ভেট : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
487

গণপতি সাধুখাঁ সদ্য অবসর নিয়েছেন । এতকাল তিনি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদ অলংকৃত করেছেন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন । তাঁর জীবন দর্শনে নিষ্ঠা ও সততা অবিসংবাদিত । সারাটা জীবন তিনি স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের নিজের সন্তানের মতো যেমন স্নেহ করতেন তেমনি শাসনও করতেন । যার জন্য ছাত্র ছাত্রীদের শ্রদ্ধা ভালবাসা ছাড়া অবসরকালীন তেমন কোনো আর্থিক সুযোগ সুবিধা তাঁর কপালে জোটেনি । বেশীর ভাগ উপার্জিত অর্থ খরচ করেছেন দুস্থ নিঃস্ব ছেলেমেদের শিক্ষা প্রসারের প্রয়োজনে । এখন টানা চাকরি জীবনের পরে তাঁর স্বস্তির নিঃশ্বাস ।
দুটি মেয়ে । অনেক আগেই তাদের বিয়ে সমাপ্ত । তারা নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত । সেদিক দিয়ে গণপতিবাবুর শান্তি ষোলোআনা । যদিও মেয়েদের সখ্‌ আহ্লাদ মিটিয়েছেন তাঁর অর্ধাঙ্গিনী । শুধু তাই নয়, মেয়েদের মানুষ করা এমনকি পাত্র নির্বাচন একা হাতে সামলিয়েছেন তাঁর প্রিয় স্ত্রী । কেননা গণপতিবাবু স্কুলের হস্টেলেই থাকতেন । যদিও স্কুল খুব দূরে নয়, বাড়ি থেকে দশ কিলোমিটার । দিব্যি তিনি মোটর বাইকে বাড়ির ভাত খেয়ে স্কুলে যাতায়াত করতে পারতেন । কিন্তু স্কুলের স্বার্থে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সামগ্রিক উন্নয়নের কথা ভেবে, তিনি দিনের শেষে বাড়ি ফিরতেন না । স্কুল হস্টেলেই কাটিয়ে দিতেন । হস্টেলে থাকার পেছনে আরও একটা কারণ ছিল, যেসব ছাত্র ছাত্রী পড়াশুনায় পিছিয়ে তাদের নিয়ে দিনের শেষে বিশেষ ক্লাস করতেন । সেইসব ছাত্র ছাত্রীদের তৈরী করতে প্রচুর সময় দিতেন । এই জন্য হস্টেলে থাকাটাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন । তা ছাড়া বেতনের অর্দ্ধেক টাকা দুস্থ ছাত্র ছাত্রীদের পড়াশুনার পেছনে ব্যয় করতেন । যার জন্য তাঁর একটা নাম স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়, ছাত্র দরদী ।
এখন অবসর জীবনে স্ত্রীকে নিয়ে গণপতিবাবু খুব ভাল সময় কাটাচ্ছেন । কিন্তু তাঁর একমাত্র চিন্তা, পত্নীকে নিয়ে । তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ । সমস্যা মূলত হার্ট নিয়ে । সময়ে অসময়ে হার্টের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে ওঠেন । স্থানীয় ডাক্তারবাবুদের চিকিৎসায় বর্তমানে কিছুটা সুস্থ ।
( ২ )
তারপর একদিন গণপতি বাবু ও তাঁর স্ত্রী সরলা দেবী রাত্রির খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে রয়েছেন । রাত্রি তখন ১টা ।
হঠাৎ সরলা দেবীর বুকে যন্ত্রণা । সহজে থামছে না । ঘরে যে ট্যাবলেট ছিল সেটা খেয়েও বুকের যন্ত্রণা কমছে না । অসহায়ের মতো গণপতিবাবু ছটফট করছেন । অতপর কী করণীয়, সেটা তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না ? অগত্যা তিনি স্ত্রীকে নিয়ে স্থানীয় হাসপাতালে পৌঁছালেন । স্থানীয় হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরা কোনোরকম ঝুঁকি নিলেন না । সেখান থেকে সরাসরি কলকাতার বড় হাসপাতালে রেফার করে দিলেন । ভীষণ সমস্যায় পড়ে গেলেন গণপতিবাবু । অ্যাম্বুলেন্সের খুব অভাব । রাত্রিবেলায় কীভাবে কলকাতা পৌঁছানোর গাড়ি জুটবে সেই দুশ্চিন্টায় তটস্থ । এমন সময় হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসা এক রিক্সাওয়ালার সাথে দেখা । রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করে গণপতিবাবু জানতে পারলেন, তাদের গাঁয়ে নাদির আলির পুরানো আমলের একটা অলটো (ALTO) গাড়ি রয়েছে । গণপতিবাবু রিক্সাওয়ালার সঙ্গে ছুটলেন নাদির আলির কাছে । নাদির আলি পেশায় চাষি । তবে বর্দ্ধিষ্ণু চাষি । রিক্সাওয়ালার ডাক শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে হাই স্কুলের হেড স্যার গণপতিবাবুকে দেখে নাদির আলি অবাক, “স্যার আপনি !”
আমি খুব সমস্যায় পড়েছি নাদির । আমার স্ত্রীর ভীষণ অসুখ । স্থানীয় হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরা কোনোরকম ঝুঁকি না নিয়ে কলকাতার হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছেন । কিন্তু কলকাতা নিয়ে যাওয়ার কোনো গাড়ি মিলছে না । তাই তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তোমার গাড়িটা যদি একজন ড্রাইভার দিয়ে পাঠাও তাহলে আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতার হাসপাতালে পৌঁছাতে পারতাম এবং তাঁকে যথাযথ চিকিৎসার সুযোগ পেতাম ।
স্যার ! আর কোনো কথা বলবেন না । আপনি গাড়িতে উঠুন । এবার সব দায়িত্ব আমার । আপনার আর্থিক আনুকূল্যে আমার লেখাপড়া । আমি বড় চাকরি পাইনি ঠিকই, কিন্তু আপনার সদর্থক ভূমিকা না থাকলে আমার গ্রাজুয়েট ডিগ্রিটা সম্ভব হত না ।
তারপর গাড়ি ছুটলো কলকাতার দিকে ।
বড় রাস্তার উপরে ক্রসিংয়ে ট্রাফিকে গ্রীন সিগনাল । হঠাৎ চুক্তিবদ্ধভাবে নিয়োজিত ট্রাফিক এসে গণপতিবাবুর অলটো রাস্তার উপরে দাঁড় করিয়ে দিল । সেই ট্রাফিক সরাসরি ড্রাইভারকে হাতের ইশারায় বাইরে বেরিয়ে তাঁর সামনে যেতে বলল । নাদির নিজে গাড়ি চালাচ্ছিল । বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পর নাদিরকে ট্রাফিক জিজ্ঞাসা করল, লাইসেন্স সহ গাড়ির কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা ? নাদির মাথা নেড়ে বলল, “গাড়ির কাগজপত্র সব ঠিক আছে স্যার । কিন্তু এভাবে আমার গাড়ি দাঁড় করানোর কারণ কী ?”
“সামনে সার্জেন্ট রয়েছে, বেশী কথা বলবেন না । সার্জেন্টের কাছে নিয়ে গেলে আপনার শ্রীঘর কে রোখে ? সুতরাং যা বলছি, চুপচাপ তার উত্তর দিয়ে যান ।“
“আমার গাড়িতে ইমার্জেন্সি রোগী রয়েছেন । তাঁকে নিয়ে সত্বর হাসপাতালে পৌঁছানো ভীষণ জরুরি । তাঁর জীবন মরণের প্রশ্ন ?” নাদির বিনীত সুরে ট্রাফিকের কাছে অনুরোধ করল !
আপনাদের কাছে কাগজপত্রের কথা জিজ্ঞাসা করলেই আপনারা নানান অজুহাত দেখিয়ে পালাবার ধান্দা করেন । চুপচাপ কাগজপত্রগুলি নিয়ে আসুন । সেগুলি পরীক্ষা নীরিক্ষা করার পর আপনার গাড়ি ছাড়া হবে । নতুবা আমি সার্জেন্টকে রিপোর্ট করতে বাধ্য হব । তারপর আপনি জেলে পচে মরবেন ।
হাটুর উপরে স্ত্রী মাথা দিয়ে শুয়ে রয়েছেন । বের হতে পারছেন না গণপতিবাবু । গাড়ির ভিতর থেকে সজোরে চিৎকার করতে পারছেন না । জানালার কাচ খুলে হাত নেড়ে নাদিরকে ডাকছেন গণপতিবাবু । কিন্তু নাদির তখন ট্রাফিককে কাগজ দেখাতে ব্যস্ত ।
সব কাগজ দেখার পর গাড়ি ছেড়ে দিলেন ।
( ৩ )
তারপর এয়ারপোর্ট পার হয়ে অনেকটা চলে এসেছেন । সামনে বড় চৌরাস্তা । রাস্তায় অনেক গাড়ি । ধীর গতিতে গাড়িগুলি এগোচ্ছে । এখানেও গ্রীন সিগনাল । নাদিরের গাড়ি বাদিক ঘেঁষে হাসপাতালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । হঠাৎ কন্ট্রাক্টে কাজে লাগা ট্রাফিক পুলিশ হাতের লাঠি দিয়ে নাদিরের গাড়িতে প্রচণ্ড আঘাত ! তারপর কড়া মেজাজে নাদিরকে বলল, “গাড়ি সাইড করুন ।“
“আমার আপরাধ ?” নাদির খানিকটা কড়া মেজাজে ট্রাফিকের কথার বিরোধীতা করল । আগের ট্রাফিকের অভিজ্ঞতায় তার ধারণা, অসৎ মতলবে তারা গাড়িকে সাইড করতে বলে । মোট কথা তাদের ধান্দা খারাপ । তাই নাদির শক্ত হাতে ব্যাপারটা মোকাবিলা করতে চাইলো । নাদির বিনীতভাবে জানতে চাইলো, “কোন্‌ অপরাধের জন্য আমাকে গাড়ি সাইডে দাঁড় করাতে বলছেন ?”
“কথা কানে যাচ্ছে না ।“ বলেই হাতের লাঠি দিয়ে আবার তার পুরানো আমলের অলটো গাড়িতে মারলো আঘাত !
নাদির রাস্তার মাঝখানে গাড়িকে দাঁড় করিয়ে তেড়ে মারমুখি হয়ে ট্রাফিককে ধমকিয়ে বলল, “তোমার এত সাহস কীসের জন্য ? সমস্যা যদি থাকে সেটা আমার জন্যে, গাড়ির জন্যে নয় । আমি জানতে চাই, আমার গাড়িকে ঐভাবে লাঠি দিয়ে মারার অর্ডার আপনাকে কে দিলো ?”
বেশী লম্ফঝম্ফ । একেবারে লক্‌ আগে ঢুকিয়ে ছাড়বো ?
এইযে শুনুন, ভদ্রভাবে কথা বলুন । আপনি লক্‌ আপ মানে জানেন কিনা আমার সন্দেহ ? সেই লক্‌ আপের ভয় আমাকে দেখাচ্ছেন ?
তোকে এক্ষুনি আমি কলকাতা পুলিশ সার্জেন্টের কাছে ধরিয়ে দেবো । আমার সঙ্গে চালাকি ? সার্জেন্টের হাতে দু-ঘা খেলে তোর বদন সোজা হয়ে যাবে ।
“চলুন, আপনার সার্জেন্টের কাছে যাব ।“ উল্টে চাপ দিলো নাদির ।
ততক্ষণে ডিউটিরত সাদা পোশাকের সার্জেন্ট এসে হাজির । তিনি অত্যন্ত বিনীতভাবে নাদিরকে বললেন, “দাদা, আপনার সমস্যাটা কী ?”
নাদির হেসে উত্তর দিলো, “আমি নিজেও জানি না, সমস্যাটা কী ? রাস্তার মাঝখানে আমাকে দাঁড় করিয়ে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে ? সে নাকি সার্জেন্টের হাতে আমাকে ধরিয়ে দেবে ? স্যার, আপনিই বলুন আমার অপরাধটা কী ?”
সার্জেন্ট তখন জিজ্ঞাসা করলেন, “গাড়ির কাগজপত্র আপনার ঠিক আছে কী ?”
সব ঠিক আছে স্যার ।
কাগজপত্রগুলি নিয়ে আসুন ?
স্যার, একটা কথা বলব ?
এই তো, আপনাদের সেই এক সমস্যা । কাগজপত্র ঠিক নেই, অথচ সেটা চাইলেই আপনারা রেগে যান ?
পাশ থেকে বিশ্রি ভাষায় ট্রাফিক বলল, “স্যার, এটাকে থানায় পাঠিয়ে দিন । কিছুদিন জেলের ঘানি টানুক ?”
কথাটা শুনে সার্জেন্ট সাহেব ট্রাফিককে ধমক দিয়ে বললেন, “কেসটা সামলাচ্ছি আমি । তুমি এখান থেকে যাও । নিজের নিজের কাজ করো ।“
ট্রাফিক অন্যত্র চলে গেল ।
ইত্যবসরে গণপতিবাবু গাড়ি থেকে নেমে নাদির ও সার্জেন্টের কাছে এসে হাজির । গণপতিবাবু করুণ দৃষ্টিতে সার্জেন্টের দিকে তাকালেন । তারপর সার্জেন্টকে দেখা মাত্র তাঁর মুখ থেকে আর কথা বের হল না । চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন । তারপর অযথা বিলম্ব হওয়া অবলোকন করে হাত দুটি জোড় করে সার্জেন্টের দিকে তাকিয়ে বললেন, “স্যার, আমাদের গাড়িটা ছেড়ে দিন প্লিজ । নতুবা আমার অসুস্থ স্ত্রীকে আর বাঁচাতে পারব না ।“ বলার পরেই তিনি হাউ হাউ করে কেঁদে দিলেন ।
এতক্ষণ পরে সার্জেন্ট সাহেব গণপতিবাবুর দিকে তাকালেন ।
সর্বনাশ ! ইনি তো তাঁর ইংরেজির স্যার । ঐ অবস্থায় সার্জেন্ট সাহেব হাটু গেড়ে স্যারকে প্রণাম করে বললেন, “আপনি গাড়িতে বসুন স্যার । এরপরের দায়িত্ব আমার ।“
তারপর সার্জেন্ট সাহেব মোটর বাইকে আগে আগে, আর পেছনের অলটো গাড়িতে গণপতিবাবু । খানিকটা ভি-আই-পি মর্যাদায় গণপতি বাবুকে এসকর্ট করে নিয়ে সোজা পি-জি হাসপাতালে । হাসপাতালে ভর্তি ও অন্যান্য কাজকর্মে গড়িমসি অবলোকন করে ঐ সার্জেন্ট সাহেব তাঁর শিক্ষা গুরুর পত্নীকে ই-এম বাইপাসের প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে তুললেন । তারপর সমস্ত চিকিৎসার খরচার দায়িত্ব সার্জেন্ট সাহেব নিজের কাঁধে নিয়ে বললেন, “আজ আমার যতোটুকু যা কিছু, সবটাই আপনার স্নেহ ভালবাসার জন্যে । আজ আপনার জন্যে আমি যদি কিছু করতে পারি সেটাই হবে আমার জীবনে আপনাকে দেওয়া শ্রেষ্ট উপহার ।“
—————————০———————-