়ির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল তমালী। আকস্মিকভাবে রঙটা সমীরের সোয়েটারের সঙ্গে মিলে গেছে। এখন একটু দূরে নিম গাছটার গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে আছে ও। তমালী দাঁড়িয়ে দূরের ঝিলটাকে লক্ষ করছিল। সেখানে বেশ কিছু পাখি। কিছু চেনা, কিছু অচেনা। ঝাঁকের মধ্যে চেনা-অচেনার রঙকে মিলিয়ে ফেলছিল তমালী। পার্কে আজ লোকজন বেশ কম। ঝিলের ওদিকটায় কেবল একটা পিকনিক পার্টি। বয়স্ক লোকজন। তাই চড়া মিউজিকটা নেই। গভীর প্রশান্তিতে ডুবে যাচ্ছিল তমালী না কি এই প্রকৃতির নীরবতা ওকে বলে দিচ্ছিল কিছুকে জড়িয়ে ধরার কথা, কিছুকে আঁকড়ে ধরার ইচ্ছাকে।
নীরবতা ভেঙে সমীর বলে ওঠে, আপনাকে কিন্তু একদিন আমার মা দেখতে চেয়েছেন। যাবেন?
– যাব, নিজের কণ্ঠকে ভাসিয়ে দিল তমালী, কবে নিয়ে যাবেন বলুন।
– আপনার যেদিন খুশি?
– চলুন। উঠে দাঁড়ায় তমালী।
– কোথায়!
– আসুন না, ঝিলের ওপারটায় যাব।
– দাঁড়ান, দাঁড়ান, সামনেটায় কাদা আছে।
কোনও কথা না বলে তমালী নিজের বাঁ হাতটা এগিয়ে দেয় সমীরের দিকে…।

নমস্কার, আপনার দেখছেন, রোজের খবর। এই মুহূর্তের সবথেকে বড় খবর – অবশেষে রায়দান সৌম্য হত্যার।

প্রায় দীর্ঘ দু’বছর পর অবশেষে মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট সৌম্য ঘোষ হত্যা মামলার শান্তি ঘোষণা করল। আজ বেলা বারোটা থেকে এই চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার রায়দান শুরু হয়। ঘন্টাখানেক আগে থেকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয় আদালত চত্বরকে। আদালতে তো বটেই, এদিন সৌম্যর বাড়ি চন্দননগরেও ছিল টান টান উত্তেজনা।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে এই খুন হওয়া থেকেই রাজ্য-রাজনীতিতে তোলপাড় শুরু হয়। সেই সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল শাসক গোষ্ঠীর নামে এই অভিযোগই আনে যে, বছরের পর বছর শুধুমাত্র তাদের মদতেই চন্দননগরে মতো শহরে অপরাধের কালো ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। সরকারের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত অবশ্য এই নারকীয় ঘটনার দ্রুত তদন্ত চলে এবং পুলিশ রাজা মণ্ডল এবং সোনা দাস নামে দু’জনকে গ্রেফতার করে।
অবশ্য প্রভাবদুষ্ট ছাতার কারণে বিচার প্রক্রিয়া যেমন বিলম্বিত হয়, ঠিক তেমনি সাক্ষীরাও সেভাবে মহামান্য আদালতকে যথেষ্ট পরিমাণ সাহায্য না করায় কেসটির ভিত্তি দূর্বল হতে থাকে। এমনও অভিযোগ উঠে আসে, যে মৃতের বোন যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পর এই কেসের রায়দানে যাবতীয় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
বছরখানেক আগে সরকার, বিরোধী পক্ষের বেশ কিছু মানুষ এবং গণ্যমান্য সমাজের মানুষেরা সৌম্যহত্যার আসামীদের শাস্তিদানের ব্যাপারে মুখ খুললে মামলাটির জট খোলার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
নেশার ঘোরে নজিরবিহীনভাবে হত্যা নির্দেশ করে বিচারপতি সুবিনয় চট্টোপাধ্যায় জানান, “আইন ব্যাপারটিকে ঘৃণা সামাজিক অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করছে। আসামীদের জন্যই সৌম্যর মতো যুবকের এই সমাজকে কিছু দেওয়া সম্ভব হল না।”

বিচারক আসামীদের দোষী সাব্যস্ত করার পর দু’জনকেই চোদ্দ বছরের জেল, দেড় হাজার টাকা করে জরিমানা ও অনাদায়ে আরও তিনমাস জেলে থাকার নির্দেশ দেন…।
এই মুহূর্তে আমরা যোগাযোগ করতে পেরেছি মনস্তত্ত্ববিদ অবন্তীকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। হ্যাঁ, অবন্তীকাদি, আপনার কাছে জানতে চাইব, এই মামলার রায়দান এই ধরনের অপরাধ কমানোর ক্ষেত্রে সমাজে কি আদৌ কোনও ভূমিকা নিতে পারে? একটু যদি বুঝিয়ে বলেন…।

উপসংহার

বোধহয় ভাবছেন, এতক্ষণ যা পড়লেন তা আসল কাহিনি কি না। না, একেবারেই নকল – নির্ভেজাল কাল্পনিক, মনগড়া ঘটনা। তবে এ ঘটনার আবর্তন নিশ্চিতভাবেই বহুল চর্চিত একটি নারকীয় হত্যাকাণ্ডের আদলে বিস্তৃত করা হয়েছে। তবে মূল প্রেক্ষাপট, স্থান, চরিত্র, কার্যকারণ – খোলনলচে বদলেই বলা যায়।
তমালী, সমীর, ইন্দ্র, নীতা, দেবাশীষদা, অনিমেষ, সুমনা এবং তাদের অন্যান্য আত্মীয়-পরিজন-কারোরই বাস্তবে কোনও অস্তিত্ব নেই। কিন্তু সামাজিক মূল অন্য কোনও চরিত্রকে বিশেষভাবে উপস্থাপন করার জন্য এই সমস্ত ছায়া শরীরের উপচরিত্রদের গঠন করা হয়েছে। যদিও উপচরিত্র পদ বা আখ্যায় ব্যক্তিগতভাবে আমার আপত্তি আছে। সম্ভবত উপপত্নীদের মতোই উপচরিত্ররা সমাজে সেইভাবে আদৃত হন না। তাই উপচরিত্রের বদলে ছায়া চরিত্র শব্দটি ব্যবহার করলে কেমন হয়? পাঠক ঠিক করুন। বরঞ্চ যাদের ছায়ায় উল্লিখিত চরিত্ররা ধীরে ধীরে রক্ত, মাংস, লসিকা, কোষ, স্নায়ু ইত্যাদি পেয়ে বেড়ে উঠেছে, সেই সমস্ত মূল চরিত্রদের দিকে তাকিয়ে নেওয়া অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য। আসলে এই সমস্ত মূল চরিত্ররাই এই উপন্যাসের শরীর
পরের পৃষ্ঠায়………….৪৩
(৪৩)
তৈরিতে সবথেকে বড় ভূমিকা নিয়েছে, আমাকে অন্তহীন প্রেরণা যুগিয়ে গেছে। এরা শুভজিৎ, শুভম, রিমা বা মধুরিমা–যে কেউ হতে পারে। এরা হতে পারে শর্মিলা, সংযুক্তা বা সায়ক। আসলে এই উপন্যাসের মূল চরিত্র এরাই। এরাই তমালী, নীতা, ইন্দ্র, সমীর বা দেবাশীষকে নিজেদের ঘাম, রক্ত আর মনের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নির্মাণ করেছে। হাত ধরে উপন্যাসের চরিত্রদের নিয়ে গেছে পাঠকের দোরগোড়ায়। ক্যামেরার আড়ালে কারা শেষ পর্যন্ত হারিয়ে গেল, আর কারা এই জীবন চলচ্চিত্রে নির্দেশকের ভূমিকা নিল, উপন্যাসের পরিণতিতে দাঁড়িয়ে আমার নিজের কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এই গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য, কোন্‌ পথে কলম চালাব তা ভেবে নেওয়ার জন্য, পাঠকের অনুমতি নিয়ে এখানেই দাঁড়ি টানলাম।

—-(সমাপ্ত)