সুন্দরবনের আদিবাসীদের টুসু পূজো।

সুভাষ চন্দ্র দাশ ,ক্যানিং — টুসু পূজোর আর এক নাম ভূমি বা মাটি পূজা। এই পূজা কে অনেকে আবার ভারত মায়ের পূজা বলে থাকেন। অনেক জায়গায় বাঁশের ডউল তৈরী করে  করেন। আবার দুই ২৪ পরগণা জেলার সুন্দরবন এলাকার দিবাসীরা টুসু ঠাকুর পটুয়া কাছ থেকে তৈরী করে তা পূজার স্থানে এনে পূজো করেন।
এই পূজায় সরিষার তেল,প্রদীপ ধূপ ধূনা সিঁদুর সলতা,পেঁপে ফলমূল সহ নানান উপকরণ প্রধান দ্রব্য। এ পূজোয় বাড়ীতে ছেলে মেয়েদের দল কিংবা পাড়াপ্রতিবেশীরা মিলে একত্রিত হয়ে পূজা করে থাকে। পূজার দিন পৌষ মাসের শেষের রাত্রি পৌষ মাসের সংক্রান্তির দিন। পৌষ সংক্রান্তিতে প্রতি বাড়ীতে পিঠে-পুলি হয়ে থাকে। শীতকালে নতুন গুড় দিয়ে পিঠে খেতে কার না ভালো লাগে।ওদিকে গঙ্গাসাগর মেলা ও স্নানযাত্রা। প্রত্যেকে কাজের অবসর পায়।  ছেলে বা মেয়ে  যেকেউ করতে পারে। যে পূজার কর্তা হয় সেই সাধারণত পূজা করেন। আদিবাসীদের পূজোয় কোন ব্রাহ্মণ প্রয়োজন হয় না। যে পূজায় পূজারী লাগে সেপূজায় আদীবাসীদের পূজারী বা পাহান থাকে।
পূজার সন্ধ্যায় পূজার মেরাপে টুসু ঠাকুর আনা হয়। বেদীতে ঠাকুর বসিয়ে ফুল পাতা দিয়ে সাজানো হয়। সন্ধ্যার প্রথম প্রহরে র মালিক থালে করে পূজার সামগ্রী নিয়ে এসে ঘটস্থাপন ,সিঁদুর লেপন, ফল মিষ্টি খই পেঁপে চিড়া সামনে রেখে পূজা করেন। পূজার সময় শাঁখ বাজানো হয়। পূজা হয়ে গেলে পেঁপে বলি দেওয়া হয়। এই হল প্রথম প্রহরের পূজা।
পূজোর পর ছেলে মেয়ের দল আলাদা আলাদা দুই দলে বিভক্ত হয়ে টুসু গান করে। সংস্কৃতির আসর বসে।  একদল গান গেয়ে অপর দলকে গান চাপান দেয় । এভাবেই এক এক সময় একটি দল এসে টুসু ঠাকুরের সামনে গান গায়।
দ্বিতীয় প্রহরের পূজায়ও পেঁপে বলি হয়। পুজার পর শুরু হয় টুসু গান ও ঢোল বাজনা। দ্বিতীয় প্রহর প্রায় প্রথম প্রহরের মতো। আসে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রহর প্রায় একই। চতুর্থ পূজায় ভোর হয়ে আসে। এক টুসুর কর্মকর্তা,অন্য টুসুর কর্মকর্তার পূজায় হাজীর হয়ে মিতালী পাতায়। ছেলে হলে ছেলে,মেয়ে হলে মেয়ে টুসু সই পাতায় চতুর্থ প্রহর গানবাজনা চলে। একটা পূজোর দল আর একটা পূজায় উপস্থিত হয়ে টুসু গান গেয়ে মনোরঞ্জন করে। সুন্দরবনের বাসন্তী,ক্যানিং,গোসাবা,কুলতলী তে একাধিক পূজা হয়। তাই একে অপরের সঙ্গে শত দুঃখের মধ্যে আনন্দ ভাগ করে নেন। বর্তমানে আদিবাসীদের অর্থনৈতিক অবস্থা পঙ্গু হয়ে পড়ায় এবং করোনা আর লকডাউনের জন্য আগের মতো আর ধূমধাম হয় না। ভাটার মূখি হতে বসেছে। তা স্বত্বেও আদিবাসীরা তাদের রীতি রেয়াজ কে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছে।
রাত কেটে প্রভাত ।প্রভাতের পর সকাল,সকাল বেলায় গান গাইতে গাইতে কাঁসার ঘন্টা,বাজনা,শাঁখ বাজাতে বাজাতে বাড়ী বাড়ী টুসু নিয়ে যায়। বাড়ীর মহিলারা ধান,দুর্বা,প্রদীপ নিয়ে টুসু ঠাকুর বরণ করে। বেলা হলে পাড়ার সকল টুসু একস্থানে জোট করে। একটা টুসুর কর্তার সাথে আরেক জন মোকর পাতায়। গানবাজনা চলে। এরপর প্রসেশানের মধ্য দিয়ে পুকুরে টুসু ঠাকুর বিসর্জন করে। বিকালে বা তারপরের দিন বাড়ী বাড়ী গিয়ে প্রীতি,প্রণাম,শুভেচ্ছা জানিয়ে আসে। এরপর আবার একটি বছর অপেক্ষায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *